আকাশটা গোমড়া-মুখো হয়ে আছে। কেউ যেন তার উজ্জ্বল মুখে ছোপ ছোপ ছাই মাখিয়ে দিয়েছে। গত দুদিন ধরে একই অবস্থা। মাঝে মাঝে চেহারার বদল হয় বইকি। হঠাৎ মনে হয় আকাশের একপ্রান্তে কেউ টর্চলাইটের আলো ফেলেছে। আবার যখন জলরঙের মতো তার পুরো গা মসৃণভাবে কেউ লেপে দেয় তখন সে অশ্রুপাত করে। গুমোট আবহাওয়ায় শীতল সে ধারা অনেক স্বস্তিকর।
আকাশের মতো সুলতানের মনটাও আজ মেঘকালো। শূন্য ঘরটাও কেমন খাঁখাঁ করছে। ইদের ছুটিতে সে রেহানা ও শিশুপুত্র দোদুলকে নিয়ে গ্রামে গিয়েছিল। স্ত্রীর আবদার ফেলতে পারেনি তাই কয়েকদিনের জন্য ওদের গ্রামে রেখে একাই সে ঢাকায় ফিরে এসেছে। এতদিনে অবশ্য তাদেরও চলে আসার কথা ছিল; কিন্তু দোদুলের জন্য তারিখ পেছাতে হয়েছে।
দু’বছরের ছেলে দোদুল শশকের মতো চঞ্চল। দাদার বাড়ি গিয়ে সে এক মুক্ত পৃথিবী পেয়েছে। এক মুহূর্তও সে ঘরে থাকতে চায় না। গ্রামের বাচ্চাদের সাথে হইরই করে এদিক ছুটছে, ওদিক ছুটছে; কখনও হোঁচট খাচ্ছে, আবার কাদা মাখামাখি হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের সার্বক্ষণিক নজরদারতে থাকলেও তাকে সামলে রাখা দায়। এসব চঞ্চলতা খুব বেশি সমস্যা করছিল না। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে বাঁধিয়ে ফেলেছে জ্বরসর্দি। জ্বর সারছিলো না বলে দুদিন পর ডাক্তার দেখানোও হয়েছে। তারপরেও শরীরটা ভাল হচ্ছে না।
রেহানা বলেছে, ‘বাবুর শরীরটা একটু ভাল হলেই চলে আসবো।’ কিন্তু সুলতানের ভয় অন্য জায়গায়। ঠাণ্ডা থেকে যদি ওর নিউমোনিয়া হয়ে যায়। ভয়ের কারণও আছে। জন্মের কিছুদিন পরই ছেলেটির মারাত্মক নিউমোনিয়ার ফাঁড়া কাটিয়ে উঠতে হয়েছিল।
অফিসে আজও ঝঞ্ঝাট হয়েছে সুলতানের। বড়সাহেব মক্কা থেকে ফোন করেছিলেন। তিনি ওমরাহ্ শেষ করে স্ত্রীকে নিয়ে মক্কার পার্শ্ববর্তী ঐতিহাসিক ও পবিত্র জায়গাগুলি জিয়ারাহ্ করে তায়েফের উদ্দেশে রওয়ানা করেছেন। বড়সাহেব মানে দীপ্ত মানবকল্যাণ সংস্থার প্রধান সৈয়দ আফজাল জরুরি কথা বলার পূর্বে তিনি আবেগের সাথে তার তীর্থকেন্দ্রিক ভ্রমণের বৃত্তান্ত দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘জানো সুলতান, মরুভূমির দেশে মনোরম তায়েফ হলো শান্ত-শীতল এক জান্নাত! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার মিটার উপরে আল্লাহ কী সুন্দর সবুজে-ঘেরা এক বাগান বানিয়ে রেখেছেন। ওখানে ফুল আছে, ফল আছে; ধর্মীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে। যাচ্ছি, যতটুকু ঘুরে দেখা যায় দেখবো।’
আফজাল সাহেব বিরতি দিলে সুলতান বলে, ‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন স্যার।’ সে অবশ্য তার ছেলের জন্যই দোয়ার কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বিগ বসের কাছে নির্দিষ্ট করে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় উত্থাপন করা বেমানান মনে করে সে আর বলতে যায়নি।
সুলতানের আশঙ্কাকে সত্যি করে দিয়ে আফজাল সাহেব বলেন, ‘তুমি নাকি নর্থ বেঙ্গল পোভার্টি অ্যালিভিয়েশন প্রজেক্টের বিভিন্ন বিল নিয়ে আবার কীসব ঝামেলা করেছ?
