পদে পদে প্রভুনারায়ণ প্রহেলিকার প্রাকারে পরিবৃত ।ভুলো মনের কারণে কতবার যে প্রভুনারায়ণকে হেনস্থা হতে হয়েছে তার হিসেব নেই।অথচ ছাত্রাবস্থায় বাড়ির অন্যদের মতো না হলেও সেও মেধাবীই ছিল।পাল চৌধুরীবাড়ির ছেলেদের নামডাক ছিল স্কুল কলেজে।তার বাবাও ছিল একসময়ের ডাকসাইটে উকিল।রামায়ণ মহাভারত থেকে শুরু করে সুকুমার রায় ,ভিক্টোরিয়ার আমলের ঘটনা থেকে চম্বলের কাহিনী সবই ছিল মগজস্থ এবং ঠোঁটস্থ।কখন কোন্ ঘটনার রেশ টেনে কোন্ কেইসে ফিট করতে হয় এসব ছিল তার কাছে জলভাত।প্রভুনারায়ণ ভেবে পায় না তার ক্ষেত্রে দিন দিন এমন হচ্ছে কেন।
প্রভুনারায়ণ পালচৌধুরী।ডাকনাম প্রভু।বন্ধুরা ডাকতো পি এন পি সি বলে,মজা করতো।তুখোড় তর্কবাগীশ ছিল সে। বিতর্কে ফার্স্ট প্রাইজটি তার বা্ধা ছিল।এখন কি তবে বয়সের কারণে সে ভুলে ভুলে যায়?বাজারে একজনের কাছে পটল কিনে খুচরো দিতে পারছিল না।দোকানী বলল, কাকু ,আপনি খুচরো করে পরে দিয়ে যাবেন।প্রভু বাজার করতে করতে ভুলেই গেছে ব্যাপারটা।পরে একদিন ঐ দোকানীটা তাকে যাচ্ছেতাই বলল।আপনারা শিক্ষিত,ক’টা টাকা না দিয়ে কি বড়লোক হবেন ?প্রভু কি করে তাকে বোঝাবে যে সে ভুলে গেছিল।অফিসে বড়সাহেব তো কতদিন ধমক দিয়ে বলেছে , প্রভু মনোযোগ দিয়ে কাজ করো।এতো ভুলে গেলে চাকরি করবে কি করে?কমলের কাছ থেকে একবার একশো টাকা নিয়ে ফেরৎ দিতে ভুলে গেছে।এই নিয়ে অফিসে কি হাসাহাসি- আরে সব মনে থাকে,ইছে করেই ভুলে যায়।একমাত্র শ্যামলদা ব্যতিক্রম।শ্যামলদা তাকে স্নেহ করে।
একবার অফিসে পিকনিকের কথা হচ্ছিল।মাথাপিছু চাঁদা ধার্য হতেই প্রভু দিয়ে দেয়।কেউই তখনো দেয় নি। পিকনিকের ঠিক আগেরদিন ক্যাশিয়ার বিক্রম বলল,প্রভুদা তোমার চাঁদা কোথায়?কালই তো পিকনিক,দাও দাও।প্রভু দিয়ে দেয়।বিক্রম মুচকি হেসে টাকাটা নিয়ে নেয়।সে জানে প্রভুর মনে নাও থাকতে পারে।পিকনিক শেষে কথাটা নিয়ে হাসাহাসি করে বিক্রমসহ অন্যরা।বলে,টাকাটা খেয়েই ফেলবো।কথাটা শ্যামলের কানে যেতেই বিক্রমকে ধমক দিয়ে বলে,একটা মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে মজা করা অন্যায়।প্রভুর টাকা ওকে দিয়ে দাও।প্রভু এমনই।
বয়সটাও তেমন আর কি।ষাট ছুঁই ছুঁই।শুনেছে কত লেখক নাকি নব্বই একশোতেও উপন্যাস লেখে রাজনীতিবিদদের তো ষাটের পর চকুরী শুরু হয় বলা যায়।মন্ত্রী আমলারা তো সত্তর আশি পার করে কেমন কেতাবী চালে দেশ চালায়।তাদের কি স্মৃতিবিভ্রাট হয় না, ভাবে প্রভু।অবশ্য হলেও কার কি আসে যায়।করিজেন্ড্যাম দিয়ে দায় খালাস।ঠ্যালা তো সামলায় পাবলিক!
