বিষয়: রসায়ন

বন্ধুত্ব (নভেম্বর ২০২২)

Jamal Uddin Ahmed
  • ৬৮
আবীরের কাছে এপর্যন্ত কুড়ি থেকে পঁচিশটি চিরকুট জমা হয়েছে। ওগুলো এ ফোর সাইজের হলুদ দাপ্তরিক খামে ভরে বিছানার নিচে ফেলে রেখেছে সে। কিংবা বলা যায় জমা করে রেখেছে। গতকালের চিরকুটটি শার্টের পকেট থেকে বের করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে বরাবরের মতো কৌতূহল মেশানো হাসিমাখা মুখে পড়ল, ‘রসায়ন বিজ্ঞানের একটি শাখা। এটি আবার কেমন করে মানবীয় সম্পর্কে ক্রিয়াশীল?’ এতটুকুই। বিজ্ঞানের যুগে কাগজের টুকরোয় কলম দিয়ে লিখে কেউ কি যোগাযোগ কিংবা ভাব প্রকাশ করে? হাফসার কাছ থেকে প্রথম দিনের চিরকুটটি পেয়েই আবীরের কাছে অদ্ভুত ঠেকেছিল। ওটি পড়ে সে ভেবেছিল ফিরতি একটি চিরকুট সে হাফসাকে দেবে। কিন্তু পরে ভাবল, না, ওসবে না গিয়ে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় উত্তরটা সে পাঠদানের ফাঁকে ফাঁকে কৌশলে দিয়ে দেবে। এ যাবত করেছেও তাই। নতুন এই চিরকুটের উত্তর কী দেবে কিংবা দেবে কি না সেটা ভাবতে ভাবতে আবীরের সন্ধ্যার আগের গড়াগড়িতে তন্দ্রা এসে ভর করল।

মফস্বলের নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আবীরের ছোট ভাই কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু রাজনীতিতে আগ্রহের কারণে পড়াশোনায় তার মনোযোগ কম। তবে তার ছোট বোন সত্যিকার অর্থে মেধাবী ও লেখাপড়ায় মনোযোগী। সে এবার কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাবা তেমন লেখাপড়া করতে না পারলেও ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য তিনি বদ্ধপরিকর। হাটে তার মাঝারি মাপের একটি চালের দোকান আছে। এছাড়া তিনি সরকারের নিয়োগকৃত খুচরো সার বিক্রেতা। ব্যবসায়ের মুনাফা এবং সামান্য পৈত্রিক জমিজমার আয় দিয়ে মোটামুটিভাবে তিনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এবং সংসারের খরচ চালিয়ে যেতে পারছেন। তবে ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া হয়ে গেলে তাকে একটু জোড়াতালির মধ্যে পড়ে যেতে হয়েছে। আবীর সেটা বোঝে। এবং বোঝে বলেই সে নিজের ভারটা নিজেই বহন করে বাবাকে একটু হালকা করতে চেয়েছে। ইউনিভার্সিটির হলে থেকে তাসনিয়া-হৃদিকে পড়িয়ে মাসে তিরিশ হাজার টাকা সে পায়। অবশ্য ঢাকাতে প্রথম এসে যে দুটো টিউশনি ধরেছিল সেখান থেকে বেশি পেত না; চোদ্দ-পনর হাজার। এখন রহমান স্যার দু’তিনমাস পর পর আবীরের ভাল-মন্দের খবর নিতে নিতে একটু হালকাভাবে যে চার-পাঁচ হাজার টাকা তার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘এটা রাখ, টুকটাক প্রয়োজনে কাজে লাগবে’, সে টাকাটা সে বাপের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বলে, ‘কবীর আর জোছনার বেতন-টেতনের জন্য খরচ করবেন।’

