মফস্বলের গৃহশিক্ষক

ভালবাসায় গল্পের শুরু (ফেব্রুয়ারী ২০২৩)

Jamal Uddin Ahmed
  • ১০
  • 0
  • ২৫
জামাল উদ্দিন আহমদ

‘বুঝলে, ঘর থেকে বেরোনোর সময় এই দোয়া পড়লে আর কোনো চিন্তা নেই; যেখানেই যাও, ঘোরো ফেরো, কোনো চিন্তা নেই। নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরে আসবে।’

‘কিন্তু, মনে রাখতে পারিনা, দাদা।’

‘মনে রাখতে পার না? গ্রাম-গঞ্জের মুক্ত হাওয়া-বাতাসে ঘুরে ফ্রেশ খাওয়া দাওয়া করে ব্রেইনতো আরও বেশি অ্যাকটিভ হবার কথা। এই ছোট-ছোট দোয়া-কালাম মনে রাখতে পারনা; কী বলছ?’

‘আচ্ছা, দোয়াটা আবার বলেন দাদা।’

‘বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ। আর গাড়িতে যখন উঠবে…’

‘দাঁড়ান, এইটা মুখস্থ করে নিই– বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ।’

ফাহমিদ এখন বেরুবে। সবজি-ভাজি, সেঁকা-রুটি এবং একটা ডিম পোচ দিয়ে সে নাশতা সেরেছে। দাদা কিন্তু এখনও নাশতা করেন নি। তিনি ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে যাবার সময় একচিমটি কালজিরা চিবিয়ে এক ঢোক পানি খেয়েছেন। আগে অল্প মধু সাথে খেলেও এখন ডায়াবেটিসের ভয়ে এড়িয়ে চলেন। নামাজ সেরে এক ঘণ্টা মিরপুর রোড এবং ক্রিসেন্ট লেক এলাকায় পায়চারি করে তবেই বাসায় ফিরেছেন। স্যার সৈয়দ আহমদ রোড থেকে ক্রিসেন্ট লেক, মানিকমিয়া এভিন্যু খুব বেশি দূরে নয়। এখন গ্লাস ভর্তি ত্রিফলা-ভেজানো পানি ঢকঢক করে গিলে বিছানায় একটু গড়া গড়ি দিচ্ছেন। এটা তাঁর দৈনিক রুটিন।

বিন্তি উটকো ঝামেলার জন্য দৃশ্যত কিছুটা বিরক্ত। তারও পর দাদার আদিখ্যেতা। ছেলেটা মাথায় টেনশন নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। তিনি এখন হুজুরদের মতো তাকে দোয়া-কালাম শেখাচ্ছেন। বিন্তি এই গায়ে পড়া দার্‌সে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য দাদার কক্ষে মাথা বাড়ায়। দাদা তাকে বলেন, ‘কী রে আপু, কিছু বলবি?’

বিন্তি দাদার মতামতের তোয়াক্কা না করে সরাসরি বলে, ‘চলেন, নাশতা খাব; আমিও খাই নি।’

‘আলবৎ! দাঁড়া, এই ছোকরাটাকে একটু দোয়া-দরুদ শিখিয়ে দিচ্ছি। আজ তো ওর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা। ’তারপর বিন্তিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, তোকে যে গাড়িতে চড়ার দোয়া শিখিয়েছিলাম, মনে আছে?’

ফাহমিদ এই সুযোগে একটি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে, ‘দাদা, দোয়া করবেন। আমি চললাম।’

দাদা বলেন, ‘সাবধানে যাবে কিন্তু; রাস্তা ঘাটের যা অবস্থা।’

বিন্তি দাদার হাত ধরে টান দিয়ে বলে, ‘চলেন, চলেন। ও খোকা বাবু নাকি যে রাস্তা ঘাটে চলতে পারবে না।’

দাদা বিন্তির মুখের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলেন, ‘আরে বুঝিসনা ও একটা মফস্বলের ছেলে। ঢাকার সব কিছু কি চেনে?’

