বাড়ির পুরনো আলমারীর একটা প্রকোষ্ঠ জায়েদের। সেই স্কুল জীবন থেকে সংগ্রহ করা সব জিনিসপত্র এখানে আছে। অনেকদিন পরপর বাড়িতে এসে সে এগুলো খুলে বসে। কি নেই এখানে? স্কুলের ব্যাচ, কলেজের ম্যাগাজিন, লাইব্রেরীর কার্ড, কিছু মার্বেল, গুলতি, চামড়া উঠে যাওয়া পুরনো বল, জীবনের প্রথম ব্যাট, সাদা রঙ ধুসর হয়ে যাওয়া পিটিসু, অনেকগুলো বছরের ডায়রী। আর বেশ বড়সর একটা চিঠির বাক্স। কতকত চিঠি! কতদিন আগের! বেশিরভাগই মায়ের। বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবের। একটা চিঠি হাতে নিয়ে খামের উপর প্রেরকের নামটা দেখে তার হাত থমকে যায়। মনে মনে দু-তিনবার সে নামটা আওড়ায়। চিঠিখানা জীবনের খুব সংক্ষিপ্ত অথচ আবেগী এক অধ্যায়ের সাক্ষী। ১২ বছর আছের এক দুপুরে ফিরে যায় সে।
(১)
মাত্রই সে ক্লাস থেকে ফিরল। বিছানার উপরে তিনটি চিঠি পড়ে আছে। জায়েদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। রুমমেট চিঠিগুলো তুলে রেছেছে।
প্রথমটা বাবার। মানি অর্ডারের সাথে ছোট একটা চিরকুট। “আব্বু ভালো থেকো, শরীরের যত্ন নিও।” পোষ্ট অফিসে যেতে হবে, টাকা তুলতে হবে। সরকারী অফিসের সামান্য করনিক বাবা প্রতিমাসে এ চিরকুট আর মানি অর্ডার পাঠান। ভার্সিটি লাইফে এ টাকাটা নিতান্তই অপ্রতুল। কিন্তু তা নিয়ে জায়েদের কোন খেদ নেই। সে জানে সংসার খরচ থেকে এটা বাচিয়ে থাকে নিয়মিত পাঠাতে বাবা-মায়ের কতটা কষ্ট হয়! জায়েদের অবশ্য সমস্যা হয়না। দুটো টিউশনী আছে, চলে যায়।
দ্বিতীয়টা চিঠিটা মায়ের। প্রতি সপ্তাহে একটা করে নিয়মিত লিখে। খুটিয়ে খুটিয়ে বাড়ির সব কথা বলে। আবার এখানকার কথাও জানতে চায়। জায়েদ মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। কিন্তু আবার ভালোও লাগে। মা তার ব্যাপারে অনেকটাই অন্ধ। জায়েদ চিঠি পড়ে আর আসে। প্রতিটি চিঠির একটি করে উত্তর তারও দিতে হয়। তার বড় বোন আছে। জুবাইদা। আগে তার চিঠিও নিয়মিত আসত। এখনও আসে, তবে কম। সর্বশেষ এসেছে দু’মাস আগে। তার এখন নতুন সংসার। তার উপর চাকুরী। খুব ব্যাস্ত। জায়দের চিঠি পেতে ভালো লাগে। লিখতেও। ঈদানিং অবশ্য চিঠির প্রচলন কমে আসছে। বন্ধুদের অনেকেই মোবাইল ফোন ব্যাবহার করা শুরু করেছে। মোবাইলে যোগাযোগ সহজ। কিন্তু চিঠির খাম, চিঠির গন্ধ, যে পাঠায় তার আবেগ এসব কি আর মোবাইলে পাওয়া যায়! তবে একটা মোবাইল থাকলে মনে হয় ভালো হত। জরুরী প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যেত। কিন্তু অনেক দাম। বন্ধুরা অবশ্য বলছে, মোবাইলের দাম কমে যাবে। আগামী দিনে নাকি যোগাযোগ ব্যাবস্থা মোবাইলের মাধ্যমে অনেক সহজ হয়ে যাবে।
তৃতীয় চিঠিটা হাতে নিতেই বুকের ভেতর ধকধক করে ওঠে। এখন খোলা যাবেনা। দিনের সব কাজ শেষে রাতে একাকী মুহুর্তে চিঠিটি নিয়ে বসতে হবে। জায়েদ ধারণা করতে পারে কি আছে ও চিঠিতে। এ চিঠির ক্ষমতা আছে তার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়ার। তার চোখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে যায়। সেই সাথে সে অবশ্য দ্রুত হৃদকম্পনও অনুভব করে! যাহোক। এখন এ চিঠি খোলা যাবেনা। সে টেবিলের এক কোনায় চিঠিখানা পরম যত্নে বইয়ের মাঝখানে রেখে দেয়।
