সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ডুব দিলে আকন্দ মির্জা অজু করে বাড়িতেই মাগরিবের নামাজ পড়ে নেন। দোকানে থাকলে হাটের জামে মসজিদে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করতেন। আজ তিনি আসরের নামাজ পড়েই দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ির পথ ধরেন। কর্মচারী ছোকরা আবুল্যা একটু দ্বিধান্বিত হয়েছিল, কেননা অন্য সময়ে মালিক কোনো কাজে বাইরে গেলে সে একাই দোকান সামাল দিত। আজ আকন্দ মির্জা তাকে বলেন, ‘যাহ্, আইজকা একটু আরাম কর। যা, বাড়িত চইলা যা।’
মাসুক জোয়ার্দারের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। বাড়ির পূর্বদিকের বিস্তীর্ণ নাল-জমির জাঙাল ধরে এক মাইলের মতো হেঁটে গেলে জোয়ার্দারের প্রাসাদোপম বাড়িতে পৌঁছা যায়। ডিসট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে গেলে স্বচ্ছন্দে যাওয়া যায়, কিন্তু গন্তব্যের দূরত্ব বেড়ে যায়। তাছাড়া খেতি জমির ভেতর দিয়ে যাওয়ার আরেকটা সুবিধাও আছে। এ পথে কারো সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম। মাসুক জোয়ার্দার আকন্দ মির্জাকে আজ সন্ধ্যার পর তার বাড়িতে যেতে বলেছেন। মাসুক জোয়ার্দারের সাথে যে কারুর দেখা করা, তা-ও আবার সন্ধ্যার পর, সমাজে অনেক গুজব, কানাঘুষার জন্ম দেয়। জোয়ার্দারের সাথে সংশ্লিষ্টতা মানেই অস্বাভাবিক কিছু। কিন্তু আকন্দ মির্জার না গিয়ে উপায় নেই।
কুলসুম অনিচ্ছায় বাপের হাতে টর্চলাইট তুলে দিতে দিতে গজগজ করে, ‘দিনের বেলায় যাইতে পারলা না। এই রাইতের বেলা সাপখোপ ডিঙ্গাইয়া যাইতেছ; বড় রাস্তা দিয়া গেলে কি অয়?’
আকন্দ মির্জা বলেন, ‘মা’রে, তুই চিন্তা করিস না; কিস্সু অইব না। আমি গেরামের পোলা না? বন-জঙ্গল দিয়া সারাজীবন চলাফেরা করছি না?’
কুলসুমের মা ঘাড় বেঁকিয়ে বলেন, ‘হ, বাহাদুরি অনেক দেখছি। মেয়ে তো ঠিকই কইছে। রাস্তা থুইয়া খেতের আইল দিয়া ছুটছো। কী যে উদ্ধার করবা আল্লাই জানে।’
আকন্দ মির্জা স্ত্রীর কথার উত্তর দেন না। কারণ কথায় কথা বাড়ে। তাছাড়া কুলসুমের মায়ের কথার মধ্যে অল্প হলেও খেদ আছে। তাই অযথা কথা বলে তিনি বাতাবরণ ভারী করতে চান না। তিনি দরজার চৌকাঠ পার হতে গেলেই স্ত্রী আওয়াজ দেন, ‘ফোনটা সাথে লইয়া যাও।’ আকন্দ মির্জা কুর্তার পকেটে হাত দিয়ে দেখেন, না, আছে; তার বাটন ফোনটি পকেটেই আছে।
