হরি চৌহান

ভ্রমণ কাহিনী (অক্টোবর ২০১৮)

ARJUN SARMA
  • 0
  • 0
  • ৬৫
কালকা পর্যন্ত ছোটোখাটো ঝামেলা গিন্নি হাসিমুখেই নিয়েছিল ।যেমন , দেরাদুনের সহস্ত্রধারায় স্নান করতে নেমে উঠছি না দেখে রাগ করে বলেছিল, সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি ।জন্মেও যেন জল দেখে নি । শেষে সর্দি না ধরলেই হয় । বুঝানোর চেষ্টা বৃথা যে এ জল সে জল নয় । যদিও সব জলই হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দিয়েই গঠিত –একথা বলতেন বিজ্ঞানের মাষ্টার । কিন্তু বিজ্ঞান টিজ্ঞান কবে ভুল মেরে দিয়েছি ! সরকারি অফিসের কেরাণীগিরি করতে করতে মনে হল জলে জলে অনেক পার্থক্য । সে যাক ।রোবার্স কেইভে ঢুকে বের হচ্ছিলাম না দেখে রাগ সপ্তমে না হলেও কাছাকাছি পৌঁছেছিল । তারও আগে রামঝোলা লক্ষ্মণঝোলা দেখে ফেরার পথে এক হোটেলের সামনে একটা লোককে সঙ সেজে বসে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম তার সাজ – আরে ! এ যে আমাদের ঢাকীর দলের ভোম্বল মহাদেব !খুব যত্ন করে সেজে চেয়ারে বসে আছে । দেখলাম এর কাজ হচ্ছে হোটেলের খদ্দের আকর্ষণ করা । সেরা আইডিয়া ।হঠাৎ দেখি মহাদেব পরিস্কার হিন্দিতে আমাকে দাবড়ানি দিল যার অর্থ -লজ্জা করছে না এখানে ভাত না খেয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আমার রূপ দেখতে ? লজ্জা তো পেলামই । ঘুরে দেখি পরিচিত কেউ নেই । দলের সবাই কখন চলে গেছে । শেষে অনেক ঘুরে শকুন-হিন্দী ব্যবহার করে একসময় ট্যুর-বাসের কাছে এসে পৌঁছলাম । শকুন-হিন্দী শব্দটা গিন্নির ডিক্সনারির । আমি হিন্দীতে যাকে বলে ক-অক্ষর শিয়ালের মাংস । তাই গিন্নি আমার হিন্দীকে ঐ বিশেষণে ভূষিত করেছেন । ভ্রমণ বিলাসের পোকা মাথায় কুর কুর করলেই গিন্নি আমাকে তীর্যক ভাষায় সুভাষিত শুনিয়ে দিয়ে আমার হিন্দী জ্ঞানের শ্রাদ্ধ করিয়ে আমাকে মনে করিয়ে দেন যে হিল্লি দিল্লীর আশা ছেড়ে জুমের ঢেপা, শিঙ্গীর বিল এসব ঘুরে দেখলেই হয় ।আমিও অবশ্য গিন্নির পটাং পটাং হিন্দী শুনে অবাক হয়ে চুপসে থাকি । বাসের কাছে আসতেই দেখি মাকালীর চক্ষুজোড়া আমার চোখে নিবদ্ধ । আমি চোখের পলক ফেলতে পারছি না ।এ যেন হিপ্নোটাইজড অবস্থা ।আমার ভাগ্য ভাল যে সেই রক্তচক্ষুর ভাষা মুখে নিসৃত হওয়ার গৌরব অর্জন করে নি । তা সত্বেও আমি ভুক্তভোগী সেই নীরব ভাষার মর্মার্থ অনুধাবন করে ব্যাধ সমুখে কম্পিত পাখির মতো বোবা হয়ে অবনতমস্তকে বাসে আরোহন করি ।তবে ঐ পর্যন্তই । গিন্নির রাগের পারদ অভিষ্ট মাত্রা ছুঁতে পারে নি ।
কালকা থেকে সিমলা যাব টয় ট্রেনে, এটা আগে থেকেই ঠিক ছিল ।মনটাও চনমনে ছিল ।ভোরে গিয়ে টিকিট কেটে এলাম ।গাড়িতে চড়বার সময় দেখলাম সাজানো গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে আর আমরা চড়ছি একটা ট্রামজাতীয় ট্রেনে । এই তো গিন্নির আসল রূপ বেরিয়ে এল ঝোলা থেকে , একটা কাজ যদি মনের মতো করতে পারে ! জীবনে তো একবারই এলাম ,তাও ধেড়ধেড়ে গোবিন্দপুরের ট্রেনে ।কিপ্টেমিটা আর গেল না । হজম করে নিলাম ।কিছুদূর যেতেই জঙ্গলের পথে চলছে ট্রেন ।জঙ্গল দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল । একথা বলতেই গিন্নির সুভাষিত-জঙ্গুলে লোকের ত জঙ্গল পছন্দ হবে না ।