ভয় ফ্রেন্ড

রমণী (ফেব্রুয়ারী ২০১৮)

মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া
মোট ভোট ১১০ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৬.৪৯
  • ৫১
  • ২৭
  • ৪৩
‘মাকড়সার কয়টা পা থাকে জানিস?’
‘কেন আটটা। হঠাৎ এ প্রশ্ন?’
‘তোর মাথায় ওটা তাহলে মাকড়সা না; আফ্রিকান উঁকুন-টুকুন হবে হয়তঃ’-কোনালকে ক্ষ্যাপায় নিঝুম।
‘কি বললি, আমার মাথায় আফ্রিকান উঁকুন!’

অতঃপর হিজিবিজি হিজিবিজি ঝগড়া। থার্টি ফাস্ট নাইটে প্রতিবারই উল্টা-পাল্টা কথা বলে এভাবে ঝগড়ার সূত্রপাত করে নিঝুম। আর ঝগড়া শুরু হওয়া মাত্রই লাবণ্য পক্ষ নেবে নিঝুমের-সবুজ পক্ষ নেবে কোনালের। সেটাও মিনিট পাঁচেকের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যাবে চৌরাস্তা ধরে চারদিকে চলে যাচ্ছে চার জন।
বলছিলাম ‘নিকোলাস’ গ্রুপের কথা। নিঝুম, কোনাল, লাবণ্য আর সবুজ-তাদের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে ‘নিকোলাস’ গ্রুপ-সহপাঠিরা অবশ্য ডাকে কাঁচকি গ্রুপ। কাঁচকি মাছগুলোর যেমন জন্ম একসাথে, চলাফেরা একসাথে, ধরা পড়ে একসাথে-এমনকি রান্নাও একসাথে-‘নিকোলাস’-দেরও তেমনি সবকিছু একসাথে-এমনকি এদের জন্মদিন এবং জন্মসালও একই।

‘নিকোলাস-প্লাস’-মনে হয় ফেসবুকে ভূঁয়া আইডি। জন্মদিন নিকোলাসদের মতোই বারো ডিসেম্বর; তবে পাঁচ বছরের বড়। প্রোফাইলে শার্টের বোতাম খোলা পশমী বুকের ছবি-যাতে উল্কি দিয়ে আঁকা-প্লাস সাইন; অনেকটা ক্রুশের মতো। নীচে আবার কাব্য করে লেখা-‘অনলি ফর কিউট’। ওহ্, শখ কত..অনলি ফর কিউট। নিজের চেহারা মোবারক দেখাতে সাহস পায়না আবার কিউট খোঁজে। মনে মনে তাচ্ছিল্যই করে লাবণ্য-তবে জন্মদিন একই বলে এড়াতেও পারে না তাঁকে।

গতমাসে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে ‘নিকোলাস-প্লাস’। এতদিন একসেপ্ট বা রিজেক্ট কোনটাই করেনি লাবণ্য। কিন্তু বয়সটাইতো কৌতুহলের। কৌতুহলের বিশেষ কারন মূলতঃ ঐ কাব্যিক লেখা-‘অনলি ফর কিউট।’ যা হোক, অবশেষে কৌতুহল দমাতে না পেরে একদিন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা আনমনে একসেপ্ট করে লাবণ্য। দু’দিন পরেই নিকোলাস-প্লাসের পোস্ট-
‘মেরী ক্রিসমাস, হাড়কাঁপানো শীত এলো বলে, উত্তরে যেও নাকো তুমি…’
‘ডিসেম্বর চলে যাচ্ছে; মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে ভনভন-আর উনি বলছেন হাড়কাঁপানো শীত এলো বলে...সো কুল, গ্রেট আবহাওয়াবিদ’-ফিরতি পোস্ট লাবণ্যের। যদিও ওপ্রান্তে আর কোন সাড়া শব্দ নেই।

