((অনুগল্প) টমেটোর জমিতে নিড়ানী দিচ্ছিল জিল্লু মিয়া। বাড়ির পেছনেই তার কাঠা পাঁচেক জমিতে এবার খুব ভালো টমেটো হয়েছে। হঠাৎ পাড়ার দিক থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এসে খবর দিল জিল্লু মিয়াকে। -“চাচা তাড়াতাড়ি বাড়িতে যান- দ্যাখেনগা কি হয়েছে বাড়িতে।” -“কি হয়েছে রে বাপ? বল আমাকে!” ভয়ে ভয়ে কেমন আড়ষ্ট আর ভাঙা গলায় জিজ্ঞাসা করল জিল্লু মিয়া। পাড়ার ছেলেটা আবার বলল-“আপনি আগে বাড়িতে যান তো , তারপর বুঝতে পারবেন। আমি অত জানিনা। উজ্জ্বল ভাই এর বুলে কি হয়েছে!” -“ উজ্জ্বল ! সে তো কেরালায় আছে দু’মাস থেকে-তার আবার কি হল?” এ কথা বলেই জিল্লু সোজা পথ বাদ দিয়ে একেবারে আমজাদ হালসানার বাঁশ বাগানের ভিতর দিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিল। বাড়িতে এসে দেখছে তার স্ত্রী সালেহা অজ্ঞান হয়ে দাঁত কপাটি লেগে পড়ে আছে। আশপাশের বাড়ি থেকে আসা দু-পাঁচ জন বৌ-ঝি তার মাথায় পানি ঢালছে। পাশের বাড়ির রুবেল দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় স্কীন টাচ মোবাইল হাতে। তাকে ঘিরে ধরছে পাড়ার বিভিন্ন বয়সের ছেলে-মেয়েরা একেবারে মৌমাছির মত করে। তার মোবাইলে লাইভ দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বলকে। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে কেরালার কোনো এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে গত দু-মাস আগে গিয়েছিল সেখানে কাজ করতে। কম বয়সের ছেলে । বারো ক্লাসে ফাইনাল দিয়েছে এই বছরে। বাড়িতে বসে থাকলে বসে থাকায় হবে- তাই সে কেরালায় গেছে পাড়ার অন্য ছেলেদের সাথে। ওখানে গিয়ে সে অল্প দিনে বেশি টাকার একটু কঠিন ও রিক্সের কাজই করত- বৈদ্যুতিক লাইনের কাজ। আর ঐ কাজ করতে গিয়ে সে কি ভাবে পা ফসকে প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু থেকে পড়ে যায়। পড়বি তো পড় বেচারার মাথা নীচের দিকে থাকায় স্বজোরে পাকা রাস্তায় মাথা পড়ে একেবারে থেঁতলে যায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করে। জিল্লুমিয়া রুবেলের মোবাইলে একবার তাকাতেই বুকের ভিতর এমন মুচড়ে উঠেছে যে তখনি মাথা ধরে মাটিতে বসে পড়েছে। আহারে! ছেলেটা অত দূরে কাজে যেতে চায়ছিলনা। জিল্লুই বলে কয়ে পাঠিয়েছিল। ফলে জিল্লুর কেবলই মনে হচ্ছে যে, তার দোষেই ছেলেটা শেষ হয়ে গেল। একটা পড়াশোনা করা মেধাবি ছেলে – পরীক্ষা দিয়ে বসে থাকবে তো কি হয়েছে? এটাই যেন জিল্লুর সহ্য হল না। এর জন্য দায়ী যেমন তাদের অভাব তেমনি তার থেকেও বেশি দায়ি তাদের স্বভাব।
অমন সুন্দর দুধের গাভীটাকে বিক্রি করে যে সতের হাজার টাকা হয়েছিল তা দিয়ে বিমানে করে নিজের ছেলের মৃত লাশ আনাতেই পনের হাজার ফুরিয়েছে। পাড়ার আরো যারা ওখানে থাকে তারাই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তারপর পাড়ার লোক আর কিছু মন্ডল মাতাব্বরের পরামর্শে ছেলের জন্য কুলখানি করতে গিয়ে বাড়ির দু-চার মন ধান গম , চাল-ডাল তাও শেষ হল। সব মিলিয়ে জিল্লু নিজের মৃত ছেলের সদগতি করতে গিয়ে নিজেই যেন আধমরা হয়ে গেল। এই নানান সব চিন্তা-ভাবনা করতে করতে জিল্লু মিয়ার মন এক অসহ্য যন্ত্রণার উদ্বেগে ভরে যাচ্ছে যেন। সে তার একমাত্র ছেলে উজ্জ্বলকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখত। ভাবত এই ছেলে তার বংশের নাম উজ্জ্বল করবে। কিন্তু হায় কিভাবে সব তছনছ হয়ে গেল। এখন কেবলই মনে যেন তারা কোনো দিনই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেনা। জিল্লু যেন সেটা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পারছে। আসলে