বদ হজম করলাম। যদিও কথাটা দশ আনা বার আনা নয় একেবারে ষোল আনা সত্যি । কিশোর বয়স অবধি তো বনমোরগের পিছনে দৌড়ে ,কাছিমের ডিম খুঁজে , বুনো শূকরের বাদি ভেঙ্গে , ঘুঘুর বাসায় হানা দিয়ে , খরগোশের পিছনে তাড়া করে কাটিয়েছি । তাই বিশেষণটা না মেনে নিলে অন্যায় হতো । কিন্তু এমন পরিবেশে এটা বদহজমই হল । জানালা দিয়ে হঠাৎ একটা ময়ূর দেখে সেদিকে মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই গিন্নি বলে ,ওটাকে আবার বনমোরগ ভেবে বসো না । একেবারেই দমে গেলাম । যাকে বলে আত্মসম্মানে বিঁধে গেল । একসময় এক গুজরাটি দম্পতির সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিচ্ছিলাম আমার হিন্দিতে । গিন্নির চোখ পাকামি দেখে ইতি টেনে দিলাম । যাত্রার শুরুতেই সতর্কবাণী শুনিয়েছিল , দেখো তোমার যা গায়ে-পড়া স্বভাব ট্রেনের কামরায় যার তার সঙ্গে বন্ধু পাতিয়ে বসো না । শেষে ফতুর হয়ে ঘরে ফিরতে হবে । সেই বাণীটাই পড়লাম গিন্নির চোখে । বোবা বনে রইলাম । গুজরাটী দম্পতি যেন জোড়া কবুতর , শুধু বকবক করেই যাচ্ছে । আর আমরা যেন জোড়া বোবা । মেয়েটা কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হা করে শর্টকাটে চালিয়ে দিই ।
সিমলা স্টেশনে গাড়ি শেষ হুইশিল দিল । ও হরি !স্টেশন কোথায় , এ যে খাদের ধারে পাতানো লাইনে দাঁড়িয়ে গেল । প্ল্যাটফর্মটা একচালা বারান্দার মতো । মালপত্র নামিয়ে একটা চেয়ারে জুত করে বসে পড়লাম । গিন্নির উপদেশ- কোথাও গিয়েই খোঁজাখুজি করলে ঠকতে হবে । দেখেশুনে এগুতে হবে । গিন্নিই সব ঠিক করেন , আমি বরাবর দর্শক । প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা । গুজরাটি দম্পতি একটা কুলি ঠিক করে ওর পিছু নিয়ে টিলা বেয়ে হাঁটা দিয়েছে । আমার ইচ্ছে ছিল ওদের অনুসরন করতে । দেখি একটা মাঝবয়সী গিন্নির সঙ্গে কি যেন রফা করছে । শুনেছি হিমাচল হল কিন্নর কিন্নরীর দেশ । কিন্নরী এখনো চোখে পড়ে নি । এই কিন্নরটা বেশ দেখনসই । হাওড়া স্টেশনের কুলি নয় । দেখি মালপত্রের গায়ে লম্বা দড়ি বিশেষভাবে পেঁচিয়ে পিঠের উপর রেখে দড়ির দুইপ্রান্ত দুই হাতে ধরে অবলীলায় উঠে দাঁড়িয়েছে । একটু যেতেই একটা ট্যাক্সিতে মালপত্র ঢুকিয়ে কিন্নর ঢুকল ,গিন্নিসহ মেয়ে ঢুকল ,আমি অনুসরণ করলাম । যে হোটেলে সেঁধিয়ে দিল প্রথম দর্শনে ভাল মনে হল । আমি এসব ব্যাপারে নীরব । কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা সুখকর নয় । সেবার দার্জিলিং গিয়েই যে হোটেলটা ঠিক করেছি তারপর থেকে এই দায়িত্ব আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে গিন্নি । একরাত থেকেই দুই দিনের টাকা দিয়ে ঊষাকালেই হোটেল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম । কারণটা ব্যাখ্যা করলে আমার ইজ্জতে সুগভীর দাগ পড়ে যাবে যা কোন হাই কোয়ালিটির ডিটারজেন্টও তুলতে পারবে না । হোটেলের কাচের জানালা দিয়ে যা দেখলাম তাতে চোখ জুড়িয়ে গেল ।পাহাড় শ্রেণির গায়ে অস্তগামী সূর্যের রং লেগে অপরূপ শোভা তৈরি হয়েছে । জানালার নিচে গভীর খাদ ।
ভাবলাম একটু জিরিয়ে নিই । গিন্নির কড়া অর্ডার , জিরিয়ে নেবার জন্য তোমার সরকারী অফিসটাই তো আদর্শ ছিল । এত টাকা খরচ করে এখানে জিরোনো হবে না । অগত্যা ! নতুবা আমার অফিসের কাহিনি বিশ্লেষণ পুর্বক আমাকে যেখানে দাঁড় করাবে সেখান থেকে আমি আর উঠতেও পারব না নামতেও পারব না । বেরিয়ে মনটা জুড়িয়ে গেল । কোন সমতল নেই , শুধুই পাহাড় । তাতে কি ? পাহাড়ের গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে গেছে অপূর্ব সুন্দর সব ইমারত । এক কথায় ছবির মতো । প্রায় সাত হাজার ফুট উপরে এত সুন্দর ঘর বাড়ি বিশ্বাস হয় না । আমাদের দেশে টিলা মানে পরিত্যক্ত । আরে এ কি ? ছোটোখাটো মাঠের মতো ! কোথাও মাটি নেই , সব বাঁধানো । একপাশে শ্রীমতি গান্ধি দাঁড়িয়ে । পূবপাশে পাহাড়ের গায়ে খুব উঁচু স্টেজ মতো । সেখানে উর্দ্দিপরা কিছুলোক শ্রুতিমধুর ব্যান্ড বাজাচ্ছে । এটা নাকি পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য । বুদ্ধির তারিফ করতে হয় । এই চাতালটাকে নাকি বলে ‘রিজ’ ।