বৈশাখের শেষে ভীষণ গরম পড়েছে ঢাকায়। দূরের জনপদে কয়েক দফা ঝড় শিলাবৃষ্টি হয়েছে প্রচণ্ডরকম। হাওর অঞ্চলে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে মানুষও মারা পড়েছে বেশ কয়েকজন। অথচ ঢাকা তাতাচ্ছে গরম তাওয়ায় সেঁকতে দেয়া রুটির মতো। ক্ষণিকের ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটা সহ্য করে মানুষ মূলত চাতকের মতো বৃষ্টির আশায় বসে আছে। কিন্তু যে কয় দফা এখানে ওখানে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা পড়েছে তা এই দূষিত নগরীর রাস্তা ভেজানোর জন্যও যথেষ্ট নয়। তাই গিজগিজে শহরের প্রাণীগুলো হাঁসফাঁস করেই চলেছে।
আবহাওয়াজনিত দুর্ভোগের বাইরেও ইব্রাহিমপুরের তিন কাঠা জমির ওপর বুরহান সাহেবের নিজের বানানো চারতলা দালানে ইদানীং যে ঝড় বইছে তা দাবদাহের চেয়েও মারাত্মক। পুরনো ধাঁচের দালানের নিচতলায় শুরু থেকেই বুরহান সাহেব থেকে আসছেন। নিচতলা বানানোর সময়ই পরিকল্পনা করে তিনি বাড়ির সামনের দিকে দুটো দোকানঘর বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন। তারপর সময় নিয়ে আস্তে আস্তে একটু একটু করে চারতলা সম্পূর্ণ করেছেন। আগে ওপরের তিনটি ফ্লোরই ভাড়া দেয়া ছিল। তবে সঙ্গত কারণে তৃতীয় ও চতুর্থ তলা মেয়েদেরকে দিয়ে দিলে শুধু দোতলাতেই এখন ভাড়াটে আছে।
যদিও ছেলে ফারহানের একটি কক্ষ পড়ে আছে বাসায়, বুরহান সাহেবকে এখন কিন্তু একাই থাকতে হচ্ছে। সেজন্য রেহানা তার ছয় বছরের ছেলে মাহীকে নানার সাথে ঘুমোতে পাঠায়। আর এমনিতেও মাহী ও মণি – মাহীর ছোটবোন – নানার খালি ঘরে খেলাধুলা করতে পছন্দ করেই, নানার তত্ত্বাবধানে লেখাপড়াও করে।
গত সন্ধ্যায় পুলিশ এসে হেনস্থা করে যাওয়ার পর থেকে বুরহান সাহেবের প্রেশার এক লাফে বেড়ে যায়। তখন রেহানা ওষুধপথ্য যা দেবার দিয়েছে সাথে একটা ঘুমের বড়িও খাইয়ে গিয়েছিল। তাই রোজকার মতো ভোরে টহলে এসে বাবাকে ঘুমোতে দেখে রেহানা চুপচাপ তার ফ্লোরে চলে যায়। সুলতানা রেহানার মতো ফুলটাইম গৃহিণী নয়। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করে – স্বামী সিটি কর্পোরেশনে, সুলতানা একটি প্রাইভেট ব্যাংকে। তবুও প্রতিদিন বেরিয়ে যাবার আগে সুলতানা বাপের সাথে দেখা করে যায়। আবার রাতে ঘুমোবার আগে আরেকবার বাবার খোঁজ নেয়। চাকরির কারণেই কি না বিয়ের দু’বছর হয়ে গেলেও সুলতানা বাচ্চা নেয়নি। এসব কারণে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই বাবার দেখভালের দায়িত্ব প্রায় পুরোটাই রেহানার ওপর। সুলতানা বিভিন্ন সময় নাশতা, ফলমূল নিয়ে এলেও বুরহান সাহেব রেহানার সাথেই খাওয়াদাওয়া করেন। অবশ্য জামাইরাও মাঝেমাঝে মাছ-মাংস বা অন্যান্য খাবারদাবার, যেমন, দই-মিষ্টি, বিস্কুট-পাউরুটি, ইত্যাদি কিনে আনে। তবে বাজার-সদাইয়ের কাজটা নিজে করতে বুরহান সাহেব খুবই আনন্দ পান। অর্থকড়ির সমস্যা না থাকায় একটু বেশি করেই সদাইপাতি নিয়ে আসেন যাতে করে ছোট মেয়ে সুলতানার প্রয়োজনটাও মিটে যায়। এরকম স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্য দিয়েই বুরহান সাহেবের পরিবার চলছিল। তবে চাঁদের কলঙ্ক তো থাকতেই হয়।