ঘড়ি দেখে। আজই মানিঅর্ডারটা নিতে হবে।
পোষ্টঅফিস ঘুরে এসে টাকাটা সে গুছিয়ে রাখে। নামাজ আর দুপুরের খাওয়া শেষে মায়ের চিঠির উওর লিখে। আজ আর ল্যাবে কাজ নেই। লেকচারগুলো নোট খাতায় তুলে রাখার জন্য বসে। জায়েদ পড়াশুনা যে খুব করে তা না, তবে সে নিয়মিত। আর মেধা বলে যদি কিছু থাকে, তবে অবশ্যই তার আছে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সে স্কলারশিপ পেয়ে এসেছে। অনার্সে সে ফাস্টক্লাস পেয়েছে। বায়োমেডিল্যাল সাইন্সের মত বিষয় যা অন্যের কাছে খটোমটো মনে হয়, তা বেশ আনন্দ নিয়েই পড়ে। মাস্টার্সেও একটা ফার্স্ট ক্লাস জুটে যাবে, সে জানে।
নোটখাতায় হাত দিতে গিয়ে দুপুরের তৃতীয় চিঠিখানার দিতে তার চোখ পড়ে। আবার হৃদকম্পন অনুভুত হয়। ধুর, এখন অন্যকাজে মন বসবে না। জায়েদ একমন চা বানায়। লিকার চা। চিঠিখানা নিয়ে হলের ছাদের এককোনায় বসে।
চিঠিখানা মুনিয়ার। প্রায় মাসখানেক আগে সে মুনিয়া কে একখানা চিঠি দিয়েছিল। তারই উত্তর। চিঠিখানা পাঠিয়ে জায়েদ ক’দিন অস্বস্থিতে ছিল। কাজটা ভালো কি মন্দ হল, তা নিয়ে সে বেশ চিন্তিত ছিল। সে ভেবেছিল উত্তরটা পাবেনা। গত একমাসে মুনিয়ার সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। ভাবভঙ্গীতে বোঝা যায়নি যে জায়দের চিঠিখানা সে পেয়েছে। অথচ সে পেয়েছে এবং অনেক ভেবেচিন্তে সে উত্তর দিয়েছে। চিঠি পেলে তার প্রভাব অবশ্যই তার আচরণ কিংবা কথাবার্তার উপর পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কি আশ্চর্য মেয়ে! সে চিঠি পেয়েছে, ভেবে উত্তর লিখেছে, জায়েদকে পাঠিয়েও দিয়েছে। অথচ তার আচরণ কিংবা কথাবার্তায় জায়েদ বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেনি!
(২)
মুনিয়া মাইক্রোবায়োলজীর ছাত্রী। তার দু ব্যাচ জুনিয়র। বায়োলজিক্যাল ক্যকাল্টির লাইব্রেরীতে বছর দেড়েক আগে জায়েদের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। কি এক টিউটোরিয়ারের জন্য প্রস্ততি নিচ্ছিল জায়েদ। হঠাত পাসে এসে এক মেয়ে বসল
“এক্সকিউজ মি, ভাইয়া, আপনি কি আমাকে একটু হেল্প করবেন?”
জায়েদ বিরক্ত মুখে ভ্রূ কুচকে তাকালো।
“কিছু মনে করবেননা প্লীজ। কিছুক্ষন পরে আমার একটা পরীক্ষা। অ্যান্টিবায়োটিকের মেকানিজম নিয়ে একটু সমস্যায় পড়েছি। আপনি যদি একটু ক্লিয়ার করে দেন, খুব উপকার হয়।”
বিরক্ত মুখে কিছু বলতে গিয়েও জায়েদ থেমে গেল মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে। খুব সুন্দরী বলতে যা বুঝায়, মেয়েটা তা নয়, তবে মুখখানা, বিশেষ করে দুটো চোখ বেশ মায়াময়। এমন মেয়েকে ধমক দিয়ে কথা বলা ঠিক না। নিজের খোলা বইটি বন্ধ করতে করতে সে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে-
“আপনার কেন মনে হল, আমি আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক মেকানিজম বুঝাতে পারব? আপনি কি আমাকে চিনেন?”