এখানে সব যানবাহন নিষিদ্ধ । একপাশে খুব উচুতে একটা মাহাবীর হনুমান দাঁড়িয়ে । মনে হল ওটাই সর্বোচ্চ স্থান । সাঁজের আলোয় চারিদিক মায়াবী মনে হল । একটু হাঁটতেই কালীমন্দিরের সাইনবোর্ড দেখে এগিয়ে গেলাম । নিশ্চয়ই বাঙ্গালী এলাকা হবে । গিয়ে দেখি অবাঙ্গালী । তবে ফেরার পথে পাশের ঘর থেকে রবীন্দ্রসংগীত শুনে বেশ অবাক হলাম । আলোর মালায় চারিদিক ভরে গেছে । সত্যিই পাহাড়ের রাণী । বনে পূজিত কালী তথা ‘শ্যামলা’ থেকে নাকি সিমলা নাম হয়েছে শুনেছি ।
হোটেলওয়ালার সঙ্গে কথা বলে তিনদিনের প্যাকেজ ট্যুর ঠিক করা হল । কুলু মানালি ঘুরে আবার কালকা পৌঁছে দেবে । মোট চৌদ্দ হাজার টাকার চুক্তি । একটা অলটো গাড়ী এই তিনদিন আমাদের হয়ে যাবে । হোটেল ভাড়াও আর দিতে হবে না । গিন্নির টিটকিরি – নিজে তো আর গাড়ি কিনতে পারবে না এজীবনে , তিনদিনের গাড়িমালিক তো অন্তত হলে !
যথারীতি পরদিন সকালে কিন্নর-কুলী এসে মালপত্র নিয়ে চলল । আমরাও পিছু নিলাম । অনেক উৎরাই পেরোতে পেরোতে মনে হল কয়েক তলা নেমে গেছি । রাস্তার ধারে একটা সাদা অলটো গাড়ির কাছে গিয়ে কুলি তার চালকের সঙ্গে কি যেন বলে মালপত্র সব ঢুকিয়ে দিল । চালক হাতজোড় করে হিন্দী ও ইংরেজী মিশিয়ে যা বলল তার মানে হল –স্যার এখন থেকে আপনাদের সব দায়িত্ব আমার । কোন ভয় নেই । যে কোন অসুবিধা আমাকে জানাবেন । আপনারা যেভাবে বলবেন সেইভাবে যাব । প্রথমে কুলু তারপর মানালি । পথে যা যা দ্রষ্টব্য সব দেখাব । আপনারা উঠে বসুন । উঠলাম । আমি চালকের পাশের সিটে । সে বলল , স্যার সিটবেল্ট লাগিয়ে নিন । আর এই নিন আমার কার্ড । এতে আমার পরিচয় লেখা আছে ।
কার্ড হাতে নিয়ে দেখলাম তার নাম হরি চৌহান । প্রথম দর্শনে তেমন খারাপ লাগে নি । গিন্নির সতর্কবাণী মনে পড়ল –প্রথম দর্শনেই যেন মাখামাখি না করা হয় । গাড়ি চলছে । দুপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখছি । মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে । পাইন , দেওদারের শোভা অতি মনোরম । কিন্তু কথায় বলে না –স্বভাব যায় না ম’লে ! কিছুক্ষণের মধ্যে সব ভুলে গিয়ে ড্রাইভারকে শুধোলাম – বাড়ি কি সিমলায় ? উত্তর এল –হাঞ্জি । বুঝলাম না কি বলল । পেছনের যাত্রীদের উদ্দেশে বললাম , সে কি হাঁচি দিল ? ওরা না হেসে পারল না । এবার চালকের উদ্দেশে – ওগুলো কি পাইন গাছ ? উত্তর –হাঞ্জি । বুঝা গেল সম্মতিসূচক উত্তর হল –হাঞ্জি । একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, টিফিন করে নিন । গিন্নি বলল , তোমার হাঞ্জির ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে । বোধ হয় কমিশন পাবে । কান না দিয়ে চা-নেশা নিবারনে ঢুকে পড়লাম । হরি দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে স্থানীয় ভাষায় কথা বলল সারাক্ষণ । মেয়ে বলল , বাবা ,তোমার হাঞ্জি রোবটের মতো কথা বলে কেন ? মেয়ের মা বলল ,ড্রাইভারের সঙ্গে কথা না বলাই ভাল । যা দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা ! প্রতি পদে বিপদ । আমি বুঝি, পথের বিপদের চেয়ে আমার মাখামাখিটাই বেশি বিপদ গিন্নির কাছে । তবে হরিকে কেমন যেন একটু চিন্তিত মনে হল ।
