ঘাটলায় বসে বাসন মাজতে মাজতে অনামিকায় চোখ পড়তেই জমিলার চোখ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মায়ের চোখ এড়িয়ে তিন চারদিন ধরে সোনার আংটিটি তার হাতের আঙুলে শোভা পাচ্ছে। মা যদি জিজ্ঞেস করে ‘আংটি কই পাইলি’ তার উত্তর জমিলা এখনও ঠিক করেনি।
মাস ছয়েক ধরে বাচ্চু মেম্বার নিরলস সাধনা করে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম মিষ্টি কথা বলতে বলতে আলতো করে হাত ছুঁয়েছে। অভয়ের কথা বলতে বলতে কখনও কাঁধে হাত রেখেছে। রূপের প্রশংসা করতে করতে ঘাড়ের ওপর দিয়ে হাত ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে যেদিন জমিলা পুকুর থেকে গোসল করে বাড়ি ফেরার পথে বড় কাঁঠাল গাছটার আড়ালে বাচ্চু তার পথ আগলে বলেছিল, ‘হারামির বাচ্চাটা কেমনে তোমারে ত্যাগ করতে পারল আমার বুঝে আসে না’ এবং এই কথা বলে দুই হাতের তেলোয় জমিলার মুখটা উঁচিয়ে ধরে আচমকা একটা চুমু খেয়ে বসল, সেদিন সে তড়িতাহত হয়েছিল বটে কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেনি। ওইদিনের পর থেকে বাচ্চুর ভয় এবং সংকোচ কেটে যাওয়ায় তার উপদ্রবের মাত্রাও বাড়তে থাকে। সুযোগ পেলেই সে জমিলাকে দখল করার কসরত করতে থাকে। কোনো কোনোদিন টিলার ধারের তাদের ফাঁকা বাড়িতে জমিলাকে একা পেয়ে গেলে বাচ্চু তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে পেষাই করেছে এবং আরও এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু জমিলা সে মুহূর্তে দেয়াল তুলে দিয়েছে। এমন পুনঃপুন অসফলতার পর বাচ্চু আরও জেদি হয়ে ওঠে এবং সে তার কৌশল বদলায় । কিছুদিন থেকে সে জমিলাকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী করার লোভ দেখিয়ে যাচ্ছে। তবুও হাতে আংটি পরার আগ পর্যন্ত জমিলা বাচ্চু মেম্বারের কাছে নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দেয়নি।
বাচ্চুকে কাছে থেকে দেখা বা তার সাথে কথা বলার সুযোগ জমিলা পেয়েছিল তার পিতা হাশিম মৃধা বাচ্চু মেম্বারকে বাড়িতে ডেকে এনেছিল বলে। রগচটা ভ্যানগাড়ি চালক ময়েজুদ্দি তার মেয়েকে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলে তার একটা বিহিত করার জন্য হাশিম মৃধা বাচ্চুর সহায়তা চেয়েছিল। বাচ্চু জমিলার কাছ থেকে ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে নিয়ে বেশ কয়েকবার ময়েজুদ্দির সাথে একটা দফারফার চেষ্টা করেছিল ঠিকই কিন্তু সেই বেয়াড়াকে বাগে আনতে পারেনি। এই সূত্রেই বাচ্চুকে বেশ কয়েকবার হাশিম মৃধার বাড়িতে আসতে হয়েছে। জমিলার প্রতি বাচ্চুর লোভের জন্ম ওখান থেকেই।
বেয়াড়া ময়েজুদ্দির চেহারা সুরত আবার বেশ পুরুষোচিত; বাংলাদেশের নাটক-সিনেমার নায়কের চেয়ে কম যায় না সে। শুল বেদনার রুগি তার বাপ বেশ তড়িঘড়ি করে জমিলাকে ছেলের বউ করে নিয়ে এসে ইহজগতের ফরজ দায়িত্বটি পালন করেছিল। কম বয়সী সুডৌল জমিলাও ফেলনা নয়; প্রথম দর্শনেই পছন্দ করার মতো। ময়েজুদ্দির যেমন মন ধরেছিল তার বাপও তেমন জমিলাকে খুব আদর করত। কিন্তু বুড়ো বেশিদিন টিকল না; ছেলের বিয়ের ছয় মাসের মাথায় সে পটল তুলল। ময়েজুদ্দি সুদর্শন হলেও ভ্যানগাড়ির আয়ের সাথে সাথে সে কিছু বদ-খাসলতও অর্জন করেছিল। শিবগঞ্জ বাজারের বাস্তুহারাদের ঝুপড়িতে অঞ্জনার সাথে যে তার শারীরিক লেনদেন ছিল জমিলাকে বিয়ে করেও সে তা ছাড়তে পারেনি। এ সংবাদটি জমিলার কানে এসেছিল তাদের বিয়ের মাস ছয়েক পরে যখন তার শ্বশুরের শেষকৃত্যে গ্রামের ছেলেবুড়ো অনেকেরই জমায়েত হয়েছিল।