খাবার টেবিলে বসতে বসতে বিন্তি বলে, ‘এক সপ্তাহ তো হয়ে গেল। শুনলাম আপনার বন্ধুর নাতি জাহাঙ্গীরনগর সহ ঢাকা-গাজী পুরের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই তবে যাবে।’

‘তোকে কে বলল?’

বিন্তি বলে, ‘সে-ই বলেছে। সে দিন নাশতার টেবিলে আব্বু জিজ্ঞেস করেছিল।’

দাদু হন্তদন্ত হয়ে তখন ছেলের খোঁজ করেন, ‘ও, আব্বু কোথায় রে? চলে গেছে?’

‘আব্বু আর কায়েস এক সাথে বেরিয়ে গেছে’, বিন্তি জবাব দেয়।

কায়েস এবার দশম শ্রেণিতে উঠেছে। বিন্তির বাবা আশফাক প্রায়ই ছেলেকে তার সেকেন্ড হ্যান্ড কারে করে স্কুল গেটে নামিয়ে দিয়ে তারপর কর্মস্থলের দিকে যান। আগে বিন্তিকেও তার স্কুলে ছেড়ে দিয়ে যেতেন, তবে বিন্তি এবার কলেজ-পড়ুয়া হয়ে গেলে সে তার মতো করে বান্ধবীর সাথে বা একাই চলে যেতে পারে।


আশরাফ সাহেব অর্থাৎ বিন্তির দাদা শেষ পর্যন্ত এস পি হয়ে রিটায়ার করেছিলেন। স্বাধীনতা-যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি রংপুরে দারোগা ছিলেন। কনে দেখা দেখি শেষ হবার পর তাঁর বিয়ের তারিখটা শুধু চূড়ান্ত করা বাকি ছিল। এমতাবস্থায় যুদ্ধের দামা মা বেজে উঠলে তিনি পালিয়ে ভারতে চলে যান এবং যুদ্ধের পুরো সময় ছয় নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। দুঃখজনক ভাবে ওই কনের সাথে তাঁর আর গাঁটছড়া বাঁধা হয়নি। কারণ কনের অভিভাবকরা আসন্ন দুর্যোগের আগেই তাদের মেয়েকে পাত্রস্থ করতে চেয়েছিল। তারা আশরাফ সাহেবের পালানোর খবর জানতে পেরেই দ্বিতীয় পছন্দের পাত্রের হাতেই তড়িঘড়ি করে তাদের মেয়েকে তুলে দিয়েছিল। দাদী মারা যাবার আগে গল্পচ্ছলে এসব কথা বলতেন; তাই বিন্তিরও এই গল্প জানা আছে। বিন্তি অবশ্য তখন কিছু বলার মতো বড় না হয়ে উঠলেও তার অন্য তুতোবোনেরা দাদিকে মজা করে বলতো, ‘তাহলে তো আপনি হলেন, দাদি বাই চান্স।’

নাশতা খেতে খেতে দাদা বলেন, ‘জানিস, ওর দাদা না খুব সাহসী যোদ্ধা ছিল। আমার খোঁজে রংপুর গিয়ে যখন দেখল আমি বুড়িমারি পাড়ি দিয়ে ওই পারে চলে গিয়েছি…’

‘…তখন সে-ও ভারতে গিয়ে আপনাকে খুঁজে বের করে।’ বিন্তি দাদার বক্তব্যের বাকি অংশটুকু পূরণ করে দিয়ে বলে,’এ কথা অনেকবার বলেছেন, দাদা।’

‘ও, তাই নাকি? ’দাদা তখন বলেন, ‘মনে আছে, গ্রামে বেড়াতে গেলেই আকবর ছুটে আসত?’

বিন্তি বলে, ‘হ্যাঁ, আপনি বলেছেন, দাদা। কিন্তু আমার মনে নেই, ছোট ছিলাম। আর আমরা কয় বারই বা গ্রামে গিয়েছি।’

দাদা বলেন, ‘তা ঠিক। তবে ও তো ইউপি চেয়ারম্যান ছিল। বিভিন্ন কাজে ঢাকায় এলে আমাদের বাসায় উঠত; মনে পড়ে?’

