বাদলের বাবা বলতেন, ‘নির্বোধরা হলো ডাটা গাছের মতো; অল্প চাপেই মট করে ভেঙ্গে যায়। টানা-হেঁচড়ার জীবনে টিকে থাকতে হলে বেতের মতো হও; মুচড়ালেও ভাঙবে না। আর কাঁটার বর্মওয়ালা বস্তুকে কে আসে মুচড়াতে?’
কিন্তু বাদল গোঁয়ারের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলো যে সে বাপের ভজকট জীবনযুদ্ধে সহযোগী হতে পারবে না। ভজকট জীবনযুদ্ধ মানে বাপের জগাখিচুড়ি উপার্জন প্রক্রিয়া। হঠাৎ দেখা যায় তিনি এক দঙ্গল হাঁস এনে পালন করতে থাকেন। কিছুদিন পর শিয়াল ও চোরের উপদ্রবে এই ব্যবসা লাটে ওঠে। তারপর কিছুদিন দেশি মুরগি পালতে শুরু করেন। হঠাৎ করে মড়ক এলে মুরগির ব্যবসাও শেষ হয়ে যায়। এরপর কয়েকটি ছাগল এনে পুষতে শুরু করলে দেখা যায় কয়েকটি ছোঁয়াচে রোগে মারা যায়, কয়েকটি চোরের কবলে যায়। এসব কাজে বাদলের চরম বিরক্তি। সে যখন জানালো সে বরং ঢাকায় গিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করবে তখন তার বাপ আব্দুল আলী একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খান।
আব্দুল আলীর ঝাঁকুনি খাওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। বড়ছেলে আওলাদ যাকে বিদ্বান বানানোর জন্য খুব শখ করে কচি বয়সে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সে দু’দুবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেনি। পরীক্ষায় পাশ করতে না পারলে কী হবে, অন্যদিকে সে পুরোপুরি কামিয়াব হয়ে যায়। সে মামার বাড়ির পাশের গ্রাম কুসুমপুরের অষ্টম শ্রেণি পাশ সালেহাকে লাভ ম্যারেজ করেছে তো করেছেই, উপরন্তু শ্বশুরবাড়িতে বহাল তবিয়তে ঘরজামাই হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছে। মামাদের মধ্যস্থতায় বিষয়টির মীমাংসা হলেও শেষপর্যন্ত আব্দুল আলীর সাথে তার বড়ছেলের যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি। সেক্ষেত্রে বিকল্প ও একমাত্র বশংবদ ছেলে বাদলই তার অন্ধের যষ্টি হয়ে ওঠে।
কিন্তু শেষপর্যন্ত বাদলকেও আব্দুল আলী ধরে রাখতে পারেননি। সে গোঁ ধরে ঢাকায় চলে আসার আগ মুহূর্তে অনেক উপদেশ-বাণীর সাথে তিনি ওই ডাটা আর বেত সংক্রান্ত মূল্যবান কথাটিও বলেছিলেন যা বাদলকে দুঃসময়ে দৃঢ়পদ থাকতে সাহায্য করেছে। ঢাকায় আসার পর বাদলকে কীভাবে টিকে থাকতে হয়েছে তা ক্রমানুসারে বলতে গেলে ছয় ফর্মার উপন্যাস হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং হালফিল বিষয়ের ওপরই নোঙ্গর করা যাক। প্রাসঙ্গিক সূত্রের প্রয়োজনে নাহয় ফ্ল্যাশব্যাক করা যাবে।