শিক্ষকের সন্তানরা ভাল পড়ুয়া হবে সাধারণভাবে এটাই আশা করা হয়। বিজ্ঞান ও অংকের শিক্ষক বুরহান সাহেবের মেয়েরা তত মেধাবী না হলেও একমাত্র ছেলে ফারহানই ছিল পরিবারের আশার আলো। ছেলে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ছাত্র থাকাকালে বুরহান সাহেবের ভাবসাবই অন্যরকম ছিল। তত নামীদামী স্কুলে শিক্ষকতা না করলেও অত্যন্ত ভাল শিক্ষক হিসেবে তাঁরও নামডাক ছিল। ঢাকার ডাকসাইটে লোকদের কাছে গৃহশিক্ষক হিসেবেও তাঁর যথেষ্ট কদর ছিল এবং এই অবসর কালেও আছে। এখনও তাঁকে গুলশান, ধানমণ্ডি, উত্তরার কয়েকটি পরিবারের অনুরোধের ঢেঁকি গিলে টিউশনির জন্য যেতে হয়। কেননা তাঁর পুরনো ছাত্ররা তাদের ছেলেমেয়েকে বুরহান স্যারের হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। তারা স্যারের জন্য নির্দিষ্ট দিনে গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আর সম্মানীর কথা স্যারকে কখনও তুলতে হয় না। ইব্রাহিমপুরের বাড়িটা আসলে টিউশনির বাড়তি আয় থেকেই করেছিলেন বুরহান সাহেব।
উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য একা বুরহান সাহেবই উৎকণ্ঠিত নন, তাঁর পুরো পরিবারই আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। সুলতানার স্বামী আনিস সেদিন বলেই ফেলেছে, ‘এখানে ফ্রি থেকে কাজ নেই; চল, আমরা অন্য এলাকায় বাসা ভাড়া নিই। নইলে আমাদেরকেও কখন পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।’ সুলতানা স্বামীর কথা শুনে কী বলবে; শুধুই চোখের জল ছেড়ে কেঁদেছে। মা তো চলেই গেছেন, বাবা আর কতদিন? ছেলেমেয়েদের নিয়ে একসাথে থাকবেন বলেই মোটামুটি পরিশ্রম করেই তিনি বাড়িটি বানিয়েছেন। আর তিনি মারা গেলে তো এমনিতেই তারা সবাই বাড়ির অংশীদার হবে। সে কাজটা তাদের বাবা জীবদ্দশায়ই এগিয়ে রেখেছেন: আপাতত ছেলে হিসেবে নিচের দুই ফ্লোর ফারহানই পাবে, তৃতীয় তলা রেহানার আর চতুর্থটি সুলতানার।
নাশতা রেডি করে রেহানা এসে বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। বুরহান সাহেবের চোখ দুটি একটু ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে। ঘুমের বড়ির শাসনে নিসাড়ভাবে যে সারারাত ঘুমিয়েছেন তা মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তারপর রেহানা ফারহানের কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। খালি কক্ষে শোবার খাট, দুটি চেয়ার, একটি টেবিল, টেবিলের ওপর একটি ল্যাপটপ, একটি সেগুন কাঠের কাবার্ড, বিছানার পাশের ছোট টেবিলের ওপর তেল, লোশন, ক্রিম, চিরুনি ব্রাশ পারফিউম, ইত্যাদি অগোছালোভাবে পড়ে