শনি, সোম ও বুধ; তাসনিয়ার জন্য বরাদ্দ এই তিন দিন। রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতি বারে যেতে হয় বনানীতে হৃদিকে পড়াতে। মূলত এই দুটি টিউশনিই নিয়েছে আবীর, টাকার প্রয়োজনেই। তিরিশ হাজার টাকাতে স্বচ্ছন্দে সকল প্রয়োজন মিটিয়ে চলতে পারে সে। আরোও চাইলে নিতে পারত, কিন্তু টাকার পিছনে ছুটে নিজের লেখাপড়ার সাথে সমঝোতা করতে রাজি নয় সে। তবে না চাইলেও, টাকার জন্য নয়, বরং দায়ে পড়ে আরেকটা অনিয়মিত টিউশনি করতে হয় তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক রহমান স্যার আবীরের এলাকার মানুষ। তাঁর মেয়ে কেমিস্ট্রিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আবীর বুয়েটে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে এসে রহমান স্যারের কোয়ার্টারে কিছুদিন থেকেছে। সেই সুবাদে রহমান স্যার আবীরকে ডেকে বলেছেন, ‘নিয়মিত না পার, মাঝে মাঝে তুমি এসে হাফসাকে একটু গাইড করে যেও।’

তাসনিয়া ও হৃদিকে তুলনায় আনলে হাফসাকে সেই দাদী-নানীদের আমলের মেয়ে বলে মনে হয় আবীরের। প্রযুক্তির রমরমা যুগে এখন কি কেউ চিঠি আর চিরকুটে ভাব বিনিময় করে? এমনিতে সে মুখচোরা স্বভাবের মেয়ে। তাছাড়া শিক্ষকের মেয়ে বলে আদর্শ আর সভ্যতার একটা অদৃশ্য শিকল হয়তো তাকে পেঁচিয়ে রেখেছে যদিও এযুগে এসব শিকল বহুলাংশে বিকল হয়ে গিয়েছে। তাই বলে চিরকুট? ফোন এখন একটি অপরিহার্য উপকরণ এবং সহজলভ্যও বটে – হাফসারও একটি আছে। সে তো মেসেঞ্জারে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করতে পারত। তা না, হস্তলিপি। প্রথম চিরকুটে লিখেছিল, “বাবা বললেও আমি আপনাকে ভাইয়া বলতে পারব না, স্যারই বলব। মাঝে মাঝে এরকম টুকরো কাগজে লিখব। আপনি কিছু মনে করতে পারবেন না। যা জানতে চাইব, তার উত্তর দেবেন। ঠিক আছে?” আবীর তার ক্লাসে এই চিরকুটের উত্তর সুন্দরভাবেই দিয়েছে। কেমিস্ট্রির জারণ-বিজারণ বিশ্লেষণ করতে করতে বলেছে, ‘দেখ, অনুসন্ধিৎসা ঔৎসুক্য থাকা খুবই ভাল জিনিস। জানার ইচ্ছা না থাকলে শিখবে কেমনে? তুমি কিছু না বুঝলে সরাসরি বলবে, আমি আমার সর্বোচ্চটুকু দেবার চেষ্টা করব।’ জানার তো অনেক কিছুই আছে। পাঠ্যবইয়ের সীমানার বাইরেও অনেক কৌতূহল আঁকড়া আঁকড়ি করে। হাফসা তাই অনেক কিছুই সরাসরি স্যারকে জিজ্ঞেস না করে সেই আদ্যিকালের চিরকুটে তার ভাবনা কিংবা প্রশ্ন তুলে ধরে।

