যুগলকিশোরকে কেউ যদি পথে পেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাচ্ছ ?’ উত্তরে সে বলবে ,’ওই তো সামনে ‘। প্রশ্নকর্ত্তা বুঝে নেয় যুগলকিশোর কথায় ফুলস্টপ দিয়ে দিয়েছে । আর কিছু বের হবে না মুখ থেকে । একটা কথায় হলে দুটো সে বলবেই না । কখনো কখনো মদনের মতো কেউ কেউ পেঁচিয়ে ধরে,আরে ,সামনেই তো যাবে । কেউ কি পেছনে যায় নাকি ? বলছি সামনেটা কোথায় ? যুগলকিশোর না দাঁড়িয়ে মুখটাকে নিমের পাঁচন গেলার ঠিক পরমুহূর্তের অবস্থানে নিয়ে বলবে ,সামনেই যাচ্ছি । মদন বড়ো ক্ষ্যাপাটে । জোরে জোরে বলবে , সামনে তো অনেক জায়গা । ধরো হিমালয় পর্বত ,তিব্বত ,চীন ,লণ্ডন - - তা তুমি কোথায় যাচ্ছ ? উত্তর না পেয়েও বলবে ,লণ্ডন যে তোমার কাছে ঠনঠন তা কি আর জানি না । আরো জোরে যোগ করবে ,ঘরে অন্তত লন্ঠনটা জ্বালিও ।
লন্ঠন শব্দটা শুনলেই যুগলকিশোরের ব্রহ্মতালু কোজাগরীর তারাবাজির মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করে জ্বলে উঠে । সবাই জানে তেল বেশি খরচের ভয়ে সে ঘরে হ্যারিকেন লন্ঠন জ্বালাতে দেয় না । একটা লন্ঠন ঘরে আছে যদিও , চিমনি কিনে না , পাছে বউ জ্বালিয়ে রাখে সেই ভয়ে । বউ সেজবাতিটা ক্ষণিকের জন্য ঠাকুরের সামনে দেখিয়েই নিভিয়ে ফেলে । এরপর দাওয়ায় বসে থাকে । কেউ এলে ঐ দাওয়ায় বসেই গল্প করে । রাতের রান্না দিনেই সেরে ফেলে । মোমবাতি এবাড়িতে প্রবেশাধিকার পায় নি কোনদিন, কোন পূজোতেও ।
যুগলকিশোরকে দুষ্টু ছেলেরা ‘লন্ঠন,ঠনঠন’ বলে দুয়ো দেয় আড়ালে ,নিরাপদ দূরত্ব থেকে। বাগে পেলে যুগলকিশোরও ছাড়ে না ।‘তোর বাপকে বলিস ‘ বলে গালাগাল দেয় । কিন্তু মদনের মুখে ‘লন্ঠন’ শুনেও যুগলকিশোর পিছনে না তাকিয়ে হাঁটা দেয় । কারণ ,উত্তর দিলে মদন এরপর যা বলবে তা যুগলকিশোর হজম করতে পারবে না এটা পুর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই জানে । মদনকে সে সত্যিই ডরায় ।
মদনের সঙ্গে অনেক এনকাউন্টারের মধ্যে একটা হল গোলবৈরাগীর চা দোকানের ঘটনা । যুগলকিশোর ,হরেন আর মদন চা খাচ্ছিল । মদনই চা খাওয়াচ্ছিল । গোলবৈরাগী বলল ,আজ কি সূর্য উত্তর দিকে উঠেছে নাকি ? যুগলদার পদধূলি আমার দোকানে ! জোর করেও তো দোকানে ঢুকাতে পারিনি ,পাছে চা খেয়ে দাম দিতে হয় সেই ভয়ে । এত টাকাপয়সা কে খাবে ? নিজের জিভটাকে একটু স্বাদের পরশ দাও না । এই মদন আজ যুগলদাই তোদের রসগোল্লা খাওয়াবে । আর চা’র সঙ্গে টোষ্ট দিচ্ছি , এর টাকাও দেবে যুগলদা । কোন কথা শুনছি না । নিত্য নিত্য খালি চা খাও । হরেন ,মদন যুগলের স্বাস্থ্য কামনার ফিরিস্থির ফাঁকেই বৈরাগী তিনপ্লেটে রসগোল্লা এনে দিয়েছে । হতভম্ব যুগলের মুখ দিয়ে কথা সরছে না । সে টোষ্টটা চায়ে ডুবিয়ে মুখে দিতে দিতে হিসাব করছে তিনটাকা করে তিনটে রসগোল্লা নয় টাকা আর টোষ্ট আট আনা করে দেড় টাকা ,মোট হলে গিয়ে সাড়ে দশ টাকা । কাশি উঠে বিষম খেল যুগল । ষাট ষাট আস্তে খাও ,বলল মদন । যুগল গম্ভীর সুরে বৈরাগীকে