সুলতান বলে, ‘স্যার, আমি কোনো ঝামেলা করিনি; আমার দায়িত্বের জায়গা থেকে কয়েকটি বড় বিলের ব্যাপারে প্রজেক্ট ম্যানেজার সাহেবের কাছে কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। কারণ, গরমিলটা চোখে পড়ার মতো। আপনি তো জানেন স্যার, গত বছরেও অডিটে বেশ ভোগান্তি হয়েছিল।’
সুলতানের কথা শুনে আফজাল সাহেব বিরক্তি বোধ করেন। তিনি বলেন, ‘সুলতান, আগেও তুমি অনেকবার বাড়াবাড়ি করেছ। প্রতিবার আমি তোমাকে সাবধান করি; তুমি আমার কথা শোনো না কেন? আমি তো তোমাকে বলেছি, ঝুট-ঝামেলা আমি দেখবো; তুমি অ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবে সব পেমেন্ট ক্লিয়ার করে দিবে আর রেকর্ড রাখবে। তারপরে তো আর কোনো কথা থাকে না।’
সুলতান জানে, বড়সাহেব এভাবেই বলেন। অথচ যতবারই অডিট হয় সব ঝামেলা তাকেই পোহাতে হয়। সব দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে অডিটরের সাথে নয়ছয় করতে হয়। সুলতানের এসব ভাল লাগে না। সে অনেকবার মনস্থ করেছে চাকরি ছেড়ে দেবে; রেহানাও বলেছে ‘ছেড়ে দাও।’ কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিলে মন্দার বাজারে আরেকটা সাফসুতরা চাকরি পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়?
শোবার আগে আরেকবার সন্তানের খবর নেয় সুলতান। রেহানা বলেছে, ‘জ্বর অল্প কমেছে, কিন্তু কাশিটা সারছে না।’
সুলতান উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, ‘তোমার অপেক্ষা করার দরকার নেই। ছেলেকে নিয়ে কালকেই চলে আসো।’
রেহানা বলে, ‘ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে। একটা দিন অপেক্ষা করে দেখি না।’
সুলতান বলে, ‘না না। রিস্ক নিতে যেয়ো না। নিউমোনিয়ায় টার্ন নিলে মুশকিল হয়ে যাবে।’
অফিসে একমাত্র ইসমাইল সাহেব ছাড়া অন্যদের সাথে সুলতানের আত্মিক মেলবন্ধন তেমন হয় না। ইসমাইল সাহেব এই এনজিওতে তুলনামূলকভাবে পুরনো। অ্যাডমিনের প্রধান হিসেবে এইচআরের দায়িত্বও তার। চাকরির শুরুতে তারও নাকউঁচু স্বভাব ছিল। অনিয়মকে অবজ্ঞা করতে করতে একসময় তা গা-সওয়া হয়ে গেছে। সুলতান অধিক ক্ষুব্ধ হয়ে গেলে বুকের ভেতরের ভারটা হালকা করার জন্য ইসমাইল সাহেবের কাছে গিয়ে বোসে। ইসমাইল সাহেব বরাবর একই কথা বলে তাকে সান্ত্বনা দেন, ‘হজম করেন, হজম করে ফেলেন ইয়াংম্যান। কপালগুণে ভাল কিছু না জোটা পর্যন্ত এখানে নিজেকে মানিয়ে নেন। আর যাবেন কোথায়? সরকারি বলেন, বেসরকারি বলেন কোথাও ধোয়া তুলসী পাতা পাবেন না।’
সুলতান বলে, ‘কিন্তু আমার তো ভয় করে,স্যার। পরিবারের যেকোনো দুঃখ-কষ্টের জন্য আমার নিজেকেই দায়ী মনে হয়। আমার ছেলের অসুখ-বিসুখ হলেই মনে হয় আমার উপার্জনে খাদ আছে বলেই হয়তো এটা আল্লাহ-প্রদত্ত শাস্তি।’
ইসমাইল সাহেব বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানে খাদ আছে বটে, কিন্তু আপনার শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্ত বেতনে কোনো খাদ নেই – ব্যাপারটা এভাবে দেখেন না কেন? তাছাড়া আপনি বা আমরা কেউ তো ব্যক্তিগতভাবে ঘুষ-দুর্নীতির সাথে জড়িত নই। এই যে দেখেন, পে-রোলে রীতিমতো দুশো জনের নাম আছে, কিন্তু সব মিলিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মী-সংখ্যা কি একশো’র বেশি?’