বিন্তি হেসে দেয়, ‘দাদা, আপনার বন্ধু পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। এর আগে তিনি যদি ঢাকায় আসেনও তখন তো আমরা পিচ্চি ছিলাম।’

টেবিল থেকে উঠতে উঠতে আশরাফ সাহেব বৌমার খোঁজ নেন। বিন্তি জানায়, কোমর ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে আম্মু বিছানায় শুয়ে আছেন। রক্ষে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাহেলার মা বাসার সব কিছু সামলায়। বিন্তির আম্মু মূলত রান্না বান্নারএকটু তদারকি করেন। চলাফেরা ওঠাবসায় ডাক্তারের অনেক বিধি-নিষেধ আছে।

আশরাফ সাহেব তখন বিন্তিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, ওই টোটকাটা পরীক্ষা করে ছিলি?’

‘কোন টোটকা?’

দাদা বলেন, ‘এইতো, ভুলে গেছিস। বলেছিলাম না, তুই নিজ হাতে করবি। গরম পানিতে আদা কুচি ভাল ভাবে সিদ্ধ করে যখন পানির রং লালচে হবে…।’

‘…মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। কিন্তু ওটা করা হয়নি, দাদা।’ সে দাদাকে নিশ্চিত করে, ‘আমি চেষ্টা করব।’

‘আর দোয়াটা? ’দাদা বিন্তিকে স্মরণ করান, ‘ওই যে হাদিসের দোয়াটা লিখে নিলি; ব্যথার জায়গায় হাত রেখে সাতবার পড়তে হয়?’

বিন্তি মুশকিলে পড়ে যায়। আসলে তার মা আদা সেদ্ধ জলের চিকিৎসার কথা ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। তারকথা, ‘দেশের বাঘা বাঘা ডাক্তাররাই কিছু করতে পারছে না, আর তোরা আছিস আদাজল নিয়ে।’ এ কথাতো দাদাকে বলা যায়না। আর দোয়া সে কোথায় লিখে রেখেছে তার মনে নেই। দোয়াটা মুখস্থ করতে পারলে অবশ্য আম্মুর ব্যথার জায়গায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সেফু দিতে পারত। বিন্তি পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে, ‘আজকেই ঝাড় ফুঁকের কাজ হয়ে যাবে, দাদা। ওই কাগজটা খুঁজে না পেলে আপনার কাছ থেকে আবার লিখে নেব।’


আশফাক একটু আগে আগেই বাসায় ফিরে এসেছেন। মাঝে মধ্যে তিনি সন্ধ্যার পর পরই চলে আসেন। তিনিতো চাকরি করেন না; পেশায় ব্যবসায়ী। তিন বন্ধুমনা পার্টনার মিলে একটি মাঝারি-মাপের গার্মেন্টস কারখানা দিয়েছেন। নিজেরা সরাসরি রপ্তানি করেন না, তবে বড় রপ্তানিকারকদের জন্য সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করেন। মোটামুটি ভালই চলছে। পার্টনার তিনজনই একটু ধর্মীয় ভাবাপন্ন বলে তাদের পড়ি মরি কোনো খাই নেই। একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলে আশফাক তার পিতা আশরাফ সাহেবের কক্ষে বসে চা-নাশতা খেতে খেতে হালকা গাল গল্প করেন। আজ মাগরেবের নামাজ মসজিদে পড়ে এসে বসে বসে হিসনুল মুসলিমিন নামক একটি দোয়ার বই পড়ছিলেন আশরাফ সাহেব। ফাহমিদ তখন বাইরে ছিল; সে ঘরে থাকলে তিনি হয়তো তার সাথে গল্পে মেতে থাকতেন। তাঁর কক্ষে একটি বাড়তি বিছানার ব্যবস্থা আছে। কোনো মেহমান এলে একক্ষেই থাকে। মেহমান পেলে আশরাফ সাহেব প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন।