মুনতাহার উপাখ্যানই এক্ষেত্রে বেছে নেয়া যাক। তিন বছর আগে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাদল যখন বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ডিপ্লোমা শেষ করে তখন মডার্ন বিল্ডার্স-এর এম.ডি মামুন সাহেব অনেকটা অনুগ্রহ করে তাকে তার প্রতিষ্ঠানে সহকারী হিসেবে নিয়ে নেন। কিসের সহকারী? অ্যাডমিন ম্যানেজারের সহকারী। প্রশাসন, হিসাব, মানব সম্পদ – এর সবটাতেই তাকে কাজ করতে হয়। প্রাইভেট ফার্মের কাজ এরকমই হয়। কাজের প্রয়োজনে সময়ের কোনো হিসাব না থাকলেও বাদলের তাতে কোনো আপত্তি নেই। অল্পদিনেই সে তার কাজে মোটামুটি দক্ষ হয়ে ওঠে। বাদলের নিযুক্তির দুবছর পর মডার্ন বিল্ডার্সে মুনতাহাকে রিসেপশনিস্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আগে অবশ্য এরকম কোনো পদ ছিল না। কর্তাব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির কথা বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেন। তবে রিসেপশনিস্ট মানেই শুধু লিপস্টিক লাগানো আর ওয়েলকাম স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার না। এর বাইরেও অনেক কিছু করতে হয়। প্রতিষ্ঠানের নাড়ি-নক্ষত্র জানা, বিভিন্ন প্রজেক্টের সদলিল আদ্যন্ত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা, বিচক্ষণতার সাথে ক্লায়েন্ট সামলানো ছাড়াও অফিসের অন্যান্য কাজ যেমন অফিসের ফাইল সংরক্ষণ করা, ডাইরেক্টরদের সভার আয়োজন করা ও মিনিটস লেখা, ইত্যাদিতে সহযোগিতা করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মুনতাহার মতো চৌকশ মেয়ে বলতে গেলে এক ঝটকায় এসব কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠে।
এটা সত্য, মুনতাহা বাদলের মতো তৃণমূল পরিবেশ থেকে উঠে আসেনি। তার বাবা সরকারি কর্মচারী হওয়ার সুবাদে সে রাজধানী শহরের বড় হাসপাতালে জন্মেছে, বড় হয়েছে সরকারি কোয়ার্টারে। লেখাপড়ায় অতি মেধাবী না হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করে বাদলের চেয়ে অনেক অগ্রসর। আর রূপ-সৌন্দর্য অবশ্য অবশ্যই গড়ের চেয়ে ভাল বলে অভ্যর্থনার চাকরিটা সে পেয়েছে। পক্ষান্তরে বাদল পল্লিবাংলার সোঁদা গন্ধ ধারণ করে সাবালক হওয়ার পর নগরমুখি হয়েছে। তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সে এ পর্যন্ত এসেছে। তবে মেধা তার ভালই ছিল; কিন্তু সার-সেচ পায়নি বলে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে তেমন বিকশিত হতে পারেনি।
তবুও বাদলের মাথায় বিদ্যের পরিমিত চাষ-বাস ছিল বলে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সে দু’চারটি স্কুল-পড়ুয়াদের টিউশনি জোগাড় করতে পেরেছিল। সেজন্যই সে কষ্টেসৃষ্টে খড়কুটোর মতো রাজধানীতে টিকে যেতে পেরেছে। কপাল ভাল ছিল বলে মামুন সাহেবের ছেলে ও মেয়েকে সে বছর দুই অনেক খেটেখুটে পড়িয়েছে। ওই সূত্রেই মামুন সাহেব দয়াপরবশ হয়ে বাদলকে তার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে নেন। চাকরি পেয়ে বাদলকে টিউশনি পেশা ছেড়ে দিতে হয়। কিছুদিন আগে মামুন সাহেবের মেয়ে ফারিয়ার সাথে আচমকা তার রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। বাদল চিনতে না পারলেও ফারিয়া পেছন থেকে উচ্চকণ্ঠে স্যার বলে চিৎকার করে উঠলে সে ভড়কে গিয়ে তাকিয়ে দেখে, ওমা, কী সুন্দর, টগবগে হরিণীর মতো