আশ্রয়

মা (মে ২০২২)

সালাহ উদ্দিন শুভ
  • ২৯
রইসুল, ওই শুয়ার তুই বাসায় আয় তোরে আজকে ঝাড়ু দিয়া পিটাইয়া মাইরা ফেলবো, জানোয়ার।
আম্মু তুমি এরকম করলে কিন্তু আমি বাসা থেকে পালাইয়া যামু বইলা দিলাম।
তুই পালাইয়া যাবি? শয়তানের বাচ্চা, তোরে কুচি কুচি কইরা কাইটা আমি নদীতে ভাসাইয়া দিমু।
রইসুল রাস্তায় দাড়িয়ে মায়ের মধুর বচনগুলো শুনছে, আমেনা বেগম তিনতলা থেকে খুন্তি হাতে নিয়ে মুখের এবং হাতের বিশেষ অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে শৈল্পিকভাবে রইসুলকে বকা দিচ্ছেন এবং কল্পনায় জবাই করছেন। তার কল্পনার মাঝে রইসুল কিছু সময় অন্তর কেরোশিন ঢেলে দিয়ে অগ্নিশিখাকে উসকে দিচ্ছে। এই অগ্নিশিখা যদি একবার রইসুলকে গ্রাস করতে পারে তবে পুড়িয়ে ছারখার দিবে। রাইসুলের উচিৎ ভালোয় ভালোয় এখান থেকে আপাতত কেটে পরা এবং সন্ধ্যালগ্নে ঘরে ফিরে আমেনা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া। হয়ত সেটাই করবে, তবে তার আগে একটু আমেনা বেগমকে উত্তেজিত করে পৈচাষিক আনন্দ নিচ্ছে। তার আজকের অপরাধ, ময়লাওয়ালা ছেলের সাথে সিগারেট খাওয়া। এই দৃশ্য মহল্লার কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবী দেখে হয়ত আমেনা বেগমকে অপূর্ব সুযোগ দিয়ে গেছেন যেন তার বখে যাওয়া ছেলেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারেন।
তুই বস্তির পোলাদের সাথে নেশা করোস শয়তানের বাচ্চা, তোর লজ্জা করেনা? আমার মান সম্মান সব ধুলায় মিশাইয়া দিলি।
নেশা করলাম আবার কবে? সিগারেট খাইছি, কোনো নেশা-টেশা করি নাই। আর বস্তির পোলা পাইলা কই? সবুজতো ভাগাড়ের পাশেই থাকে, কোনো বস্তিটস্তিতে থাকেনা। তুমি হুদাই মানুষের কথা শুইনা উলটাপালটা কাহিনী করো।
আমেনা বেগম এবার রাগে দোতালার বারান্দা থেকে জুতা ছুড়ে মারলেন। রইসুল একজন পাক্কা ফিল্ডারের মত জুতাটা ক্যাচ ধরলো। ছেলের এই অপুর্ব প্রতিভা সহ্য করতে না পেরে আমেনা বেগমের মাথায় রক্ত উঠে গেল। দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বটি এনে বারান্দায় ছুটলেন, তবে বটি দিয়ে কি করবেন এখনো মনে মনে ঠিক করেননি আমেনা বেগম। হয়ত গায়ে ছুড়ে মেরে বলবেন, নে এবার ক্যাচ ধর, নয়ত নিজেই লাফ দিয়ে রইসুলের ঘারের উপর এক কোপ দিয়ে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি টানবেন। অবস্থা বেগতিক টের পেয়ে আমেনা বেগমের দেখা পাবার আগেই রাস্তা থেকে উধাও হয়ে গেল রইসুল।
আমেনা বেগম বটিটা হাতে নিয়ে এদিকে ওদিকে খুজে বেড়াচ্ছেন তার গুণধর ছেলেকে। ছেলের এমন উপস্থিত পলায়ন বুদ্ধিতে তার রাগ আরো বেড়ে গেল কিনা তা মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই। আপাতত ছেলের কৃতকর্মগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে রান্নাঘরে মনযোগ দেবার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে পোড়া গন্ধ বেড়ুতে শুরু করেছে। একা একা বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন, পুড়ুক, এই পোড়া ভাতই গিলুক শয়তানের বাচ্চা। কথাটা বলে কিছুটা আত্মতৃপ্ত হওয়ার কথা, কিন্তু কেন যেন আমেনা বেগমের চোখ দুটো জলে ভিজে গেল। চোখ দুটি না মুছেই ভাতগুলো উঠিয়ে রেখে অন্য কাজে মনযোগ দিলেন।