এখানে রাতের বেলায়ও ভ্যাপসা গরম-পৌষ এলেও শীত এলো না এখনো। একদিন হঠাৎ করেই শুরু হলো শৈত্য প্রবাহ। নিকোলাস-প্লাসের পূর্বাভাস মনে পড়তেই আপনমনে হাসে লাবণ্য-কৌতুহলও বাড়ে। উত্তরে অর্থাৎ রংপুরে গ্রামের বাড়ীতে যাওয়া হলো তাঁর।
‘কোরাল মাছের রান্নাটা নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে’-আজ আবার পোস্ট নিকোলাস-প্লাসের।

সত্যিইতো বাসায় আজ কোরাল রান্না হয়েছে। নিকোলাস-প্লাসেরতো এসব জানার কথা নয়। তবে কি পরিচিত কেউ? নাকি দুষ্টুমি করছে কেউ-বুঝে উঠতে পারে না লাবণ্য।

দেখতে দেখতে ছুটিটা কীভাবে যেনো শেষ হয়ে গেল। কাল মেডিকেল কলেজ খুলছে নিকোলাসদের। রাতের ট্রেনেই ঢাকা যাবার জন্য লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত লাবণ্য। এমন সময় আবার পোস্ট-আজ না গেলেই কী নয়..? এবার আর কৌতুহল নয় বরং ভয় পেয়েই পোস্ট করে লাবণ্য-

‘সত্যি করে বলবেন, কে আপনি?’-দু’দুবার লিখেও কোন উত্তর মেলেনা।


ষ্টেশনের পাশেই লাবণ্যদের ফ্ল্যাট। কথায় বলে-ষ্টেশনের পাশের মানুষ ট্রেন ফেল করে বেশী। লাবণ্যেরও আজ হয়েছে এই দশা। ট্রেন ছাড়তে মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকী। তাড়াহুড়া করে ষ্টেশনে পৌঁছেই বিপত্তিটা টের পেলো সে। টিকিটটা খুঁজে পেলো না কোথাও। ফোন দিল নিঝুমকে।
‘কিরে কই তোরা সব। জানিস আমি টিকিটটা খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের সিট নম্বর কতো?’
‘কি বললি! টিকিট হারিয়ে ফেলেছিস। আবার বলছিস সিট নম্বর কতো? আমরা তিনজন এখনো সুরমা ব্রীজের জ্যামে আটকে আছি। হায় আল্লাহ, আজ নিশ্চিত ট্রেন ফেল।’

লাবণ্য কি করবে বুঝতে পারে না। টিকিট নেই, বন্ধুরাও আসেনি-ট্রেনও ছেড়ে দিচ্ছে। দৌড়তে দৌড়তে কোনমতে একটা রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টে উঠতেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে এদিক-ওদিক তাকায় লাবণ্য-নাহ, ওরা আজ ট্রেনটা মিসই করল! এমন সময় সাত-আট বছরের একটি ছেলেসহ কেউ একজন ঢুকল কম্পার্টমেন্টটিতে-দু’জনের গায়েই সাদা চাদর। কেন জানি চাদর জড়ানো লোক দেখতে পারে না লাবণ্য। আড়চোখে লোকটিকে দেখেই বিরক্ত সে। নিজেও চাদর পড়েছে; আবার ছেলেটির গায়েও জড়িয়েছে চাদর। এতো রাতে কালো সানগ্লাস পরে কেউ। এই অদ্ভূত লোকটার সাথে যেতে হবে এতোদূর-ভাবতেই তার অস্বস্তি বাড়তে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবনায় পড়ে যায়। ভাবে-টিকিট হারিয়ে ফেলেছে; যে সিটটিতে বসেছে সেটি কার কে জানে। তবে রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টের টিকিট ছিল ওদের-এটা মনে আছে। যা থাকে কপালে। না হয় আক্কেল সেলামী দিয়ে টিকিট করিয়ে নেবে টিটি এলে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। এমন সময় সশব্দে মোবাইলের রিং টোন বাজে। স্ক্রীনে ‘কলিং নিঝুম’....
‘ট্রেন লেট নাকি…’
‘উজ্বুকের দল। বাসায় গিয়ে ঘুমাও নাকে তেল দিয়ে। আর এসে কাজ নেই। ট্রেন সাতগাঁও পার হইছে…’-কথা শেষ না হতেই হঠাৎ করে মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যায়। ব্যাগের সাইট পকেটেই তো ছিল মোবাইল চার্জারটা। আজ কিযে হলো তাঁর; মোবাইল চার্জারটাও আনতে ভুলে গেছে সে।