রাহেলার মা আশরাফ সাহেবের কক্ষে বাপ-ছেলের চা-নাশতা দিয়ে যায়। তার ডিউটি আজকের মতো শেষ। রাতে তেমন কোনো কাজ থাকেনা। বাসন-কোসন দুচারটা থাকলেও অসুবিধা হয়না; রাহেলার মা সকালে এসেই সব কিছু ঝকঝকে পরিষ্কার করে ফেলে।

আশরাফ সাহেব বইটা হাত থেকে রাখতে রাখতে বলেন, ‘খুব ভাল একটা বই দিয়েছিস। আলতু-ফালতু কিছুনেই; সবই ক্বুরআন-হাদিসের দোয়া-কালাম।’

আশফাক চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘বাবা, ওই ছেলেটা কই? চলে যায়নি তো?’

আশরাফ সাহেব কাঁটা চামচে স্প্যাগেটি পেঁচিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বলেন, ‘ফাহমিদ? না, যায়নি। আর একটা নাকি দুইটা টেস্ট বাকি আছে। বলা যায়না, বুয়েটেও হয়ে যেতে পারে। ছেলেটা খুব মেধাবী।’

‘হ্যাঁ, শিক্ষক বাপের ছেলে; মেধাবী তো হবেই’, আশফাক বলেন। ‘তবে বায়োলজি পড়েও নাকি ডাক্তারিতে তার আগ্রহ নাই।’

‘ওর বাপ ফোন করেছিল।’ছেলের দিকে তাকিয়ে আশরাফ সাহেব প্রশ্ন করেন, ‘চিনিস না জাহিদকে?’

আশফাক বলেন, ‘চিনবনা কেন? তা, কি বলল সে?’

‘তেমন কিছু না; তার ছেলের জন্য দোয়া করতে বলল। আর বলল, তার ছেলের যদি কোথাও হয়ে যায় তবে যেন আমরা খেয়াল রাখি।’

তখন রাহেলার মা বেরিয়ে যেতে যেতে আশরাফ সাহেবকে স্মরণ করিয়ে দিল, ‘দাদা, তিরিফলা কিন্তু শেষ। আর একদিন চলব।’

আশফাক বলেন, ‘অসুবিধা নাই, আমি কালকে নিয়া আসব।’ তারপর ফাহমিদের কথায় ফিরে গিয়ে বলেন, ‘আমিও ভাবছিলাম বুয়েট কিংবা নিদেনপক্ষে ঢাকা ভার্সিটিতে হয়ে গেলে ভাল হত।’

আশরাফ সাহেব খেই ধরতে একটু সময় নেন। তারপর বলেন,’ঢাকায় না হয়ে গাজীপুরের আই ইউ টিতে হলে তো আরও ভাল।’

চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে আশফাক এবার একটু খুলে বলেন, ‘আমরাতো দুজনের জন্যই চেষ্টা করছি; মানে বিন্তি আর কায়েসের কথা বলছি। মেডিকেলে অন্তত একজনের হয়ে গেলেও আমরা খুশি।’

‘হবে হবে, ইনশাআল্লাহ; তুই এত চিন্তা করিস না।’তারপর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আশরাফ সাহেব বলেন, ‘আমিতো জাহিদকে বলে দিয়েছি যে তোমার ছেলে আমাদের বাসায় থাকবে এবং আমার নাতি-নাতনিদের একটু গাইড করবে।’

আশফাক একটু চমকে উঠে বলেন, ‘আমি এরকমই চিন্তা করছিলাম, বাবা। বাসায় থাক বা না থাক, ঢাকাতে থাকলেই হল। আশা করি ওর আপত্তির কোনো কারণ থাকবে না।’

আশরাফ সাহেব বলেন, ‘তুই চিন্তা করিস না, আমি ম্যানেজ করব।’