মেয়ে। কলেজছাত্রী ফারিয়াকে নতুন অবয়বে দেখে তার ভেতরটা চনচন করে ওঠে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী যে এ ক’বছরে এমন পল্লবিত হয়ে উঠবে বাদল তা ধারণাই করতে পারেনি। কিন্তু প্রাক্তন ছাত্রী, তা-ও আবার মামুন সাহেবের মেয়ে, তাকে সে তার অনুভবের তরঙ্গিত আরশিতে কিভাবে স্থাপন করবে সেকথা ভাবতে ভাবতে বাদল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে পরিশীলিতভাবে বলে, ‘আরে, ফারিয়া নাকি! আমি তো চিনতেই পারছি না; তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ – কলেজ স্টুডেন্ট! হা হা হা।’
ফারিয়া এখন আর ছোট্ট মেয়েটি নয়। সে পরিপক্ব হয়েছে; তার কথা বলার ঢং বদলেছে। সে তার মুখে অভিমান ফুটিয়ে বলে, ‘আপনি সেই কবে যে গেলেন আর একটা দিনও তো আমাদের বাসায় আসেননি।’
বাদল বলে, ‘আসিনি ঠিক, কিন্তু সবসময় স্যারের কাছ থেকে তোমাদের খবর পেয়েছি। যাক, আজ তো দেখা হয়ে গেল।’
ফারিয়া বলে, ‘বাসায় আসবেন, স্যার। ছুটির দিনে চলে আসবেন।’
ফারিয়ার সাথে হুঁ হ্যাঁ ছাড়া বলার তেমন আর কিছু না থাকায় বাদল মাথা নেড়ে তার পথ ধরে। কিন্তু এই আকস্মিক সাক্ষাৎ আর অল্প কথাই এক ভারী পাথরের মতো তার বুকে চেপে বসে।
যাক, মুনতাহার কথায় ফিরে আসা যাক। মুনতাহা এ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বাদলের সাথে ভাব জমে যায়। তারা অফিসে ততোটা সাবলীল হতে না পারলেও বেশ কয়েকবার এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করেছে, চা-কফি খেয়েছে, বেশ সময় নিয়ে হৃদয়ের উষ্ণ উপত্যকায় ছুটাছুটি করেছে। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, মুনতাহার মতো মেয়ে অনায়াসে শাহী গুলবাগে প্রজাপতি হয়ে উড়তে পারতো, সে কেন বাদলের মতো বুনোফুলের দিকে ঝুঁকে পড়লো? এটার একটা সনাতন ব্যাখ্যা হলো, মনের কোনো পাহারাদার নেই – ও যখন যেখানে ইচ্ছে উড়ে বেড়াতে পারে। দৃশ্যত বাদলের দিকে হেলে পড়তে মুনতাহা তার আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় আনেনি। আর একথা বিবেচনায় না আনলে বাদলের প্রতি অবিচার করা হবে যে সে-ও গড়ের ওপরে সুদর্শন পুরুষ। শিক্ষাজীবন তার মসৃণ ও ঊর্ধ্বগামী না হলেও সে আপন প্রচেষ্টায় তার প্রতিযোগিতামূলক যোগ্যতাকে শানিত করেছে। মডার্ন বিল্ডার্সে ঢুকে যে সে শুধু মার্জিত হয়েছে তা নয়, কাজেকর্মেও যে উৎকর্ষতা দেখিয়েছে তাতে এটা প্রায় সুবিদিত যে শীঘ্রই সে প্রমোশন পেতে যাচ্ছে।
বাদল যখন তার মনের জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল মুনতাহা তখন বাদলের ক্যারিয়ারকেও অংশত বিবেচনায় রেখেছিল। মুনতাহার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকলেও বাদলের মনে কিন্তু একটু দ্বিধা ছিল। একদিন চা-শিঙাড়া খেতে খেতে সে মুনতাহাকে বলেই ফেলেছিল, ‘জানো, আমার কেবল মনে হয়, আমি তোমার যোগ্য নই।’
মুনতাহা খিলখিল করে হেসে বলেছিল, ‘তাহলে প্রেম করার সাহস পেলে কীভাবে?’