দলছুট লাবণ্যের মেজাজ আরো খারাপ হতে থাকে। এদিকে লোকটা চাদর মুড়ি দিয়ে লাবণ্যের উল্টোদিকের সিটে পা তুলে সটান শুয়ে পড়েছে। লাবণ্যের মেজাজ তিরিক্ষি হতে থাকে। বিন্দুমাত্র কমনসেন্স থাকলে একজন যুবতীর সামনে এভাবে ঘুমাতে পারে কেউ। সাথের ছেলেটি অবশ্য অবাক চোখে দেখছে তাঁকে-ভারী মিষ্টি চেহারা। লোকটি ছেলেটির কে হতে পারে-আন্দাজ করার চেষ্টা করে লাবণ্য। কৌতুহল থেকেই জানতে চায়-
‘কি নাম, খোকা?’
‘গিট্টু।’-বলেই ভেংচি কাটে। ওমা পিচ্চিতো দেখি আরো এক ডিগ্রী উপরে। তবু মেজাজ ঠান্ডা রেখে বলে সে
‘কোন ক্লাশে পড়?’
‘আন্ডার ফাইভ।’-চটাং চটাং জবাব। যেনো ফাইভ পাস করতে পারেনি বলে অনেক রাগ পিচ্চির। লাবণ্যও বেশ মজা পায় কথা বলে।
‘হি..হি…তা, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’
‘ঘুমাইন্না মামার বাড়ী। দ্যাখেন্না, ট্রেনে উঠেই কেমন ঘুমাচ্ছে মামা...’
‘ভীষন অন্যায় ভাগ্নেকে একা রেখে ঘুমানো। শুন, তোমাদের সাথে কী মোবাইল চার্জার আছে, খোকা?’
‘ট্রেনে না উঠতেই এটা সেটা খুঁজতাছেন। বলি, মতলবটা কি; মামার লগে…হি.. হি… হি… হি…। পিচ্চির কথা শুনে গা-জ্বালা করে লাবণ্যের…
লাবণ্যের কথা শেষ না হতেই হঠাৎ ঝাঁকি মারতে মারতে ট্রেনটি কেন জানি থামতে শুরু করে। ঝাঁকি খেয়ে মামা ভদ্রলোকের ঘুমও ভাঙে-চাদর গায়ে নেমে পড়ে ট্রেন থেকে-চলে যায় ষ্টেশনের ওদিকে কোথায় যেনো। লাবণ্য বিচিত্র মামা ভদ্রলোকটিকে দেখে জানালার কাঁচ দিয়ে।

ওমা, লাবণ্য ঘাড় ফেরাতেই দেখে ভাগ্নে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে চাদর মুড়ি দিয়ে; ঠিক তাঁর ঘুমাইন্না মামার মতো। একি কান্ড! মামার ঘুম ভাঙেতো ভাগ্নে ঘুমায়।

হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আচমকা ট্রেনটি ছেড়ে দিল আবার। আরে লোকটি কোথায় গেল…ট্রেনতো ছেড়ে দিল…লোকটা কী তবে উঠতে পারলনা ট্রেনে। ছোট্ট ছেলেটির এখন কী হবে? চেইন টানবে, না কী করবে বুঝে উঠতে পারেনা সে। মোবাইলেও চার্জ নেই যে কারো সাথে যোগাযোগ করবে। টেনশনে এই শীতেও ঘামতে থাকে সে।
মিনিট দশেক পরে কোত্থেকে যেনো কম্পার্টমেন্টের দরজা ফাঁক করে ঢুকলেন মামা ভদ্রলোক। ঢুকার সাথে সাথেই লাবণ্যের ঝাড়ি…
‘ভাগ্নেকে ফেলে কোথায় উধাও হয়েছিলেন শুনি। যদি ট্রেনে উঠতে না পারতেন-শিশুটির কী হতো..’