জিল্লুরা যাতে কোনো দিনই সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে তার জন্য যা করার তা যেন পাকা-পোক্তভাবেই করা হয়ে আছে। প্রকৃতির কি এটা অমোঘ নিয়ম যে যুগে যুগে এই জিল্লুরাই রক্ত পানি করে করে সস্তায় বড়লোকদের খায়য়ে খায়য়ে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু জিল্লুরা লাগাতার অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে অকাল মৃত্যুর প্রহরকে তাড়াতাড়ি কাছে টেনে আনতে থাকবে। এই তো কিছুদিন আগে সে সস্তায় টমেটো খাইয়ে দিয়েছে একবার। এখন আবার চেষ্টা করে চলেছে সে সবাইকে মিষ্টি কুমড়ো খাওয়ানোর জন্য। কুমড়োর লতাগুলি কি সুন্দর লকলক করছে। কিছু কিছু গাছে ফুলও এসে গেছে। কুমড়োর ফাঁকে ফাঁকে জিল্লু মিয়া লাল পুনকার বীজ ছিটিয়েছিল – তাও বেশ ভালো বাহাল হয়েছে। এখন জিল্লু মিয়ার ঐ পুনকা গাছের গোড়াগুলি একটু উছলিয়ে দিচ্ছে। তার কপাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ছে। হয়ত একেই বলে রক্ত পানি করা। দুর্লভপুরের দিকে থেকে আজ সারাটা দিন ট্রাকটারের ট্রলিতে ইঁট বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই মেঠো রাস্তা দিয়েই। তার ধুলি বালি বার বার উড়ে উড়ে চোখে মুখে পড়ছে জিল্লু মিয়ার। ইঁট যাচ্ছে তারই প্রতিবেশি গনেশ সরকারের । গনেশ সরকাররা কয়েক পুরুষ আগেকারই অবস্থা সম্পন্ন লোক। তাই তার একমাত্র ছেলে সুভাসকে সে কলকাতাতে রেখে বেশ ভালো করেই পড়াশোনা করিয়েছিল। দু বছর আগেই সুভাস ডব্লিউ বি সি এস পাশ করে বিডিও এর চাকরী পেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস যে, বেচারা কিছুদিন আগে এক বাস দুর্ঘটনায় মারা যায়। বেশ কিছু মানুষ ঐ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। সরকার প্রত্যেক মৃত ব্যক্তি পিছু ৭ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়। সেই টাকা পেয়েই গনেশ আবার কালীতলার মোড়ে আরেকটি বিরাট গোডাউন বানানোর আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। জিল্লুর কালো মুখে মেঠো রাস্তার লাল ধুলো আবার এসে পড়ল। এবারের ট্রাকটারের ট্রলিটা যেন স্বাভাবিক আওয়াজের থেকে কয়েক গুন বেশি আওয়াজ করে চলে গেল জিল্লুর সামনে দিয়ে। জিল্লুর কেবলই মনে হতে লাগল –“এটা কি অন্যায় নয় যে, তার ছেলে উজ্জলও তো মারা গেছে এক দুর্ঘটনায় । তাহলে তার জন্য কেন কোনো দল বা কেউ কিছু বরাদ্দ করল না? আমরা কোন যুক্তিতে বা ঠিক কোন নায্য কারণে আর্থিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হলাম!”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু
গাভী বিক্রির টাকা দিয়ে নিজের ছেলের লাশ আনতে হলো জিল্লু মিয়াকে। তাছাড়া কুলখানি করতেও অনেক কিছুই গেল। আর অন্যদিকে গণেশ সরকারের ছেলের মৃত্যুর পর সরকারের আর্থিক সহায়তার টাকা পেয়ে সেই টাকা দিয়ে গোডাউন বানানোর আয়োজন শুরু করা হলো। জিল্লু মিয়া সত্যিই বঞ্চিত। অনেক ভাল লাগল। আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী
সুন্দর একটি থিম ছিল। গল্পটিতে যে চরিত্র ছিল, সেটাকে আরও একটু ঘুচিয়ে সামান্য আলোচনা বাড়ালে আরও চমৎকার গল্প হত। যাক গে, চর্চা করতে থাকলে একদিন আরও চমৎকার গল্প পাবো আশা করি। শুভকামনা নিরন্তর
সাদিক ইসলাম
খুব মানবিক দিক তুলে ধরেছেন। দেশের গরীব ছেলেরা দেশের বাইরে গিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট করে আর সুবিধাভোগীরা সেই কষ্ট লোপাট করে খায়। সবার শান্তি ফিরে আসুক জিল্লু মিয়ার মতো লোকেরা সুখের সন্ধান পাক এই কামনা। শুভ কামনা।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।