প্রভু তার মত করে ভাবে,সব মুহুর্তে সবকিছু মনে ধরে রাখা কোন ক্রেডিট হতে পারে না।সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপারগুলি ঘটে ছাত্রদের ক্ষেত্রে।শিক্ষক চায় সে সব মুখস্থ রাখুক, মা বাবা চায় তার মগজে বিশ্বের সব ধারন করুক।প্রথম কোন্ খেলোয়াড় কবে কোন্ মাঠে কার বিরুদ্ধে কত নম্বর ওভারে নো বল খেলতে গিয়ে আউট হয়েছে – এটা না জানলে ক্যুইজে জেতা যাবে না।ইতিহাসের কোন্ নবাব হুকো খেতেন, কোন তারিখে ভিক্টোরিয়া বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন , কোন্ দেশের বাঁহাতি মহিলা পাইলট প্রথম বিমান চালিয়েছিলেন , কোন্ টাকওয়ালা ভদ্রলোক প্রথম পরচুলা পরে অভিনয় করে পুরস্কার জিতেছিলেন ইত্যাদি মনে রাখতে না পারলে ঐ ছেলে বা মেয়ের মা বাবার প্রেস্টিজ থাকে না।ছেলে বা মেয়েটির মাথাটাকে বিশ্বকোষ ভাবতে তার আত্মীয় পরিজন গর্ব বোধ করে।আর টিচারের কথা বলে তো লাভ নেই।পান থেকে চুন খসলেই লাল কালিতে ঘ্যাচাং।হ্রস্ব-ই কারের জায়গায় দীর্ঘ-ঈ কার দেখলেই বাংলা দিদিমণির ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠে।অংক স্যার তো স্বয়ং ভাগবান।একটা শুন্য দিতে ভুল হলে কিংবা জ্যামিতির একটা আঁক চুল পরিমান সরে গেছে কি যায় নি , বড় একটা লাল কালির রসগোল্লা!প্রভুর এখনো মনে আছে,বাবরের বাবার নাম ভুল করেছিল বলে তাকে একশোবার ঐ নাম লিখতে হয়েছিল।ছোটনাগপুর এলাকা সঠিক ভাবে চিহ্নিত করতে পারে নি বলে সমরেশের কানের লতি টেনে টকটকে লাল করে দিয়েছিল ভুগোলের স্যার।এসব কথা এখনো মনে করে প্রভু আর খুব ইচ্ছে জাগে টিচারগুলো আর ওদের দোসর মা বাবাদের বিরুদ্ধে একটা জম্পেশ প্রতিবাদী সমিতি গড়ার।নিজের ছেলে কন্দর্পনারায়ণকে সে কোন পীড়ণ করে নি বরং তক্কে তক্কে থাকতো যাতে ছেলে পড়া দেখানোর জন্য তাকে না ডাকে।তার জন্য বিড়ম্বনাও কম সইতে হয়নি গিন্নীর কাছে।‘হাড়ে-বাতাস-লাগানো-ফুলবাবুটি’ এই বিশেষণের বিশেষণটির গঞ্জনা তিরিশটি বছর তাকে হজম করতে হয়েছে।
সংসারের আর এক আজব সৃষ্টি এই ‘গিন্নী’ নামক প্রজাতি।তার স্ত্রী কনকপ্রভাকে দেখেই হাঁড়ির সব ভাতের থুড়ি গিন্নীর রকমসকম সে আন্দাজ করতে পারে।কনকপ্রভা তো সাক্ষাৎ স্ত্রী-নারদ।ছাব্বিশ বছর আগে কোন্ সন্ধ্যায় রেলিং ধরে ঘাড় কাত করে কোন্ কথাটা প্রভু বলেছিল তার রেশ টেনে আঁশ বের করে এই তো সেদিনও গিন্নী তাকে নাকানি চোবানি খাইয়েছিল।বাজার ফর্দের ঝামেলা তো রেকারিং।এগারোটা আইটেমের দুটো ভুল হলেই সুন্দরকান্ড,কিস্কিন্দাকান্ড ঘুরে হনুমান কান্ড অবধি টেনে নিয়েও ইতি টানতে মন চায় না।