ডেকে বলল, রসগোল্লাটা তুলে নাও । আজ আমার খাওয়া হবে না । বৈরাগী বলল ,আরে আজই খাও তো ,নইলে আর কোনদিনই খাওয়া হবে না । যুগল ভাবছে একটা রসগোল্লার টাকা বেঁচে যাবে । বাজারে আসার পথেই রূপন ধানের দাম বাবদ ষাট টাকা দিয়েছিল । ট্যাঁকে এখনো সেই টাকার তাপ অনুভব করছে । সেখান থেকে এতগুলো টাকা চলে যাবে এত সহজে ! হরেন আর মদনের খাওয়া শেষ । যুগল দশ টাকা দিয়ে বৈরাগীকে বলল, এখান থেকে সাড়ে সাতটাকা রেখে বাকীটা দাও । রসগোল্লাটা রেখে দাও । হাটবার বলে দোকানে খুব ভিড় । বৈরাগী রেগে গিয়ে বলল ,যুগলদা অনেক কিপ্টে দেখেছি । এমন দেখি নি । এই নাও তোমার রসগোল্লা কুকুরকে দিলাম , বলে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল । মনে রেখ ,ভগবান টাকাপয়সা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখে লোকটা ভোগ করতে পারে কিনা । না পারলে ফিরিয়ে নেয় । তোমার টাকাও উইপোকায় খাবে একদিন । সবাই শুনল ,মন্তব্য ছুঁড়ল । দোকান থেকে বের হয়েই ধরল মদন , টোষ্টটা গিলতে পেরেছিলে তো ,নাকি উগরে দেবে ? তোমাকে দোকানে আনাটাই ভুল হয়েছে । সাড়ে সাত টাকার শোক সামলাতে পারবে তো ? তোমার টাকার রসগোল্লায় পেট না ফুলে উঠে ভাবছি । তুমি আসলে চিমসার হদ্দ । যাও বাড়ি গিয়ে দুদিন উপোস দাও । তোমার পোলাটা ঠিকই বলে , তোমার টাকা ঘুণা পোকায়ই খাবে । আর বলে কি জান ,তুমি মরলে সে মচ্ছব দেবে । মদনকে ডরায় যুগল । চুপচাপ চলে যায় ।
যুগলের অনেক ধানি জমি,সব্জি ক্ষেত ,সুপুরীর বাগান,নারিকেল গাছ আছে । সারা বছর সুপুরী আর নারিকেলই বিক্রী করে অনেক টাকার । টাকা সে নিজের কাছেই রাখে । ছেলে রমেশ বা বউ সুমতিবালাকে ধরতেও দেয় না । রমেশ একবার বাজার করতে গিয়ে দেড় টাকা বেশি খরচ করেছিল বলে তাকে এই মারে কি সেই মারে । দেড় পয়সার মুরোদ নেই দেড় টাকার সৌখিনগিরি ! আজ উপোস দিবি হারামজাদা । এই তোর শাস্তি ।
রমেশ সাদাসিধে ছেলে । মাকে জড়িয়ে ধরে দুয়েক টাকা আদায় করে । সাবধানে চুরি করে সুপুরী বিক্রী করে সুমতিবালা । তবে মাঝে মাঝেই যুগলকিশোরকে বকে তুলোধূনো করে দেয় । এক কাপড়ে থাকে সারাক্ষণ । ব্লাউজ কি জিনিস বিয়ের সময় ছাড়া বুঝে নি । দুটো কাপড় আনতে বললে যুগল পরীক্ষা করে একটাই আনবে । তাহলে একটা কাপড়ের দাম বেঁচে গেল । যেকোন কিছু দুটো আনতে বললে যুগল সর্বদাই একটা আনবে । বলবে , একটা শেষ না করে আরেকটা ব্যবহার করা অন্যায় । একটার দাম বাঁচানোর জন্য এটাই তার ফর্মূলা ।
যুগলকিশোর নিজে ধূতি পরে ,ভিতরে পরে কাপড়ের টুকরোর ল্যাঙ্গট । উপরে একটা ফুলহাতা গেঞ্জি । তাও বাজারে বের হলে ,অন্য সময় খালি গা । খালি পা । ল্যাঙ্গটের প্রস্তাবে রমেশ দুদিন উপোস ছিল । শেষে বউয়ের জ্বালাধরানো বকুনি খেয়ে একটা সর্ট আর একটা লং প্যান্ট কিনে দিতে কলজে ছিঁড়ে যাবার জোগাড় । রমেশ বাজারে বের হলেই প্যান্ট পরে । অন্য সময় লুঙ্গি , গেঞ্জি বা খালি গা । দুটো আইটেম তারও নেই । যুগল এক আইটেমের লোক !