কিছুই বললো না লোকটি। শুধু মোবাইল চার্জারটা বাড়িয়ে দিল লাবণ্যের দিকে-হাসল ভুবন মোহিনী হাসি। তাতেই দমে গেল লাবণ্য। অদ্ভূত সুন্দর হাসিটা। অমন সুন্দর করে কোন পূরুষ হাসতে পারে! এই প্রথম ভালোভাবে তাকালো সে লোকটির দিকে। বয়স সাতাশ-আটাশের কাছাকাছি; খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি-অদ্ভূত সৌম্য-সুন্দর সুপুরুষ।
‘সরি এবং ধন্যবাদ’, লাজুক হাসিতে চার্জারটা নিতে নিতে বলল লাবণ্য।
‘আপনি তাহলে ঘুমাননি। ঘুমের ভান করে আমাদের কথা শুনছিলেন... এটা ভারী অন্যায়। আচ্ছা, রাতে কেউ কালো চশমা পড়ে।’
‘কালো চশমা না পরলে আমি যে প্রেডিক্ট করতে পারিনা...’
‘যেমন’
‘যেমন কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এক্সিডেন্ট…’

কথাটা শেষ না হতেই আচমকা ঝাঁকি মারতে মারতে কর্কশ শব্দে ট্রেনটা থেমে যায়। নিভে যায় ট্রেনের সব বাতি। প্রচন্ড শোরগোল। হঠাৎ ইঞ্জিন বিকল।
এবার সত্যিই যুবককে ভয় পেতে শুরু করল লাবণ্য। এক্সিডেন্ট বলার সাথে সাথেই…. আর চিন্তা করতে পারেনা সে। ভাবে-কে এই যুবক।


জায়গাটি দুই পাহাড়ী বনের মাঝামাঝি কোথাও। ট্রেনের আলো নিভে গেল বলেই হয়তঃ পূর্ণিমার চাঁদটা উদয় হলো-এতোটা আলো ছড়ালো। শীতের কুয়াশা-ঢাকা চাঁদ কতোটা মায়াবী আজ আঁধারের ঝিঁঝিঁ ডাকা বনে। পাহাড়ী ঝোঁপের ঘুটঘুটে আঁধারে আজ দোল পূর্ণিমায় মেতেছে যেনো বন-জোনাকীর দল। চারিদিকে শীতের নিঃস্তব্ধ নিরব রাত। মামা ভদ্রলোক জেগে আছে; নিয়ম মেনে তাই ক্লান্ত ভাগ্নে ঘুমাচ্ছে এখন। আবছা চাঁদের আলোয় মুখোমুখি দু’টি মানব-মানবী। চাঁদের জলজ জোছনায় লাবণ্যের ভয় কেটেছে কিছুটা; লাবণ্যের মনে হলো অমন আলো-আঁধারীতে মনের কথাগুলো বলা যায় যুবকের সাথে। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারে না সে। অবশেষে বলেই ফেলে-
‘আচ্ছা, কীভাবে প্রেডিক্ট করলেন যে ট্রেন এক্সিডেন্ট হবে।’
‘প্রেডিক্ট-টেডিক্ট কিচ্ছুনা। আসলে আপনাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম-ঘটনাটাও ঘটে গেল কাকতালীয়ভাবে।’
‘যদি না ঘটতো তখন।’
‘তখন ঘুমিয়ে পড়তাম। আপনিও জিজ্ঞ্যেস করতে পারতেন না।ব্যস বেঁচে যেতাম।’
‘আপনার পটানোর বুদ্ধি বেশ ভালো।’
‘তাই, আপনি পটেছেন বুঝি…’-লাবণ্যের ঝাড়ির ভয়ে কথা শেষ হয়না যুবকের।
‘আচ্ছা ধরুন, কারো বাসায় কি রান্না হয়, কে কোথায় কখন যাবে-এসব কী কেউ প্রেডিক্ট করতে পারে?’
‘হয়তোবা। ধরুন, আপনাকে কেউ বিরক্ত করে। গেলেন র্যা বের কাছে। সেই র্যা ব অফিসারও প্রেমে পড়ে গেল আপনার-মোবাইল ট্র্যাক করে বিভিন্ন কথোপকোথন শুনে কিছু চমকপ্রদ প্রেডিক্ট করলো আপনার নীহারিকা মন পেতে… হতে পারে…’