বাচ্চু মেম্বার আংটিটি কেনার দিন আগেভাগেই জমিলাকে বলে রেখেছিল যে তার জন্য একটি বিশেষ উপহার আছে, রাতের বেলা বাপ-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে জমিলা যেন তার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে। বিটুমিনের ড্রাম কেটে তৈরি করা ঘরে দরজা মাত্র একটাই। তা-ও বাব-মা’র কক্ষের দিকে। তবে উত্তরমুখী একটা জানালা আছে জমিলার কক্ষে। জমিলার একমাত্র ভাই হেলাল ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করে। সেখানে সে তার সহকর্মীকে বিয়ে করে ঢাকাতেই থাকে। ঈদেপর্বে কখনও বাড়িতে আসে। তখন সে স্ত্রীসহ এই কক্ষেই থাকে। এটুকু সময় ছাড়া বিয়ের আগে যেমন ছিল, এখনও এটি জমিলার জন্য বরাদ্দ। তো বাচ্চুর কথায় নিমরাজি হয়েই সে রাতে জমিলা তার কক্ষের জানালার হুড়কো লাগায়নি। রাতের বেলা সবাই শুয়ে পড়লে বাচ্চু চোরের মতো এসে জমিলার জানালায় দাঁড়ায়। সে সেদিন সচেতনভাবেই নীল রঙের নতুন টি-শার্ট পরে, জবা কুসুম তেলমাখা চুল পরিপাটি করে, তোলপাড় করা বুক নিয়ে অভিযানে বের হয়। অতি সাবধানে এসে জমিলার ঘরের জানালা ফাঁক করতেই প্রায় একসুতোর ব্যবধানে সে জমিলার পদ্মমুখ আবিষ্কার করে। জমিলা বাচ্চুর মুখ চেপে ধরে বলে, ‘চুপ। শব্দ করবা না।’
বাচ্চু বলে, ‘আমি ভিতরে আসমু কেমনে?’
‘আওনের দরকার নাই। বাইরে দাড়াইয়া থাক।’
বাচ্চু অস্থির হয়ে বলে, ‘না না। তুমি সাবধানে আলগি দিয়া একটু উজাও, আমি তোমারে বাইরে নিয়া আমু।’
জমিলা বলে, ‘না, আমার ভয় করে।’
কিন্তু শেষপর্যন্ত বাচ্চুর জোরাজুরির কাছে জমিলা পরাস্ত হয়। অনেক কসরত করে সে জমিলাকে জানালা দিয়ে বের করে নিয়ে আসে। তারপর চুপিচুপি ঘরের পেছনের কলাগাছের ঝোপের নীচে বসে সে জমিলার লিপজেল-ঘষা পুরু ঠোঁট ললিপপের মতো চুষতে চুষতে তার শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশ নাড়াচাড়া করতে থাকে। এরই এক ফাঁকে সে পকেট থেকে নক্সা করা ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের কৌটো বের করে জমিলার হাতে দিয়ে বলে, ‘খুইলা দেখ।’
জমিলা আংটির কৌটো খুলেই বুঝতে পারে এটিই বাচ্চু মেম্বারের বিশেষ উপহার। বাচ্চু নিজ হাতে জমিলার অনামিকায় আংটিটি পরিয়ে দিয়ে পাশবিক উন্মাদনায় তাকে জড়িয়ে ধরে। জমিলা দায়সারা প্রতিরোধ করলেও তার জৈবিক কোষগুলো বিভীষণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাই অতি সহজেই সে বাচ্চুর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
জমিলা মুখ ভার করে যেদিন শিবগঞ্জ বাজারের অলিগলির কথা জিজ্ঞেস করেছিল, ময়েজুদ্দি তখন খ্যাঁক করে উঠে বলেছিল, ‘পুলিশের লাহান পেচাইয়া পেচাইয়া কথা কস ক্যা?’