যত পথ যাচ্ছে , প্রাকৃতিক শোভা তত পরিবর্তিত হচ্ছে । হঠাৎ দেখি একটা নদী । হরি বলল , স্যার, এটা শতলুজ ।বুঝলাম , শতদ্রু । মেয়ে বলল বাবা পঞ্চ নদের একটা ? মেয়ে খুব খুশি বইয়ের নদী দেখে । একজায়গায় দাঁড় করালো । বলল ,স্যার নদীটা দেখুন , মামণিকে দেখান । বলেই মোবাইল কানে জুড়ে দিল । গিন্নি তো ফায়ার । এটা দেখার কি আছে ? সে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছে । আমার খারাপ লাগছে না ।গাড়িতে উঠলাম । হরির মুখের অভিব্যক্তি শুরুর মতো প্রানচঞ্চল নেই । এতক্ষণে হরি বুঝে গেছে যে আমি নেহাত একটা বকবক –প্রিয়-লোক । সে বলল, স্যার ঘরে আমার মেয়েটা অসুস্থ । ওকে ডাক্তার দেখাচ্ছে । আমি ‘ও আচ্ছা’ গোছের একটা শব্দ করেছি । এক সময় বলল ,স্যার ঐ যে ডানদিকে একটা চিমনি দেখছেন ওটা অম্বুজা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি । নামলাম । ও দেখাল বহুদুরে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে রোপওয়ের মাধ্যমে চূনাপাথর আনছে ।পাহাড়ে অঢেল চূণাপাথর ,বিনামূল্যে । খুবই অদ্ভুত মনে হল ।
কিছুদূর গিয়ে বলল ,স্যার এটা ‘বিয়াস রিভার’ । এই জায়গায় সবাই ছবি তোলে । নেমে ছবি তুলুন । ব্যাস , এবার আমারও বিরক্তি ধরে গেল –ব্যাটা নিশ্চয়ই ফোন করবে । ঠিক তাই । মোবাইল কানে। গিন্নিকে আস্বস্ত করলাম এই বলে যে ,সে অন্তত চালাতে চালাতে কথা বলে না – এটাতো ভাল । নেমে দেখলাম জায়গাটা খুবই সুন্দর । কেমন দুটো পাহাড় প্রায় খাড়া উঠে গেছে বিপাশাকে মাঝে রেখে । হরি বলল বিয়াস সারাক্ষণ আমাদের সাথে সাথে চলবে মানালি পর্যন্ত । এবার অবশ্য গিন্নি বলল ,উত্তম-সুচিত্রার বইয়ের সে বিপাশা ? খুশি হল । বিপাশা এখানে খুবই সরু । ভূগোল স্যারের কথা মনে পড়ল ,উচ্চগতিতে নদী তেমন প্রশস্ত নয় । কখনো বিপাশার উপর সেতু পার হয়ে যাচ্ছি, কখনো ডানপাশে ,কখনো বাম পাশে –এভাবে বিপাশা আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে । ডানপাশে বিপাশা তো বাঁদিকে গা ঘেঁষে খাড়া পাহাড় । আবার বাঁপাশে বিপাশা তো ডানদিকে যেন গাড়ির গায়ে লেগে যাবে পাহাড় । এমন হল যে রাস্তার ঠিক উপরেই পাহাড়ের খাঁজ । মনে হল গাড়িটা খাঁজের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে এবং যেকোন মুহূর্তে পাহাড় ভেঙ্গে গাড়ির উপর পড়বে ।এত ভয়ংকর সুন্দর দৃশ্য আগে দেখি নি । মনে হল দুটো পাহাড় দুদিক থেকে নেমে এসে বিপাশার জল পান করছে । রাস্তার জন্য জায়গা একেবারেই কম । জলে বাঘ ডাঙায় কুমিরের মতো একপাশে বিপাশার খরস্রোত ,অন্য পাশে পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত পাথর । হরি বলল ,কিছুদিন আগে নাকি একটা গাড়ি যাত্রীসহ বিপাশার জলে ডুবে গেছে । গা শিউরে উঠল ।
এতক্ষণে হরির অনেক কথা আমার জানা হয়ে গেছে । সে বিএ পাশ । তার এক ছেলে এক মেয়ে , মেয়েটা ছোট , ওর জ্বর । বৌটা হাসপাতালে নিয়ে গেছে । দেখবার কেউ নেই –ইত্যাদি ।হরিকে এখন আমার মোটামুটি ভালই লাগছে । কারণ সে আমার সব বকবকানির সঙ্গত দিচ্ছে । এটা কি ওটা কি , ঐ গাছটার নাম কি , এখানে চাষবাস কেমন হয় , কি ফসল হয় , বৃষ্টি হয় কিনা –এসব । গিন্নির শাসন মনে রেখেও স্বভাবদোষে হরির সঙ্গে অনেক মত বিনিময় করে নিয়েছি ফাঁকে ফাঁকে ।
দুপয়সার কেরাণীর এ বড় বিচিত্র শখ । প্রায় হর বছরই ভ্রমণ-পোকা চাগাড় দিয়ে ওঠে আর ‘উঠ ছেরি তোর বে’-র মতো বোচকা কাঁধে প্রস্তুতি ছাড়াই দুর্গা বলে নেমে পড়ি । এই একটা ব্যাপারে ঘরের মহিলাটি তালে তালে সঙ্গত দেয় । লাগে টাকা দেবে জি পি এফ ! কেরাণি শব্দে গিন্নির বড় আপত্তি । আমি বলি আরে , সব কেরাণি তো আর মাছি মারে না । তাহলে কেরাণিতে দোষ কোথায় । কেরাণিই তো দেশ চালাচ্ছে । অফিস চালানো মানেই কেরাণির কাজ । গিন্নিকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে সব