আছে। ছোট টেবিলটির সোজা উপরে দেয়ালে বড় একটি ধুলোপড়া আয়না এবং উল্টোদিকের দেয়ালে তাদের মা’সহ একটি পারিবারিক ছবি টাঙানো আছে। এসব দেখে রেহানা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এক সময়কার ক্যাডেট কলেজের ছাত্র তার প্রিয় পিঠোপিঠি ছোটভাই আজকে যে পর্যায়ে এসেছে এটা ভাবতে গেলেই গায়ে কাঁটা দেয়। ছোটনের কথা যদি সত্য হয় তবে সামনে যে ঘোর বিপদ তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
গতরাতে শোবার আগে ফারহানের বন্ধু ছোটন চুপিচুপি রেহানার সাথে দেখা করতে এসেছিল। সে রাখঢাক না করেই তার শঙ্কার কথা রেহানাকে জানিয়েছে। সে বলেছে, ‘আপা, তুমি তো জানোই আমরা বন্ধুরা কম চেষ্টা করিনি। কিন্তু লাভ হয়নি। সে যে কোথায় কোথায় কার সাথে মিশে ইয়াবার সাথে জড়িয়ে পড়ল…আর এখন তো আইস না কি জানি আরেকটা নেশা করে।’
রেহানা বলে, ‘তুই তো জানিস ভাই, আমরা কি কম যুদ্ধ করেছি তার সাথে। তার কথা চিন্তা করতে করতে মা-ই মারা গেলেন; বাবাও কখন যে টুপ করে চলে যান।’
ছোটন গলার স্বর নিচু করে বলে, ‘এখন তো সমস্যা মনে হয় অনেক বড়।’তারপর আশেপাশে তাকিয়ে সাবধান হয়ে বলে, ‘পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, এখন ডিজিটাল যুগ, কয়দিন আর লুকিয়ে থাকতে পারবে? শুনেছি সে নাকি কক্সবাজারের ড্রাগ ট্রাফিকারদের সাথে যোগ দিয়েছে।’
ছোটনের কথা শুনে রেহানার বুকটা ধক করে ওঠে। সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ‘পুলিশ বাবাকে যেভাবে ধমকিয়েছে…কী যে লজ্জার কথা…বাবা একজন সম্মানিত শিক্ষক…।’ রেহানা আর কিছু বলতে পারে না, শুধু চোখ মোছে। আসলে ছেলের কারণে বুরহান সাহেবকে পুলিশের এ কথাও শুনতে হয়েছে: কী শিক্ষকতা করলেন, নিজের ছেলেকে মানুষ বানাতে পারলেন না। ওকে তাড়াতাড়ি থানায় হাজির করান, নইলে তো আপনাদেরই থানা-হাজত করতে হবে।
বুরহান সাহেব নিজেকে হালকা করার জন্য এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের আশায় বেশ ক’বার মেয়ে, জামাইদের নিয়ে বসেছেন। সবাই যার যার মত ব্যক্ত করেছে। ছোটবোনের স্বামী হিসেবে আনিস বেশি কিছু না বললেও রেহানার স্বামী ফরহাদ অনেক কথাই বলেছে। সে বলেছে, ‘আব্বা, ও তো রিহ্যাবে যেতে চায় না, ওকে যদি ফোর্স করে কিছুদিন আটকিয়ে ট্রিটমেন্ট করা যেত তবে একটি রিজাল্ট পাওয়া যেত।’
বুরহান সাহেব মাথা নাড়তে নাড়তে বলেছেন, ‘ফোর্স কীভাবে করব বল। পুলিশের কাছে গেলে তো আঠার ঘা।’
তখন রেহানা বলেছে, ‘পুলিশের কাছে না গিয়ে, আব্বু, যদি আপনার কোনো ছাত্রের সহযোগিতা নিতে পারতেন; আপনিই তো বলেন ওরা বড় বড় অফিসার, জজ-ব্যারিষ্টার; আর্মিতেও আছে কেউ কেউ।’
বুরহান সাহেব আবারও অসহায়ের মতো বলেছেন, ‘নারে মা, এমন পচা বিষয় নিয়ে ওদের সাথে কথা বললে আমার মান-সম্মান থাকবে না।’