তখন বাদল বলেছিল, ‘আমিও আশ্চর্য হয়ে ভাবি, চাঁদের দিকে হাত বাড়াবার সাহস পেলাম কেমন করে।’
পরিস্থিতি যখন কী কেন কীভাবে এসব পার হয়ে স্থিতাবস্থায় পৌঁছায় তখন বাদল ও মুনতাহা সিদ্ধান্ত নেয় তারা বিয়ে করবে। দুর্বল চিত্তের বাদলের প্রণয়াকাঙ্ক্ষা বেতের মতো শক্ত হলেও বাস্তবতার কথা চিন্তা করতে গিয়ে নিজেকে তার ডাটার মতো মনে হয়। বিয়ে করতে গেলে টাকা লাগবে। কিন্তু বাবা-মাকে মাসিক ভাতা পাঠানোর পর কত টাকাই বা তার সঞ্চয় হয়েছে। তারপরও সে নিয়মিত প্রাণায়ামের মাধ্যমে নিজের মনকে দড় করার চেষ্টা করে। মুনতাহা তার এই দুর্বলতার কথা অনুভব করে বলেছে, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমার নিজের একটা ফিক্সড ডিপোজিট আছে। সব মিলিয়েঝিলিয়ে হয়ে যাবে।’
মুনতাহার এই বদান্যতায় বাদল কুণ্ঠা বোধ করে। কিন্তু আপত্তি করার মুরোদ যে নেই। এক্ষেত্রেও মুনতাহা বাদলকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করে। সে ভুরু নাচিয়ে বলে, ‘ঠিক আছে, তোমার প্রমোশনটা হয়ে যাক, তার পরই…। কী বলো?’
বাদল বলে, ‘প্রমোশন কি এত সহজ?’
মুনতাহা বলে, ‘আমি জানি। গতমাসে স্যারদের মিটিঙে আলাপ হয়েছে। কিন্তু গোপনীয়তার জন্য আমাকে তা মিনিটসে উঠাতে নিষেধ করেছেন।’
মুনতাহার কথা শুনে বাদলের মনটা ভাল হয়ে যায়। সে মনে মনে বলে, বিয়েটা নাহয় দুদিন পরে হোক, আগে প্রমোশনটা হোক।
তো, আখ্যানের অবতারণায় মুনতাহাকে বেছে নেয়া হলো কেন? বেছে নেয়া হলো এজন্য যে একদিন মুনতাহা হুট করে অফিসে তার পদত্যাগপত্র জমা দেয়। মুনতাহার পদত্যাগপত্র দেখে বাদলের মাথা আউলা হয়ে যায়। সে কোনোভাবেই মুনতাহার কাছ থেকে এর কারণ উদ্ধার করতে পারেনি। আচমকা মুনতাহাকে তার অপরিচিত মনে হতে থাকে। মুনতাহার অভাবিতপূর্ব পরিশীলিত আচরণ বাদলকে প্রায় ক্ষেপিয়ে তোলে। সে একান্তে কথা বলার জন্য মুনতাহার কাছে সময় চায়। মুনতাহা বলে ছুটির দিনে তার জরুরি কাজ আছে; ঢাকার বাইরে যাবে। বাদল বারবার মুনতাহার এই আচরণের কারণ জানতে চেয়েছে। মুনতাহা শুধু এইটুকু বলেছে, ‘আমার ব্যক্তিগত একটা সমস্যা আছে। প্লিজ, আমাকে ডিস্টার্ব কোরো না; পরে জানতে পারবে।’ বলা বাহুল্য, বাকি যে কয়দিন মুনতাহা এই প্রতিষ্ঠানে ছিল তা বাদলের জন্য রিমান্ডের মতো ছিল। হঠাৎ করে এমন বজ্রাঘাত কেন হলো তার কোনো হদিসও সে উদ্ধার করতে পারেনি। সঙ্গত কারণে বাদলের স্নায়ু জট পাকিয়ে যায়। অনেক কষ্টে সে ডাটার মতো মট করে ভেঙ্গে পড়া থেকে রক্ষা পেলেও একদিন মুনতাহা চলে যাওয়ার পর বাদলের জীবন তছনছ হয়ে যায়।