“আপনাকে এখানে কে না চিনে? আমি মাইক্রোবায়োলজীতে পড়ি। ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল চলছে। আপনার দু ব্যাচ জুনিয়র। আমার নাম মুনিয়া।” একবারে নিজের পরিচয়টা দিয়ে মেয়েটা হাসল।
‘মুনিয়া’ নামটা মনে মনে সে আওড়ায়। ‘মুনিয়া’ একটি সুন্দর পাখির নাম। শিল্পী পাখি। বেশ যত্ন করে এরা বাসা বানায়।
“আচ্ছা ঠিক আছে শুরু করুন”
“সে কি! আমি তো আমার পরিচয় দিয়েই ফেললাম, আপনার দু ব্যাচ জুনিয়র। আমাকে এখনো আপনি করে বলছেন কেন?”
“আচ্ছা ঠিক আছে”, একটু হেসে জায়েদ বলল “নাও, শুরু করো।” পেছনের তাকের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে একদিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়-
“ওখান থেকে পেলজারের বইটা নিয়া এসো।”
আধাঘন্টার মধ্যেই সুন্দর ভাবে কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিকের মেকানিজম বুঝে নিল মেয়েটা। নাহ! এই ভাইয়াটার সম্বন্ধে সে যা শুনেছে, তার চেয়েও মেধাবী সে। এত অল্প সময়ে এত চমৎকার ভাবে মেকানিজমগুলো বুঝিয়ে দিলেন!
অথচ ক্লাসে তিন লেকচারে ম্যাডাম কি পড়িয়েছিলেন তার সবটাই মাথার উপর দিয়ে গেছে। কৃতজ্ঞচিত্তে “অনেক ধন্যবাদ জায়েদ ভাই। বিষয়গুলো এখন অনেক সহজ মনে হচ্ছে। আপনাকে কিন্ত মাঝেমাঝে বিরক্ত করব” বলে মুনিয়া বিদায় নেয়।
জায়েদ হাসে। এমন বিরক্ত তাকে মাঝেমধ্যেই অনেকে করে। সে বিরক্ত হয়না। সে জানে, জ্ঞান বিতরনে জ্ঞান কমে না। জ্ঞান হল আলোর মত।
(৩)
তারপরের সময় যেমন চলছিল তেমনই চলছিল। হাসি, আনন্দ, বেদনা, বিষন্নতা, আশা, হতাশা ইত্যাদি মিলিয়ে অন্য মানুষের জীবন যেভাবে কেটে যায়, সেভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন।
পড়াশুনা, পরীক্ষা, টিউশনি, বছরে ২-৩ বার বাড়ি ঘুরে আসা। অনার্স পরীক্ষা শেষ হল। মাস্টার্স শুরু হল। ক্লাসের পরে ল্যাব নিয়েও ব্যাস্ত থাকতে হয় এখন। মুনিয়ার সাথে তার বিশেষ কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি। আর দশটা জুনিয়র ছেলে-মেয়ে যেমন দেখা হলে সালাম দেয়, কুশলাদী বিনিময় করে, মাঝে মাঝে পড়া বুঝে নেয়, তেমনই। তবে হ্যা, মাঝে মধ্যে চা টা খাওয়া হয়েছে একসাথে ডিপার্টমেন্টের পাশের লাল্টু ভাইয়ের দোকান থেকে। তেমনি একদিন বিকেলে ল্যাব থেকে বেড়িয়ে ক্লান্ত পায়ে বায়োলজিক্যাল ফ্যাকাল্টির দরজায় দাড়লো জায়েদ। অনেকক্ষন কাজ করতে হয়েছে ল্যাবে। আজ আর হেটে হলে যেতে ইচ্ছে করছেনা। একটা রিকশা পেলে ভালো হত। কোনদিক থেকে যেন মুনিয়া চলে এলো।
“আরে জায়েদ ভাই, এখানে দাঁড়িয়ে কেন?”