একেক জনের দুর্ভাগ্য একেক রকম হয়। বুরহান সাহেবের দুর্ভাগ্য তাঁর ছেলে। দশম শ্রেণীতে উঠতে না উঠতেই ডিসিপ্লিন ভঙ্গের কারণে তাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে বের করে দেয়া হয়। সেই থেকে পতনের শুরু। অনেক ঝক্কি ঝামেলা করে এক বছর বিরতি দিয়ে ঢাকা থেকে তাকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পাশ করলে কী হবে; জিপিএ-৫ সে ছুঁতে পারেনি। আশাহত হলেও বুরহান সাহেব চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু তেমন লাভ হয়নি। এইচএসসির ফলও আশানুরূপ না হওয়ায় বুরহান সাহেব বাধ্য হয়ে ছেলেকে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেন। অনেক ঠেলাধাক্কার পর বিবিএ করলেও ছেলেকে আর মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে তিনি রক্ষা করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ওঝার ছেলে বনগরুই হলো।
আজ বিকেলে গুলশানের দুইটি বাসায় টিউশনিতে যাওয়ার কথা বুরহান সাহেবের। কিন্তু গত সন্ধ্যার ধকলে একেবারে কাবু হয়ে পড়েছেন তিনি। যানবাহনের তো ঝামেলা নেই, কিন্তু গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করবেন কীভাবে? নাশতার টেবিলে বসে তাই তিনি তাদের ফোন করে জানিয়ে দেন যে তার শরীরটা ভাল নয়, আজকে যেতে পারবেন না। তবে এটাও বলে দেন যে এই সেশনটা তিনি অন্যদিন পুষিয়ে দেবেন। সুলতানা ও তার স্বামী অফিসে যাওয়ার পথে বাবার খোঁজ নিয়ে গেছে। তারাও বাবাকে টিউশনিতে যেতে বারণ করেছে।
রেহানা ভোর থেকে অনেকবার ফারহানের নম্বরে ফোন করেছে। কিন্তু ও তো ফোন বন্ধ করে রেখেছে। ছোটনের কথা শোনার পর থেকে রেহানা ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। সত্যি যদি ফারহান ড্রাগ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে থাকে তবে তার পরিণতি কী হতে পারে সেকথা চিন্তা করলেই তার মাথা ঘুরে যায়। এধরণের অনেক ক্রিমিনাল গুম হয়েছে, ক্রসফায়ারে পড়ে মরেছে। মা মারা যাওয়ার আগে রেহানার হাতেই ফারহানের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। মা বলতেন, ‘মা’রে, ওকে সর্বনাশের পথ থেকে ফেরা। ও তো শুনেছি নেশা ধরেছে।’ মা বেঁচে থাকলে দেখতেন তাঁর ছেলে এখন নেশার সম্রাট বনে গেছে।
ছেলের অবস্থা যখন দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল বুরহান সাহেব তাকে বলেছিলেন, ‘ভাড়াটে তুলে দিই, দোকান দুইটি তুই চালা – একটাতে ইলেক্ট্রনিক্স গুডস তুলে দেব, অন্যটি ফার্মেসী।’ মেয়ে, জামাই সবাই তাঁর কথায় সায় দিয়েছিল। কিন্তু না, তাতে সে রাজি হয়নি। অথচ নেশা করার জন্য ওসব দোকান থেকেই সে টাকা নিয়ে যায়; দোকান ভাড়ার সাথে পরে তা সমন্বয় করা হয়।
