রিমঝিম - রিমঝিম - রিমঝিম রিমিরিমি - ঝিমঝিম রিমঝিম - রিমঝিম। নক্ষত্ররায় জানলায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিপতনের মিষ্টি ধূনি মরমে পশেছে। ঘর নেই ,দোর নেই , পরিচিত জগৎ নেই ,যেন এক অপরিচিত অনুভূতি। আঁখিপল্লব বিস্ফারিত ,তবু দর্শনানুভূতি লুপ্ত। নিজের কাছে নিজেকে অচেনা মনে হচ্ছে শুধু । বৃষ্টিপতনই সত্য , অন্যসব মিথ্যে। এ জনম নয় ,যেন অন্য জনমের ছবি ভাসছে, নাচছে। তালে তালে বৃষ্টির ছন্দে। মিষ্টি সুবাস চারিদিকে, চেতনা লুপ্ত করে দিচ্ছে । সুদীর্ঘ প্রায় ষাট বছরের বেড়াকে ডিঙিয়ে কেমন করে যে ঐ সুবাস এত তাজা ,এত বিদির্ণকারী সেকথা তত্ত্বকথায় দুয়ে । তার্কিক নিয়মের - নিগড়ে বাঁধা,অঙ্ক কষে -জীবন সাজানো , বাহ্যিক দিক -পালিশ -করা ,রোবট -প্রাণ লোকের কাছে সে সুবাস সতীত। যার আকাশে কালপুরুষ নেই ,সপ্তর্ষিমন্ডল নেই ,চাঁদের চরকা - কাটা - বুড়ি নেই ; যে সূর্যোদয় দেখে না ,সূর্যাস্তের রক্তিমাভা যার মনের আকাশ রাঙিয়ে দেয় নি ;ভাঙা মেঘের দলের মধ্যে যে কখনো ভালুকের ছবি , রাক্ষসের ছবি খুঁজে পায় না , নক্ষত্ররায় সে দলভুক্ত নয় । নন্দীস্যার বলতেন ,তুই তো সব আঁধার রাতে জ্বলজ্বল করে আমাদের আলো দিস ,এখানে এলি কী করে ? নক্ষত্র,তুই একদিন খুব বড় হয়ে ঐ আকাশের নক্ষত্রের মতোই উজ্জ্বল হবি ।স্যার আরও বলতেন ,নক্ষত্র ,রাতে আকাশ দেখবি ,যত দেখবি ততই পাগল হবি , মানুষ হবি । কল্পনার তুলিতে ছবি আঁকিস। নক্ষত্র’র এখন হাসি পেয়ে যায়। নিজের পথ আলোকিত হয়েছে কি ? পথ হারিয়ে গেছে আনেকদিন আগে যখন ছকে প্রবেশ করল। একদিন ধীরে ধীরে আবিস্কার করল এতবড়ো আকাশটা ছোট হয়ে গেছে। এলোমেলো মেঘ নেই সে আকাশে। সব সাজানো ,সব আঁচে বসানো। পাগল ছিল ততদিন - যতদিন মেপেজুকে কথা বলতো না ,অগোছালো ছিল। তারপর মাপা কথা বলতে শিখল যান্ত্রিক হল ,ছকবদ্ধ হল, পাগলামি ঘুচলো।
‘বাঘচালা’ খেলায় নক্ষত্র প্রায়ই জিততে পারতো না। প্রতি পক্ষে ছয়টি করে মাত্র বার খুঁটির খেলা। প্রায়ই চালে ভুল হয়ে প্রতিপক্ষের বাঘের পেটে চলে যেতে হত। কখনো বড়ো ছকে করবী ফুলের শুকনো বীচি ,কখনো বা ছোটো ছকে বুনো কাঁটার ফল বাঘের ভূমিকা নিত । পালিশ করা জীবনে ঢুকে মনে হতো যেন প্রতি পদে পদে বাঘচালার খুঁটিগুলো ভুল জায়গায় বসিয়েছে ।
সুবাসটা নক্ষত্ররায়কে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। ঐ তো - -ঐ- - - রান্নাঘর থেকে মা আর বড়দি ডাকছেন। রাঙ্গাদি আর নক্ষত্র কাগজের নৌকো বানিয়ে উঠোনের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। অনুদাদা এসবের মধ্যে নেই , ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলেই কঁাথামুড়ি দিয়ে ঘুম। মায়ের হাতের নকশী কাঁথার ফুলগুলো কী সুন্দর ! বড়দির ডাকে