ধানিজমির মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকন্দ মির্জা ডানে-বাঁয়ে টর্চের আলো ফেলেন। ঘন সবুজ ধানের নিবিড়তা প্রাণস্পর্শী। কিছু ধানগাছের থোড়ও বেরিয়েছে। মিষ্টি গন্ধে ম-ম করছে চারিদিক। আকন্দ মির্জার খুব বেশি জমিজিরাত নেই। বাপের থেকে পাওয়া তিন কানি মিরাসই সব। তা-ও বর্গা দেওয়া। নিজের ব্যস্ততা মোল্লার হাটের মুদির দোকান নিয়েই। নিজে চাষবাস না করলেও চোখ-জুড়ানো ধানের খেত দেখলে তার মন ভরে যায়। জোয়ার্দারের বাড়িতে জটিল একটি সমস্যা নিয়ে যাওয়ার পথেও এখন তার বেশ ফুরফুরে লাগছে।
কৃষ্ণপক্ষ থাকায় সন্ধ্যা নামতেই চরাচর অন্ধকার হয়ে গেছে। মাসুক জোয়ার্দারের বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে আকন্দ মির্জা একবার আকাশের দিকে তাকান। আকাশের নীল শামিয়ানার নিচে ছোট-বড় তারকারাশি মুক্তোর মতো ঝুলে আছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও এখনও দুই-একটি খেচরকে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখা যায়। ওগুলো বক কিংবা ফিঙে হতে পারে। আকন্দ মির্জা কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে প্রকৃতির আটপৌরে অথচ অপরূপ রূপ দেখে দৃষ্টি নামিয়ে আনতেই টর্চের আলোয় কিছুদূরে একটা প্রাণী দেখতে পান। প্রাণীটির চোখদুটি জ্বলজ্বল করছে। মুহূর্তকাল ওটি থমকে দাঁড়ালেও পরে পড়িমরি করে পাশের আল দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আকন্দ মির্জা এতে ভয় পান না। কারণ এখন তিনি যে দুঃসময় পার করছেন তা শেয়ালের চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর।
মাসুক জোয়ার্দারের আলো ঝলমল বাড়ির সীমানায় ঢুকতেই আকন্দ মির্জার বুকটা ধক করে ওঠে। বাড়ির সামনের টাইলস-মোড়ানো তোরণে বড় করে লেখা আছে ‘জোয়ার্দার ভবন’। ভেতরের কাচারি ঘর থেকে গমগম আওয়াজ ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই জোয়ার্দার তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে তুমুল ব্যস্ত আছেন। আকন্দ মির্জার মনে প্রশ্ন জাগে, এই হুলস্থূলের ভেতর তাকে ডাকা হলো কেন? মাসুক জোয়ার্দারের সাথে তার দেখা হওয়ার কথা একান্তে। এমন সময় ভুলু এগিয়ে আসে। সে আকন্দ মির্জাকে দেখে বলে, ‘কী ব্যাপার কাকা; বস কি আফনারে আইতে কইছে?’
আকন্দ মির্জা আমতা আমতা করে বলেন, ‘জোয়ার্দার সাব খুব ব্যস্ত মনে লয়; হ, আমারে মাগরিবের পরে আইতে কইছিল।’
ভুলু জোয়ার্দার বাড়ির ফাইফরমাশ খাটা কর্মচারী। হাট-বাজার করা সহ মাসুক জোয়ার্দারের সব ধরনের হুকুমের গোলাম। সে বলে, ‘তাইলে আফনে এইখানে ইট্টু অপেক্ষা করেন; পোলাপানরা এহনই যাইবগা। দরবার শেষ।’