বিন্তিদের বাসায় আজ একটা উৎসব উৎসব ভাব।সন্ধ্যায় দাদার কক্ষে আড্ডা জমেছে। চা-কফির সাথে আছে ফাহমিদের নিয়ে আসা সমুচা আর ডালপুরি। পুরো কক্ষ জুড়ে একটা রেস্তোরাঁ রেস্তোরাঁ গন্ধ। আগামী কাল ফাহমিদ চলে যাবে। তাই দাদা চুটিয়ে ফাইন্যাল সেশন চালিয়ে যাচ্ছেন।পরিবারের সবাই জানে যে ইতি মধ্যে দাদার বলে ফেলা কথাগুলো অন্য কোনো পরিস্থিতিতে কিংবা আসরে তিনি নতুন করে আবার বলেন। এইটুকু মনো দৈহিক বৈকল্য ছাড়া সত্তর বছর বয়সেও আশরাফ সাহেব মোটামুটি সুস্থ। তিনি কায়েস,বিন্তি ও বৌমাকেও তার কক্ষে ডেকে এনেছেন চা-কফি খেতে খেতে গল্প করবেন বলে। রাহেলার মাকেও বলে কয়ে ধরে রাখা হয়েছে কিছু সময়ের জন্য। সে ঘরের সবার রুচি-পছন্দ জানে; বিশেষ করে দাদার ব্যাপারে সে অধিক মনোযোগী। তার হাতে বানানো আদা-কুচি আর কাল জিরার মিশেলে চিনি-ছাড়া চা আশরাফ সাহেবের খুব পছন্দ। আশফাক এখনও ফেরেননি। তিনি এলেই হয়তো রাহেলার মায়ের ডিউটির পরিসমাপ্তি ঘটবে।

আশরাফ সাহেব বউমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজকে তোমার ব্যথা কম আছে তো বউমা?’

বিন্তির মা কাঁচুমাচু করে বলেন, ‘জিবাবা।’

‘বলেছিলাম না, আমার টোটকায় কাজ হবেই হবে। তোমরা তো বোঝোনা।’ আশরাফ সাহেবের চেহারায় এক ধরনের তৃপ্তির ঔজ্জ্বল্য দেখা যায়।

বউমা মেয়ের চোখের দিকে রহস্যজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শশুরের কথায় সায় দেন, ‘হ্যাঁ বাবা।’

আশরাফ সাহেব আবার তাঁর অসমাপ্ত প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে ফাহমিদের দিকে মুখ ঘোরান,‘বুঝলে, তোমার দাদার যেমন সুঠাম শরীর ছিল তেমনি ছিল সাহস। যুদ্ধের সময় অ্যামবুশ থেকে আমরা রিট্রিট করলেও সে মেশিনগানের গুলি পুরোটা শেষ না করে পজিশন ছাড়ত না। দুইটা গুলিতার গায়ে লেগেছিল, একটা ঘাড়ে আর অন্যটা হাঁটুর নিচে।’এই বীরত্ব গাথা আশরাফ সাহেব বহুবার বলেছেন, পরিবারের সবাই জানে।

‘কিন্তু দাদা, আপনার সেই বীর বন্ধু বিয়ে করবে না বলে যে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল…’বলে বিন্তি মুখ টিপে হেসে ওঠে।

বিন্তির কথায় একটু বাধাগ্রস্ত হলেও দাদা দাঁত বের করে হেসে দেন–ডানপাশের ছেদন দাঁতটা ছাড়া বাকি সব দাঁত তাঁর এখনও অটুট। দাদা বলেন, ‘শোন শোন, স্কুলের কাবাডি খেলায় প্রতি পক্ষ পুরোদল…।’