“রিকশা’র অপেক্ষায় আছি, হলে যাবো।”
“সে কি, আপনি তো সচরাচর রিকশায় উঠেন না”!
মুনিয়ার মনে পড়ল বেশ ক’দিন আগে ভার্সিটির গেট থেকে সে রিকশা নিয়েছে ডিপার্টমেন্টে আসবে বলে। জায়েদকে সামনে দেখতে পেয়ে সে প্রস্তাব দিয়েছিল একসাথে রিকশায় আসার। সে একটু অস্বস্থি নিয়ে বলেছিল “না,তুমি যাও, আমি হেটে আসছি। রিকশায় উঠতে ভালো লাগে না।” মুনিয়া বুঝতে পেয়েছিল, হয়ত তার সাথে রিকশায় উঠতে জায়েদ অস্বস্থি বোধ করেছে। কথা না বাড়িয়ে সে চলে এসেছিল। তবে এর বাইরেও জায়েদকে রিকশায় উঠতে খুব কমই সে দেখেছে।
“নাহ! আজ খুব টায়ার্ড লাগছে। পুরো দুপুরটা ইদুরদের সাথেই দৌড়ঝাপ করতে হয়েছে কিনা!” বলে জায়েদ একটু হাসল।
“এক কাপ চা খাবেন? ভালো লাগবে।”
মেয়েটা এমন করে বলল, জায়েদ না বলতে পারলনা।
“চলো”
চা খেতে খেতে টুকটাক গল্প হচ্ছিল। বেশিরভাগেই তার রিসার্চ আর মুনিয়ার পড়াশুনা নিয়ে। ঠিক তখনই শীতের শেষের দিকের পড়ন্ত বেলায় সূর্যের মিষ্টি আলোয় জায়েদ নতুন এক রূপ দেখল। মেয়েটার মায়াভরা মুখটা অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে! আরে এই মেয়েটার অতি সাধারন সৌন্দর্যের মাঝে কি চমৎকার মিষ্টতা লুকিয়ে আছে, সে এতদিন জানতেই পারলনা!
“জায়েদ ভাই, কি হল? কি ভাবছেন?” উহ! মেয়েটা বোধহয় বুঝতে পারল সে তার দিকে তাকিয়ে বিহবল হয়ে গিয়েছিল!
নাহ, এখানে আর আর বেশিক্ষন থাকা যাবেনা। চায়ের কাপে লম্বা দুটো চুমুক দিয়ে সে বলে,
“চলো উঠি”।
“চা টা শেষ করতে দেবেন না?”
জায়েদ অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বলে “আচ্ছা, ঠিক আছে, শেষ করো।”
সে চায়ের বিল দিতে যায়। মুনিয়া হইহই করে ওঠে “না না, আজকে বিল আমি দেবো। আপনিই তো সবসময় খাওয়ান। আজ আমি আপনাকে ধরে এনেছি”।
জায়েদ মেনে নেয়, কিন্তু মুনিয়ার দিকে তাকাতে পারেনা। কি হচ্ছে তার! হঠাত কোথা থেকে রাজ্যের লজ্জা এসে ভর করল!
