সেদিন বড় রাস্তার মোড়ে মার্কেটের সামনে পারু’দিকে দেখলাম।
প্রায় বছর দেড়েক পর।
হঠাৎ দেখে চিনতে পারিনি।
চিনব কী করে?
আগের মতো আছে নাকি ও?
নীল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে চোখদুটো কেমন নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল।
কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িতে আগে ওকে অনেকবার দেখেছিলাম।
কতো প্রাণবন্ত লাগতো!
কিন্তু সেদিন মনে হলো, ও যেন বহু অযত্নের ফুল।
একটু স্পর্শেই টুপ করে ঝরে পড়বে।
সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকা ঠোঁট দুটো ফেটে চৌচির হয়ে আছে।
সিঁথির সিঁদুরটাও আমার চোখ এড়ালো না।
দুহাতে দুটো বাজারের ব্যাগ।
.
আমি কাছে গিয়ে ডাকলাম, ‘পারুদি!’
চমকে আমার দিকে তাকালো ও।
আমাকে দেখে ওর চোখদুটো কি একটু উজ্জ্বল হয়েছিল?
ঠোঁট কি একটু প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল?
নাকি আমার মনের ভুল!
‘আরে তুই!’ ‘এখানে!’
নিষ্প্রাণ অথচ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল শব্দ কয়টি।
আমিও হেসে জবাব দিলাম, ‘আমি তো এখানেই থাকি। কতোবার বলেছিলাম তোমাকে!’
‘ওহ তাই তো।’ নিচু স্বরে বলল ও।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিয়ে করলে কবে?’
যেন নিজের দিকে তাকালো ও,
শাঁখা-সিঁদুর ওর বিবাহিত জীবনের পরিচয় এটা যেন ওর মনে ছিল না।
ম্লান হেসে বলল, ‘এই তো মাস ছয়েক হলো।’
‘এখানেই কাছে কোথাও থাকো নাকি?’
‘হ্যারে। রাস্তার ওপারে গিয়ে দু’গলির পরের গলিটাতে বাসা আমার।
একদিন বাসায় আসিস।
জমিয়ে গল্প করবো।
আজ আসি তবে? শাশুড়ি একা ঘরে।
কখন কী লাগে...
আমাকে ছাড়া তার চলে না।
আবার গিয়ে রান্নাও বসাতে হবে।
যাই ভালো থাকিস।’
ও একাই সব কথা বলে ফেলল।
তারপর দ্রুত রাস্তা পার হয়ে হারিয়ে গেল ভীড়ের মাঝে।
আমি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আরও কিছুক্ষণ।
.
কিছুক্ষণ? না, যেন কয়েক বছর।
স্মৃতির অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে আমি পারুদিকে খুঁজে চলেছি।
এই পারুদি সেই পারুদি নয়,
যাকে আমি চিনতাম।
এ যেন অন্য কেউ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত মুখ,
চঞ্চলতার কারণে বন্ধুমহলে ক্যাঙ্গারু নামে জনপ্রিয়,
নারী আন্দোলন, সমঅধিকার, ধর্ষণের প্রতিবাদ সবকিছুতে মুখর ছিল,
যে ছিল নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।
কোথায় সেই পারুদি?
এ যেন আর দশটা সাধারণ নারীর মতো,
সংসারের চাপে বাঁকা হয়ে যাওয়া বাঙালী ললনা।
বিয়ের কারণেই কি এমন বদলে যাওয়া!
মনে মনে বিয়ে, সংসার এসবের চৌদ্ধগুষ্ঠি উদ্ধার করলাম।
বদ্ধমূল ধারণা হলো আমাদের পারুদি সুখে নেই।
.
আমাদের মধ্যে একজন পারুদির প্রতিবেশি ছিল।
সে আজ পারুদির সুখ সংসারের গালগল্প করছিল খুব।
আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না।
সেদিন বাজারে ওকে ভগ্নদশায় না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতাম।
তখনই বললাম, ‘চল ওর বাসায় যাই।’
একেবারে নিমন্ত্রণ ছাড়া মেহমানের মতো হাজির হলাম ওর বাসায়।
ওমা! সেকি আপ্যায়ণ!
আর পুরো ঘর জুড়ে ওর প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো আমাকে মনে করিয়ে দিল
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পারুদির কথা।
কোথাও যেন কোন তফাত নেই।
ওর শাশুড়িকেও দেখলাম খুব মিশুক।
যেনো সদ্য কৈশোর পেরোনো কোন তরুণী,
পুরোটা সময় আমাদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছিলেন।
.
সব দেখেশুনে দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
কোনটা সত্যি? সেদিনেরটা নাকি আজকেরটা?
এক ফাঁকে পারুদিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুমি সুখে আছো তো?’
প্রশান্তি মাখা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল ও, ‘কী মনে হয় তোর?’
আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘সেদিন বাজারে তোমাকে ওভাবে দেখে…’
হেসে বলল ও, ‘মাথার ওপর চৈত্রের রোদ,
ঘরে বৃদ্ধা শাশুড়ি একা,
অসুস্থ স্বামীর একদিনের জন্যও ছুটি নেই,
এতকিছুর প্রভাব কি চেহারায় পড়বে না?
আর তখনও জানতাম না আমার ভেতরে আরেকটা প্রাণ জেগে উঠেছে।
শারীরিক দূর্বলতাটা তো ছিলই।
হঠাৎ তোর সাথে দেখা সেদিন।
আমাকে দেখে খারাপ লাগাটা ছিল স্বাভাবিক।
তার মানে এই নয় যে আমি সুখে নেই।’
আমি লজ্জায় চুপ হয়ে রইলাম।
আমার হাতে সজোরে চাপ দিয়ে ও বলল,
‘চোখের দেখায়ই সবকিছু নয় রে,
মনের দেখায়ই আসল।
অন্তর্দৃষ্টি খোলা রাখিস,
কখনো ভ্রান্তি হবে না তোর।’
.
আমি শেষ প্রশ্ন করলাম, ‘কোথায় গেল তোমার নারী স্বাধীনতা?
আজ ঘর সংসার নিয়ে পড়ে আছো কেন?
তোমার তো কর্মক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা।’
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল পারুদি।
‘নারী স্বাধীনতা মানে কী?
আমি বলি চিন্তার স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা।
আমার বর আমার যৌক্তিক কোন কাজে বাঁধা দেয় না,
যেকোন কাজে আমার পরামর্শ নেয়,
যখন ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে আমি যেতে পারি,
সংসারের সিদ্বান্তগুলো আমিই নিই,
এগুলোই তো আমার স্বাধীনতা।
মেয়েরা চাকরি করা মানেই কি স্বাধীন হওয়া?
তোরা যে স্বাধীনতার কথা বলিস সেটা আসলে
পরাধীনতার শৃঙ্খলে নারীদের আবদ্ধ করা।
এই অন্ধত্ব থেকে বেরিয়ে আয় আলোকিত জগতে,
এখনও সময় আছে, অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেখ।
তবেই না সুখ আর অসুখে পার্থক্য বুঝতে পারবি।
বুঝবি স্বাধীনতার খোলসেও পরাধীনতা লুকিয়ে থাকে।’
আমি বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম পারুদির দিকে,
আর
আমার দীর্ঘদিনের ভ্রান্তির দেয়াল চূর্ণ হলো আজ।।
০৫ জানুয়ারী - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