কাসুন্দির বদলে মুখশুদ্ধি এনেছিল বলে সংস্কৃতের দিদিমণির ভয়াবহ শব্দরূপ ভুলের শাসনত্রাসকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল।গিন্নীদের হাতে লাল কালির গোল্লার বদলে ঠোঁটে অগ্নি-উদ্গীরণ- ক্ষম ব্রাহ্মণকে বসিয়ে দিয়েছেন ভগবান।প্রভু কি ইচ্ছে করে ভুলে যায় ?কত উপদেশ তো শুনেছে ‘টু আর ইজ হিউম্যান’।কিন্তু তার বাস্তব প্রয়োগ এই গিন্নী নামক প্রজাতির অভিধানের লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে।সুযোগ পেলেই বকম বকম করে খই ফুটিয়ে , হুল ফুটিয়ে , কানের পোকা বের করে ভুলের মাসুল উসুল করে নেয় ।
প্রভুর ভুল স্বভাবের জন্য কাজের লোক নিযুক্ত হলে কনকপ্রভা আরো যেন এডভান্টেজ পেয়ে যায়।প্রথম দিন থেকেই পই পই করে পাখি-পড়া করে তাকে সতর্ক করে দেবে,সাবধান, টাকাপয়সা যেখানে সেখানে ফেলে রেখো না, যা স্বভাব তোমার! মানি ব্যাগটা যত্ন করে রেখো।আর কোনদিন যদি আমি না থাকি তবে ওকে চোখে চোখে রেখো।তোমার মতো উড়নচন্ডী, ভাবজগতে ভাসমান লোকের সম্পর্কে এরা সর্বদা নজর রাখে জেনে রাখো।ফাঁক পেলেই সরিয়ে নেবে।ফাউ হিসেবে আরো একলাইন যোগ করে, তোমার মতো আলাভোলা লোকের তো সংসার করা সাজে না ।
প্রভু গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে ,ঠোঁট ফাঁক করে না, পাছে আরো অজ্ঞানতা ধরা পড়ে যায় এই ভয়ে।সে খেয়াল করেছে কনকপ্রভা বাড়ি না থাকলে কাজের লোকের কোন ত্রুটি সে খুঁজে পায় না।অথচ কনকপ্রভা পদে পদে কত ‘জেন্যুইন’ ভুল ধরে দেয়।ফলস্বরুপ কোন কাজের লোকই বেশীদিন টিকে না।এবারের মহলাটি মানে মানিকের মা কেমন করে যেন আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে।কয়েকমাস পার করে দিল।বয়স চল্লিশ পঞ্চাশের মাঝে কিছু হবে।প্রভুর চোখের রেটিনায় মহিলার ভদ্র আর মার্জিত ছবিই ফুটে উঠেছে।কনকপ্রভা সহজাত ভঙ্গীতেই সতর্ক বার্তা শুনিয়েছিল।মাঝে দুই ধাপে কনকপ্রভা কিছুদিন বাড়ি ছিল না।প্রভু লক্ষ্য করেছে ঐ দিনগুলিতে মানিকের মা ভারমুক্ত, স্বাধীন।অনেকদিন শিকলে- বাঁধা-পাখি ছাড়া পেলে যেমন হয় তেমন মনে হয়েছে মানিকের মাকে।তাকে কত দরদ দিয়ে ডাকে , মেসো আর এক কাপ চা করে দেবো?মেসো মাছের ঝালটা ভালো লেগেছিল?মেসো আজ বিকেলে গাছের মেলায় যাব ভেবেছিলাম , একটু বেলায় বেলায় চলে যাব।প্রভুও বেশ খোশমেজাজে থাকে।তার হালে সে থাকে,মানিকের মা নিজের মতো করে কাজ করে যায় । সেদিন মেলায় খরচ করার জন্য তিরিশ টাকা দিয়েছিল প্রভু ।