রান্নাঘরে যেতেই দেখে বড়দি আর মা কাঁঠালের বীচি ভেজেছেন । রাঙ্গাদির সঙ্গে সব। কিছুতেই প্রতিযোগিতা , তাই বড়দির কাছ থেকে গুনে গুনে সমানভাগে ভাগ করে নিয়েছে । মুখে দিতেই মিষ্টি গন্ধটা ছড়িয়ে পড়েছে। মা বলছেন , খোকা ,বেশী খেওনা , অসুখ করবে। কিন্তু সে কথা শোনা-ই সার , বড়দির অংশেও ভাগ বসানো চাই। রাঙ্গাদি নক্ষত্র’র সবচেয়ে আপন ,বড়দি যেন মা’র সমকক্ষ । ভাল লাগে ,কিন্তু দুষ্টুমি করা যায় না। অনুদাদা সকলের চেয়ে আলাদা। নিজেকে নিয়েই থাকবে ,গুনগুন করে কী যেন গান গাইবে । ভাল নাম অনিত্র রায়। সবাই ‘অনু’ বলে ডাকে। একদিন বৃষ্টির বিকেলে মা আর বড়দি ঘুমিয়ে । রাঙ্গাদিসহ চুপি চুপি উনুন থেকে আগুন তুলে তাতে ঝিনুক বসানো হল। ঝিনুকে সর্ষের তেল ঢেলে খোসা - ছাড়ানো কুমড়োর বীচি তেলে ছেড়ে দেওয়া হল। মূহুর্তের মধ্যে বীচিগুলো ফুলে লালচে বর্ণ ধরে গেল ! কী মিষ্টি গন্ধ ! স্বাদটা যেন জিভে এসে গেল। আজ এত বছর পর কেন জানি ঐ বিশেষ অনুভূতিটা সজীব হয়ে জেগে উঠেছে। অতীশের তখন ক্লাশ টু কি থ্রী হবে। একবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হল গ্রীষ্মের ছুটিতে । অনুদাদার মেয়ে টুকাই অতীশকে নিয়ে বসেছে সেই কুমড়োর বীচি গরম তেলে ভাজবে বলে । অতুর সে। কী উৎসাহ ! অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দিদিভাই -এর সঙ্গে বসেছে । শশ শব্দে কুমড়োর বীচিগুলো কেমন ফুলে ফুলে উঠেছে। এমন সময় অনীতা এসে ছোঁ মেরে ছেলেকে টেনে নিতে নিতে বলে , ওসব ছোটোলোকের খাবার খেতে শিখছো ? টুকাই কাকীমার আচরণে হতভম্ব হয়ে কেঁদে ফেলে । বেচারা অতীশ !! অনীতা কেন জানি গ্রামের পরিবেশকে সহ্য করতে পারতো না। বছর - ছ - মাসে এক আধবার অনিচ্ছাসত্ত্বে বেড়াতে গেলেও যে কয়দিন থাকতো শুধু গ্রামাজীবনের সরলতাকে ব্যঙ্গ করতো । নক্ষত্র বুঝতো ,অনিতা নিজেও শান্তি পাচ্ছে না , পরিবারের সদস্যদেরও ভালবাসতে পারছে না। মা-কে কেন জানি সহ্য করতে পারতো না। অতু একটু বড় হলে ঠাম্মার কাছে , টুকাই দিদির কাছে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেই অনীতার রুক্ষ কণ্ঠস্বর শোনা যেত , যেমন বাপ তার তেমন ছেলে তো ! গাঁইয়্যা ভাষা না বললে ,গাঁইয়্যা বাতাস গায়ে না মাখলে তো বংশের ধারা রক্ষা হবে না ! যাও ,হাড় জুড়িয়ে এসো। সেবার অনেক বুঝিয়ে শেষে অতুকে নিয়ে একাই গিয়েছিল নক্ষত্র । অতুর সে কী বাঁধন - হারা আনন্দ। রাতে টুকাইদিদিকে জড়িয়ে ধরে রূপকথার গল্প শোনে ,চাঁদের বুড়ির গল্প শোনে। সারাদিন ছুটোছুটি নদীর জলে দাপাদাপি করে স্নান - এই সব কিছু অতুকে চুম্বকের মতো টানতো। নক্ষত্র সব বুঝতো । কিন্তু অনিতার এক কথা , খোকার গায়ে গাঁইয়্যা মাটির আঁচ লাগতে পারবে না । তাই সর্বদা আগলে
আগলে রাখতো।