ইদানীং একটা বাড়তি প্যারা একেবারে আবীরের মাথায় ঠাই করে নিয়েছে। সে হৃদিকে ‘না’বলে দেবে কি না তাই ভাবছে। কিন্তু সে পড়াতে পারবে না বললে হৃদির বাবা-মা তাকে নিয়ে যদি বিচার সালিশ বসিয়ে দেয় তখন কী হবে? সে তো সাহস করে বলতে পারবে না যে তাদের মেয়ে লেখাপড়ার চেয়ে তাকে নিয়ে গুলশানের ভিআইপি রেস্টুরেন্টে যেতে বেশি আগ্রহী কিংবা তার ফিউচার প্ল্যান কী তা জানতে উৎসুক। শিল্পপতি বাবার সাথে বিদেশ ভ্রমণে গেলে সে ‘ভাইয়া’মানে আবীরের জন্য দামি গিফট নিয়ে আসে। যদিও আবীর জানে হৃদির রেস্টুরেন্টে যাবার আবদার কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এখনকার বাস্তবতায় অতি সাধারণ ব্যাপার তবুও সে ঝুঁকি নিতে চায় না। সে তার শেকড় সম্বন্ধে সচেতন। তাছাড়া তার একটি লক্ষ্য আছে; সে লক্ষ্যচ্যুত হতে চায় না। তার শুধু ভয়, যদি তার নর্থ-সাউথের ছাত্রীর পারফর্মেন্স ওপরের দিকে টেনে তোলা না যায় তাহলে তো তার বদনাম হয়ে যাবে। হৃদির এফবি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট সে নীতিগত কারণে অ্যাকসেপ্ট না করলেও মেসেঞ্জারে সে তাকে কাজে অকাজে অনবরত বার্তা পাঠায়। আবীর হৃদিকে জ্ঞানীর মতো অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এসব উপদেশ উলুবনে মুক্তা ছড়ানো বই কিছু নয়।

তাসনিয়ার ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। সে প্রায়ই আবীরকে নেয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তাদের বাসা খুব বেশি দূরে নয় – নিউ ইস্কাটনে। গাড়ি আমদানিকারক বাবার ছত্রিশ শ’ বর্গফুটের বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। সে ভিকারুন্নিসার ইন্টারমিডিয়েটের পরীক্ষার্থী। দুবছর ধরে আবীর তাকে পড়াচ্ছে। সবাই আশা করছে সে মেডিকেলে সহজেই ভর্তি হতে পারবে। আবীর ভাইয়ার জন্য তাসনিয়ার আগ্রহ অনেকটা বাস্তবসম্মত। তবে এজন্য পড়াশোনায় তার মোটেই ঢিলেমি নেই। তাসনিয়ার প্রচ্ছন্ন ভালবাসা আবীর টের পায়, কিন্তু সে সচেতনভাবে তা পাশ কাটিয়ে যায়। আবীরকে তাসনিয়া আন্তরিকভাবেই সমীহ করে, যত্ন করে ভাল ভাল নাস্তা খাওয়ায়, পারিবারিক অনুষ্ঠানে জোর আমন্ত্রণ জানায় এবং মা-বাবার কাছে তার খুবই প্রশংসা করে। তুলনামূলকভাবে কম বয়সী বলে তার বাধোবাধো ভাব রয়ে গেলেও মাঝে মাঝে আবীরের সাথে একটু-আধটু রসিকতাও সে করে। যেমন, …ভাবী আসবে যখন… কিংবা …বিয়ে করবেন যখন… ইত্যাদি। তাসনিয়া এখনও সাহস করে আবীরকে এফবি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় নি; প্রয়োজনে ফোনেই কথা বলে। তার মা-বাবার মনোভাব পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও আবীর জানে তারাও তাকে খুব স্নেহ করেন। ঈদে-পর্বে তাকে দামি উপহারও দেন।

আজ হৃদির বাসায় গেলে কড়া একটি বার্তা দেবে বলে মনস্থ করেছে আবীর। একথা ভাবতে গিয়ে হাফসার রসায়নের প্রশ্ন মনে পড়ে গেলে তার হাসি পায়। হাফসা কেমন একটা বেখাপ্পা প্রশ্ন করল। তার বাহ্যিক আচরণে রসায়ন বিষয়ক জটিলতা চোখে পড়ে না। এসব কথা, বিষয়ের উপযোগিতা এবং বিশ্লেষণ হৃদির মতো মেয়েদের সাথেই বেশি যায়। কেননা হৃদির আচরণ এবং উচ্ছ্বাসের মধ্যে রসায়নের প্রাবল্য উদ্বেগজনক। কিন্তু আবীরের নিষ্ক্রিয়তা সে রসায়নের পূর্ণতা এনে দিতে পারছে না। আবীর আপাতত রসায়নকে পাঠ-প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়, শরীরবৃত্তীয় বিশ্লেষণ বা ব্যবহারিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে যেতে অনীহ।