রইসুল এখন আপাতত হান্নান মিয়ার বাড়ীর পেছনে ঘাপটি মেরে রয়েছে। তার চেহারার ধরন দেখলে যে কেউ অনায়াসেই বুঝতে পারবে সে মনের মধ্যে কোন একটা কু মতলব আটছে। গত পরশুদিন হান্নান মিয়ার বাগান থেকে আম চুরি করে পালিয়েছিলো রইসুল এবং তার বাহিনী। সেই সামান্য কটা আম চুরির কারনে ব্যাটা কিনা আমেনা বেগমের কাছে বিচার দিতে গেল! সেদিন রাতে আমেনা বেগম রইসুলকে পিটিয়ে একটা হাতপাখা ভেঙ্গে ফেলেছিল। ব্যাটা হারকিপটের কারনে সেদিন হজম করতে হয়েছিল পাখা ভাঙ্গা ধোলাই। অবশ্য সামান্য কটা আম চুরির পাশাপাশি সেদিন সবকটা লিচু গাছে মাথাও ভেঙ্গে দিয়েছিল রইসুল বাহিনীরা। লিচু গাছ ভাঙ্গার পেছনে অবশ্য তেমন কোন কারন নেই, ভাঙতে আনন্দ পাওয়া যায় তাই ভেঙ্গেছিল। কিন্তু তাই বলে বিচার দিতে হবে! আজ ব্যাটাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। রইসুল আশেপাশে তাকিয়ে দুটি ইটের দলা নিয়ে শন শন করে হান্নান মিয়ার কাচের জানালায় ছুড়েই ভোঁ দৌড়। আহা, কাচ ভাঙ্গার শব্দটা কতইনা মধুর! প্রান জুড়িয়ে যায় এই শব্দে। ঢের শিক্ষা হবে এবার হান্নান মিয়ার। অবশেষে আজ দিনটা খুবই সুখকর হবে এমন আভাস পেতে লাগলো রইসুল।

পথিমধ্যে আতিক ভাইকে দূর থেকে দেখে মুখ শুকিয়ে গেল রইসুলের। এই ভদ্রলোককে রইসুল অনেক ভয় পায়। অথচ লোকটা কত শান্ত মনের মানুষ, দেখা হলেই আদর করে, সুন্দর করে কথা বলে। ভয় পাবার কারন লোকটা পাগল টাইপের। খেয়ে দেয়ে কোন কাজ কর্ম নাই সারাদিন শুধু ছেলেদের ধরে দেশের কথা বলে। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কোনো কাজ কর্ম ছাড়াই সারাদিন দেশ বিষয়ক জ্ঞান দেয়! কিসব সংগঠন করে বুঝে আসেনা রাইসুলের। এর আগে দুইটা বই দিয়েছিলো আতিক ভাই, এত বেশি উপদেশ যে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর খুব সুন্দর করে আবার ফেরত দিয়ে দিয়েছে রইসুল। বইয়ে লেখা কিনা দেশকে নাকি মায়ের মত করে ভালবাসতে হবে। কি হাস্যকর কথা! সারাদিন চিল্লাচিল্লি আর ঝাটাপিটা খাবার পর ভালবাসা! হাহ, আসবে কোত্থেকে! ওই মহিলা না থাকলে জীবনটা আনন্দে ভরপুর হয়ে যেতো। দেশকে মায়ের সাথে তুলনা করার পরই সব পরিষ্কার হয়ে গেছে রইসুলের কাছে, দুটোই লস প্রজেক্ট। রইসুলের যেমন প্রতিদিন তার মায়ের কাছে ঝাটাপিটা খেতে হয়, আতিক ভাইয়েরও ঠিক তেমনি ভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের উত্তম মাধ্যমের স্বীকার হতে হয়। মাঝেমধ্যেতো জেলও খাটতে হয়। আহা কি ভালবাসা। এই ভালবাসা আতিক ভাইদের মত পাগলদের জন্যেই ঠিক আছে।

রইসুল এড়িয়ে যাওয়ার আগেই চোখে পড়ে গেল আতিক ভাইয়ের। একটা মুচকি হাসি দিয়ে পাশ কেটে যেতে চাইলেও আতিক ভাই ডাক দিলেন রইসুলকে। মুখে হাসি ধরে রেখে মনে মনে শ্রুতিমধুর গালী চলমান রেখে ধীরে ধীরে কাছে আসলো রইসুল।
কীরে রইসুল, এমন অবস্থা কেন? ঘেমেতো একেবারে বেহাল দশা বানাইছোস! আবার কি ঝামেলা করে আসছোস!