অফিসারই কেরাণি , কিন্তু সব কেরাণি অফিসার নয় । গিন্নি মানতে নারাজ । বিপাশার অপর পাশের পাহাড়ের চূড়ার দিকে কি একটা উঠে গেছে দেখে হরিকে জিজ্ঞেস করতেই হরির পা ব্রেক-এ । সবাই নামলাম । হরি বুঝিয়ে বলল ঐ আকাশের কাছাকাছি পাহাড়ের চূড়ার পেছনেও জনপদ আছে । যাবার রাস্তা নেই এখান থেকে । বিপাশার এপাড় থেকে এই বিশেষ ব্যবস্থায় ওদের জন্য খাদ্যসামগ্রীসহ সব প্রয়োজনীয় জিনিস পাঠান হয় । রোপওয়ের মতো দুটো তার ঝুলে আছে । আসলে একটিই তার দুটো কপিকলের গায়ে ঘুরে গেছে । এক তারে পাত্র ঝুলিয়ে তাতে চাল,ডাল ,নুন সব রেখে দেয় । অপর প্রান্ত থেকে অন্য তারে জলভর্তি একটি পাত্র নেমে আসে আর তারে টান পড়ায় এপারের জিনিসভর্তি পাত্র তরতর করে উঠে যাচ্ছে উপরের মানুষের কাছে । বাহবা দেবার মতো । তেল খরচ নেই , বিদ্যুৎ খরচ নেই । এমন বুদ্ধির জন্যই তো দুপেয়ে ছোট্ট মানুষ বিশাল, হিংস্র জন্তুকেও বাগে আনতে পেরেছে । তবে ঐ আকাশের কাছে পাহাড়ের চূড়ায় কিভাবে তার টেনে নিয়ে গেছে সেটা বোধগম্য হল না ।
একজায়গায় লাঞ্চের জন্য থামল । ধাবা হবে । অনেক গাড়ি , অনেক লোক । হরিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি খাবে না ? উত্তর –হাঞ্জি । এতক্ষণে আমরা বুঝে গেছি হাঞ্জি মানে -হ্যাঁ জি । আমরা তাকে হাঞ্জি ,মাঝে মাঝে হরু বলে আড়ালে ডাকি । গিন্নি বলল ,ওর এখানে কমিশন আছে নিশ্চয় । হতে পারে খাওয়া ফ্রি ।
অনেকক্ষণ পর দেখি বিপাশা হঠাৎ ডানদিকে বেঁকে গেছে আর আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল উঁচু খাড়া পাথরের পাহাড় । হরি ব্রেক কষে থামিয়ে বলল -স্যার নামুন ,ছবি তুলে রাখুন ,স্মৃতি হয়ে থাকবে । হরির উপদেশে গিন্নির পিত্তি জ্বলে উঠছে জানি । কিন্তু পথ কোথায় ? হরি কানে মোবাইল লাগিয়েও বলল ,স্যার এবার টানেল পার হতে হবে । তিন মাইল লম্বা টানেল । নেমে দেখি অবাক কান্ড ! পাথরের পাহাড় ছিদ্র করে রাস্তা , ডবল লেনের দুটো রাস্তা , একটা যাবার , একটা ফেরার । কিছুক্ষণ এর শোভা উপভোগ করে ছুটলাম । জীবনে এত লম্বা টানেল দেখি নি । মিটমিট করে লাইট জ্বলছে । ভিতরে যেন রাত্রি । এমন পাথর ছিদ্র করতে কতদিন লেগেছিল কে জানে । ইংরেজদের দ্বারাই এটা সম্ভব । টানেল থেকে বের হতেই শীত শীত করছে । পাহাড়টার ওপাশে গরম ,এপাশে শীত ।
বিকেলের দিকে এক জায়গায় থেমে বলল ,স্যার এই মন্দিরটা দেখে আসুন ,ভাল লাগবে । দেখি রাস্তার উপরেই উঁচু মন্দির পাহাড়ের গায়ে যেন লেপটে আছে । অনেক সিঁড়ি বেয়ে ঊঠতে উঠতে দেখি অনেক ঘর ,অনেক মূর্তি । মাঝে একটা বড় হল ঘর । সিংহাসনের মতো চেয়ার ও অন্য জিনিস দেখে অনুমান হল বিয়েবাড়ি হিসেবেও ভাড়া দেয় । একটা বড় ঘর যেন মিনি বাজার । মনোহারী থেকে সুরু করে ঘর সাজানোর জিনিস কি নেই । শেষ কক্ষে উঠে দেখি অনেক পূজারী , সাধু । একটা হাত তিনেক উঁচু মূর্তি , ব্রোঞ্জের হবে । এর সামনে একটা বড় জালার মতো । ওতে তেল ভর্তি । কোন ফুল ফল চোখে পড়ল না । একপাশে অনেক সাইজের বোতল ভর্তি তেল । দক্ষিণা দিয়ে তেল কিনে ঐ মূর্তির মাথায় ঢালতে হয় । এতে নাকি পূণ্য হয় । পূণ্য করলাম । ঠাকুরের স্নান করা তেল ঐ জালায় এসে জমা হয় ।