অথচ চিনিমামা কি সব উল্টো কথা বলতো ,নক্ষত্র ,জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এ মাটিই প্রথম তোমাকে কোলে তুলে নিয়েছে। মাটিই তোমার প্রথম মা। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে সেই মাকে প্রণাম করবে , মাটিকে ভুলবে না। শম্ভু ,বিশু সবাই চিনিমামা আর নন্দীস্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখতো। চিনিমামা মা’র দূর সম্পর্কের ভাই । চিনিমামা এলেই গ্রামের কিশোরদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত । চিনিমামা সবাইকে নিয়ে নদীতে স্নান করতে যেত। সকলের গায়ে পরম যত্নে সাবান মাখিয়ে দিত। চিনিমামা নিজেই মিষ্টি গন্ধের সাবান লজেন্স ,খেলনা ইত্যাদি নিয়ে আসতো। এক একবার এলে দশদিন পনেরদিন করে থকতো। আবার কখনো একদিন থেকেই চলে যেত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় চিনিমামা আকাশ দেখিয়ে তারা চেনাতো। সপ্তর্ষিমন্ডলটা দেখতে ভারী সুন্দর । রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নচিহ্নটা কেমন ঘুরে যেত। বশিষ্ঠ্য তারার পাশে বিন্দুর মতো তারাটি দেখিয়ে বলতো , দেখ ,এটা হচ্ছে বশিষ্ঠ্য মুনির সাধী স্ত্রী অরুন্ধতী। আর সকলেই খুঁজে পেত ,নক্ষত্র অনেকক্ষণ ধরে চেয়েও ‘অরুন্ধতী’ স্পষ্ট দেখতে পেত সকলেই হাসতো। কালপুরুষের ছবি চিনিমামা এঁকে দেখাতো । তবু নক্ষত্র“র কাছে কেমন ধোয়াশার মতো মনে হতো। কোথায় কালপুরুষের হাতের ঢাল ,কোথায় বা মুগুর ! নক্ষত্র ভাবে , এতদিনেও কি কালপুরুষটা চেনা হয়েছে ?
বাবা কখনোই অকর্মন্য তোক পছন্দ করতেন না। বলতেন , অকর্মন্য লোক সমাজের বোঝা ।অথচ চিনিমামাকে কখনো কিছু বলতেন না। চিনিমামা কিছুই করতো না। মাঝে মাঝে দুজনে খুব তর্ক করতো। চনিমামা বাবাকে ‘জমিবাবু ' বলে ডাকতো। বলতো , যিনি এত জমির মালিক তিনি তো জমি-বাবুই। আরও বলতো , জমিবাবু ,আপনাদের দিন শেষ হল বলে । আমরা সব জমি সকলকে সমান ভাগে ভাগ করে দেব । সকলকে সমানভাবে বাঁচাবো। বাবা হেসে বলতেন , দেখো চেষ্টা করে ।তবে পাঁচটা বীজ পুঁতে দেখো তো সব সমাম হয় কিনা ? একই বনে তো বাঘ আর শশক থাকে ,অথচ বাঘের প্রতাপ দেখো।
চিনিমামা বলতো , পশু আর মানুষ এক করলেন ? বাবা হাসতেন , দেখো ,বিধাতার সৃষ্টিতে তুমি কি কোন দুটি জীব হুবহু একরকম দেখেছ ? সৃষ্টিতেই ভেদ রয়েছে । এসব তর্ক অবশ্য বড় হলে শুনেছে। রাত বেড়ে যেত ,বাবা আর চিনিমামার তর্ক চলতো।
চিনিমামার সঙ্গে নন্দীস্যারের বেশ ভাব ছিল । যোগাযোগটা হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে । একদিন চিনিমামা নক্ষত্রকে অংক বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। বইয়ের একটা অংক কলম দিয়ে আগগোড়া কাটা দেখে চিনিমামা বলল , কিরে ? অংকটা এমন কেটে দিলি কেন ?