না, আতিক ভাই, কি যে বলেন, আমি কি সারাদিন ঝামেলা করি নাকি!
তোর এমন দশা হলো কি করে বলতো! কত ভাল ছাত্র ছিলি, আর এখন কি করে বেড়াচ্ছিস। সামনে এসএসসি, কি যে করবি আল্লাহ ভালো জানে।
পড়ালেখা নিয়ে চিন্তা করে জীবন নষ্ট করতে চাইনা।
কীরে, এসব কি বলিস তুই? মাথাটাও কি গেছে নাকি? আংকেলে মারা যাবার পর তোর মা কত কষ্ট করে তোদের পুরা পরিবারটারে টানছে, তোর পড়াশুনার পেছনে সব সম্বল ঢালতাছে, আর তোর মুখে এগুলো কি কথা! আন্টির প্রতি তোর কোনো দায়িত্ব নাই? শোন, আর পাচ-দশটা সাধারণ ছেলের মত করে তোর জীবন কাটবেনা। এটা তোর মেনে নিতে হবে। তুই পরিবারের বড় ছেলে। প্রতি পরিবারের সন্তানদের ছাতা হয়ে থাকে তাদের বাবা, কিন্তু তোর ছাতা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে। তুই যদি তোদের পরিবারের হাল না ধরিস তবে পুরো পরিবার শেষ হয়ে যাবে। তোর মা অনেক ক্লান্ত, তাকে একটু বিশ্রাম দিতে হবে রে রইসুল।
রইসুল আর আতিক ভাইকে কোনো জবাব দিতে চাইলোনা। কথার জবাব দিলেই আরো কয়েক দফা জ্ঞান বিতরণ শুরু হবে। এই মুহুর্তে এই জ্ঞান বিতরণী অনুষ্ঠানে বলির পাঠা হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। এর থেকে যত দ্রুত সম্ভব কেটে পরা ভালো। হান্নার মিয়া কাচ ভাঙ্গার পর ভেবেছিলো দিনটা ভালো কাটবে, এখন দেখা যাচ্ছে পুরাটাই মাটি করে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন স্বয়ং আতিক ভাই নিজেই।
তোরে বলছিলাম সংগঠনে আসতে, আমার কথা শুনলিনা। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস আর জীবনটা নষ্ট করছিস। আমার এখানে কত মেধাবী ছাত্ররা আছে তোর কোনো আইডিয়া আছে? সবার ভিশন, ক্যারিয়ার পরিকল্পনা শুনলে তো আমিই অবাক হয়ে যাই যে এখন এতটা স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে ছেলেরা। পড়াশুনায় যেমন, সাংগঠনিক কার্যক্রমেও তেমন।
রইসুল কোন জবাব না দিয়ে চেহারাটা জোর করা মুচকি হাসিময় করে রাখছে। এই মুহুর্তে কোনো আলোচনায় প্রবেশের ইচ্ছে নেই। আতিক ভাই একা একা কিছুক্ষন বকবক করতে থাকুক। জবাব না পেলে এমনিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
শোন, আগামী শুক্রবার আমাদের সংগঠন থেকে রাস্তা পরিষ্কার র‍্যালীতে নামবো সবাই। তোকে যেনো আবশ্যই দেখি। নিজের ঘরটাকে যেমন সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতে হয় ঠিক তেমনি নিজের দেশে রাস্তাটাকেও পরিষ্কার করে রাখতে হবে। মনে রাখবি, দেশ নিজের মায়ের মতো।
ইশশ, দিলোতো কানে আগুন ধরিয়ে। এই ফালতু লাইনটা প্রতি আলোচনায় আনাটা খুব বেশি প্রয়োজন! মানুষ কিভাবে এত ছ্যাবলা হয়! এত সিনেমাটিক কথাবার্তা, ধুর, মা, দেশ, মাটি, ছাই, এদের হাত থেকে আর রক্ষা নাই। বিরক্তিকে একপাশে রেখেই আতিক ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলো রইসুল।