আবার চলা । সন্ধ্যে হয়ে গেছে । হরি বলল , স্যার এটা কুলু । এখানকার র্যা বিটের কম্বল বিখ্যাত ।সামনে একটা সরকারী কো-অপারেটিভ আছে । অনেক জিনিস পাবেন । কিনে নিন, আবার কবে আসবেন । বুঝলাম ব্যাটা আমাদের ফাঁদে ফেলতে চাইছে । গিন্নি তো শুনেই আগুন – খবরদার , ঘুরতে এসেছি ঘুরব ,এসব হাবিজাবি একদম নয় । সাবধানে পা ফেললাম । এলাহি ব্যাপার । যা দেখি তাই পছন্দ হয়ে যায় । এসব তো মুখ ফুটে বলা যাবে না । নয়ন সার্থক করছি । অনেক নেড়েচেড়ে গিন্নি বলল,র্যা বিটের একটা কম্বল নিলে নেওয়া যেতে পারে । অভয় পেয়ে বললাম দেখ ,দারুণ শাড়িটা,তোমাকে মানাবে ভাল । নিয়ে নাও । আর ঐ কম্বলটাও খুব সুন্দর । মাদুরটা দেখেছ ? আমাদের ঐ পোড়া জায়গায় এসব তো চোখেও দেখা যায় না । নিতে পারো । আমরা তো আর বোঝা বইব না । গাড়িই বয়ে নিয়ে যাবে । হরিও সঙ্গত দিল , এখন অফার দিচ্ছে স্যার , দশ হাজারেরটা মাত্র সাত হাজারে পাবেন । শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়াল - দুটো কম্বল ,শাড়ি ,শোয়েটার , শাল ,মাদুর সব হল । আমরা মুর্গী বনে গেলাম । হরুর কমিশন খাড়া ।
প্রায় রাত আটটার সময় যেখানে গাড়ি দাঁড়াল সেটাই মানালি । হরি বলল ,স্যার ,এটাই আপনাদের হোটেল । কোনরকম অসুবিধা হলেই ফোন করবেন । বিশ্রাম করুন । আলো আঁধারীতে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না জায়গাটা কেমন । ঝিরঝির করে ঝর্ণার শব্দ শোনা যাচ্ছে । সারাদিনের গাড়ি চড়ার ধকল, বিছানায় পড়তেই ঘুম ।
হরির কথামতো ভোরেই উঠে গেছি ।সকাল সকাল গিয়ে স্নো-ভিউ পয়েন্ট দেখে আসতে হবে । আবহাওয়া কখন কি রূপ ধারন করবে ঠিক নেই । ঘরের ওয়াল জোড়া কাচের ভিতর দিয়ে যা দেখলাম চোখ জুড়িয়ে গেল । একটু দুরেই পাহাড়ের গায়ে সাদা বরফের উপর প্রাত-সূর্যের রশ্মির খেলা এককথায় অপরূপ । ঘরের সামনেই আপেল গাছের সমারোহ । ছোট ছোট আপেল ভর্তি গাছে গাছে । আর আছে গোলাপ বাগান । এত বিশাল সাইজের গোলাপ আগে দেখি নি । ঝর্ণার উৎস ঐ পাহাড় । হরি হাজির , স্যার কোন অসুবিধা হয় নি তো ? উত্তরে ‘চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি , ক্ষুদ্র দুখ সব তুচ্ছ মানি ’ গাইতে ইচ্ছে করছে ।
টিফিন খেয়ে রওনা দিলাম স্নো-ভিউ-পয়েন্টের দিকে । একটু যেতেই হরি থেমে বলল ,স্যার ,ঐ দোকান থেকে র্যােপার ভাড়া নিতে হবে । গ্যাংটকের অভিজ্ঞতা মনে রেখে নামলাম । দরদাম করলাম । চড়া দাম । অন্য দোকানে দেখব । হরি বলল, স্যার , নিয়ে নিন । এর কমে পাবেন না । বিরক্ত হলাম । নিশ্চয়ই তার কমিশনের ব্যাপার । রাগ হল । আশ্চর্য ,যে দোকানে জিজ্ঞেস করি সবাই বলে না হবে না । কান ধরে আগের দোকানে ওই দামেই কিনতে হল । একটু যেতেই দৃশ্যপট পরিবর্তন হল । উঁচু পাহাড়ের গায়ে পাকদন্ডী বেয়ে উঠছি তো উঠছি । সামান্য এদিক ওদিক হলেই গাড়ি অতলে তলিয়ে যাবে যাত্রীসহ গাড়ি । খাদের অপর পাড়ে পাহাড়ের কোল বেয়ে নামছে নয়নাভিরাম ঝর্ণা । গায়ে গায়ে লেপটে আছে মেঘ। আরে ,একি ! রাস্তার পাশে পাশে বরফের স্তুপ ।গলছে না । সুতরাং তাপমাত্রা কোথায় বুঝতে অসুবিধা নেই । কোথাও কোথাও মনে হচ্ছে বরফ কেটে রাস্তা গেছে । সামনে গাড়ি পেছনে গাড়ি । নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেকগুলো রাস্তায় পিল পিল করে গাড়ি উঠছে । সামনে উপরের দিকেও গাড়ির লাইন । সবাই উঠছে । ভয় লাগছে , প্রকাশ করছি না । হরির চোখ রাস্তায় নিবদ্ধ । আমিও যেন কথা বলতে ভুলে গেছি । মনে হচ্ছে পলক ফেললে জীবনে আর এই দৃশ্য দেখতে পারব না । শেষে যেখানে এসে রাস্তার পাশেই গাড়ি থামল তার বর্ননা দেওয়া মুস্কিল । চারিদিকে বরফ । দক্ষিণে বরফের পাহাড়ের গায়ে বড় বড় পাথর । উত্তরের পাহাড়ে বরফ কম । পুবে শুধুই বরফাবৃত পাহাড় যার থেকে লুঙ্গার মত হয়ে নেমে এসেছে বরফ গলা জলের ক্ষীণধারা । এই ধারাই নাকি বিপাশা । বিশ্বাস হয় না। মানে বিপাশার উৎসের কাছাকাছি !