সুলতান যতবারই তার অস্বস্তি নিয়ে ইসমাইল সাহেবের সাথে মত বিনিময় করতে এসেছে ততবারই ধোপে টিকতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিয়েছে। তবু তার এটুকু সান্ত্বনা যে ইসমাইল সাহেবও মানসিকভাবে একই ঘরানার লোক। সে বিষণ্ণভাবে বলে, ‘আমার ছেলেটার জন্য দোয়া করবেন, স্যার। বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লাগিয়েছে।’
ইসমাইল সাহেব বলেন, কোনো চিন্তা করবেন না, ইনশাল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এরপর কিছুটা রস সিঞ্চন করে বলেন, ‘আর বড়সাহেব চলে এলে তো জমজমের পানি, মদিনার খেজুরের ভাগ পাবেন; এসব পবিত্র জিনিস খেলে রোগবালাই সেরে যাবে।’
খোঁচাকথাটা যদিও বড়সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলা, ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় সুলতানের মন কিন্তু আগের মতোই বিষণ্ণ রয়ে যায়। বড়সাহেবের টুপি, জায়নামাজ, তসবীহদানা, আতর, সুরমা যে পবিত্র হবে একথা সুলতান কেন কেউই মানতে রাজি হবে না। আফজাল সাহেবের বৈভবের সাম্রাজ্য, জ্ঞাত-অজ্ঞাত অর্থের পাহাড়ের উৎস সম্বন্ধে সবাই পরিজ্ঞাত। এটা তো তার প্রথম নয়, আরও কয়েকবার তিনি ওমরাহ্ করেছেন। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মক্কা-মদিনার বিভিন্ন পবিত্র স্থানের ফজিলতের কথাও বলেছেন। তার বিবরণ কৃত্রিম আগ্রহ নিয়ে সবাই প্রাণভরে শুনেছেন।
আফজাল সাহেব নির্ধারিত সময়ের আরও পাঁচদিন পর দেশে ফিরেছেন। তিনি অবশ্য ইসমাইল সাহেবকে ফোনে জানিয়েছিলেন যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তার আগে দেখা হয়নি, সেগুলো দেখে তিনি ফিরবেন। ওসব জায়গার একটি হলো জ্বিনের পাহাড়। ওখানে গেলে নাকি পাহাড় সবকিছুকে তার নিজের দিকে টানতে থাকে। চাবি বন্ধ করে দিলেও নাকি গাড়ি আপনাআপনি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রাস্তার ওপর পানির বোতল রাখলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গড়িয়ে চলতে থাকে।
দোদুলের অবস্থার অবনতি হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর পরও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে রেহানা তার পিতাকে সাথে নিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়। সুলতান ইতিমধ্যে পাগলপারা হয়ে ভাল শিশু-ডাক্তারের খোঁজ করতে থাকলে ইসমাইল সাহেবই পরামর্শ দেন ছেলেকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া হলেও ওখানে ভাল ডাক্তার পাওয়া যাবে। তাছাড়া ইমার্জেন্সি সামাল দেবার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ওখানে আছে। অধস্তনদের হাতে রাখতে পারলে চিকিৎসা ভাল হবারই আশা করা যায়।
ডাক্তার দোদুলকে তাৎক্ষণিকভাবে আইসিইউতে ভর্তি করলে রেহানা ও সুলতানের মাথা ঘুরে যায়। তারা পাগলের মতো কান্নাকাটি আরম্ভ করে দেয়। রেহানার বাবা মেয়ে ও জামাইকে সামলাতে হিমশিম খান।