(৪)
পরবর্তী দিনকতক জায়েদের মনের মধ্যে ব্যাপারটা বেশ ঘুরপাক খায়। সে হিসেবে মেলাতে বসে। মুনিয়ার সাথে পরিচয় হওয়া থেকে শুরু করে পেছনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা সে ভাবে। কখন কবে কোথায় দেখা হয়েছিল, কি কথা হয়েছিল, কিভাবে মুনিয়া তার দিকে তাকিয়েছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। ঈদানিং পড়াশুনায় ঘাটতি পড়েছে। ল্যাবের কাজেও ভুলচুক হচ্ছে। সেদিনতো সুপারভাইজার স্যার ছোটখাট একটা ধমকই দিলেন। তার থেকে এরকম ভুল তিনি আশা করেননা।
জায়েদ অনেক ভেবেচিন্তে বের করে সে সম্ভবত মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তাই কি? সাংঘাতিক ব্যাপারস্যাপার! পেছনের দিনগুলোর হিসেব করে সে এও বুঝতে পারে, সম্ভবত মুনিয়াও তাকে একটু আধটু ভালোবাসে। উম্মহু, না। একটুআধটু না, হয়ত অনেকখানি। গত দেড় বছরে মুনিয়ার সাথে যতবার দেখা হয়েছে রাস্তার পাশে কিংবা ফ্যাকাল্টি বিল্ডিঙের করিডোরে অথবা লাইব্রেরীতে, তার হাতে যে কাজই থাকুক, কিংবা সাথে যে’ই থাকুক সে এসে জায়েদের সাথে কথা বলেছে কিংবা কুশলাদী বিনিময় করেছে। সে যখন তাকে বায়োমেডিল্যাল সাইন্সের জটিল জিনিস বুঝাতো, কিংবা কখনো জীবনদর্শন নিয়ে আলোচনা করত মেয়েটা মুগ্ধ হয়ে শুনত।
নিশ্চিত, মেয়েটাও তাকে ভালোবাসে।
নাহ! এরকম নিজের সাথে লুকোচুরি করতে ভালো লাগছেনা। ব্যাপারটার সমাধান হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কিভাবে? জায়েদ কি গিয়ে সরাসরি মেয়েটাকে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলে দেবে? ধুর! ব্যাপারটা সিনেমার মত হয়ে যায়! ডায়রির মাঝখানে একটা পাতা ছিড়ে সে কলম নিয়ে বসে। একটা চিঠি লিখতে হবে।
“প্রিয় মুনিয়া” লিখে কেটে আবার নতুন পৃষ্ঠায় শুরু করে-
মুনিয়া,
অনেক ভেবে দেখলাম তোমার সাথে মনের কথাগুলো বলে ফেলাই ভালো। কিন্তু ঠিক মনস্থির করতে পারলাম না, কখন কিভাবে বলব। তাই চিঠির আশ্রয় নিলাম। জানিনা, কিভাবে নেবে। আমি সম্ভবত তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অন্য ধরনের ভালোবাসা। বুঝতে পারছো, নিশ্চয়ই। আচ্ছা, তোমার কি মনে হয়, তুমি আমার সাথে জীবন কাটাতে পারবে? অথবা তোমার জীবনসঙ্গী হওয়ার মত যোগ্যতা আমার আছে?
তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম-
জায়েদ
ছোট্ট চিঠিখানি পকেটে নিয়ে সে দুদিন ঘুরল। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলনা, কিভাবে মুনিয়ার হাতে দেবে। কিংবা দেয়া ঠিক হবে কিনা। তারপর হঠাত করেই পোস্টঅফিসে গিয়ে একটা খাম কিনে চিঠি ভিতরে ঢুকিয়ে মুনিয়ার ঠিকানা লিখতে গিয়ে মনে হল, আরে ওর হল আর রুমনম্বরই তো জানা নেই! সে নাম লিখে, পাশে লিখল তৃতীয় বর্ষ, এরপর বিভাগ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। এ চিঠি পাবে কি? ফেলে দিল ডাকবাক্সে। বাহ! বেশ নির্ভার লাগছে।
কিন্তু কিছুক্ষন পর থেকেই অস্বস্থি লাগা শুরু হল। আচ্ছা, কাজটা কি ঠিক হল?
তারপরের সপ্তাহখানেক মুনিয়া কে পারতপক্ষে এড়িয়ে গেছে। হঠাত একদিন ধরে ফেলল মেয়েটি, লাইব্রেরীর সামনে।
“জায়েদ ভাই, আপনি কি খুব ব্যাস্ত? বেশ ক’দিন ধরে দেখছিনা। আপনাকে দু’দিন ধরে খুঁকছি।”
“কেন, বিশেষ কোন দরকার?” নার্ভাস কন্ঠে জায়েদ জানতে চায়।
“হ্যা একটু। আপনি সেদিন এপিজেনেটিক্সের উপর যে বইটার কথা বলেছিলেন, সেটা আমি নিউমার্কেটে পেয়েছি। দাম একটু বেশি হবে। তবে আপনি যদি লাইব্রেরিয়ান আংকের বা ডীন স্যার অথবা আপনাদের চেয়ারম্যান ম্যানেজ করতে পারেন, তাহলে হয়ত সবার জন্যই ভালো হত।”
জায়েদ একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, মেয়েটা তাহলে চিঠিটা পায়নি। আবার দিনগুলো আগের মত হতে লাগল। মুনিয়ার সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে, কিন্তু তার কথাবার্তা আচার আচরনে কখনো মনে হয়নি সে ঐ চিঠি পেয়েছে।
কিন্তু আজ প্রায় মাসখানেক পরে চিঠি!