হৃদির মনটা কেমন ভার ভার আজ। ফটর ফটর কম করে সে বই-খাতায় নজর দিয়েছে বেশি। তবে আবীর চলে আসার আগে একটু বিষণ্ণ হয়ে বলে, ‘আব্বুর কথা না শুনে ভুলই করলাম মনে হচ্ছে এখন।’

‘কী ভুল করেছ?’ আবীর জিজ্ঞেস করে।

‘দেখেন না, আব্বু কত করে বলল স্টেটসে গিয়ে পড়তে। আমি গেলাম না।’

আবীর বলে, ‘সেটাই তো ভাল ছিল। একটা ভাল ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিতে পারতে। যাওনি কেন?’

হৃদি একটু দম ধরে আবীরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সে এক অন্য কাহিনী, ভাইয়া। আপনাকে বলতে চাই না।’

আবীর ভেবেছিল হৃদি আজ বেশি জ্বালাতন করলে একটু শক্ত কথা শোনাবে। কিন্তু তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। সে শুধু বলল, ‘ঠিক আছে, বলার দরকার নেই। তবে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে দেশেও ভাল করা যায়।’

হৃদি তো আবীরকে বলেনি বা বলতে চায়নি যে সে এবং শাকিল আমেরিকায় যাবার জন্য এক পায়ে খাড়া ছিল। কিন্তু স্কাউনড্রেলটা শম্পার দিকে ঝুঁকে পড়ায় সে শাকিলের পাছায় লাথি মেরে গুডবাই বলে চলে আসে। ওই শাকিলের জন্যই সে ইউএসের পরিকল্পনা বাতিল করে। এদিকে এনএসইউতে ভর্তি হবার আগেই এক কাজিনের মাধ্যমে আবীর টিউটর হিসেবে এসে গেলে হৃদির ব্রেকআপের ক্ষতটা শুকাতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু লাভ হল কী? এই মিডিলক্লাস পণ্ডিত তো বছরখানেক ধরে শুধু পণ্ডিতিই করে যাচ্ছে, ধরা দিচ্ছে না।

কদিন পর একটি হুলস্থূল কাণ্ড ঘটে যায়। সোহরাওয়ার্দি হলের আবীরের রুমমেট জিল্লু হুট করে বিয়ে করে বসে। পাত্রী তার দু’বছরের প্রেমিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির ছাত্রী লাবণী। জটিলতা হল, ওদের দুই পরিবারের কেউ ব্যাপারটি জানে না। লাবণী রায়ের পরিবার মিনেসোটা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করা এক সুপাত্রের সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে পাকাপাকি করে যখন তাকে চাপ দিচ্ছিল তখন সে কৌশলে তা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু পাত্রপক্ষ যখন আর দেরি করতে চাইছিল না, তখন লাবণী জাতপাত সব জলাঞ্জলি দিয়ে কোর্টে গিয়ে এফিডেবিট করে বিয়ের কাজ সেরে ফেলে। তার পরিবার যে এ বিয়ে গ্রহণ করবে না তা নিশ্চিত, কিন্তু জিল্লুর এই হটকারিতা তার বাবা-মায়েরা মেনে নিবে কি না বলা যাচ্ছে না।