যুবকের কথায় আনমনা হয় মানবী-আলো-আঁধারীতে কি যেনো মনে করার চেষ্টা করে লাবণ্য। অবচেতন মনে ঝাঁপসা ছবি ভাসে। একবার আসে, আবার পরক্ষণেরই মিলিয়ে যায়।
‘আচ্ছা, কেউ কী আপনাকে ফলো করে?’-যুবকের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় সে।
‘নাহ্, হয়তঃ আমিই খুঁজে বেড়াই তাঁকে।’-নিজের মনেই যেনো উত্তর দেয় লাবণ্য।
‘সত্যি করে বলবেন, ভাগ্নেকে বিপদে রেখে চার্জার আনতে গেলেন কেন? যদি ট্রেনে উঠতে না পারতেন…’-ঘুমন্ত ভাগ্নের দিকে ইঙ্গিত করে বলে লাবণ্য।
‘এটা না করলে অমন মধুর ঝাড়ি খেতাম কীভাবে?’-আবার সেই অদ্ভূত সুন্দর হাসি। আঁধারেও টের পায় লাবণ্য। তবু মিথ্যে রাগ করে আবার ঝাড়ি মারে…
‘কি বললেন?’
‘না, না, জাস্ট মজা করলাম’
‘তা অমন মজা করে আর কী কী করেন আপনি?’
‘ধরুন, আপনার ঐ প্রিয় চাঁদটাকে আজ ঢেকে দিতে পারি’–বলেই জানালার শাটার টেনে দিলো যুবক। সত্যিই চাঁদটা ঢাকা পড়ল শাটারের ওপারে; সারাটা কম্পার্টমেন্ট ঢেকে গেল আঁধারে।
‘প্লিজ আমি ভয় পাচ্ছি। জানালার স্টিল শাটারটা তুলে দিন। সত্যি ভয় পাচ্ছি…প্লিজ, ভয় পাচ্ছি আমি…’ কতগুলো জোনাকী আগেই ঢুকেছিল ভেতরে। তৃষিত যুবক জোনাকী আলোয় দেখে প্রেয়সীর মুখখানি। লাবণ্যের কথা বোধ হয় কানেই ঢুকেনি তাঁর। চেয়ে থাকে লাবণ্যের দিকে। মন জোনাকী যেনে আজ পেতে চায় প্রেয়সীর জলজ জোছনার আলো। মনে মনে হাসে যুবক-‘এতো কাছে তবু....’ সম্বিৎ ফিরে পায় যুবক লাবণ্যের কথায়....
- ‘প্লিজ আমি ভয় পাচ্ছি...’-বলে নিজেই এবার শাটারটা খুলতে এগিয়ে যায় লাবণ্য।