শান বাঁধানো ঘাটে যেমন ইট-সিমেন্টের বেঞ্চি থাকে তেমনই ‘জোয়ার্দার ভবনের’ ফটকের দুপাশে টাইলস-ঢাকা দুইটি সিমেন্টের বেঞ্চি আছে। আকন্দ মির্জা তার একটিতে বসেন। কিন্তু এতক্ষণ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে তেমন কাবু না হলেও এমুহূর্তে তিনি হাঁসফাঁস বোধ করেন। কারণ যে সমস্যা সমাধানের জন্য আজ মাসুক জোয়ার্দারের কাছে তার আসা সেটার সাথে জোয়ার্দারের পোলাপান জড়িত। ওরাই এখন তার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কী অস্বস্তিকর অবস্থা! হঠাৎ করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি চুপি চুপি দেয়াল ঘেঁষে বাড়ির পূর্বদিকের পুকুরপাড়ে চলে যান। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। জোয়ার্দারের ছোকরা বাহিনী হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলে আকন্দ মির্জা পুনরায় ফটকের কাছে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে ভুলু ছুটে এসে তাকে জোয়ার্দারের কাচারি ঘরে নিয়ে যায়।
আলাপ শুরুর আগেই মাসুক জোয়ার্দার ভুলুকে বলেন, ‘অ্যাই যা, মেহমানের লাইগা চা-বিস্কুট নিয়া আয়।’
আকন্দ মির্জা ‘না-না’ বলে আপত্তি জানালে জোয়ার্দার বলেন, ‘আরে মিয়া রাখো, না-না করার কী আছে, এক কাপ চা-ই তো খাইবা। তো, কেমন আছো কও।’
আকন্দ মির্জা বলেন, ‘না, ভালাই আছি। আপনি কইলেন তাই দোকান বন্ধ কইরা দিয়া আইসা পড়লাম।’
মির্জা আর জোয়ার্দার প্রায় সমবয়সী। পাঠশালায় দুইজন একসাথেই পড়েছেন। এরপর আকন্দ মির্জার পড়াশোনা আর না এগোলেও মাসুক জোয়ার্দার আণ্ডার-মেট্রিক পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন। জোয়ার্দার এলাকার গণ্যমান্য নেতা হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত তাদের মধ্যে ‘তুমি’ সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে আকন্দ মির্জা ‘তুমি’কে ‘আপনি’তে উন্নীত করলেও মাসুক জোয়ার্দার আগের মতো ‘তুমি’ই চালিয়ে যান।
জোয়ার্দার বলেন, ‘শোনো আকন্দ মির্জা, তোমারে একটা কথা কই। তুমি তো কোনোদিন পলিটিক্স করো নাই, তাই দুনিয়ার হালচাল তোমার বোঝার কথাও না। হাঁ, স্বীকার করি ব্যবসার লাভ-ক্ষতি তুমি আমার থাইক্যা অনেক বেশি বোঝো।’
আকন্দ মির্জা সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলেন, ‘কথা হাছা। পলিটিক্স আমার মাথায় ঢুকে না।’
জোয়ার্দার কেশে গলা পরিষ্কার করে বলেন, ‘এইডা একটা জটিল ব্যাপার। তুমি তো জানো, আমি ছোটবেলা থাইক্যা বড় বড় নেতাগো লগে মিটিং, মিছিল, আন্দোলন – কী করি নাই? এই রাজনীতিই আমার সব। আর রাজনীতির গুটির চাল দেয়া বহুত হেকমতের কাম। হাওয়া বুইঝ্যা পাল খাটাইতে অয়। ঝোপ বুইঝ্যা কোপ মারতে অয়। এইসব অনেক রিস্কের কাম, বুঝলা?’
আকন্দ মির্জা বলে, ‘এইডা তো অবশ্যই বুঝি। তয় আফনে তো আমার আপন মানুষ, হের লাইগ্যা দাবিও ইট্টু বেশি। আমার সমস্যা তো আফনার কাছেই কইতে অইব, কী কন?’
জোয়ার্দার বলেন, ‘তোমার একটু বোকামি আছে; বুঝলা?