নাতির শারীরিক অবস্থার অবনতির কথা শুনে সুলতানের মা-ও নিজেকে গ্রামে আটকে রাখতে পারেননি। বউমার অনুপস্থিতিতে তিনিই ছেলের বাসা সামলাচ্ছেন। ঢাকায় আসার পথে স্থানীয় মাদ্রাসার বড় হুজুরের কাছ থেকে এক বোতল পানি-পড়া ও একটা তাবিজ নিয়ে এসেছেন। সুলতানের অবশ্য এসব বুজরুকিতে বিশ্বাস নেই। কিন্তু জলে-ডোবা মানুষ যেমন খড়কুটোকে পরম আশ্রয় হিসেবে আঁকড়ে ধরে তেমনি সে ছেলের মুমূর্ষু অবস্থায় যেকোনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে একপায়ে খাড়া। তাবিজ আর পড়াজল নিয়ে সে পাগলের মতো হাসপাতালে ছুটে গিয়েছে। কিন্তু ডাক্তারের বারণ থাকায় পানি তো খাওয়াতেই পারেনি, তাবিজটাও গলায় ঝুলাতে পারেনি। এখন সেই পানির বোতল আর তাবিজ হাতে নিয়ে রেহানা হাসপাতালের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।
রেহানা দু’দিন হয় বাসায় যায়নি। অনিদ্রায় তার চেহারা পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে। বাবা টানাটানি করে তাকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলেও সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বাবা বলেন, ‘মা রে, তুই শান্ত হ, আমার নাতি ভালা অইয়া যাইব। আর টেকাপয়সার লাইগা চিন্তা করিস না; আল্লাহ তোর বাপেরে কম দেয় নাই। নাতির চিকিৎসার লাইগা যত টেকা লাগে আমি দিমু।’
রেহানা বিলাপ করে বলতে থাকে, ‘আমি তোমার জামাইকে কতবার বলেছি – এই চাকরি ছেড়ে দাও, এই চাকরি কুফা। সে কি আমার কথা শোনে!’
রেহানার বাবা বলেন, ‘মা রে, আমি আমার জামাইরে চিনি; সে খুব ভালা মানুষ। বাইধ্য অইয়া এই চাকরি করতাছে। আচ্ছা যা, চিন্তা করিস না। আমি এই সমস্যার একটা সমাধান কইরা ফালামু ইনশাল্লা। এই চাকরি তার না করলেও চলবো।’
তীর্থভ্রমণের পর পূতপবিত্র আফজাল সাহেব প্রথম দিন অফিসে ঢুকে সবার সাথে কুশল বিনিময় করেন। একটি ব্যাগে করে তিনি সবার জন্য আজোয়া খেজুর নিয়ে এসেছেন। একে একে কর্মীরা তাকে এসে সালাম দিচ্ছে, আর তিনি তাদের ব্যাগ থেকে চার-পাঁচটা খেজুর তুলে নিতে বলছেন। সবাই চলে গেলে তিনি হঠাৎ ইসমাইল সাহেবকে তার দপ্তরে ডেকে পাঠান।
ইসমাইল সাহেব শঙ্কিত মনে এই ডাকেরই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আসন্ন জেরার মোকাবেলা কীভাবে করবেন সে চিন্তায় হতবুদ্ধি হয়ে আছেন। কপালে যা-ই থাক বস যখন ডেকেছেন তখন তো যেতেই হবে। তিনি আলতো পায়ে হেঁটে এসে ভীতিবিহ্বল হয়ে আফজাল সাহেবের সামনে দাঁড়ান।
আফজাল সাহেব চশমার কাঁচের ওপর দিয়ে চোখ গলিয়ে তাকান। ইসমাইল সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার অ্যাকাউন্টস অফিসার কোথায়? তাকে তো দেখলাম না।’
ইসমাইল সাহেবের বুকটা ধক করে ওঠে। তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, ‘তার ছেলেটা খুবই অসুস্থ, স্যার। সিরিয়াস নিউমোনিয়া।’
‘ও, তাহলে ছুটি দিয়েছেন।’ আফজাল সাহেব জিজ্ঞেস করেন, ‘খোঁজটোজ নিয়েছিলেন?’