ফারহান ফোন ধরছে না বলে রেহানা বাধ্য হয়েই ছোটনের কাছে ফোন করে। ছোটনকে খুব প্রেশারের মধ্যে থাকতে হয়। সে একটি স্টুডেন্ট কনসাল্টিং ফার্মে চাকরি করে। সে রেহানাকে জানায় যে সে-ও অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু ফারহানকে ফোনে পায়নি। তবে সব সত্যি কথা তো প্রকাশ করা যায় না। ছোটন বেশ কিছুদিন আগেই নিরাপত্তার জন্য ছোটনের নম্বরটা তার ফোনের কন্ট্যাক্ট থেকে মুছে ফেলেছে। তাছাড়া ফারহানও ইদানীং তাকে ফোনটোন করত না। অথচ ছোটবেলা থেকেই ওদের গলায় গলায় ভাব ছিল।
বুরহান সাহেব সারাদিন বাসা থেকে বের হননি। তিনি অবসর নেবার পর থেকে ধর্মকর্মে মোটামুটি মনোযোগ দিয়েছিলেন। বাসায় থাকলে মসজিদে গিয়েই নামাজ পড়েন। গত দুই তিনদিন তিনি মসজিদেই যাননি। মাহী-মণি দুয়েকবার নিচতলায় নেমেছে ঠিকই। কিন্তু বেশি হৈচৈ করেনি। মা বলে দিয়েছে, ‘নানার শরীর খারাপ, খবরদার চিৎকার চেঁচামেচি করবে না।’ তবুও তারা নানার কাছে গিয়েছে। বুরহান সাহেব নাতি-নাতনিকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছেন। পড়তে বসার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু তারা আর নিচে পড়তে বসেনি।
সন্ধ্যায় পাশের বাসার জহির সাহেব এসে হাজির। এমনিতেই মাঝেমধ্যে জহির সাহেব বুরহান সাহেবের বাসায় এসে চা-নাশতা খান, গল্পগুজব করেন। কিন্তু আজ বুরহান সাহেব কারুর সাথেই দেখা করার জন্য প্রস্তুত নন। পুলিশ এসে বাসায় হানা দিয়েছে এখবর মহল্লার কারও অজানা থাকেনি। পরিচিতজনের প্রশ্নের উত্তর কী দেবেন সে লজ্জায়ই তিনি চুপসে আছেন।
জহির সাহেব জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাইজান কেমন আছেন? দুই তিনদিন আপনার সাথে দেখাসাক্ষাৎ নাই। ভাবলাম একটু খোঁজ নিয়ে যাই।’
পাশের বাসার প্রতিবেশী হয়ে জহির সাহেব পুলিশের আসার খবর জানবেন না এটা হতেই পারে না। তাছাড়া ফারহানের বখে যাওয়ার খবর তো প্রায় সবাই-ই জানে। বুরহান সাহেবকে কিছু একটা বলতে হবে বলেই তিনি উত্তর দেন, ‘শরীরটা তেমন ভাল যাচ্ছে না। প্রেশারটা বেড়ে গেছে।’
জহির সাহেব বলেন, ‘না না, তাহলে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, ঘরেই থাকুন, রেস্ট নেন। আজ তাহলে আর বসব না। প্রয়োজন হলে খবর দিয়েন।’
বুরহান সাহেব বলেন, ‘চা খেয়ে যান, আমিও খাব। এইতো এখনই ওরা চা নিয়ে আসবে।’
চা-নাশতা খেতে খেতে দুজন টুকটাক কথাবার্তা বলেন। কিন্তু আলাপের মধ্যে ঘুণাক্ষরেও ফারহানের প্রসঙ্গ ওঠে না। চা খেয়ে জহির সাহেব চলে যান।
কয়েকদিন আগে আনিস বিরক্ত হয়ে সুলতানাকে বলেছিল, ‘তোমার ভাইকে বিয়ে করিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে; কোথাও ছ্যাকাট্যাকা খেয়েই হয়তো এমন হয়েছে।’
সুলতানা বলেছে, ‘ধুর, ভাইয়াকে কখনও এসবে দেখিনি; হলে ভালই হতো। ওর তো মাথায় গোল বেঁধেছে ওকে ক্যাডেট কলেজ থেকে রাস্টিকেট করার পর।’
আনিস বলেছে, ‘তার এই আচরণের জন্য আমার লজ্জা লাগে; পাড়ার ভেতরে ঢুকলেই নিজেকে চোর চোর মনে হয়।’