সেই দুপুর থেকে সে আবেগ নিয়ন্ত্রনে রেখেছে। চিঠিটা খোলেনি। কিন্তু আর ধৈয্য ধরা সম্ভব হচ্ছেনা।
(৫)
ধীরেধীরে একটু কাপাকাপা হাতে জায়েদ চিঠির খাম খোলে। চিঠির ভাঁজ খোলে।
প্রিয় জায়েদ ভাই,
আপনার চিঠিটি যখন হাতে পেলাম, কতক্ষন আবেশিক হয়েছিলাম জানা নেই। সেই প্রথম দিন, যেদিন আপনার সাথে পরিচিত হলাম, সেদিন থেকে আপনাকে ভালো লাগে। সেটা ঐ বিশেষ ধরনের ‘ভালোবাসা’ কিনা আমি জানিনা। শুধু এটুকু জানি, আপনার সাথে দেখা হলে ভালো লাগত, আপনার সাথে কথা শুনতে ভালো লাগত। আপনাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে বুঝেছি, আপনার মত কোন মানুষের জীবনসঙ্গী হতে পারাটা যেকোনো মেয়ের জন্য পরম ভাগ্যের ব্যাপার।
কিন্ত আপনাকে জীবনসঙ্গী করার কথা করার কথা আমি মনে স্থান দেইনি। আমার কাছে আপনি ‘ধরাছোঁয়ার বাইয়ের মানুষ’ ছিলেন। আপনি আমার হতে পারেন, সেটা আমি দুঃসাহসেও ভাবতে পারিনি। কারন এ আমার প্রত্যাশাতীত। আমার খুব খারাপ লাগছে, জানেন? কারন সৃষ্টিকর্তার বিধান, আমাকে অন্য আরেকজনকে জীবনসঙ্গী করতে হবে। আব্বুর বন্ধুর ছেলে, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। আব্বু আম্মু তাদের কথা দিয়ে ফেলেছে। আমিও তাকে কথা দিয়ে ফেলেছি। আপনি কি খুব কষ্ট পেলেন? কষ্ট পাবেননা প্লীজ। আপনি কত বড় একজন মানুষ। কত মহান। আপনার আলোয় আলোকিত হবে এ পৃথিবীর অগনিত মানুষ। আমার মত সাধারন একটা মেয়ের জন্য আপনি কষ্ট পাবেন, সেটা কি হওয়া উচিৎ?
আমার কাছে আপনি সবসময় শ্রদ্ধ্যেয়। আপনি আমার মেন্টর। আমি চিরজীবন আপনাকে শ্রদ্ধা করে যাবো। ভালো থাকবেন।
আপনার সবকিছুতে মুগ্ধ-
মুনিয়া
চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে ঢুকায় জায়েদ। পশ্চিম দিকে সূর্য ডুবুডুব। গোধুলীর রাঙা আলোয় দিগন্ত আলোকিত। কে যেন বলেছিল, গোধূলি বেলায় আকাশের দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। কথাটা সত্যি মনে হচ্ছেনা। জায়েদের মন খারাপ লাগছেনা। তবে নিজের কাছেই একটু লজ্জা লাগছে।
ভূল হয়ে গেলো। যা তার জন্য নয়, তাই কেন সে চাইতে গেল! মেয়েটা বড় ভালো। কি সুন্দর করে চিঠি লিখল! কোন প্রত্যাখ্যান নেই, অপমান, অবহেলা নেই, হেয়ালী নেই। অথচ কি সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিল, জীবনে যা পাওয়া সহজ মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে তা পাওয়া হয়ত অনেক কঠিন।
ছাদের এখানটার ঠিক নিচের রুমে হানিফ থাকে। ওখান থেকে থেকে গান ভেসে আসছে। হেমন্তের।
“সমুখে রয়েছে পথ, চলে যাও চলে যাও।
পেছনে যাকিছু ডাকে, ফেলে যাও ফেলে যাও।”
হলের মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিম রিজওয়ান ভাইয়ের সুমধুর কন্ঠে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। যা হল, ভালোই হল। নতুন শুরু করতে হবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্নসমর্পনের মাধ্যমেই পেছন ভুলে সামনের শুরু হোক।