‘স্যার কেটে দিয়েছেন । “ কেন ? পারে না বুঝি ? কেমন তোর স্যার ? দে তো ,আমি এক্ষুনি করে করে দিচ্ছি। ‘স্যার বলেছেন , এক গোয়ালা সাত লিটার দুধে এক লিটার জল মেশায় ---- -এমন কোন অংক নাকি বইতে থাকা উচিৎ নয়। তাই কেটে দিয়েছেন । ‘ বলিস্ কিরে ? তাহলে তো একবার তোর স্যারকে দেখতে যেতে হয়। চল ,এক্ষুনি যাব ।
সেই সন্ধ্যাবেলাতেই নক্ষত্র চিনিমামাকে নন্দীস্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। দুজনের এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে যতদিন চিনিমামা থাকতেন প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে স্যারের সঙ্গে ক্লাশ করাতেন ,ছাত্রদের মজার মজার খেলা শেখাতেন। তারপর কবে যেন চিনিমামা হারিয়ে গেল । কোথায় গেছে কেউ জানে না। আজ এতদিন পর চিনিমামাকে কেন জানি খুব মনে পড়ছে।
অতুর জন্য কষ্ট হয় । অতুর কোন চিনিমামা ছিল না ,রাঙ্গাদি ছিল না। বেচারা পরে কেন জানি অমীতার কথাই শুনতো বেশী ।একবার সবেমাত্র গ্রামের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে। পড়ার ঘরে একমনে জোরে জোরে বলছে -
ইস্কুলে আজ যাব না , বেতের বাড়ি খাব না , বেত গেল ভাঙ্গি , মাষ্টার দিল কান্দি। অনীতা শুনেই রণচন্ডী । দাঁত খিচিয়ে ছেলেকে বলে , এসব ছোটোলোকের ভাষাই তো শিখবে , আমি জানি। খবরদার ! আর কখনো যদি এসব শুনি , আর ঐ গাঁইয়া হাওয়া খেতে যাওয়ার বায়না কর ,তবে তোমার ছাল তুলে নেব দেখো।
সেদিন অনীতার কথার ধরনে এমন কিছু ছিল যার ফলে অতু কেমন যেন বদলে গেল । ধীরে ধীরে অতু হয়ে গেল বই-পােকা আর মায়ের কথায় ওঠে বসে। এখন মনে হয় অনীতার জন্যই অতু আজ এত বড়ো ইঞ্জিনীয়ার । এখন গুজরাটে থাকে। এই শহরেই ছিল বছর তিনেক । অতুর মন বসেনি। কোম্পানীর চাকুরী নিয়ে চলে গেল। সহসা নাকি জার্মানী চলে যাবে। প্রায়দিনই ফোন করে । তবে প্রতি রবিবার নিয়ম করে ফোন করবেই ,বাপী ,ভালো আছো তো ? নিয়ম করে ঔষধ খেও কিন্তু -- - ইত্যাদি । নক্ষত্র ভাবে ,নিয়ম করে ছক কষেই তো সব করলাম ।অনীতার সঙ্গে কত ঝগড়া ! অনীতা নিয়মের লোক । শেষ অবধি তারই জয় হতো । বোঝাতে ‘হাম দো হামারা এক’ না হলে এযুগে অচল। একটাকেই মানুষের মতো মানুষ করবো। কী জানি মানুষ হওয়া কাকে বলে । অতু বড় ইঞ্জিনীয়ার হয়েছে। অবশ্যিই । কিন্তু ধীরে ধীরে তার আকাশ থেকে সপ্তর্ষিমন্ডল হারিয়ে গেছে , ধ্রুবতারা হারিয়ে গেছে । শেষে আকাশটাও একদিন বিলীন হয়ে গেছে ।