স্বামীর কথা শুনে সুলতানার কষ্ট হয়। তার ভাইকে নিয়ে সবার গর্ব করার কথা ছিল, অথচ আজ সে নর্দমার কীট হয়ে পড়েছে। স্বামী-দুলাভাই তাকে নিয়ে যা তা কথা বলে। সংসারের পরিপালনের সার্বিক বোঝা বড়বোনের ওপর থাকলেও সুলতানাও মানসিক চাপ এড়াতে পারে না। সেও লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। তাছাড়া স্বামী বললেও বাবার এই দুঃসময়ে সে অন্যত্র যেতে চায় না।
থমথমে অবস্থায় তিনদিন চলে গেলেও ফারহানের হদিশ না পেয়ে বাসার সবাই বেচইন হয়ে পড়েছে। বুরহান সাহেব এ কদিন একবারের জন্যও বাসা থেকে বের হননি। ধানমণ্ডি ও লালমাটিয়ায় দুইটি টিউশনিতে তাঁর যাওয়া একান্ত জরুরি ছিল; কারণ এসএসসির এই স্টুডেন্ট দুটির সামনে পরীক্ষা। কিন্তু বুরহান সাহেব অনন্যোপায় হয়ে ওদেরকেও তাঁর সাময়িক অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। একবার ভেবেছিলেন ফারহানের খোঁজ পেলে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র লে. কর্নেল শিহাবের কাছে তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবেন, যদি তার ধমকে কোনো কাজ হয়। কিন্তু ছেলের গতিবিধিই তো তিনি আঁচ করতে পারছেন না।
রাত বারোটার দিকে হঠাৎ রেহানার ফোন বেজে ওঠে। রাতের বেলায় সাধারণত তারা ফোন মিউট করে ঘুমায়; কারণ ফরহাদের একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর সারারাত চোখে ঘুম আসে না। কিন্তু ফারহানের অন্তর্ধানের পর থেকে রেহানা ফোনের রিং বন্ধ রাখলেও ভাইব্রেশন অন করে ফোনটি বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমায়। এই কঠিন সময়ে কখন কে জরুরি ফোন করে বসে, তাই।
ফোনটি হাতে নিয়ে সে চুপি চুপি ড্রইং রুমের দিকে চলে যায়। স্ক্রিনে ফারহানের নাম দেখেই তার হার্টবিট বেড়ে যায়। রেহানা উদ্ভ্রান্তের মতো জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কোথায়?’
ফারহান নিচুকণ্ঠে বলে, ‘আপু চুপ করে শোনো, আমার খুব বিপদ, আব্বুকে দেখে রাখবা। আর ফোন করতে পারব কি না জানিনা।’
রেহানা আবার অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই এখন কোথায় আছিস বল।’
ফারহান বলে, ‘বলা যাবে না; আমার কল মনিটর হচ্ছে।’ বলেই, লাইন কেটে দেয় সে।
রেহানা হাত-পা ছেড়ে সোফায় বসে পড়ে। ফারহানের সাথে কথা বলে সে শোকে পাথর হয়ে যায়। তার চোখ দিয়ে পানি আসছে না। অথচ এখন তার হাউমাউ করে বাড়ি মাথায় তোলার কথা। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেলেও সে উঠে গিয়ে টেবিল থেকে পানি খেতে পারছে না। এ খবরটা সে তার বাবাকে জানাবে কীভাবে এই ভাবনায় সে দিশেহারা। এ কদিনের রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে বাবার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা সংকটজনক হয়ে পড়েছে।
সোফায় বসতে বসতে কখন যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল তা বুঝতে পারেনি রেহানা। হঠাৎ ফজরের আজান শুনে সে ধড়ফড়িয়ে উঠে ডাইনিং টেবিলের দিকে ছুটে যায়। তারপর ঢকঢক করে দু’গ্লাস পানি খেয়ে নিঃশব্দে বিছানায় গিয়ে ফরহাদের পাশে শুয়ে পড়ে।