কিন্তু গত পরশুদিন যা ঘটল তাতে তার হিসেবে গোলমাল হয়ে গেল,নিজেকে প্রথমে বেকুব বলে মনে হয়েছিল।আর গিন্নীর কথাই সত্যি বলে বার বার মনে হয়েছিল।রবিবার ছিল।তাই আয়েস করে চা টিফিন খেয়ে ধীরে সুস্থে বাজারে যাবে এমনই প্ল্যান।তৈরী হয়ে ব্যাগ হাতে নিল।গিন্নীর ফর্দ নিল।টাকার পরিমাণ পরখ করতে মানিব্যাগ খুলে চক্ষু চড়কগাছ! পাঁচশো টাকার নোট থাকার কথা।সেটা নেই।ভালো করে খুঁজে দেখল।নেই ।না , বেশ স্পষ্ট মনে আছে সেদিন এক হাজার টাকার নোটটা ভাঙ্গিয়ে আরো একটা পাঁচশো টাকার নোট ছিল।মানিব্যাগটা তার পড়ার টেবিলে ছিল।এমন হয়।কোন কারণে টাকার দরকার পড়লে টাকা বের করে টেবিলেই রেখে দেয় মানিব্যাগ।কনকপ্রভা তো কতবার শাসিয়েছে।এখন তো তাকেও বলা যাবে না।বললেই তো ঘরটা মুহূর্তে পলাশীর রনাঙ্গনে পরিণত হয়ে যাবে।এখন সে কি করবে?সব প্যান্টের পকেট বার বার খুঁজে দেখল।তবে কি - - -। প্রভুর মনে হল একটু আগে টিফিন খাওয়ার সময় মানিকের মা ঘর ঝাড় দিয়ে মুছে গিয়েছিল।কিন্তু এও কি সম্ভব?গিন্নীর সাবধান বাণী মনে পড়ল- যাকে তাকে বিশ্বাস করাটাই বোকামি।গিন্নী ঘরে না থাকলে না হয় মানিকের মাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখত।সে পথও তো বন্ধ।সে ঘোরের মধ্যে আরো টাকা নিয়ে বাজারে গেল ।
সারাদিন অস্থিরতার মধ্যে কাটল।অনেক বিচার করে শেষে সব সন্দেহ ঘনীভুত হল মানিকের মা’র উপর।পাঁচ পাঁচশোটা টাকা ?না,গিন্নী ঠিকই বলে , কাজের লোককে বেশী লাই দিতে নেই।কাজের লোক কাজের লোকই।ওদের যারা বিশ্বাস করে তারাই বেকুব।সুযোগ পেলেই ওদের আসল রূপ বের হয়।পরদিন মানে গতকাল প্রভুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল । হাতে নাতেই চোর ধরবে।আরো একটা পাঁচশো টাকার নোট মানিব্যাগে ঢুকিয়ে ঠিক আগের জায়গায় রেখে দিল।গিন্নী যথার্থই বলে-টাকার লোভ বড় লোভ ;ধনী গরীব সবার টোপ।মানিকের মা ঘর ঝাড় দিতে ঐ ঘরে ঢুকলে প্রভু দরজার পাল্লার পেছনে লুকিয়ে তাকিয়ে রইল।না , কিছু হয় নি।তবে মানিকের মা টেবিলের দিকে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ।মনে হয় আরো নিরাপদ সময় খুঁজছে।সে ব্রেকফাস্টের টেবিলে এসে বসল।মানিকের মা এবার ঘর মুছবে।অনেক সময় পাবে কাজ হাসিল করবার।প্রভু টেবিল থেকেই নজর রাখবে এবার ,তাহলে মানিকের মা’র সন্দেহ হবে না।গিন্নী একবার বলেই ফেলেছে ,কি হয়েছে তোমার বিনা কাজে টেবিলে বসে আছো চুপচাপ।প্রভু উত্তর না দিয়ে অকারনে গুনগুন করতে থাকে । মানিকের মা ঢুকেছে ঐ ঘরে।প্রভু একটু ঘুরে বসল যাতে ঐ ঘরের টেবিলটা দেখা যায়।এবার চাঁদু ধরা পড়বেই । তারপর বামালসমেত একেবারে থানায় দিয়ে দেব।আমার মত সোজা মানুষের সঙ্গে বাটপাড়ি!মানিকের মা দাঁড়িয়ে টেবিলটা আড়াল করে আছে।হাত দিয়ে কিছু একটা করছে মনে হচ্ছে।এখন গিয়ে ধরলেই হয়।