ভুলুর এনে দেওয়া চা খেতে গিয়ে আকন্দ মির্জা বিষম খান। বোকামির ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে তার মুখটা হা হয়ে যায়।
জোয়ার্দার বলতে থাকেন, ‘শোনো, রাস্তার বেয়াড়া পোলাপাইন; তুমি ওগোরে পাত্তা দিতে যাইবা কেন? তুমিও জানো আমিও জানি এগুলান বেয়াদব। হাছা কথাটা কইয়াই ফালাই; এরা অইল আমার ইনভেস্টমেন্ট।’ জোয়ার্দার একটু ব্রেক কষে বলেন, ‘ইংলিশ তো তুমি বুঝবা না। এইসব বখাইট্যা পোলাপাইনগো আমি কাজে লাগাই। পলিটিশিয়ানগো মূল কাজই এইটা।’
আকন্দ মির্জা বলতে উদ্যত হন, ‘কিন্তু……’
মাসুক মির্জা তাকে বাঁধা দিয়ে বলেন, ‘হেরা যখন তোমার কাছে কিছু চাইছে, কথা না বাড়াইয়া কিছু দিয়া দিতা। তোমার মান তুমি বজায় রাখতা। তুমি কি একলা ব্যবসা করো? আর কারো লগে তো সমস্যা অয় নাই। হেরা তো চুপ মাইরা বইসা নিজেগো কাম করতাছে।’
আকন্দ মির্জার চেহারা দেখে বোঝা যায় জোয়ার্দারের কথা শুনে তিনি বেশ হতাশ হয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন জোয়ার্দার তাকে প্রবোধ দিয়ে কথা বলবেন; বলবেন তিনি ছেলেগুলোকে বকে দেবেন বা অমন কিছু। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তিনি পুরোপুরি ওদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন। তারপরও আকন্দ মির্জা একটু কাঁচুমাচু করে বলেই ফেলেন, ‘না, আমি ভাবছিলাম আপনার পোলাটা অন্তত আমারে ইট্টু খাতির করবো, ওই বাজে পোলাপাইন-গো ইট্টু ধমক-টমক দিবো; সে-ও চুপ কইরা পিছনে খাড়াইয়া রইল।’
জোয়ার্দার এবার উত্তেজিত হয়ে যান, ‘আরে মিয়া, কথা তো একই অইল। তুমি ওগোরে টেকা দশ হাজার দিয়া উষ্ঠা দিয়া সরাইয়া দিতা। দশ হাজার তোমার লাইগা তো বেশি টেকা না। পোলা থাকে দুবাই; তোমার ব্যবসাও রমরমা। বেশি বোঝো!’
আকন্দ মির্জাও মন খারাপ করে জবাব দেন, ‘টেকা তো কমবেশি আরও দুইবার দিছি। আফনার কাছে তো কিছু কই নাই।’ তখন তার ফোনটা বেজে ওঠে। কুলসুম। কুলসুম বাপের খবর নিতে ফোন করেছে। আকন্দ মির্জা বলেন, ‘নারে মা, কুনু অসুবিধা অয় নাই। আমি এহন জোয়ার্দার সাবের ঘরে আছি।’
মাসুক জোয়ার্দারের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি আকন্দ মির্জার কথাবার্তায় বিরক্ত হচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমার এক জরুরি কাজ আছে। বেশি কথা কইতে পারুম না। তুমি এখন পরিষ্কার কইরা কও, তুমি কী চাও।’
আকন্দ মির্জা বলেন, ‘না, আর তেমন কিছু না; আমার যা কওয়ার ছিল আমি হেইদিনই আফনারে কইছি। আফনে কইছিলেন আফনার বাড়িত আইতে। আমি তো আইছি, আলাপ যা করার করছি। হের পরও আফনার কাছে আমার অনুরুদ, আফনে আফনার পোলাপাইন-গুলারে যদি ইট্টু কইতেন তারা যেন আমারে রেহাই দেয়। আমি, আমি যা পারি দিয়া দিমু।’
মাসুক জোয়ার্দার হয়তো আপদ বিদায় করার মানসে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলেন, ‘ঠিক আছে, আমি ওগোরে বুঝাইয়া কমু।’
আকন্দ মির্জাও চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন, ‘আরেকটা কথা আছিল। কইতে গেলে শরম লাগে। আবার না কইয়াও উপায় নাই।’
জোয়ার্দার বলেন, ‘কইয়া ফালাও, কইয়া ফালাও; ঝটপট কইয়া ফালাও। শরমের কী আছে।’
আকন্দ মির্জা কিছুটা জড়তা নিয়ে বলেন, ‘আমার মাইয়া, কুলসুম, এইবার ফাইনাল পরীক্ষা দিবো।’
‘খুব ভালা, খুব ভালা। এর মইদ্যে শরমের কী?’ মাসুক জোয়ার্দার উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘নিজে তো পাঁচ কেলাসের বেশি … আচ্ছা তোমার পোলা তো মেট্টিক পাশ করছিল; করছিল না?’