‘…তাকে আটকাতে পারত না। তাই না দাদা? ’বিন্তি আবারও দাদার কথায় ঢুকে যায়।

ফাহমিদ দাদা-নাতনির কথাটা না টানি দেখে একটু বিব্রত হচ্ছিল–তা-ও আবার তার দাদা প্রসঙ্গে। সে কথার মোড় অন্য দিকে ঘুরানোর জন্য বলল, ‘আপনার চাকরির গল্প কিন্তু খুবই খাসা, দাদা। ওই যে সেদিন এক ডাকাতের কথা বলছিলেন–আপনার থানা হাজত থেকে পালাতে গিয়েও পারল না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওসব তো পার্ট অফ মাই জব ছিল, বুঝলে। ওই সময় এই বাড়িতে আকবরও ছিল কিছু দিন। এটাতো অ্যবানডেন্ট প্রপার্টিছিল। পরে সরকারিভাবে সব ঠিক করে নিয়েছি। কিন্তু অন্যায় সুবিধা নেইনি। ’দাদা হয়তো কথা বলতে গিয়ে জট পাকিয়ে ফেলেছেন। ইদানীং মাঝে মধ্যে এরকম হচ্ছে। তাই একটু থেমে আবার শুরু করেন, ‘ও হ্যাঁ, ওই ডাকাত বেটা না আমাকে বলেছিল ‘আপনারে একলাখ টেকা দিমু আমারে ছাইড়া দেন…’

দাদার কথা শেষ না হতেই আশফাক এসে ঢোকেন বাসায়। আশরাফ সাহেব হই হই করে ওঠেন, ‘জানিস, এই ছোকরার ঢাকা ভার্সিটিতে হয়ে গেছে; এই দেখ ডাল পুরি, সমুচা–ও-ই নিয়ে এসেছে।’

স্বামী কে দেখে বিন্তির মা গাত্রোত্থান করতে যাবেন তখনই রাহেলার মা বলে, ‘আপনি বসেন খালাম্মা, আমি সব বেবস্তা করতাছি; খালুজান তো এই হানেই বইবো।’

আশরাফ সাহেবও বলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বউ মা, তুমি বস; খাতুন নাশতা-টাশতা নিয়ে আসবে।’ রাহেলার মা’র নাম কী যেন খাতুন। দাদা তাকে শুধু খাতুন বলেই ডাকেন। অন্যরা রাহেলার মা নামেই ডাকেন।

আশফাক চেয়ারে বসতে বসতে ফাহমিদের উদ্দেশে বলেন, ‘তাহলে তুমি ঢাকা ভার্সিটিতেই পড়বে?’

ফাহমিদ বলে, ‘বুয়েটের রিজাল্ট দেখব, চাচা।’

দাদা বলেন, ‘বুয়েট হোক আর ঢাকা ইউনিভার্সিটি হোক তুমিতো ঢাকাতেই থাকবে। বাড়ি থেকে গাট্টি বেঁধে ছেদে সোজা এখানে চলে আসবে–পরেরটা পরে দেখা যাবে।’

রাহেলার মা আশফাকের জন্য কফি বানিয়ে আনলে দাদা তাকে বলেন, ‘খাতুন, তাড়াতাড়ি বাসায় যা, অনেক কাজ করলি আজকে।’ রাহেলার মা সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলে আশফাক সমুচা চিবুতে চিবুতে বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই। বাবা কথা বলেছেন, আমিও তোমার বাপের সাথে কথা বলেছি। জাহিদ ভাই জোর দিয়ে বলেছেন, তুমি শুধু থাকবেই না, বিন্তি আর কায়েসকে মনোযোগ দিয়ে মেডিকেলের জন্য রেডি করবে।’ বলে, আশফাক একটু মুচকি হাসেন।

দাদার খাটের ওপর বসেছিল বিন্তি ও কায়েস। আব্বুর কথা শুনে নির্বিকার ভাবে তারা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। নতুন গৃহশিক্ষকের নিযুক্তিতে তারা খুশি নাকি বেজার তা তৎক্ষণাৎ বোঝা যায়না। বিন্তি শুধু ফাহমিদের দিকে একবার আড় চোখে তাকায়।