কিন্তু আঁধারে ঠাহর করতে না পেরে লাগেজে পা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় যুবকের বুকে। যুবকের হাত দু’টো পথ হারিয়ে ফেলে লাবণ্যের চুলের গহীনবনে-কেশবনের বুনো ফুলের গন্ধে মাতাল হয় যুবকের মন। তৃষিত শিহরণে কাঁপতে থাকে লাবণ্য; জীবনে অমন আলো-আঁধারীতে এই প্রথম কোন পূরুষ স্পর্শ করে তাঁকে গভীর উঞ্চতায়-অমন প্রথম স্পর্শের জন্য অপেক্ষায় প্রহর গুণে প্রতিটি নারীমন-যা একবারই আসে জীবনে। নিজেকে হারাতে গিয়েও সামলে নেয় যুবক। হঠাৎ কম্পার্টমেন্টের লাইটগুলো জ্বলে উঠে। লম্বা হুইসেল দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করে আবার।

সিটে ফিরে গিয়ে চোখ বুঝে লাবণ্য-লজ্জায় না অনুভবে বোঝা গেল না-স্বপ্ন ভঙ্গের ভয়ে একবারও চোখ খোলে না আর। ট্রেনের দুলুনিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে টেরই পায় না সে।

সাত সকালে কমলাপুরে পৌঁছে কুলিদের হাঁক-ডাকে ঘুম ভাঙে লাবণ্যের-তাকায় চারিপাশে-কেউ নেই পাশে। কখন নেমে গেছে প্রেমিক পুরুষ কে জানে। তার দেহে জড়ানো রয়েছে যুবকের গায়ের অপ্রিয় চাদরখানি-ঘুমন্ত লাবণ্যকে যা উষ্ণতা দিয়েছিল শীতের সারাটা পথ। এরপর আরো কতো ট্রেন এলো গেলো। কতো প্রেমিক যুগল আঁড়ালে চুমু খেলো-শুধু লাবণ্য খুঁজে পেলনা তাঁকে। তবু প্রতীক্ষার প্রহর গুণে আশাবাদী মন-এক.. দুই.. অযুত নক্ষত্র রাত।


দু’বছর পরের কথা। আজ ভ্যালেন্টাইন ডে। টিএসসিতে আজ সবুজ প্রাণের উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত দিন। ওপাশে চলছে কবিতা পাঠের আসর। মাইকে ভেসে আসে কোন এক অখ্যাত কবির কবিতাখানি-

‘ত্রিশে তৃষিত মন
রমণী রমণ মন-ভালোবাসে অনুক্ষণ;
অযুতনক্ষত্ররাত নীহারিকা মন কেবলি খুঁজেছি আমি; তবুও-
কেউ কাছে আসোনি; কভু ভালোবাসোনি...’

কবিতাটা শুনেই লাবণ্যের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু-কই, সেতো আসেনি; আমি যে হারিয়ে ফেলেছি তাকে।

এদিকে সন্ধানীর ব্যানারে চলছে রক্তদান কর্মসূচী। ঢাকা মেডিকেল থেকে রক্ত সংগ্রহের জন্য ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে ‘নিকোলাস’ গ্রুপ। রক্ত পরীক্ষার কাজটি বিনামূল্যেই করে দিচ্ছে ওরা। এরি মধ্যে কয়েকজন দান করেছে-বিভিন্ন গ্রুপের রক্ত।

চারুকলার এদিকটায় বসেছে তারুণ্যের বসন্ত মেলা। কতো বাহারী সাজে সেজেছে যুব-ললনার দল। এমন সময় হঠাৎ কোথায় যেন বোমা ফাটল কয়েকটি। দ্রুত র্যা ব এসে ঘিরে ফেলল এলাকাটি। পরপর বিশ-ত্রিশ রাউন্ড গুলির শব্দ এলো কানে। অনেক হতাহত। সন্ধানীর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো আহত এক র্যাব অফিসারকে। ক্লিন শেভড্ অজ্ঞান অফিসারকে দেখে নিজেই অজ্ঞান হবার মতো অবস্থা লাবণ্যের। এতো সেই যুবক-যার অফিসে গিয়েছিল অভিযোগ নিয়ে কোন একদিন-কালো চশমা থাকায় ট্রেনে যাকে চিনতে পারেনি; অথচ সঁপেছিল মনপ্রাণ মায়াবী জোছনা রাতে-হারিয়েও ফেলেছিল তাঁকে।