ইসমাইল সাহেব বলেন, ‘ফোনে কথা হয়, স্যার। ওর ছেলেটা আইসিইউতে আছে।’
আফজাল সাহেব আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘তাহলে ওর কাজ কে দেখছে এখন? আর ও তো সব জায়গায় ফ্যাঁকড়া বাঁধায়।’
ইসমাইল সাহেব ত্রস্ততার সাথে জানান, ‘জব্বার; ওর অ্যাসিস্টেন্ট। আমি অবশ্য ক্লোজলি মনিটর করছি।’
‘নর্থ বেঙ্গল প্রজেক্টের বিলের সুরাহা হয়েছে তো?’, আফজাল সাহেব জানতে চান।
ইসমাইল সাহেব বলেন, ‘না না, ওটা নিয়ে আর কোনো ঝামেলা নেই, স্যার। সুলতান যাবার আগে ওটা ক্লিয়ার করে দিয়ে গেছে।’
প্রথম দফার বাক্যালাপ শেষ করে ইসমাইল সাহেব নিজের কক্ষে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। তিনি জানেন প্রথম দফা ভালোয় ভালোয় উতরে গেলেও, দ্বিতীয় দফা হবে একটা লঙ্কাকাণ্ড। তখন তার বোকাকান্ত আচরণে বড়সাহেব ধাতস্থ হবেন না।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মিনিট দশেক পরেই বড়সাহেবের জরুরি তলব আসে। ইসমাইল সাহেব মোটামুটি প্রস্তুতই ছিলেন। ডাক পেয়ে তিনি হন্তদন্ত হয়ে আফজাল সাহেবের দপ্তরে গিয়ে পৌঁছেন।
আফজাল সাহেব হাতে একটি কাগজ নিয়ে উত্তেজনায় চেয়ারে বসছিলেন আর দাঁড়াচ্ছিলেন। ইসমাইল সাহেবকে দেখে তার মুখের ওপর কাগজটি ছুঁড়ে দিয়ে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কী?’
ইসমাইল সাহেব বলার চেষ্টা করেন, ‘আমি স্যার……।’
‘আপনি কী?’ ইসমাইল সাহেবের কথা পূর্ণ হতে না দিয়ে দিয়ে আফজাল সাহেব ঝাল ঝাড়তে থাকেন, ‘আপনি এখানকার একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হয়ে আমার সাথে মশকরা করলেন?’
ইসমাইল সাহেব ঝড় থামাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলেন, ‘আমি বলতে চাইছি স্যার……।‘
‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’ আফজাল সাহেব থামতেই চাইছেন না, ‘আমি তো একটু আগে আপনার সাথে কথা বললাম, তখন তো বলেননি; এখন বলতে চাইবেন কেন?’
ইসমাইল সাহেবের সাহস সঞ্চয় করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিনি প্রায় জোর করেই বলেন, ‘স্যার আমি জানি জিনিসটা সেনসিটিভ; তাই আমি মুখে কিছু না বলে ফাইলের মধ্যেই তা পুট আপ করেছি। বিশ্বাস করেন স্যার, আমি সুলতানকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু আমি তাকে তার কথা থেকে একচুলও নড়াতে পারিনি। সে আর চাকরি করবে না। তাই আমি আপনার সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা করে ফাইলটা আপনার সামনে রেখেছি।’
আফজাল সাহেব রাগে গজগজ করতে করতে বলেন, ‘তাহলে যান। দায়িত্ব যখন আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন তখন দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান।’
ইসমাইল সাহেব বেরিয়ে গেলে বড়সাহেব সুলতানের পদত্যাগপত্রটি সবেগে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘মিস্টার ক্লিন!’ চেঁচানোর সাথে সমন্বয় রেখে তিনি তার গ্লাসটপ টেবিলে এক প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দেন। গ্লাসটি নির্ঘাত আস্ত থাকেনি। রক্তপাতের সম্ভাবনাও শতভাগ। এই বিস্ফোরণের পরও কেউ তার কক্ষে পা বাড়াবার সাহস করেনি।