মডার্ন বিল্ডার্সের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মী হয়ে ওঠার পর প্রমোশন যখন বাদলের নাকের ডগায় ঝুলছিল তখনই তার এ অঘটন ঘটে। তার কাজকর্মে ভুলভ্রান্তির পরিমাণ বেড়ে গেলে উপরমহল থেকে ঘনঘন অভিযোগ আসতে থাকে। এমতাবস্থায় তার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বড়সাহেবের পিএ মেঘলা বাদল ও মুনতাহার ঘনিষ্ঠতার ব্যাপার হয়তো কিছুটা জানতো। তবে সে বাদলকে তা কোনোদিনই বুঝতে দেয়নি। কিন্তু সেদিন কুশল বিনিময়ের ফাঁকে সে হঠাৎ করে বলে, ‘বাদল ভাই, মুনতাহা আমেরিকা চলে গেছে; জানেন নাকি?’
বাদলের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা! তাহলে মেঘলা তাদের ব্যাপারটা জানে! তার ওপর হৃদয়ছেঁড়া দুঃসংবাদ। মেঘলার কথা শুনে তার দম আটকে যাওয়ার অবস্থা। আমেরিকার স্বপ্নই কি তবে মুনতাহাকে তার কাছ থেকে ছো মেরে নিয়ে গেল! এমনই যদি তার ইচ্ছা ছিল, সে ছলনা না করলেও পারতো। বাদল বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘না, আমি তো জানি না।’
মেঘলা আবার জিজ্ঞেস করে, ‘ওই আমেরিকান ভদ্রলোক, মানে আমাদের ক্লায়েন্ট, যাকে মুনতাহা বিয়ে করলো তাকে চিনেন তো?’
একথা শোনার পর বাদলের হা হতাস্মি অবস্থা। এ মুহূর্তে নিজেকে তার নিতান্তই ইঁদুর কপালে মনে হয়। অনেক উপদেশ, অনেক নীতিকথা শোনালেও জীবনের এরকম জটিল মুহূর্ত কীভাবে মোকাবেলা করতে হয় তা তার পিতা তাকে শেখাননি। বাদল মেঘলার কথার কোনো জবাব না দিয়ে পাথরের মতো স্থির চোখ নিয়ে তার দিকে তাকায়।
মেঘলা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চলে গেলে বাদল যন্ত্রচালিতের মতো তার ডেস্কে এসে ঝিম ধরে বসে থাকে। বাবার বাতলানো টোটকা যেন আর কাজে আসছে না। তার মনে হচ্ছে সে মট করে ভেঙ্গে যাবে। কী ভয়ঙ্কর প্রতারণা! কী নিষ্ঠুর রসিকতা! মেয়েরাও এমন লোভী হয়? তার আরও মনে হতে থাকে তার ভাই-ই ঘরজামাই হয়ে ভাল আছে, সুখে আছে।
‘বাদল!’ অ্যাডমিন ম্যানেজার রকিবুল সাহেবের ডাকে বাদলের ভাবনায় ছেদ পড়ে।
বাদল অ্যাডমিন ম্যানেজারের কক্ষে গেলে তিনি তাকে ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতে বলেন। আগে থেকে কক্ষে থাকা একজন ভিজিটরকে বিদায় দিয়েই রকিবুল সাহেব কোনো ভূমিকা ছাড়া বাদলকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার সমস্যা কী স্পষ্ট করে বলো।’
এমন প্রশ্নে ভড়কে যাবারই কথা। বাদলকে তেমনটা মনে হলো না। সে বলে, ‘স্যার, আমার একটু সমস্যা আছে; আমাকে কিছুদিনের ছুটি দেন।’
‘তোমার সমস্যার কথা কি আমাকে বলা যায়?’, রকিবুল সাহেব জিজ্ঞেস করেন।