জিল্লুর এই ঘটনা আবীরের মাথা আউলা ঝাউলা করে দেয়। সমাজে কত কী যে হচ্ছে, আর সে এক রক্ষণশীল মানস-কাঠামোয় বন্দী হয়ে আছে। আজ না হোক কিছুদিন পর তাকেও বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে। বাবা-মা’রা অবশ্যই চাইবেন তাদের শিক্ষিত ছেলে তার সাথে মানানসই কোনো মেয়েকে বিয়ে করুক। এসব কথা তার মাথার ভেতর কয়েকবার ঘুরপাক খেলে আবীরের চোখে তার ছাত্রীদের ছবি ভেসে ওঠে। নিজের ভেতরে রসায়নের উপস্থিতি একটু একটু টের পায় সে। তার তিনটি ছাত্রীই মোটামুটি মেধাবী। সৌন্দর্যের কথা ভাবলে হাফসাকে প্রথম দিকে রাখতে হবে। উজ্জ্বল শ্যামলা রং, লম্বা গড়ন, মিষ্টি চেহারা, মায়াবী কণ্ঠ সব মিলিয়ে হাফসাকে প্রথম দর্শনেই যে কেউ পছন্দ করবে। সাধারণ উচ্চতার তাসনিয়া বা হৃদিকেও উড়িয়ে দেয়া যাবে না, তবে তারা অধিক রূপসচেতন। তাদের দামী প্রসাধনীর প্রমাণ যে কেউ সহজেই পাবে। আবীরের মনে হয় হাফসা যদি ওদের মতো রূপচর্চা করত তবে তাকে সিনেমার নায়িকাদের মত লাগত।

আবীর প্রেম-পরিণয় নিয়ে সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী না হলেও জিল্লু আর লাবণীর চাঞ্চল্যকর ঘটনা তার মাথায় একটি অনাহূত আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। ইদানীং সে বেশ ঘনঘনই তাসনিয়া-হৃদি-হাফসাকে পছন্দের পাল্লায় তুলে মাপজোক করে। যতবারই সে তা করতে যায় ততবারই পাল্লাটা হাফসার দিকে ঝুঁকে যায়। এক সময় আবীর মনস্থির করে ফেলে, সে হাফসা ও তার মধ্যকার কাঁচের দেয়ালটা ভেঙ্গে ফেলবে। সে বুঝতে পারে, হাফসা যদি কোনোদিন তার জীবনে আসে তবে তাকে দূরের কেউ মনে হবে না।

হাফসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বরাদ্দ না থাকলেও প্রয়োজনে যেকোনো দিন যেতে আবীরের কোন অসুবিধা হয় না। একটু রাত বেশি হয়ে গেলে রহমান স্যারই জোর করে তাকে খেতে বসিয়ে দেন। তবে সে শুক্রবারে সাধারণত টিউশনিতে যেতে চায় না। কিন্তু হঠাৎ করে সে এই শুক্রবার বিকেলে হাফসাকে ফোন দেয়।

হাফসা চমকে যায়, ‘স্যার, আপনি?’

‘বেশ কিছুদিন আসা হয় না’, আবীর বলে, ‘তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’

হাফসা বলে, ‘তেমন কোনো জটিল সমস্যা নেই, তবুও আপনি যখন আসবেন তখন ভালভাবে বুঝে নিতে পারব।’

আবীর বলে, ‘সন্ধ্যায় আমি টিএসসির দিকে যাব, তখন নাহয় তোমাদের বাসা হয়ে আসব?’

‘আসুন’, হাফসা জবাব দেয়।

আবীরের মাথায় হাফসার শেষ প্রশ্নটা সজীব থাকলেও সে ভাবল এসব জটিল প্রশ্নোত্তরে সে যাবে না। সে সরাসরি প্রসঙ্গে চলে আসবে। তাই হাফসার পড়াশোনার পাঠ শেষ করেই সে বলল, ‘তোমার সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই।’

হাফসা একটু থমকে গিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার স্যার? ব্যক্তিগত?’

‘বলতে পার।’আবীর জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার আপত্তি আছে?’

হাফসা অকম্পিত কিন্তু মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘জি, কিছুটা; কোনো কোনো ক্ষেত্রে।’

‘যেমন?’