নিয়ম মাফিক দাদার নাশতা খেতে দেরি হবে। সবে মর্নিং ওয়াক করে বাসায় ফিরেছেন। রাহেলার মা ত্রিফলা-ভেজানো পানি টেবিলে রেখে গিয়েছে। আশফাক এবং কায়েস নাশতার টেবিলে বসে গেলে ও ফাহমিদ দাদার ফিরে আসার অপেক্ষা করছিল। দাদা পুলিশি কায়দায় বলেন, ‘আমার জন্য বসে আছ কেন? তোমার না তাড়াতাড়ি বেরোবার কথা। যাও, কুইক নাশতা শেষ কর, আমার দেরি হবে।’

অগত্যা ফাহমিদকে ডাইনিং টেবিলে যেতে হয়। কিন্তু ততক্ষণে আশফাক ও কায়েস বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত। আশফাক যেতে যেতে ফাহমিদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে ফিরছ তুমি?’

ফাহমিদ বলে, ‘এইতো বুয়েটের রিজাল্ট হয়ে গেলেই চলে আসব, চাচা।’

‘ঠিক আছে, রাস্তাঘাট সাবধানে দেখে যেয়ো’, বলে আশফাক ছেলে সহ দ্রুত বেরিয়ে যান।

ইতিমধ্যে রাহেলার মা টেবিলে ফাহমিদের নাস্তা দিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছে, ‘ভাইজানতো সকালে চা-কফি খান না; এখন দিমুনি এক কাপ?’

পেছনে পেছনে বিন্তি এসেও দাঁড়িয়েছিল। সে যেন দায়িত্ব নিয়েই বলল, ‘দিয়ে দাও, কফি দিয়ে দাও। লম্বা জার্নি। কফি খেলে ভাল লাগবে।’

ফাহমিদ কিছু না বলে শুধু বিন্তির দিকে সম্মতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।

রাহেলার মা কফি আনতে চলে গেলে বিন্তি হাসিহাসি মুখ করে সন্তর্পণে বলল, ‘বলেছিলাম না আপনি আমাদের স্যার হবেন! দেখলেন তো।’

ফাহমিদ লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি মফস্বলের ছেলে; আপনাদের কী মাস্টারি করব বলেন?’

বিন্তি ফিক করে হেসে বলে, ‘এভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আপনি আপনি করলেতো মাস্টারি করতে পারবেন না।’

হঠাৎ মায়ের কণ্ঠ শুনে বিন্তি আড়ষ্ট হয়ে যায়। রাহেলার মায়ের কাছে মা খোঁজ নিচ্ছেন, সব কিছু ঠিক আছে কিনা। এতক্ষণ তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ফাহমিদ চলে যাবে বলে হয়তো উঠে পড়েছেন।

বিন্তি তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে যেতে বলে, ‘তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, স্যার।’ তারপর একটু সাবধানতার সাথে বলে, ‘আম্মু হয়তো আসছেন।’ এ মুহূর্তে বিন্তির এর চেয়ে বেশি কিছু বলবার নেই।

বিন্তির আচরণে ফাহমিদ কী বুঝল কিংবা কিছু বোঝার চেষ্টা করল কিনা তা বোঝা গেল না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান "হলুদ রঙের লেফাফা" এখনও হৃদয়ে দাগ কাটে। তাই এ গল্পটিও সময় নিয়ে পড়লাম,কিন্তু ভোট অপশন পেলাম না।
ভালো লাগেনি ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
ভাই, আপনি একজন ভালবাসার মানুষ। অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
শিশির সিক্ত পল্লব লেখার বুননে গল্পটি সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। কবির জন্য শুভকামনা
ভালো লাগেনি ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
Dipok Kumar Bhadra খুব সুন্দর।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
অনেক ধন্যবাদ, দাদা।
ভালো লাগেনি ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
Muhammadullah Bin Mostofa খুব ভালো লেখেছেন। ফেসবুকে “সত্যবাণী প্রকাশনী” সার্চ করে “কলমকার” ম্যাগাজিনে লেখা দিয়েন।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
doel paki তারপর প্রেম হল নাকি ?
ভালো লাগেনি ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
ওইটা জানার জন্য আরেক গল্প পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।???? ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একটি মফস্বলের ছেলের ঢাকার জীবনের গল্প

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