আকন্দ মির্জা বলেন, ‘হ, পোলায় কিছুদিন কলেজেও গেছিল। আমি আসলে আমার মাইয়ার কথা কইতেছিলাম। ভালা ছাত্রী, তয় পড়াশোনায় মন লাগাইতে পারতাছে না।’
‘ক্যান, সমস্যা কী?’, জোয়ার্দার প্রশ্ন করেন।
তখন আকন্দ মির্জা দু’কদম এগিয়ে এসে জোয়ার্দারের হাত চেপে ধরে বলেন, ‘আফনে আমার আপন লোক…, আফনার পোলারে একটু বুঝাইয়া কইয়েন…, ডিস্টাব করলে লেখাপড়ার ক্ষতি অয়।’
মাসুম জোয়ার্দার কপাল কুঁচকে বলেন, ‘হেলাল? ও! আমার কানেও এইরকম কথা কেডা জানি তুলছিল। শালার পুতে লেখাপড়াও ঠিকমতো করলো না, এখন পিরিতের শখ অইছে! কী করুম, বাপ অইয়া বিপদে আছি।’
আকন্দ মির্জার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বেরোচ্ছে না।
জোয়ার্দার কিছুটা বিব্রত হয়ে আকন্দ মির্জাকে বিদায় জানান, ‘আচ্ছা, তুমি চিন্তা কইরো না; আমি দেখি কী করা যায়।’
আকন্দ মির্জা ফেরার পথে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরেন। বাড়ি পৌঁছাতে একটু দেরি হবে, তবু রাতের বেলা মাঠের আল ধরে যাওয়ার চেয়ে নিরাপদ। পথ চলতে চলতে অনেক ধরনের ভাবনা তার মগজে চামচিকার মতো ওড়াউড়ি করতে থাকে। তিনি ভাবতে থাকেন, তার ছেলে হেলালের বিরুদ্ধে মাসুক জোয়ার্দারের কাছে অভিযোগ করাটা কি ঠিক হলো। সে কী করে বেড়ায় তা কি তার বাপের অজানা? কলেজের খাতায় নাম লেখানো থাকলেও সে তো কার্যত তার বাপের সাম্রাজ্যের সেনাপতি। লোকজন বলে, এখন আর মাসুক জোয়ার্দারকে কোনো মিশনে যেতে হয় না, ছেলেই দলবল নিয়ে সামাল দেয়। আকন্দ মির্জা ভাবেন, চাঁদাবাজির জ্বালাতন নাহয় সহ্য করা গেল, এখন যে বদমাশটা তার মেয়ে কুলসুমের দিকে নজর দিয়েছে, সেটার সুরাহা করবেন কীভাবে। মাসুক জোয়ার্দার কী তার ছেলেকে কিছু বলবেন, আর বললেও ছেলে কি বাপের কথা শুনবে?
দুই দিন পার হয়ে গেছে। মাসুক জোয়ার্দারের সাথে দেখা করে আসার পর তার চ্যালা-চামুণ্ডারা এখনও এমুখো হয়নি। কিন্তু আকন্দ মির্জা কোনোভাবেই নির্ভার হতে পারছেন না। তিনি তো কমবেশি কিছু টাকা ছাড়ার কথা জোয়ার্দারের কাছে কবুল করে এসেছেন। অতএব একটা হেস্তনেস্ত করতে হলে একবার মস্তানদের মুখোমুখি হতেই হবে।
আকন্দ মির্জাকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। দুপুর গড়িয়ে গেলে সেই তিনটি ছেলে যারা ওইদিন এসে দাবড়ানি দিয়েছিল তারা এসে বললো, ‘চাচা মিয়া, খুব তো খেল দেখাইলেন। দেন, দিয়া দেন, যাইগা।’
আকন্দ মির্জা গুটিশুটি হয়ে পকেট থেকে টাকা বের করেন। গত দুদিন ধরে তার বুকপকেটে এক হাজার টাকার পাঁচটি নোট নিয়ে তিনি প্রস্তুত আছেন। পিন্টু নাকি মিন্টু নামের ছেলেটির হাতে তিনি টাকাগুলো গুঁজে দিয়ে বলেন, ‘এই টেকাটা রাখো। তোমরা আমারে আর জালাইও না, বাবা। নইলে আমার দোকানটা বন্ধ কইরা দিতে অইব।’
ছেলেটা টাকা হাতে নিয়ে চোখ গোল করে আকন্দ মির্জার চোখের দিকে তাকালো, কিন্তু কিছু বললো না। তারপর বাকি দুই সঙ্গীকে নিয়ে বাজারের পেছনদিকে চলে গেল।
আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় আকন্দ মির্জার ফোন বেজে ওঠে। তিনি ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ফোন ধরেন। কুলসুমের মা ফোন করেছেন। আকন্দ মির্জা হেলো বলার আগেই তার স্ত্রী হড়বড় করে বলেন, ‘কুলসুম এহনও ইশকুল থাইক্যা ফিরে নাই। ফোনও ধরতাছে না। তোমার দোকানে গেছে নাকি?’