স্প্রিন্টারটা পেটের নীচ দিকে লেগেছে কোথাও। রক্তে ভিজে লেপ্টে আছে পোশাকটা। ‘নিকোলাস’ গ্রুপ অফিসারের কালো পোশাকটা কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলে দ্রুত। সলাজ চোখে লাবণ্য দেখে অফিসারের প্রশস্ত খোলা বুক-একি! আড়াআড়ি প্লাস সাইন-অনেকটা ক্রুশের মতো। অস্ফুষ্টভাবে বলে উঠে লাবণ্য-‘নিকোলাস-প্লাস’ তুমি!

সারাটা ক্ষণ পাশে বসে থাকে লাবণ্য। কতো কথা মনে পড়ে আজ। অভিমান ছাপিয়ে লাবণ্যের তপ্ত অশ্রু ঝরে পড়ে যুবকের বুকে। তপ্ত অশ্রুতে জ্ঞান ফিরে পায় প্রেমিক পুরুষ।

অতঃপর যার জন্য এতো প্রতীক্ষা, এতো অশ্রু গঙ্গা জল; তার জ্ঞান ফিরতেই যথারীতি লাবণ্যের সেই পরিচিত ঝাড়ি… হিজিবিজি.. হিজিবিজি… যুবক কেবলি হাসে…ইশারায় কাছে ডাকে… না, আসব না-তুমি সত্যিই ‘ভয় ফ্রেন্ড’। ‘সত্যি করে বলো-আমিই কী তোমার সেই কিউট।’

অতঃপর পরম মমতায় লাবণ্যকে কাছে টানে পশমী খোলা বুক-রেশমী চুলে চিবুক ঘঁষতে ঘঁষতে বলে ভয় ফ্রেন্ড-‘আমার এ খোলা বুক-অনলি ফর কিউট।’