আমেনা বেগম তার বড় ছেলের কৃতকর্মের সমস্ত রাগ যত্ন সহকারে ঝেরেছেন তার ছোট ছেলের উপর। স্কুল শেষে ঘরে ফিরে শুধু বলেছিল, আম্মু ক্ষুদা লাগছে, ভাত দাও। ছেলেটাকে এমন ভাত খাইয়েছে তাতে এতক্ষনে বেশ ভাল করে পেট ভরে যাবার কথা। আশ্চর্য, পেট অতিরিক্ত ভরে গেলে মানুষ ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে নাকি! পেট ভরে গেলে তো তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কথা, কান্নার আওয়াজ নয়। সম্ভবত কান্নার আওয়াজ আমেনা বেগমের কাছে আরো জঘন্ন লাগছে। কান্নার আওয়াজ বন্ধ করার জন্যে আরো এক দফা উত্তম-মাধ্যম দিলেন ছোট ছেলে আমিনুলের কানের নিচে। কান্নার আওয়াজটা এতটাই বিরক্তিকর তাতে অন্য কেউ এখানে উপস্থিত থাকলে আমেনা বেগমকে মুখে মুখে মারতে নিষেধ করলেও মনে মনে বলতো আর কটা মাইর দেন প্লিজ। আমেনা বেগম নিজেকে সংযত করে ভাত বেড়ে নিয়ে এসে হাঁ করে কাদতে থাকা মুখের ভেতরেই এক মুঠো ভাত গুজে দিলেন। মুখের ভেতর ভাত থাকার কারনে এবার অবশ্য কান্না শব্দ কিছুটা অন্যরকম গম্ভীর্যভাব এনেছে। আমিনুলের নিজের কাছেই কাঁদতে বেশ অস্বস্তি পোহাতে হচ্ছে ভাতগুলো মুখের ভেতর লুকিয়ে দেয়ার কারনে। কি মুশকিল! সে চাইছে আরো কিছুক্ষন কাঁদতে, কিন্তু মুখের ভেতর ভাত নিয়ে কতক্ষন কাদা যায়! শ্বাস-প্রশ্বাসেরও তো একটা ব্যাপার আছে। এর চেয়ে ভাল কান্নাটাকে আপাতত বিরতি দিয়ে খাওয়াটাকে উপভোগ করা। আমিনুলও সেই সিদ্ধান্ত নিলো। ভাত থেকে পোড়া পোড়া গন্ধ বেরুচ্ছে, খেতে মোটেও ভাল লাগছেনা। তবে এই কথা বলে আবারো উত্তম মাধ্যম গ্রহন করার মত সাহস নেই বলে চুপচাপ পোড়া গন্ধযুক্ত খাবার গ্রহন করাটাকেই বেছে নিলো আমিনুল।

রইসুল চুপি চুপি ঘরে ঢুকে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। ধোলাই হবার আগে একটু ভোজন না হলে খুব বেশি কষ্ট হয়ে যাবে। চুপটি করে থালাটা নিয়ে ভাত বেড়ে এবার তরকারি নেবার পালা। কিন্তু একি! এর আগেই যমের দেখা মিলে গেলো। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন আমেনা বেগম। অন্ধকারে চেহারা দেখা যাচ্ছেনা, চুপচাপ সোঝা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রইসুল ঠাহর করে নিল এখন নিশ্চয়ই তার মায়ের রাগ ভেঙ্গেছে। মুখটাকেও কেমন হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে। মায়েদের অনেকগুলো খারাপ বৈশিষ্ট থাকলেও একটা বিশেষ ভাল গুনাবলী হল তারা কিছুক্ষন পর রাগ অভিমান ভুলে যান। এই ভুলমনা স্বভাবটার কারনেই রইসুল তার মাকে কিছুটা হলেও দেখতে পারে, নয়ত একা ফেলে রেখে চলে যেতো সেই কবে! কিন্তু আমেনা বেগমের কি আসলেই রাগ ভেঙ্গেছে! তার ডানহাতে মাখা ভাতের টুকরো দেখা যাচ্ছে আর বা হাতে ঝাড়ু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রইসুলের উপর সপাৎ করে ঝাপিয়ে পরলো তার মা। কষিয়ে দুটি ঝাড়ুর পিটুনি খেয়ে লাফিয়ে উঠল