পূব দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারি না । রোদ পড়ে সাদা বরফের সমুদ্রে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে তা অনির্বচনীয় । ঈশ্বরের অধিষ্ঠান কি তার ওপারে ! আমি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক জীব । এখানে নিজেকে কিটানুকীট বলে বোধ হচ্ছে । কোথায় আমার বাড়ি , কোথায় জন্ম ,কেন এই পৃথিবীতে এসেছি , কোথা থেকে এসেছি – সব কেন জানি প্রশ্ন হয়ে ধেয়ে আসছে । কার অদৃশ্য হাত এই বিপুল বিশাল সৌন্দর্যের পেছনে ? কিছুই তো জানি না । এখন এই বিশালের মধ্যে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের মাঝে বালিকণার সদৃশ মনে হল । এটা নাকি চৌদ্দ হাজার ফুট উপরে । রাস্তাটা আরো উপরের দিকে গেছে । হরি বলছিল আর উপরের দিকে লাহুলস্পিতি বলে একটা জনপদ আছে । এও সম্ভব ! মানুষের বুদ্ধি আর সাহসকে নমস্কার । এই রাস্তাটা না করলে এখানে কেউ আসতে পারতো না । শুনেছি এদিকেই সিল্করুট ছিল । মানুষ সব করতে পারে ।
হরির নির্দেশে নেমে গেলাম বরফের দেশে । এক বুড়ি থেকে পাঁচ টাকা করে লাঠি ভাড়া করে নিলাম । বরফে হাঁটতে সুবিধে হবে । বিপাশা এখানে দশ ইঞ্চিও গভীর নয় । পেতে রাখা পাথরে পা ফেলে জল পেরিয়ে দক্ষিণের অংশে গিয়ে মেতে গেলাম বরফ খেলায় । নিজের পরিচয় ভুলে গেছি । সেই মানুষের কেরামতি ! এখানে অনেক ঘোড়া , চমরী গাই , মাই তিন চাকার গাড়ী সব হাজির । পর্যটকের পরিষেবায় অনেকের অন্নসংস্থান হচ্ছে প্রতিদিন । উত্তরের পাহাড় থেকে অনেকে প্যারাস্যুটে চড়ে নেমে আসছে নিচের বরফে । দক্ষিণে তাকাতেই ভয় খেয়ে গেলাম । উপরের থেকে যদি একটা পাথর এখন নেমে আসে তাহলে ! যদি এখান থেকে না ফিরি ? আবার বরফ খেলায় মেতে সেই ভয় ভুলে গেছি । ক্লান্ত হয়ে মনে হল এবার ফেরা দরকার । শুরুর জায়গায় এসে খুঁজে দেখি হরি নেই । গিন্নি বলল ,এও তো হরির স্থান । সহজে মিলবে না দর্শন । জোরে ডাকলাম হ-রি-ই-ই-ই- । কিছুক্ষণ পর এল –স্যার , শেষ ? তাহলে চলুন । আকাশের অবস্থা ভাল ঠেকছে না । বৃষ্টি নামতে পারে । আর এখানে বৃষ্টি বিপজ্জনক । উঠে গেলাম গাড়িতে । শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে । খুব অবাক হলাম আবার । পদে পদে বিপদ জেনেই সবাই আসছে । এবার নামার পালা । হরির কথাই ঠিক হল । ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে । শুধু ভাবছি কখন সমতলে নামব । কারো মুখে কথা নেই । ভয়ংকর সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে নামছি আর ঈশ্বর নামক কাকে যেন উদ্দেশ্য করে প্রণাম জানালাম ।
সমতলে নেমেই হোটেল । হরির তত্ত্বাবধানে । আমরা বুঝলাম এখানেও কমিশন । ঢুকিয়ে দিয়েই ফোন কানে লাগিয়ে কোনদিকে লুকিয়ে গেল । কত কি দেখাবে বলেছিল । ফাঁকি দিচ্ছে । একটু বাদে এসে বলে ,স্যার , আমাদের লিস্টে তো আরো আছে , চলুন যাওয়া যাক । গেলাম । হিড়িম্বা টেম্পল , মিউজিয়াম দেখতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল । কাঠের তৈরি টেম্পল । ভিতরে সবাই ঢুকে হিড়িম্বার পা দেখে , আমি খুঁজে পাই নি বলতেই সবাই হো হো করে হাসল ।
সিমলায় শেষ রাত । হরি বলল ,স্যার ,ভোরে রওনা হলেই ভাল । বার ঘন্টা লাগবে কালকা যেতে । ভোরে উঠেই হরিদর্শন । মনে হচ্ছে রাতে ঘুম ভাল হয় নি । কি জানি কোথায় কাটিয়েছে । গাড়ি ঠিকঠাক চালাতে পারলেই হয় । রওনা দিলাম । হরি কথা বলছেই না বলা যায় । গিন্নি বলল, তোমার হরি রাতে অন্যলোকে ছিল মনে হচ্ছে । এক জায়গায় থেমে বলল, স্যার এখানে একটা হটস্প্রিং আছে দেখে আসুন। বলে গাড়ির মধ্যে বসে মোবাইল কানে দিল ।