শুয়ে পড়লে কী হবে, ঘুম তো আসার কথা না। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে হবে; ফরহাদও বেরিয়ে যাবে বাচ্চাদের সাথে। আসমারও আসার সময় হয়ে গেছে। সাধারণত আসমা এসে বেল বাজালেই রেহানা ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দেয়। আজ সে আসমা আসার আগেই বিছানা ছাড়ে। আলুথালু বেশে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচতলায় যায়। মাহী আর বুরহান সাহেব এখনও ঘুমের ঘোরে। স্বাভাবিক সময়ে বুরহান সাহেব এভাবে ঘুমান না। শরীর ভাল থাকলে মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বাসায় ফেরেন। আর ঘরে নামাজ পড়লেও বারান্দায় বসে তসবিহ গুনেন নয়তো নুরানি ওজিফা হাতে নিয়ে দুয়েকটা সুরা-কালাম পড়েন।
ইতিমধ্যে আসমা এসে মূল ফটকে টোকা দিলে রেহানাই গেট খুলে দেয়। বুরহান সাহেব অসুস্থ না হলে তিনিই সকাল বেলায় গেট খোলা রাখতেন। এ ক’দিন ধরে মাহীকেই গেট খোলার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আসমা আসলে অন্য কোনো বাড়িতে কাজ না করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু বুরহান সাহেব ও তাঁর মেয়েদের বাসার সব ধরণের কাজ করে। সকাল-দুপুর তো আছেই, একটু বেশি সময় থাকা পড়লে রাতের খাবারও তার জন্য বরাদ্দ। তবে বাড়ির নিরাপত্তা ও অন্যান্য দিক বিবেচনা করে বুরহান সাহেব তাঁর একমাত্র ভাড়াটের অনুরোধ ফেলতে পারেননি। আসমাকে প্রতিদিন কিছুক্ষণের জন্য ছেড়ে দিতে হয়। ভাড়াটের কিছু বাঁধা কাজ সে করে দেয় এবং বাড়তি কিছু পয়সা পায়।
রেহানাকে গেট খুলতে দেখে আসমা চমকে যায়। রেহানাদের পরিবারের সাম্প্রতিক ঘটনা সম্বন্ধে সে পুরো ওয়াকিবহাল। সে কয়েক বছর ধরে বুরহান সাহেবের বাসায় কাজ করছে। তাই এই পরিবারের জন্য তার একটা মায়া পড়ে গেছে। সে রেহানার বিষণ্ণ চেহারার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাইয়ার কোনো খবর পাইছেন আপা?’
রেহানা একটু সময় দম ধরে রেখে বলে, ‘না। এখনও পাওয়া যায়নি।’
আসমা সমবেদনা জানায়, ‘আহারে, আল্লাহ্!’ তারপর আস্তে করে বলে, ‘আমি কি উপরে যামু, আপা?’
রেহানা বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যাও। আমি আসছি।’
রেহানার সময় ফুরোচ্ছে না। ফারহানের ফোনের কথা সে কাউকে বলতে পারেনি, সুলতানাকেও না। সে জানে বাবাকে বলা মানে আরেকটি বড় ঝুঁকির মুখে পড়া। স্বামী ছেলে-মেয়েকে বিদায় দিয়ে সে ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়েও পড়ে।
সাড়ে দশটার সময় হঠাৎ ছোটনের ফোন পেয়ে রেহানা লাফ দিয়ে উঠে বসে। রেহানা হেলো বলার আগেই ছোটন দ্রুতলয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপা কেমন আছ? খালু কেমন আছেন?’
রেহানা পাগলের মতো বলে, ‘ভাল। কোনো খবর পেলি ভাই?’