ছোটোবেলায় কোজাগরীতে বাজি পোড়ানোর বায়না ধরেছিল রমেশ । সুমতিবালা বলল , অন্তত দুটো প্যাকেট তারাবাজি কিনে দাও । অনেক বকবকানির পর যুগল এক প্যাকেটের টাকা দিয়ে বলেছে,বাজী পুড়িয়ে কী লাভ । এতো শুধু দেখার বিষয় । যা , সামুরা অনেক বাজী কিনেছে । ওদের উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখে আয় । এক প্যাকেট বাজীর দাম বেঁচে গেল ।
সুমতিবালার মায়ের দেওয়া একজোড়া কানের হালকা রিং আছে । যুগল সেগুলিকে লুকিয়ে রেখেছে । ঘুমোবার জন্য কাঠের বড়ো চৌকির পায়ার নিচে গর্ত করে রেখে মাটি চাপা দিয়েছে । অন্য পায়ার নিচে আছে টাকার বান্ডিল । আর একটা ট্রাঙ্কেও থাকে টাকা । চাবি সর্বদা তার কোমরের তাগায় আটকানো থাকে ।
কালিপূজোর চাঁদা আদায় করতে ছেলেদের কালঘাম ছুটে যায় । গেল বছর এক টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পাঁচ টাকায় পৌঁছুতে এক ঘন্টা তর্ক চালিয়েছিল যুগল ।
রমেশকে সবসময় সমবয়সী বন্ধুরা, বড়োরা ক্ষেপায় আর দুয়ো দেয় ,
কিপ্টে যুগলের চিমসে ব্যাটা,
তোদের, টাকা খাবে উইয়ের পোকা ।
এই নিয়ে রমেশের মনে ক্ষোভ আছে ,প্রকাশ করতে ভয় পায় । সুমতিবালাও মাঝে মাঝে লেগে যায় যুগলের সঙ্গে । তখন যুগল একটু ঘাবড়ে যায় । তাও বাইরে প্রকাশ করে না । রমেশ একদিন বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় যাবে বলে দেড়শো টাকা চাইল বাপের কাছে । যুগল তো বকে বকে এই মারে কি সেই মারে অবস্থা । দেবেই না টাকা । টাকা কি গাছের পাতা যে চাইলেই ঝরে পড়বে । শেষে সুমতিবালাও মাঠে নামে ,বিরক্ত হয় । অনেকদিনের পূঞ্জিভূত রাগ ,অভিমান বিষ্ফোরিত হল । কোমর বেঁধে বলল , সারাজীবন তো দুটো বললে একটা আনার অভ্যাস ছাড়তে পারলে না । না দিলে নিজের পরানে , না ছেলেকে , না আমাকে । কে খাবে তোমার টাকা ? হাড়মাস কালি করেও সুখ নাই । ছেলেটা দেড়শোটা টাকা চাইল ,তাতেও আঙ্গুলে জল সরে না । দাঁড়াও ,তুমি এখনো আমাকে চিনতে পার নি । তুমি মরলে আমরা ব্যাণ্ডপার্টি লাগিয়ে শ্মশানে যাব আর তোমার শ্রাদ্ধে গ্রামচুক্তি ভুরিভোজের আয়োজন করব ।