উঠতে যাবে , এমন সময় গিন্নীর অর্ডার , উদাসীর মত বসে না থেকে এদিকে এসে আমাকে তেলের প্যাকেটটা কেটে তেলটা বোতলে ঢুকিয়ে দাও । সঙ্গে যোগ করল ,দেখো আবার অর্ধেক তেল যেন নীচে না পড়ে ,যা ভাবসাগরে ভাস!মনে হল মানিকের মা অকারণে এদিকে তাকাচ্ছে।সন্দেহ আরো পোক্ত হল।মানিকের মা এঘরে এসে বলল,মেসো তুমি মাসীর ঘরে যাও,এঘর মুছবো । তোমার ঘরেও যেও না এখন , পাখা চালিয়ে দিয়েছি ,শুকোবে তারপর ঢুকবে।ব্যাস ,হান্ডেড পার্সেন্ট সিওর হওয়া গেল । অনিচ্ছা সত্বেও গিন্নীর অর্ডার পালন করে দ্রুত গিয়ে মানিব্যাগ খুলল।না, আছে তো।তাহলে নেয়নি।প্রভু চিন্তা করে ঠিক করল, মানিকের মা এত বোকা নয়।পরপর দুদিন চুরি করলে সবাই সন্দেহ করবে এটা আমার মতো বোকাও জানে।কিছুদিন গ্যাপ দিয়ে ঠিকঠিক মুহুর্তে কাজ হাসিল করে নেবে।দুশ্চিন্তা আর কাউকে না-বলতে-পারার যন্ত্রণায় কাল রাতেও ভাল ঘুম হয়নি ।না , এর হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে প্রভু ।
সকালেই পুলিশ এল।স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ মানিকের মাকে।মানিকের মা তো আকাশ থেকে পড়ল।কনকপ্রভা এই সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া করবে না জানা কথাই।প্রয়োজনের চেয়ে বেশী জোরে গলা থেকে স্বর বের হল ,বলেছিলাম না মানুষ চেনো না,দুনিয়া এত সোজা নয়।দাঁত চিবিয়ে আরো কঠিন কঠিন কথা শুনিয়ে দিয়ে মানিকের মা’র দিকে নজর দিল । পুলিশের চেয়েও জোরে ধমক দিয়ে বলল , এ ই বল্ কেন নিয়েছিস এতগুলো টাকা।আমরা তোকে এত বিশ্বাস করি।তুই শেষপর্যন্ত এই করলি।পূজোতে শাড়ি দিলাম,আর এটা সেটা তো বলে লাভ নেই।পুলিশের লোক তো পারলে গায়ে হাত তোলে।নেহাত মহিলা হওয়ায় হাত গুটিয়ে রাখল।বলল,এই ভালোয় ভালোয় বল টাকাটা কবে দিবি।না হয় সোজা শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেব।তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল।প্রভুও গলা মেলাল, তোমার টাকার দরকার হলে আমাকে বলতে।মেলায় খরচ করার জন্যও তো সেদিন টাকা দিলাম।বলেই ঢোক গিলে গিন্নীর পানে তাকায়।চুরি করতে তোমার লজ্জা করল না? সকলের তিরস্কার আর ব্যঙ্গবিদ্রুপে মানিকের মা কাঁদতে ভুলে গেছে।সে হাত জোড় করে প্রভুকে বলে, মেসো আমরা গরীব হতে পারি, চোর নয়।তোমরা যাই করতে চাও তাই করো।আমি চুরি করি নি।কনকপ্রভা আরো তেজে জ্বলে উঠে,সাহস দেখ।আরে চোর কি আর এত সহজে স্বীকার করে।পুলিশ বলল, এখন তো সাধু সাজবেই।লাভ হবে না।আমাদের সময় নেই।জেলে না যেতে চাইলে তাড়াতাড়ি বল্ কবে টাকাটা ফেরৎ দিবি।মানিকের মা’র দিকে তাকানো যাচ্ছে না।সে প্রায় মাটিতে মিশে গিয়ে প্রভুর পায়ের কাছে বসে বলে ,মেসো এ মাস শেষ হতে তো আর মাত্র ক’টা দিন বাকি।আমি এমাসের টাকা নেবো না।তাহলে তো হবে।তবু তুমি অন্ততঃ আমাকে আবিশ্বাস করো না।বলেই প্রভুর পায়ে লুটিয়ে পড়ে এই প্রথম কাঁদতে লাগল।প্রভু স্থির থাকতে পারলো না।