জমিলা বলেছিল, ‘ক্যান, অঞ্জনা নামের একটা বাজারী মাইয়া শিবগঞ্জে থাকে না?’
ময়েজুদ্দির মাথায় আগুন চড়ে গেলে সেদিনই প্রথম বারের মতো সে জমিলার গালে কষে একটি থাপ্পড় বসিয়ে বলে, ‘এইসব কথা তোরে কেডা কইছে?’
জমিলা সেদিন কান্নার তোড়ে আর কোনো কথা মুখ দিয়ে বের করতে পারেনি। তবে এ ঘটনার পর থেকে তার চেহারা থেকে আনন্দের আলোকচ্ছটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। ময়েজুদ্দির সাথে প্রয়োজনের বেশি কথা বলে না। দুশ্চিন্তার কাল ছায়া সারাক্ষণই তার মুখে লেপটে থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় বেয়াড়া ময়েজুদ্দিও ক্রমে ক্রমে তেঁতে ওঠে। কখনও বেশি রেগে গেলে জমিলাকে একটি ঠোকর বা ধাক্কা মারে। কিন্তু বউয়ের প্রতি ছেলের এই আচরণ ময়েজুদ্দির মা যে সমর্থন করে এমন নয়। কিন্তু সে জোর গলায় প্রতিবাদও করতে পারে না। কারণ ময়েজুদ্দির বাপের সাথে পঁচিশ বছর সংসার করার পর তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে এসব তাদের বংশগত দোষ। ময়েজুদ্দিও যে এরকম হবে তাতে আর বিস্ময়ের কী।
কিন্তু সমস্যা চরমে পৌঁছোয় সেদিনই যেদিন জমিলার ডান হাতের মাদুলিটা ময়েজুদ্দির হাতে ঠেকে । ময়েজুদ্দি মাদুলি চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘এইটা কী?’
জমিলার গলার পানি শুকিয়ে যায়। সে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘তাবিজ।’
ময়েজুদ্দি শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তাবিজ পাইলি কই? কীসের তাবিজ?’
জমিলা অন্ধকারে চুপ করে থাকে। একই সাথে তাদের শরীরের আন্দোলনও পুরোপুরি থেমে যায়।
ময়েজুদ্দি এক ঝটকায় জমিলার শরীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসে। সে বলে, ‘চুপ কইরা থাকিস না; পুরা ঘটনা খুইলা ক।’
আসন্ন বিপদের আশংকায় জমিলা ফুঁপিয়ে উঠলে ময়েজুদ্দির রাগ আরও বেড়ে যায়। সে জমিলার ঘাড় ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, ‘ক, কই গেছিলি, কার সাথে গেছিলি? আর তাবিজের দরকার পড়ল ক্যান?’