যুগল মরেই গেল । ছেলে আর বউ গর্ত খুঁড়ে , ট্রাঙ্ক খুলে টাকা বের করল । ব্যাণ্ডপার্টি এল । চন্দন কাঠ এল । দামী কাজ করা ধূতি পাঞ্জাবী পরানো হল যুগলকে । রমেশের পরনে দামী পায়জামা পাঞ্জাবী,মাথায় পাগড়ী আর সুমতিও পরল দামী শাড়ী । গ্রামের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ল । এমন শবযাত্রা কেউ আগে দেখে নি । শ্রাদ্ধের দিন যথারীতি ভুরিভোজের আয়োজন হল । রমেশ আর সুমতিবালাকে চেনাই যাচ্ছে না । ওদের অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পেয়ে আনন্দ আর ধরে না । শামিয়ানার নিচে টেবিল চেয়ারে বসে সবাই কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছে । সপ্ত ব্যঞ্জন শেষে দই মিষ্টি । গোলবৈরাগীকেই দেওয়া হয়েছে দইমিষ্টির বরাত । হরেন ,মদন আর বৈরাগী একসঙ্গে বসে হাসছে আর আকন্ঠ গিলছে । বৈরাগী হা হা করে হেসে বলছে, যে কোনদিন একটাও রসগোল্লা খায়নি আজ তার টাকাতে রসগোল্লা খাব মনের সুখে । এ্ আমাকে পাঁচটা রসগোল্লা দিবি । হরেন বলে ,আমাকে তিনটে দিবি । মদন আরো ক্ষেপে যায় ,শালা হাড়কিপ্টে যুগল ,দেখ কেমন তোর টাকার শ্রাদ্ধ করছি । এই, আমাকে দশটা রসগোল্লা দে তো ।
য়োঁ য়োঁ য়োঁ না না না ,খবরদার কিছুতেই না । আমি থাকতে কিছুতেই হবে না মদনা ,হরু । আমার টাকা , আমার টাকা , য়োঁ - - য়োঁ - -য়োঁ - - -য়োঁ - - -। সুমতিবালা ছুটে আসে , এই ,কী হয়েছে ? এইরকম করছ কেন ? বেলা হয়েছে । আরে ! পায়ার নিচে কী খুঁজছ । তুমি কী এখনো ঘুমুচ্ছো না কি ? দেখা গেল যুগল চৌকির পায়া ধরে বসে আছে । সুমতির ঠেলা খেয়ে ধাতস্থ হয় । পায়ায় হেলান দিয়ে স্বপ্নের বিষয়গুলো আর একবার ঝালিয়ে নেয় । সুমতিবালা ‘মরণ !’ বলে চলে যায় ।
এসব ঘটনা অনেকদিন আগের । আজ সত্যি সত্যিই যুগলকিশোর মরণের কাছাকাছি । কয়েকদিনের পুরনো জ্বর । খাওয়া বন্ধ । শরীর একেবারেই দুর্বল । কথা বলার শক্তি নেই । তাকে না জানিয়েই গোপাল ডাক্তারকে আনা হয়েছে । অনেকক্ষণ দেখেশুনে গোপাল ডাক্তার বলল ,অবস্থা ভাল নয় । কমপক্ষে তিনটে স্যালাইন দিলে পর বুঝা যাবে । কানে যেতেই চোখ না খুলেই যুগলকিশোর সর্বশক্তি জড়ো করে বলল, ডাক্তার , একটা কম দিলে হয় না ? ডাক্তার বলল, হবে না কেন , হবে । তবে সবই তাঁর ইচ্ছা । তুমি আমি কে বল ? জনান্তিকে বলে ,দুটোও লাগে কিনা সন্দেহ । সুমতিবালার কাতর আহ্বানে ডাক্তার স্যালাইন লাগিয়ে দিয়েছে ।
যুগলকিশোরের চোখ আর খোলে নি । সুমতিবালা স্যালাইনের দিকেই তাকিয়ে বসেছিল সারাক্ষণ । একটা স্যালাইনও পুরো টেনে নিতে পারেনি যুগলের শরীর । দুটো স্যালাইনের টাকাই বেঁচে গেল !