এই কী বিড়বিড় করছ?রোদ উঠে গেছে কখন।আলো তো গায়ে এসে পড়ল বলে।কী বলছিলে বিড়বিড় করে ?স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি?ভোরের স্বপ্ন মিথ্যে হয় না জান তো।চা হয়ে গেছে ,ওঠো চা খেয়ে বাজারে যাও।ওঠো ওঠো , মানিকের মা ঘর ঝাড় দেবে।মানিকের মা’র কথা শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল প্রভু।হাতমুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসল নিঃশব্দে।মানিকের মাকে বেশ খোসমেজাজে আছে বলে মনে হল।মানিব্যাগটা আজও টেবিলে রেখে পরীক্ষা করবে কিনা ভাবতেই কলিং বেলের পাখিটা ডেকে উঠল।গিন্নি গিয়ে দরজা খুলেই , ওমা , কে এসেছে দেখো , আসুন দাদা আসুন । আগন্তুক সোজা চায়ের টেবিলে এসেই বলে, কি রে এত বেলা করে চা খাচ্ছিস?হঠা্ৎ ছুটি পেয়ে বেশ ঘুমিয়ে নিলি?আজ স্পেশাল কিছু হবে নাকি?তাহলে খেয়েই যাব কী বল?প্রভু বলে ,শ্যামলদা তুমি খেলে আমরা যে কি খুশি হবো।তুমি গল্প করো,আমি বাজারে যাই।আজ খেয়েই যেতে হবে তোমেকে।শ্যামল বলে, না রে আজ নয় অন্য আর একদিন খাবো।চল উঠি,বাজারে যাবি তো?বলে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা পাঁচশো টাকার নোট প্রভুর দিকে এগিয়ে ঘরে বলল, সেদিন তুই আমাকে টাকাটা না দিলে আমি বড়ো লজ্জায় পড়ে যেতাম রে প্রভু।নে টাকাটা রাখ।চল যাই।প্রভু হতচকিত হয়ে যায়।মনে পড়ে,কিছুদিন আগে অফিস ছুটির পর হন্তদন্ত হয়ে শ্যামলদা বলেছিল, প্রভু ভাই পাঁচশো টাকা হবে তোর কাছে?দেখ তো , না হয় ইজ্জত থাকবে না।প্রভু দিয়েছিল ।
এখন প্রভুর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।সে বাকরুদ্ধ হয়ে টাকাটার দিকে চেয়ে রইল।শ্যামলদা কি যেন সব বলছে । কিছুই কানে ঢুকছে না।সে পুলিশ,জেরা,মানিকের মাকে সমবেত ধমকানি – সব মনে করল।মনে মনে পুড়ে যাচ্ছে , জ্বলে যাচ্ছে।লজ্জায় শরমে সে মরমে মরে যাচ্ছে।মানিকের মাকে বলবে, মানিকের মা,আমায় ক্ষমা করো।তোমাকে চোর ভাবাটা- - - -‘টাকাটা ধর’ – শ্যামলদার গলা।কিছু ভাবছিস নাকি?বাজারে যাবি না?চল একসঙ্গে যাই।হ্যাঁ দাঁড়াও , বলে সে উঠল।টাকাটা নিল,মানিব্যাগে রাখল।ড্রেস পরে এল।মানিকের মা সামনে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে - মেসো , কাঁচা লঙ্কা একেবারে নেই ,এনো কিন্তু মনে করে।প্রভু মানিকের মা’র চোখের দিকে তাকাতে পারল না।ছোঁ মেরে ব্যাগটা টেনে নিয়ে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।