রুইসুল। নারিকেল গাছের শলার ঝাড়ু যখন চামড়ার উপর সজোড়ে ভূপাতিত হয়, তখন চামড়াটা বিদ্যুৎ গতিতে আন্দোলিত হতে থাকে। রইসুল হাত থেকে প্লেট ফেলে দিয়ে পশ্চাৎদেশ ঢলতে ঢলতে আমেনা বেগমের পায়ের ফাক দিয়ে বেড়িয়ে দিলো একটা ভো দৌড়। ঘরের দরজা পর্যন্ত দৌড়ে এসে সজোড়ে দরজায় আঘাত করলো পালিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু একি, দরজা ভেতর থেকে তালা লাগানো। রইসুল ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরে তাকালো। আমেনা বেগমের হাতে এখন আর ঝাড়ু নেই, তার হাতে এখন বটি। ভয়ে রইসুলের গলা শুকিয়ে এলো, চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। তবে কি আমেনা বেগম সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেলো নাকি!
শয়তানের বাচ্চা তুই একটা দিনও আমায় শান্তিতে থাকতে দিবি না? প্রতিটা দিন মানুষ আসে বিচার নিয়া। তুই আজ আবার হান্নানের বাড়ির জানালা ভাঙছিস।
রইসুল মনে মনে ভাবলো, আশ্চর্য এ খবর কি করে পেল! আমিতো আশেপাশে ভালভাবে দেখে নিয়েছিলাম। কেউ দেখেনি এরপরেও বিচার আসলো! বুঝতে পেরেছি, ব্যাপারটা এমন যে অন্য এলাকার চোর চুরি করলেও সব দোষ এলাকার চোরের। শালার সব হারামীর দল। আন্দাজে ঢিল মারলো আমার উপর।
তোকে জন্ম দিয়ে আমি যে পাপ করেছি আজকে তার প্রায়শ্চিত্ত করবো। তোকে আমি টুকরা টুকরা করে কাইটা কুকুরকে দিয়া খাওয়াবো।
রইসুলের গাল বেয়ে ঘাম ঝরে যাচ্ছে। ভীত সম্ভান্ত্র দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পিছু পায়ে হাটতে হাটতে দরজায় এসে পিঠ ঠেকলো। হাতটা পেছনে দিয়ে দরজার কাঠগুলো অযথাই স্পর্শ করে অন্তিম সময়ের প্রহর গুনছে। তার মায়ের মুখটা এতটা ভয়ানক আর কখনো লাগেনি। আমেনা বেগম ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন, ছোট ছেলে আমিনুল অবুঝের মত করে তাকিয়ে রইছে তার মায়ের দিকে। আমিনুলকে দেখামাত্রই রইসুলের চোখ গেলো পাশের বারান্দার দিকে। কোনো চিন্তাভাবনা না করেই সোজা বারান্দায় দৌড়ে গেলো রইসুল, তার পিছু পিছু বটি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমেনা বেগম। যথারীতি বারান্দায় গিয়েও একইভাবে আটকে পড়ল রইসুল। আলোতে তার মায়ের চেহারাটা আরো দানবীয় আকার ধারণ করেছে। সে কি আসলেই আমাকে মারতে চাইছে! এই মহিলাই কি আসলে আমার মা! ভাবছে রইসুল। আর কোনো চিন্তাভাবনা না করে সোজা বারান্দা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল রইসুল। নিচতলায় থাকা ইটের ভাঙ্গা টুকরোর উপর খাড়া হয়ে পরেই গড়িয়ে পরে মাথায় সজোরে আঘাত পেল রইসুল। পা টা ভেঙ্গে গেছে বোধহয়, চিৎকার করার মত শক্তি কিংবা ইচ্ছেশক্তি নেই রইসুলের। তার মধ্যে এখনো ভয়ের ঘোর কাটেনি। কোনোভাবে হেলতে দুলতে নিজের শরীরটাকে দাড় করে একবার উপরে আমেনা বেগমের দিকে তাকালো। কিন্তু এখন আর সেই দানবটাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা, এ যেন সেই চিরচেনা মা, যে প্রতিদিন শ্রুতিমধুর কন্ঠে বকা দেয়, হাতপাখা কিংবা ঝাড়ু দিয়ে আদর করে দেয়া সেই প্রিয় মহীয়সী নারী। সেই নারী যে কিনা আমাকে ধারন করেছে তার পেটের ভেতর, তার অধিকার আছে আমাকে মেরে ফেলার। কিন্তু আমারো অধিকার আছে বেচে থাকার। আমাকে নিয়ে তার এতটাই যন্ত্রনা! হ্যা আমি অনেক দুষ্ট, আমি তার মনের মত হতে পারিনি, আমি তার অশান্তির কারন, তাই বলে আমাকে মেরে ফেলতে হবে! একা একা নিজের মনের মাঝে কথাগুলো ধীরে ধীরে বলছে রইসুল। আমেনা বেগমের মুখটা পুরো শূন্য হয়ে গেছে এতক্ষণে। রইসুল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার একটু পাশে তাকিয়ে আছেন তিনি। রইসুল নির্বিকার হয়ে আছে, এতক্ষণ ধরে যা হলো তার ঘোর কাটেনি এখনো। উপর থেকে লাফিয়ে হয়ত মরে যেতে পারতো। তার মা কি করে পারলো এমনটা করতে? সর্বশেষ বার তার মায়ের দিকে অপলক তাকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো রইসুল। এরপর চিরচেনা রাস্তাটা ধরে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো, আর কখনই ফিরবেনা এই জাহান্নামে।

হঠাৎ করে কার যেন কন্ঠ ভেসে আসছে রইসুলের কানে। ‘এই রইসুল, এই’ বলে ডাকছে। অথচ আশেপাশে কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। রাস্তাটাও একেবারে নিরব, সুনসান। রইসুলের কানে ভেসে ওঠছে, ‘ভেবে দেখেছিস একা একটা মা কারো সাহায্য ছাড়াই কি করে তোদের দুজনকে এত বড় করলো!’ অনেক পরিচিত একটা কথা তবুও রইসুল থমকে দাড়ালো। হঠাৎ করে বুকের ভেতর প্রবল চাপ সৃষ্টি হলো, মাথায় আঘাত পাওয়া অংশটুকু প্রচণ্ড ব্যাথা সৃষ্টি করছে। জীবনের প্রথমবার তীব্র অনুশোচনায় ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। আতিক ভাইয়ের মুখে অনেকবার এমন কথা শুনেছে রইসুল। কিন্তু এমন সহজ একটা কথায় এত কাতর হওয়ার কি আছে আজ! কন্ঠটার মানুষটি কে? অনেক পরিচিত মনে হচ্ছে কন্ঠটাকে! তবে কি আমি আমার মায়ের সাথে অন্যায় করে ফেললাম! কোনো মা তো তার সন্তানকে মেরে ফেলতে চায়না, মনে মনে ভাবল রইসুল। আবারো শব্দটা ভেসে ওঠলো, ‘বাবা ছাড়া কি করে তোর মা কত কষ্ট সহ্য করে তোদের এত বড় করে তুললো, ভেবে দেখেছিস! সারাটা জীবন মানুষের ভর্ৎসনা সহ্য করে ছেলে দুটোকে বড় করলো, প্রতিদানে তোর কারনে প্রতিনিয়তই তিরষ্কার হতে হচ্ছে তার।’

রইসুল পুরো স্তব্ধ হয়ে রইলো। এক পলকে জীবনের সকল স্মৃতিগুলো তুফানের মত এসে হানা দিলো। অথচ এসব স্মৃতিগুলো একটু আগেও মনে ছিলো না রইসুলের, হঠাৎ কি করে সব হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো দানা বেধে গেলো এক নিমিষেই! নাহ, রইসুল তুই অনেক বড় অকৃতজ্ঞ। কি করে তুই ভুলে গেলি মাত্র ৪ বছরের সময় তোর বাবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমাবার পর এই নারী সামলে রেখেছিল এতগুলো বছর। কি করে ভুলে গেলি একা কত ঝড়, তুফান সহ্য করে তোর সমস্ত কুকর্মকে ছাপিয়ে বুকের মাঝে আগলে রেখেছিল এই নারী! কিন্তু এসবের বিনিময়ে সে কি চাইছে? তার লাভ কি? নানাবাড়ি থেকে বারবার বিয়ের চাপ দেয়া স্বত্বেও দুটি ছেলেকে নিয়ে তার যৌবনটাকে টানতে টানতে বৃদ্ধের দোরগোড়ায় এসে পৌছেছে। আর তুই প্রতিনিয়তই মানুষের সামনে তাকে ছোট করছিস! এবার তোর বড় হতে হবে রইসুল! তোর মা এখন বড্ড ক্লান্ত, তোর সাহায্য তার বড্ড প্রয়োজন। যা ফিরে যা, তোর মায়ের বুকে ফিরে যা। তাকে জড়িয়ে ধরে বল, মা, আমি আর কোনোদিনও তোমাকে কারো সামনে মাথা নত হতে দিবো না। যা রইসুল যা, তোর মায়ের ঘারের উপর থেকে কিছুটা বোঝা হালকা কর, গর্বে আর আনন্দে ভরে যাবে তার আন্তর।

রইসুল দৌড়ে ছুটে চলছে তার চিরচেনা আশ্রয়ে। এবার সে ফিরবে ডানা মেলা পাখির মত করে, তার মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে। তার মায়ের দুঃখ এবার ঘুচবেই। কতদিন মন ভরে হাসতে দেখে না তাকে রইসুল। আজ তার মুখে হাসি ফুটবেই। দূর থেকে দেখা যায় আমেনা বেগমের চোখের পানির ঝলকানি। সে চোখের জল সুখের নয়, আকাশ কাপিয়ে করুন আত্মচিৎকার। বাড়ির নিচে কার যেন রক্তমাখা শরীর শুয়ে আছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শাহ আজিজ ক্রুদ্ধ আচরনে ভরপুর গল্প।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও একক অভিভাবকের ক্রদ্ধ দিকটা ফোটানোর চেষ্টা করেছি।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

অনেকের কাছেই দেশকে ভালবাসা এখন অসম্ভব। কি আছে এদেশে, কি দিয়েছে এই দেশ আমায়? না আছে কোনো নিয়ম, বিচার, কিংবা সুশৃঙ্খল একটা স্বাভাবিক জীবন। দেশের মানুষগুলোর অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার আর লুটপাট সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে ঘৃণা আর অভিমানে ভিন্ন আশ্রয়ে পাড়ি জমান অনেক মানুষ। ভিন দেশে জীবন যাপনে হয়ত কোনো একসময় উপলব্ধি হয় দেশ তো আমায় আশ্রয় দিয়েছিল, আমি কি দিয়েছি দেশকে! নোংরামী, দুর্নীতি আর অনিয়মের হলেও সেটা আমারই দেশ, দেশ এখন এত বছর ধরে এতগুলো মানুষের দায়িত্ব নিতে নিতে ক্লান্ত। এখন তাকে বিশ্রাম দেয়ার সময় এসেছে, হাল ধরতে হবে আমাদেরই। কিন্তু যতদিনে উপলব্দি হয় ততদিনে বেলা ফুরিয়ে যায়। নির্বাক হয়ে অন্তিম প্রহরের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। আমাদের হয়ত সময় শেষ হবার আগেই উপলব্ধি করা উচিৎ, যে মা আমাদের জন্ম থেকে লালন পালন করে এসে বড় করেছে, হোক সে জগন্য মা, অপূর্ণ এক নারী। কিন্তু আমাদের উচিৎ তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। তার প্রয়োজনের মুহুর্তে নিজেকে সপে দেয়া।

০৪ ডিসেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