যে দেলোওয়ারের মা শিবগঞ্জ বাজারের অঞ্জনার খবর পাচার করেছিল তারই পরামর্শে এবং তারই সাথে শাশুড়ির অবর্তমানে লুকিয়ে যে বদরগঞ্জের খুন্তি শাহ্র দরবারে জমিলা গিয়েছিল শেষপর্যন্ত সে খবর চাপা রাখা গেল না। ময়েজুদ্দির উত্তমমধ্যমের আতিশয্যে জমিলা স্বীকার করতে বাধ্য হল যে সে তার সংসারের সুখের জন্য স্বামীকে বাজারী মেয়ের খপ্পর থেকে বাঁচিয়ে আনতে তাবিজ, পড়া-তেল ইত্যাদির জন্য সে বদরগঞ্জের পীর সাহেবের কাছে গিয়েছে।
ভণ্ড লুচ্চা খুন্তি শাহ্কে ময়েজুদ্দি ভালভাবেই চেনে। অঞ্জনার ঝুপড়ি ছাড়াও খুন্তি শাহ্র দরবারেও ময়েজুদ্দির যাতায়াত আছে। দরবারের অনেক কারামতি কাজ-কারবারে সেও মাঝে মাঝে যোগ দেয়। জমিলাকে তাবিজ আর পড়া তেলের ভেল্কিতে ফেলে খুন্তি শাহ্ কতটুকু কারামতি দেখিয়েছে সেই সন্দেহ ময়েজুদ্দির মাথা আউলা-ঝাউলা করে দেয়। সে জমিলার চুলের মুঠি ধরে পশুর মত পেটাতে পেটাতে বলে, ‘এই খানকি মাগী, আমারে দিয়া তোর পোষায় না? তুই বদমাশ পীরের ঠাপ খাইতে গেছস ক্যান? ক, ওই হারামজাদার সাথে কী করছস – তোরে তার খাস কামরায় নিছিল?’
জমিলা গোঙাতে গোঙাতে বলে, ‘আল্লার দোহাই, পীর আমার সাথে কুনু খারাপ কাজ করে নাই। দেলোওয়ারের মা আমার সাথে আছিল। আমারে তাবিজ-কবজ দিয়া বিদায় কইরা দিছে।’
দেলোওয়ারের মা সাথে থাকলে কী হবে, জমিলাকে ঠিকই পীরের খাস কামরায় যেতে হয়েছিল। তারপর তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত রেখে খুন্তি পীর ঝাড়ফুঁক করতে করতে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি আমার দরবার শরীফে আইছ; পবিত্র শরীরে আইছ তো?’ কিন্তু জমিলার মাসিক সেদিন পর্যন্ত পুরোপুরি শেষ হয়নি বলে লজ্জাবনত হয়ে সে বলেছিল, ‘আমার শরীর ভালা না।’ পীরের আশাভঙ্গ হলে আরও কিছুক্ষণ জমিলার গা-গতর টিপে ফুঁক দিতে দিতে সে বলেছিল, ‘এখন যা দিবার দিয়া দিলাম। আস্তে আস্তে তোমার স্বামীর নজর ঠিক হইয়া যাইব। কিন্তুক এক শ’ভাগ ফল পাইতে হইলে তোমারে আরেকদিন আইতে অইব।’ – স্বামীর প্যাঁদানি খেয়েও জমিলা এই অংশটুকু তার কাছে গোপন করে রাখে।
জমিলা যতই গোপন রাখুক না কেন, ময়েজুদ্দি জানে নিতান্ত প্রৌঢ়-বৃদ্ধ না হলে খুন্তি পীর কোনো মেয়ে দর্শনার্থীকে খালি হাতে ফেরাবে না; কিছু না কিছু সেবা দেবেই। অতএব জমিলাকে এই জঘন্য অপরাধের মাশুল দিতেই হবে। ময়েজুদ্দির মা নির্লজ্জের মতো ছেলেকে বিভিন্নভাবে বুঝিয়েছে। কিন্তু মায়ের কথা কানে না তুলেই দুদিন পর সে জমিলাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
বাচ্চু মেম্বার দ্বিতীয় দিন নৈশ অভিযানে গেলে জমিলা অবশ্য অকপটে বলেছে, ‘দেখ, মেম্বার সাব, কাজটা কিন্তুক ঠিক হয় নাই। আমার স্বামীর সাথে কিন্তুক অহনও তালাক হয় নাই।’
বাচ্চু দাঁত খিঁচিয়ে বলেছে, ‘স্বামী! ওই শালা স্বামী হইলে তোমারে নিল না ক্যান? আমি কি দেনদরবার কম করছি? হের কথা তুমি মন থেকে মুইচ্ছা ফালাও।’
জমিলা মনমরা হয়ে বলেছে, ‘দ্যাশ আছে না, সমাজ আছে না? হে আমারে ফিরাইয়া না নিলেও ছাইড়াও তো দেয় নাই; তুমি আমারে কেমনে বিয়া করবা কও?’