অতুর বৌ -এর সঙ্গে অনীতার কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব ছিল। সব যেন অনীতা মেনে নিতে পারতো না। সব তার মনের মতো হতো না। অনীতা বুঝতো না যে সবকিছু একজনের মনের মতো। হয় না । শেষে ছেলে , বৌ যখন গুজরাট চলে গেল অনীতার সে কি কষ্ট ! নক্ষত্র বুঝতো অনীতা নিঃশব্দে কাঁদছে।
অনীতা নেই , তাও বছর গড়িয়ে গেল। অতুরা এসেছিল। অনুদাদা নেই ,রাঙ্গাদিও নেই। বড়দি কেমন করে যেন টিকে আছে। পরিচিত বৃত্তটা ক্রমশঃ ছোটো হয়ে আসছে। এই বিশাল ‘ড্যাফোডিলস্ ' - এর পাহারাদার হয়ে নক্ষত্র রায় ভাবে সে কি সত্যিই আছে ? বাড়ি করার জন্য অনীতার সে কী উদ্বেগ ! তার পরিকল্পনা অনুসারেই বারান্দা , করিডাের , দেওয়ালের রং - সব । শেষে নক্ষত্র বাড়ির নাম প্রস্তাব করে ‘শাপলাকুঞ্জ । সঙ্গে সঙ্গে অনীতার খিস্তি , স্বভাব যায় না ম’লে । সেই গাইয়্যা ফুল ! নাম। হবে, ‘ড্যাফোডিলস্ । দক্ষিণের বারান্দার গা ঘেঁষে একদিকে মাধবীলতা আর একদিকে বেলীফুলের গাছ। থেকে মন-মাতানো সুবাস শেষ বসন্তে এখনো সারা ঘরে অনিতার উপস্থিতির সাক্ষী হয় । পরম যত্নে তৈরী স্বপ্নের সাজানো ঘর আছে, শুধু থাকবার লোকটি নেই।
নক্ষত্র এখন উপলব্ধি করে, এক একজন লোকের বাঁচার উপাদান একেকরকম। অনীতাও তার নিজের মতো করে বাঁচতো। ছেলেকে নিয়েই তার পৃথিবী। সেখানে অন্যসব প্রলোভনের হাতছানি থেকে সে শতহাত দূরে । বাড়ি তৈরী করার সময় যখন প্রায়ই ঝগড়া হতো তখন বলতো , অনেক দূরে চলে যাব একদিন , দেখো। সেই কথা যে এত দ্রুত নির্মমভাবে সত্যি হবে তা কে জানতো। শেষের বছরটিতে অনীতাকে যেন চেনা যেতো না। ঝগড়া নেই ,কথায় কথায় মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে না। কেমন যেন আত্মমগ্ন । কেমন যেন আত্মগরীমায় গরীয়সী মনে হতো।
বাবা বলতেন , সব মানুষ জন্মের মুহূর্তেই মৃত্যুর বাশী বুকে নিয়েই আসে। সেই বাশী কখন বাজবে কেউ জানে না। প্রতিদিন প্রতিকাজে বেঁচে থাকাটাই জীবন । তখন নক্ষত্র কলেজে পড়ে । একদিন পড়ার ঘরে সারা সকাল ধরে বাঁশের আঁকাবাঁকা কয়েকটা শেকড় দিয়ে কী যেন করছিল। মা তো দেখে রেগে আগুন, খোকা , তোমার না সামনে পরীক্ষা ? এসব আজেবাজে কী করছ ? তোমার বাবা আসুক , দেখবে মজা । বাবা এলে যথারীতি নালিশ । বাবা এসে পড়ার ঘরে বসে । বলে , কী হয়েছে। খোকা ? কী করেছিস ? টেবিলের তলা থেকে বাঁশের তৈরী ড্রাগনটা দেখালে বাবা বলে , কি চমৎকার