এক্কজায়গায় এসে বলল , স্যার ,আমরা সিমলা যাচ্ছি না , এই সর্টকাট পথে কালকা যাব । মন্দ নয় , নূতন দৃশ্য দেখা যাবে । কিছুদূর পরে দুপুরের খাওয়ার জন্য থামল । সে নামছে না দেখে বললাম ,তুমি খাবে না । সে মাথে নেড়ে অসম্মতি জানাল । তাহেলে কি এখানে কমিশন নেই ? গিন্নি বলল , ব্যাটা রাতের ঠ্যালা সামলে উঠতে পারছে না । পাহাড়ী পথ ধরে চলছি । প্রাকৃতিক দৃশ্য তেমন মনোরম নয় । মাঝে মাঝে জঙ্গল , জনপদহীন । একসময় লোকালয়ে ঢুকলাম । গরিব এলাকা বলে মনে হল । পথের পাশে হলদেটে ক্ষেত দেখে মেয়ে বলল ,বাবা ওগুলো কি ? বললাম, গমক্ষেত । সে ব্লল , আমি কখনো গম গাছ আগে দেখিনি । হরি হঠাৎ থেমে বলল ,স্যার খুকিকে দেখিয়ে আনুন । গাড়ি থেকে না নেমেই কানে মোবাইল । বিরক্ত হলাম , ব্যাটা কথা বলার জন্যই নামতে বলছে ।
কালকার কাছাকাছি আসতে সন্ধ্যা হয় হয় । হরি বলল , স্যার সামনে পুলিশের গেইট । আমি গেইটের এপারে নামিয়ে দিই , আপনারা আর একটা গাড়িতে করে চলে যান । আমিই গাড়ি ঠিক করে দেব । গেইট পার হলে আমার ফিরতে দেরি হয়ে যাব । গিন্নি এবং আমি দুজনেই লাফিয়ে উঠলাম । ব্যাটা বলে কি ? এতগুলো টাকা দিয়ে ভাড়া করেছি কি এসব ঝামেলা পোহানোর জন্য ? একটু বিরক্ত হয়েই বলে দিলাম , না হবে না । যেমন কথা ছিল তেমনই হবে । নামতে পারব না । হরি দ্বিরুক্তি না করেই চালাতে লাগল । গেইটে গাড়ির ভিড় । পার হতে আধঘন্টা লেগে গেল । স্টেষনের কাছে পার্কিং এর জায়গা নেই । দ্রুত লাগেজ নামিয়ে দিল । টাকা দিলাম । হরি হাতজোড় করে বলল ,স্যার আবার দেখা হবে । সিমলা এলে আমাকে ফোন করবেন । কার্ডে নম্বর আছে । আমি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে লাগেজে হাত লাগাতে যাব । হরি গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেওয়ার আগে বলল ,স্যার , সি ইজ নো মোর । মাই চাইল্ড ইজ নো মোর। হতভম্ব হয়ে গেলাম । বার বার ফোন , আজকে ভাত না খাওয়া , কথা কম বলা ,গেইট পার হতে না চাওয়া –সব জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেল । এত কষ্ট বুকে চেপে রেখেও সে তার কর্তব্য পালন করেছে কোন ঘাটতি না রেখে । কেউ কোন কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম । হরিকে আমার এই মূহুর্তে রহমতের মতো মনে হল । কিন্তু আমি তো মিনির বাবা হতে পারলাম না । চেয়ে দেখি হরির গাড়ি দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ভ্রমণ কাহিনি অবলম্বনে ছোটোগল্প । সিমলা, ঋষিকেশ,কুলু, মানালি দেখতে বেরিয়ে পথে পথে লেখকের যে সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে ছত্রে ছত্রে । মনে হবে লেখকের সঙ্গে পাঠকও চলছেন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ,বরফের দেশে ,মেঘেদের দেশে , আকাশের কাছাকাছি । কখনো মনে হবে বিপাশা নদীতে এই বুঝি ঝুপ করে পড়ে গেলাম,কিংবা গগনচুম্বী পাথরের খাজে গেল গাড়ি আটকে । প্রাকৃতিক পরিবেশ বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা পরিবর্তন বিশেশভাবে লক্ষ্যনীয় । এতকিছুর প্রধান সাক্ষী হল গাড়ির ড্রাইভার হরিচৌহান । মিতভাস ,কর্তব্যে প্রতি একনিষ্ঠ হরি নিজের ছোটো মেয়ের অসুস্থতার কথা চাপা দিয়ে লেখককে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে । ভ্রমণের অন্তিম লগ্নে একটু আগে চলে যাওয়ার আকুতি লেখক নাকচ করে দিলেও হরি তার দায়িত্ত্ব পালন করেছে । শেষে তার মেয়ের মৃত্যুর খবরে লেখকের আক্কেলগুড়ুম হলেও ততক্ষণে হরি দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে । টানটান এক ছোটোগল্প বুনন হয়েছে ভ্রমণকে কেন্দ্র করে ।

০৮ এপ্রিল - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