ছোটন একটু ইতস্তত করে বলে, ‘না, এখনও যোগাযোগ করতে পারিনি। তবে চেষ্টা করছি আপা। কোনো খবর পেলেই জানাব।’ বলেই, সে লাইন কেটে দেয়।
রেহানার সাথে কথা বলার পর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ছোটন সিএনজি অটোরিকশায় বসিলা ব্রিজের দিকে ছোটে। সে মনে মনে দোয়া করতে থাকে – আল্লাহ, ওদের মধ্যে সে যেন না থাকে। খবরটা এতক্ষণে প্রেসে গিয়েছে কিনা কে জানে। তবে সে তার এক সহকর্মীর মুখে শুনেছে বসিলা ব্রিজের গোড়ায় পুলিশ এনকাউন্টারে দুজন ড্রাগ চোরাচালানকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।
ব্রিজের সামান্য দূরে অটোরিকশা থেকে নেমে ছোটন সামনের দিকে হেঁটে যায়। কোথাও সে পুলিশ কিংবা মানুষের বড় জটলা দেখতে পায় না, তবে এলাকায় একটা থমথমে ভাব লক্ষ করে। আরেকটু এগিয়ে গেলে একটা চায়ের দোকানের সামনে একটি ছোট জটলা দেখতে পায়। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সে কান খাড়া করে এবং বুঝতে পারে ঘটনা সত্য। কাঁপা হাতে কাপ নিয়ে সে আস্তে আস্তে চায়ে চুমুক দেয় এবং কাউকে কিছু না জিজ্ঞেস করেই লাশের অবস্থান জানার চেষ্টা করে। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে একজনও প্রত্যক্ষদর্শী নেই, তবে দুজন বলছে যে পুলিশ লাশ দুটি গাড়িতে তুলে নেয়ার সময় যে রিকশাওয়ালা দেখেছিল তারা তার কাছ থেকে শুনেছে। পুলিশ লাশ দুটি নাকি বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উঠিয়ে গাড়িতে তুলেছিল। উপস্থিত অন্য একজন জিজ্ঞেস করল, ‘লাশ কই লইয়া গেছে?’ আরেকজন তখন বলে উঠল, ‘কই নিব আবার – মেডিকেলে। ডাক্তারের সার্টিফিকেট লাগব না?’
ছোটন আর স্থির থাকতে পারে না। লাশ না দেখা পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। এমনও তো হতে পারে সে যা সন্দেহ করছে তা সত্য নয়; লাশ দুটির মধ্যে ফারহান হয়তো নেই। সে চায়ের দাম চুকিয়ে দিয়ে আরেকটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
যানজটের কারণে হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় একঘণ্টা সময় লেগে যায়। হাসপাতালে নেমে ছোটন দিশাহীনভাবে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। আগে হয়তো একবার অথবা দুইবার সে ঢাকা মেডিকেলে এসেছিল; তা-ও রুগি দেখতে। আজকে আসার বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় সে কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না।
এভাবে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ায়। সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে দেখতে পায় বুরহান সাহেব চোখ মুছতে মুছতে দুজন পুলিশের সাথে কথা বলছেন। ছোটন আর কিছু বুঝার চেষ্টা না করে বুরহান সাহেবকে ঝাপটে ধরে বলে, ‘খালু, আপনার শরীর খারাপ নাকি, হাসপাতালে কেন, আর একা?’
বুরহান সাহেব ছোটনকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন কিন্তু কিছুই বলেন না। তাঁর পকেটে রাখা ফোন অনবরত বেজেই চলেছে, কিন্তু তিনি ধরছেন না।
ছোটনের বুঝতে বাকি থাকে না যে তার আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছে। সে-ও কোনো কথা না বলে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।
‘যান, ফর্মালিটি শেষ করুন।’ পুলিশের কথায় বুরহান সাহেব সম্বিৎ ফিরে পান।
ছোটন আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার শরীর তো খারাপ; সাথে কেউ আসেনি?’
বুরহান সাহেব চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘পুলিশের ফোন পেয়ে আমি লুকিয়ে চলে এসেছি, কাউকে বলিনি।’
‘হায় হায়! ওরা তো আপনার চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে।’ বলে, ছোটন তার পকেট থেকে ফোন বের করে।
বুরহান সাহেব আবার ছোটনকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘পচা হোক, গলা হোক ও তো আমারই সন্তান। ওর ভার শেষবেলা পর্যন্ত আমাকেই বইতে হবে।’ বুরহান সাহেবের অশ্রুধারা ছোটনের গ্রীবা গড়িয়ে বুকের ওপর গিয়ে জমা হতে থাকে।