বাচ্চুর এসব প্যাঁচালে আগ্রহ থাকার কথা নয়। সে জমিলাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, ‘এইসব ঝামেলা আমার উপর ছাইড়া দেও ময়না পাখি। তোমার লাইগা সব ঝড়-ঝাপটা আমি মাথায় নিমু। প্লিজ, এইসব বেদরকারি কথা কইয়া মনটা খারাপ কইরা দিও না।’
জমিলা বাচ্চুর কথায় আবার পটে যায়। বাচ্চু তাকে আইনের অজুহাতে বিয়ের জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলে। তারপর থেকে সুবিধা-মতো সপ্তাহে অন্তত একদিন সে অভিসারে আসে।
কিছুদিন পর জমিলা যখন পুকুরঘাটে বসে কাপড় কাচছিল তখন ছায়ার মতো একটা লোককে উত্তর পাড়ের গাবগাছের আড়ালে চলে যেতে দেখে চমকে উঠল সে। চমকে ওঠার কারণ ছিল, ওই ছায়ামূর্তিকে তার কাছে বেয়াড়া ময়েজুদ্দির মতো মনে হয়েছে। ছয় মাসের অধিক হয়ে গিয়েছে ময়েজুদ্দি তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও ময়েজুদ্দির ঘাড় সোজা করা যায়নি। অবশেষে বাধ্য হয়ে জমিলার পিতা হাশিম মৃধা নিজের গ্রামের বাচ্চু মেম্বারের দ্বারস্থ হয়েছিল। এতে ঘটনার সুরাহা না হয়ে তা বরং অন্যদিকে মোড় নিয়েছে।
হঠাৎ পুরনো স্মৃতির সাথে খুন্তি পীরের তাবিজ-কবজের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় জমিলার বুকের ধুকপুকানি আরও বেড়ে যায়। পীরের তাবিজ-তুমারির আসর কি তাহলে একটু হলেও ময়েজুদ্দির ওপর পড়েছে? তার মনটা কি নরম হতে শুরু করেছে? কিন্তু অনেক দেরি যে হয়ে গিয়েছে। জমিলার মা এখনও আন্দাজ করতে না পারলেও সে নিজে বুঝতে পারছে তার শরীরটা কেমন কেমন করছে। বমি বমি ভাব হয়। ময়েজুদ্দি জন্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেয়ায় জমিলার এ ধরণের অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। তবে সে জানে পেটে বাচ্চা এলে শরীরের অনেক পরিবর্তন হয়। সেজন্যই গত কয়েকদিন ধরে বাচ্চু মেম্বারকে সে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু বাচ্চু মেম্বার শুধুই অপেক্ষার কথা বলে। জমিলা বলেছে, ‘তুমি দেরি করলেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’ শেষ যেদিন বাচ্চু এসেছিল – প্রায় দশদিন আগে – সেদিন বলেছিল, ‘এত অস্থির হইও না সোনা, আমার ঘরের মাগীটারে মেনেজ করার চেষ্টা করতাছি। ওই দিকটা সামলাইয়াই তোমারে উঠাইয়া নেয়ার বেবস্থা কইরা ফালামু।’ জমিলা তখন বলেছিল, ‘যদি তোমার বউ ঝামেলা পাকায়, তহন আমার কী অইব?’ বাচ্চু মেম্বার অবলীলায় বলেছিল, ‘ঝামেলা অইব না, ঝামেলা অইব না। আর যদি দেখা যায় আরেকটু দেরি অইব তয় অন্য বেবস্থা আছে; তুমি চিন্তা কইরো না।’