আকন্দ মির্জা যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। তিনি অবশ গলায় বলেন, ‘ইশকুল থাইক্যা ফিরে নাই!’ আর কিছু না বলে তিনি সংযোগ না কেটেই তার বাটন ফোনটি পকেটে ঢুকিয়ে পাগলের মতো দোকানে ছুটে আসেন। তারপর হতবিহ্বল হয়ে মুহূর্ত খানেক দাঁড়িয়ে থেকে আবুল্যাকে বলেন, ‘তুই দোকান দেহিস; আমি জরুরি কাজে বাইরে গেলাম।’ বলেই, আকন্দ মির্জা মেয়ের স্কুলের পথে ছুট লাগান।
দ্রুতবেগে হাঁটতে হাঁটতে আকন্দ মির্জা মেয়ের নম্বরে ফোন দিতে থাকেন। কিন্তু মেয়ের ফোনটি যে বন্ধ। আকন্দ মির্জার পা ভারী হয়ে আসে। তিনি আর সামনে এগোতে পারছেন না। ভয়ে তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। অমনি তার ফোন ভয়ঙ্কর শব্দে বেজে ওঠে। স্ত্রীর কল মনে করে তিনি ফোনের দিকে তাকাতেই দেখেন অচেনা নম্বর। কয়েকবার বাজার পর তিনি ফোনের রিসিভ বাটনে চাপ দেন। এবারও তিনি হেলো বলার সুযোগ পাননি। ওপাশ থেকে এক অপরিচিত কণ্ঠ বলে, ‘মির্জা সাব, ভাল কইরা শোনেন, আফনার মাইয়ারে পাইতে অইলে দুইলাখ টেকা নিয়া আসেন। আর শোনেন, মুখ বন্ধ রাখবেন। নইলে মাইয়ার আশা ছাইড়া দিতে অইব।’
আকন্দ মির্জা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আমার মাইয়া কই আছে এহন?’
‘আছে আছে, আফনে ফটাফট টেকা রেডি কইরা এই নম্বরে ফোন দেন। ঠিক আছে?’
আকন্দ মির্জা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, আমার হাত খালি। টেকা কই পামু রে বাবা।’
ছেলেটি বলে, ‘টেকা আফনারে দিতেই অইব।’ এর পরপর গলার সুর পালটিয়ে সে বলে, ‘টেকা না থাকলে আফনারে একটা বুদ্ধি দিতে পারি।’
আকন্দ মির্জা অসহায়ের মতো উচ্চারণ করেন, ‘কী?’
‘আপনার মাইয়ারে হেলালের লগে বিয়া দিতে অইব।’ ছেলেটি বলে, ‘আফনে রাজি অইলে আইজ রাইতেই আমরা কাজী ডাকুম।’ একথা বলেই সে ফোন কেটে দেয়।
আকন্দ মির্জা আগেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এখন তিনি ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে একবার আকাশের দিকে, আরেকবার মাটির দিকে তাকান। তিনি এ মুহূর্তে বাড়িতে ফিরবেন না মাসুক জোয়ার্দারের কাছে যাবেন নাকি গলায় দড়ি দেবেন ঠিক করতে পারছেন না।