হাফসা কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকে।

আবীর সহজে তার কথার সূত্রপাত করতে না পেরে একটু বিব্রত বোধ করে। তবুও সে বলে, ‘হাফসা, আমি কোনো ভণিতা না করে একটা ব্যাপার জানতে চাই; তুমি কি আমার সম্বন্ধে কখনও ভেবেছ? মানে…’

হাফসা তখন আবীরের কথা পূর্ণ হতে না দিয়ে বলে, ‘স্যার, আপনি যদি জিজ্ঞেস করতে চান আমি আপনাকে পছন্দ করি কি না, তবে আমার কাছে কোনো সন্তোষজনক উত্তর নেই।’

আবীর চকিতে চুপসে যায়। তার মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে সে বলে, ‘হাফসা, তুমি বুঝতে পারছ, আমি কতটুকু সিরিয়াস হলে তোমাকে সরাসরি এ প্রশ্ন করতে পারি। আমি সত্যি সত্যি তোমার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে পোঁছে গেছি।’

হাফসার চোখ আর্দ্র দেখা যায়। সে বলে, ‘স্যার, আমার এরকম একটা ভয় ছিল। আমি এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাইনি বলে আপনাকে স্যার সম্বোধন করতে চেয়েছি।’

‘কেন কেন, হাফসা? তুমি নির্দ্বিধায় বল। তোমার কোনো অ্যাফেয়ার্স থাকলে আমার কোনো কথা নেই।’ আবীর অস্থির হয়ে বলে।

হাফসা চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘আমার কোনো অ্যাফেয়ার্স নেই স্যার, হবেও না কোনোদিন।’

আবীর বলে, ‘আমি আর কখনও কিছু বলব না, তুমি শুধু পরিষ্কার করে ব্যাপারটা বল।’

হাফসা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ‘আমি অনেক উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে আপনাকে হয়ত বিব্রত করেছি। ক্ষমা করবেন। সত্য কথাটা শুনলে আপনি কষ্ট পাবেন, আর না বললেও আমাকে ভুল বুঝবেন। তাই বলছি, ছোটবেলায় আমার একটা জটিল রোগ হয়েছিল। অপারেশন করে বেঁচে গেছি। বড় হয়ে জেনেছি এবং এখন ভালভাবে বুঝতে পারছি আমি শারীরিক অনুভূতিহীন। আমার কখনও কোনো সঙ্গী হবে না, সংসার হবে না, সন্তানও হবে না।’এতটুকু বলে সে চোখ মুছতে থাকে।

আবীর নির্বাক হয়ে হাফসার শেষ চিরকুটের কথা গভীরভাবে ভাবতে থাকে। হাফসা কি কোনোদিন মানব-মানবীর কেমিস্ট্রি উপলব্ধি করতে পারবে না? তার জীবনটা এভাবেই সঙ্গিহীন, বন্ধুহীন কাটবে? সে হাফসাকে কী বলবে, কী বলে এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে তা বুঝতে পারে না। হাফসার জন্য তার খুব কষ্ট হয়। তারপর হঠাৎ তার কী যেন হয়। সে ভ্যাবাচ্যাকার মতো বলে, ‘আমি তোমার বন্ধু হব।’

হাফসা মুখে ফ্যাকাসে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, ‘বন্ধুত্ব অনেক ভারী বস্তু, স্যার।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
doel paki অভিনন্দন।
Dipok Kumar Bhadra আবীর আপাতত রসায়নকে পাঠ-প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়, শরীরবৃত্তীয় বিশ্লেষণ বা ব্যবহারিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে যেতে অনীহ।-খুব সুন্দর লিখেছেন ।এগিয়ে যান। সময় পেলে Sahitya Biggan Wave siteটি দেখবেন এবং লেখা পাঠাবেন।
ধন্যবাদ,দাদা।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

আবীরের কাছে এপর্যন্ত কুড়ি থেকে পঁচিশটি চিরকুট জমা হয়েছে।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