বাদল নিচুকণ্ঠে থতমত হয়ে বলে, ‘না, মানে আমার একটু শারীরিক সমস্যা আছে। ডাক্তার বলেছে কিছুদিন রেস্ট নিতে হবে।’
রকিবুল সাহেব জানেন এটা মিথ্যা কথা। তিনি আর রাখঢাক না রেখে সরাসরি বলেন, ‘শারীরিক নয়, বলো মানসিক।’
বাদল তখন আঁতকে ওঠে। সে কী বলবে ভেবে উঠতে পারে না।
রকিবুল সাহেব বলেন, ‘শোনো। তোমার জন্য আমার খারাপ লাগে। এম.ডি স্যারের লোক তুমি; তোমার ওপর তাঁর নেক নজর ছিল। কিন্তু তোমার পারফরম্যান্স এতোটা ডিটেরিয়োরেট করেছে যে প্রায় হয়ে যাওয়া প্রমোশনটা আর হলো না।’
বাদল তো এমনিতেই ধসে আছে; আর কী ধস নামবে? সে শুধু মাথাটা নিচু করে।
রকিবুল সাহেব এবার মূল জায়গায় হাত দেন। বলেন, ‘তুমি একটা পোড়-খাওয়া লোক। তোমার তো রং তামাশা মানায় না। না জেনে, না বুঝে আগুন নিয়ে খেলতে গেছ কেন? আমি সব শুনেছি।’
বাদল আগের মতোই চুপ করে বসে থাকে।
রকিবুল সাহেব শেষ কথা বলেন, ‘যাও, চাকরিটা বাঁচাতে হলে মন দিয়ে কাজ করো।’
বাদল ছুটির প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অবসন্নভাবে অ্যাডমিন ম্যানেজারের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে।
নিজের ডেস্কে এসে বাদল সত্যি সত্যি শারীরিকভাবে খারাপ বোধ করে। ডাক্তারের কাছে যাবার কথা বলে অ্যাডমিন ম্যানেজারের অনুমতি নিয়ে সে একটু আগে আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ফার্মগেট থেকে হাঁটতে হাঁটতে ক্রিসেন্ট লেকে চলে আসে। জীবনের ওপর অনেক ধকল গিয়েছে, কিন্তু সে এতোটা চাপ আগে আর কোনোদিন অনুভব করেনি। একটু চিন্তা করবার জন্য সে চোখ বন্ধ করতেই ধোঁয়াশা দেখতে পায়। তারপর হতাশ হয়ে মাথা নুইয়ে সিঁড়িতে বসে পড়ে।
এভাবে কতক্ষণ পার হয়েছে তার খেয়াল নেই। হঠাৎ বাদল দেখতে পায়, তার থেকে অল্প দূরে, উল্টোমুখো হয়ে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জড়াজড়ি করে বসে গল্প করছে এবং মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে উঠছে। মেয়েটির কণ্ঠ তার পরিচিত মনে হয়। কিন্তু তা কী করে হয়? নিশ্চিত হবার জন্য সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর খুব সাবধানে একটু নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে লক্ষ করে দেখে, সে যা ভেবেছে ঠিক তাই। ফারিয়া! মামুন সাহেবের মেয়ে, কিছুদিন আগে যাকে দেখে সে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। সাথী অল্পবয়সী ছেলেটি নিশ্চয়ই তার প্রেমিক। বাদল আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। সে অনুদ্দিষ্টভাবে দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে থাকে।