অন্য ব্যবস্থা বলতে বাচ্চু কী বুঝিয়েছে তা তাৎক্ষণিকভাবে জমিলা বোঝেনি কিংবা জানতে চায়নি। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে জমিলার ভয় তত বাড়ছে। তাছাড়া গত দশদিনের মধ্যে বাচ্চু মেম্বার না আসায় তার মতিগতির প্রতি জমিলা কিছুটা সন্দিহান হয়ে পড়েছে। এমনই ক্রান্তিকালে ময়েজুদ্দি যদি তাকে আবার ফিরিয়ে নিতে চায় তখন জমিলা কী করবে? জমিলার নিজের কিংবা তার বাপের কোনো মোবাইল ফোন নেই। নইলে বাচ্চু মেম্বারের খোঁজ নেয়া যেত। এমন বিশ্বস্ত কেউ নেইও যার মাধ্যমে বাচ্চুর কাছে খবর পৌঁছানো যায়। এসব ভাবনা জমিলাকে অস্থির করে তোলে।
আরও এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও বাচ্চু যখন জমিলার কাছে এল না তখন সে পাগলপ্রায় হয়ে ওঠে। মেয়ের উদ্ভ্রান্ত অবস্থা লক্ষ্য করে জমিলার মা এই ভেবে কষ্ট পায় যে ময়েজুদ্দির সাথে ঘর করতে না পেরে হয়ত মেয়েটি নিজেকে অপয়া মনে করছে। তাই মেয়ের মনটা হালকা করার জন্য সে গোপন কথাটি বলেই ফেলল। সে জমিলাকে কানে কানে বলল যে তাদের বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য ময়েজুদ্দি বাচ্চু মেম্বারের শরণাপন্ন হয়েছে। কিন্তু অতীতে অনেক চেষ্টার পরও যেহেতু ময়েজুদ্দি বাচ্চু মেম্বারের কথার মূল্য রাখেনি তাই সে এ আলাপের মধ্যে থাকতে চায় না। তাই হাশিম মৃধা এখন বাচ্চুর পরিবর্তে অন্য একজন মধ্যস্থতাকারীর খোঁজে আছে।
মায়ের সান্ত্বনাবাণী শুনে জমিলা একটি কথাও বলল না, একটু চোখের পানিও ফেলল না; মায়ের মুখের দিকেও তাকাল না। হাতের কাজ সেরে সে তার চৌকিতে গিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে সে দেখতে পেল ঘুটঘুটে অন্ধকার এক জগত। ওখানে তার বাপ-মা কেউ নেই, ময়েজুদ্দি কিংবা বাচ্চু মেম্বার নেই, তার লাঞ্ছিত জীবনের দুঃখ শুনবার মতোও কেউ নেই। সে বুঝতে পারে আলোময় পৃথিবী তার জন্য বিভীষিকাময়; অন্ধকার জগতই নিরাপদ। এই পৃথিবী খুন্তি পীর, ময়েজুদ্দি এবং বাচ্চু মেম্বারেই পরিপূর্ণ। এখানে বেঁচে থাকতে হলে এদের কারুর না কারুর থাবার নিচেই থাকতে হবে। কিন্তু তার যে সে সুযোগও হাতছাড়া। বাচ্চু মেম্বার তাকে যে উদ্ধার করতে আসবে না তা পরিষ্কার। আর ময়েজুদ্দি? সে নিজে বদমাশ হলেও কলঙ্কিত স্ত্রীকে কি ফিরিয়ে নেবে?
জমিলা সিদ্ধান্ত নেয়, আজ রাতে সে কারও অপেক্ষা করবে না। তার নিজের মুক্তির জগত নিজেই খুঁজে নেবে।