নিকোলাস গ্রুপের কেউ একজন টিপ্পনী কাটে-‘প্রেমিক, তোমার ব্লাড কোন গ্রুপ।’ আনমনে লাবণ্য বলে-‘নিকোলাস-প্লাস’ গ্রুপ। সবাই হেসে উঠে। সত্যিই সেদিন থেকে ওরা হয়ে গেল ‘নিকোলাস-প্লাস’ গ্রুপ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
দীপঙ্কর বেরা স্যার অভিনন্দন। আরো অনেকে ভালো লিখছে।
ধন্যবাদ আপনাকে। অবশ্যই এখানে সিনিয়ররা অনেক ভালো লিখেন; আপনিও। তবে গল্পটিতে গতমাসের ভ্যালেন্টাইন ডে, পহেলা ফাগুন এবং শীতের বিদায় থাকায় হয়তঃ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। দোয়া করবেন।
স্যার এ পর্যন্ত কটা পুরস্কার হল। ভালো থাকবেন।
আনোয়ার উদ্দিন আপনাকেও অভিনন্দন।
ধন্যবাদ আপনাকে। দোয়া করবেন।
কাজল Ovinondon.
ধন্যবাদ আপনাকে। দোয়া করবেন।
রফিকুল ইসলাম চৌধুরী অনেক অনেক অভিনন্দন।
ধন্যবাদ আপনাকে। দোয়া করবেন।
মনজুরুল ইসলাম congratulation dear writer.wish u will sustain your consistency.stay fine forever.
ধন্যবাদ বন্ধু। দোয়া করবেন। আপনার লেখাও আমি উপভোগ করি। লিখবেন সতত।
সাদিক ইসলাম আমি পাঠক ভোটে তৃতীয় ছিলাম। ৯৬ সাল থেকে জাতীয় পত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ লিখি। International Journal এ ও সাহিত্য বিষয়ক লেখা প্রকাশিত হয়েছে আরো তিনটা হবার পথে। কততম হলাম তা বিষয় না পরপর দুবার সেরা দশে আমার গল্প আমি তৃপ্ত। এই প্লাটফর্ম ( গল্প কবিতা) আমাকে অনেক শিখাচ্ছে। সবার গল্প পড়ে জীবনের নানা দিক জানতে পারছি। এমনকি যারা দশের ভিতরও নেই তাদের গল্পও আমার ভালো লেগেছে। স্থানের হেরফেরে লেখা হারিয়ে যায়না ; মান কমে যায়না তাই কেউ যেন উৎসাহ না হারিয়ে ফেলি। সবার প্রতি শুভ কামনা।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আমার উপরের মন্তব্যটি বুঝতে পারার জন্য। আপনার লেখার এতো বিস্তৃতি জেনে খুব খুশী হলাম বন্ধু। আশা করি আপনি আপনার যোগ্যতার পুরস্কার একদিন না একদিন পাবেন। লিখবেন সতত। আমিও আপনার লেখা খুব উপভোগ করি। দোয়া করবেন।
আপনার লেখার মধ্যে গতি আর শক্তি রয়েছে। আপনি একদিন লেখা দিয়ে দেশের সবার মন জয় করুন এই শুভ কামনা।
আপনার লেখার মধ্যে গতি আর শক্তি রয়েছে। আপনি একদিন লেখা দিয়ে দেশের সবার মন জয় করুন এই শুভ কামনা।
তাই কি হয়? নিরাশা তো হবেই।
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া শ্রদ্ধেয় বন্ধু, পাঠক, লেখক ও শুভাকাঙ্খী-আপনারা গকতে একজন নবীন লেখককে যেভাবে গ্রহন করেছেন তারঁ জন্য আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা সবাই কর্মব্যস্ত থাকি; তারপরও ক্ষণিকের অবসরে আমরা আপনারা একটু আধটু লিখি। একে অপরের লেখার বিষয়ে মতামত জানাই, উৎসাহ দেই এবং ছোট-খাট ভুল-ত্রুটি নিয়ে সমালোচনাও করি। আর প্রিন্ট মিডিয়ায় কাগজের স্বল্পতা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে আমরা হয়তঃ অনেক প্রতিভাবান লেখক-কবিদের লেখা তাই প্রিন্ট মিডিয়ায় পাই না। কিন্তু গল্প ও কবিতার এ প্লাটফর্মটি আমাদেরকে সে সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। আজ থেকে এতো বছর আগে সেই ২০১১ সাল থেকে গক আমাদেরকে সে সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে; যা আমাদের মতো পথহারা, হতাশ লেখক-পাঠকদের জন্য একত্রিত হওয়ার সুযোগ। আমরা সে সুযোগটি কাজে লাগিয়ে এখানে প্রতিনিয়ত লিখছি ও শিখছি। এখানে যারা দীর্ঘসময় ধরে লিখছেন তাদের কাছ থেকেই বেশী শিখছি। আর এ সুযোগটি করে দিয়েছে গল্প ও কবিতা কর্তৃপক্ষ-এ জন্য গক কর্তৃপক্ষকে অনেক ধন্যবাদ। তাই যে যেখানেই থাকি গককে যেনো ভুলে না যাই। আবারো সবাইকে ধন্যবাদ।
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। দোয়া করবেন।
আজাদ ইসলাম বিজয়ী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
মোস্তফা হাসান অভিনন্দন, মামুন ভাই।
ধন্যবাদ বন্ধু। আপনি অনেক সময় অনেক রাতেও আমার লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত করতেন। আপনাদের সমর্থনই আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ বন্ধু।

০৬ ডিসেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৭ টি

সমন্বিত স্কোর

৬.৪৯

বিচারক স্কোরঃ ৩.৮৫ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৬১ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