হয়েছে রে খোকা। তুই খুব সুন্দর কাজ জানিস তো । মাকে বোঝায় দেখো খোকার মা ,ঐ খেলনাটা তৈরী করে খোকা আজ বেঁচেছে । তুমি যে রোজ নূতন নূতন পদ রান্না করে , নূতন খাবার তৈরী করে আমাদের খাইয়ে আনন্দ পাও , তার মধ্য দিয়ে তুমি কিন্তু একটু একটু করে বেঁচে থাকো । ঠাকুর ঘরে ফুল সজিয়েও তুমি বেঁচে থাকো। এভাবেই মানুষকে বাঁচতে হয়। মা চুপ করে শুনতেন। বাবা সবাইকে কথার মাধ্যমে সম্মোহিত করতে পারতেন। ছোটবেলায় পূর্ণিমার রাতে উঠোনের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে দৌড়ে যখন অনুদাদাসহ হাসাহাসি করতো, বাবা ,বাবা, দেখো , চাঁদটা কেমন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়চ্ছে - তখন বাবাও সে হাসিতে যোগ দিতেন ,ওদের সঙ্গে দৌডুতেন। বাবা বাঁচার স্বপ্ন দেখাতেন।
মা এখনো আসেন , নিশীথে চুপিচুপি । গতরাতেও এসছিলেন । শিয়রে বসে কপালে হাত রেখেছিলেন অনেকক্ষণ। কী হৃদয় জুড়ানো শীতলতার পরশ ! গালে ,চিবুকে হাত বুলিয়ে মা বলেছিলেন , হারে খোকা , তুই যে বড্ড রোগা হয়ে গেছিস্ । তোর জন্য বড় দুশ্চিন্তা হয় । তোর ছক মিলেছে। তো বাবা ? নক্ষত্র বলে , মা গো আমি যে বড় একা হয়ে গেলাম মা। প্রিয়জন সব চলে গেছে । মা বলে , দূর বোকা , তুই তো একাই এসেছিলি । নক্ষত্র বলে , আমার ছক যে মেলেনি মা । বাঘচালা খেলায় যে আমি বারবার হেরে যাচ্ছি মা। নন্দীস্যারের সিড়ি-ভাঙ্গা অংক’র সিঁড়ি ভেঙ্গে আমি যে উপরে উঠতেই পারছিনা মা। এত চেষ্টা করেও অরুন্ধতীটাকে খুঁজে পেলাম না মা। | হঠাৎ ‘মেসো ,তোমার চা’ শুনে থতমত খেয়ে ওঠে নক্ষত্র রায় । গত রাতের স্বপ্নের জালটাও ছিড়ে যায় , কী রে লক্ষী ,সন্ধ্যে হয়ে গেল?
‘হ্যা মেসো ,একটু আগে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ছিল । দেখছেন না এখনো কেমন ঝিলিক দিচ্ছে। বাইরে। কী করে যে আজ বাড়ি যাব কে জানে । লক্ষীই এখন নক্ষত্র’র কেয়ারটেকার। সারাদিন এখানে থাকে ,সন্ধ্যের পর রাতের খাবারের নির্দেশ দিয়ে চলে যায়। ব্যবস্থাটা অতুই করেছিল। নক্ষত্র চা’র পেয়ালা হাতে নেয়। বাইরে শ্রাবনের আকাশে কালো মেঘের গুরুগর্জন আর বিদ্যুৎ ঝলকানি। আকাশের সব নক্ষত্র আজ অদৃশ্য।