জন্মভূমির ঋণ

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০২১)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • 0
  • ২৬
বলা নেই কওয়া নেই সবাইকে চমকে দিয়ে একদিন হঠাৎ করে দেওয়ানেরচালায় আবির্ভূত হন জাকির হোসেন। প্রায় সবাইকে টেনেটুনে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার পর বিরান পৈত্রিক ভিটায় বাতি জ্বালাবার জন্য একমাত্র ফুফুকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল, জীবনের শেষ দিনগুলো স্বামীহারা ফুফু যেন একটু আরাম আয়েশে কাটাতে পারেন; তাছাড়া বাড়িঘর দেখেশুনে রাখার মত বিশ্বস্ত এবং আপন মানুষই দরকার ছিল। ফুফু অবশ্য বেশ আগেই ইহধাম ত্যাগ করেছেন। এখন ফুফুর দুই ছেলে সালাম ও কালাম মামার বাড়িকে নিজের বাড়ি বানিয়েই থাকছে। আমেরিকা থেকে মামার গোষ্ঠীর কেউ এলে আর কতদিনই বা থাকে। সালাম-কালামের পরিবার অবশ্য প্রাণ ঢেলে তাদের যত্ন-আত্তি করে। এ ব্যবস্থায় দুই পক্ষই সন্তুষ্ট।

অতুল চন্দ্র সাহা খবরটি কালামের কাছ থেকে জানতে পারেন দু’দিন পর। তিনি কালামকে বলে দিয়েছেন, ‘জাকিররে কইস আমি কাইল সকালে আমু। আইজকা ইউনিয়ন অফিসে আমার জরুরি কাম আছে। কতক্ষণ লাগে জানিনা।’ জাকির হোসেন আর কালকের অপেক্ষায় না থেকে ওইদিন বিকেলেই চুপি চুপি গিয়ে হাজির হন অতুলের বাড়িতে। অতুল বিকেলের আগেই ফিরে এসেছিলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনি ছিপ নিয়ে পুকুরঘাটে বসেছেন মাত্র। পাশে বসে আছেন স্ত্রী পুষ্পরাণী। বড়শী দিয়ে মাছ ধরা অতুলের পুরনো শখ। ঘন্টাখানেক বসলে দেখা যায় চারটা কৈ, দুইটা টাকি এবং কয়েকটা পুঁটি শিকার করা গেছে। এতেই তার আনন্দ।

পায়ের আওয়াজ শুনে অতুল পেছন ফিরে তাকান। পরিচিত মুখ দেখে তিনি হৈ হৈ করে ওঠেন, ‘আরে জাকির‍্যা না? তুই তো আরো বুইড়া হইয়া গেছস, আমি চিনতে পারতেছি না!’ তারপর দুই বন্ধুর কোলাকুলি।

‘আমি বুইড়া হইছি, আর তুই জওয়ান হইছস?’ বলতে বলতে জাকির বৌদির দিকে তাকান। ‘বৌদির এ কী অবস্থা?’ এক সময়কার গুলবদন পুষ্পরাণীর পাপড়ি যেন আর অবশিষ্ট নেই। দিনে দিনে আরোও ভেঙ্গে পড়েছেন।

বৌদির সব হারিয়ে গেলেও সেই মিষ্টি হাসিটি এখনও মুখে লেগে আছে। তিনি বলেন, ‘আইজ আমাগো কী সৌভাগ্য।’

অতুল বলেন, ‘চল, ঘরে চল; আইজ আর মাছ ধরুম না।’

‘মাছ না ধরলে বৌদি ঠেঙ্গাইব’, জাকির বলেন।

অতুল বলেন, ‘ধুর, ঠেঙ্গানোর সেই তাকদ নাই। কুনুরকম টাইন্যা-টুইন্যা চলে।’

দুই বন্ধুর গপ্পো-সপ্পোতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। জাকির বিভাসের দেয়া ভিটামিন আর ক্যালসিয়ামের ট্যাবলেটের পোটলা তার বাবা-মায়ের হাতে দেন। বিভাসের মা অসুস্থ হলেও জাকিরের উপস্থিতিতে বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। চিড়া, নারকেল, নাড়ু খেতে দেন জাকিরকে। বৌদির হাতের লেবু চা জাকিরের খুব পছন্দ, সেটাও তিনি দিতে ভুলেন না। জলখাবার খেতে খেতে জাকির অতুলের দেশপ্রেমের এন্তার বয়ান শোনেন। বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য তিনি এক বিঘা জমি যে আজ সাফ কবলা করে দিয়ে এসেছেন সেটাও অতুল বন্ধুকে জানান।

বিদায় নেবার আগে জাকির বলেন, ‘যা করবার কইরা নে, এইবার তোমগোরে নিয়াই যামু। বৌদি রেডি অইয়া যাও।’

বৌদি শুকনো হাসি দিয়ে বলেন, ‘আমার আর যাওনের সময় শেষ। বিভাস তো ফোন কইরা জালাইতাছে কবে থেইকা।’

অতুল তখন হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকাতে থাকেন।

কিছুদিন আগে বিভাস এসেছিল বাবার বন্ধু জাকির চাচার কাছে। প্যাটারসনে দীর্ঘদিন থেকেই আছেন জাকির চাচা। বিগত চল্লিশ বছরে গুষ্টিশুদ্ধ প্রায় সবাইকে বিভিন্নভাবে নিয়ে এসেছেন আমেরিকায়। তবে গুষ্টির বেশির ভাগই এখন তার কাছাকাছি নেই। সবাই যার যার মতো ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন রাজ্যে। জাকির চাচা কিন্তু তার স্বস্থানেই শেকড় গেড়ে আছেন মূল থেকে।

এবার শীত বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল নিউ জার্সিতে। নর্থে বেশ তুষারপাত হয়েছে। কোভিডের প্রকোপ কম থাকায় ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার্স মোটামুটি হুল্লোড়েই কেটেছে। অবশ্য এসব হুল্লোড় বিভাসকে খুব কমই প্রভাবিত করেছে এবার। বরং গেল পূজায় দেশের সাম্প্রদায়িক হঠকারিতায় তার মনটা ভারী হয়ে আছে। ক্যাব চালিয়ে মোটামুটি ভালই কামাই-রোজগার করে সে। ঘর কিনেছে প্যাটারসনেই। কোভিডের কারণে পৃথিবী নিশ্চল থাকায় সে ও বেশ কিছুদিন সময় দিতে পেরেছে স্ত্রী-কন্যাকে। ঘরবন্দী থাকলেও জাকির চাচার খোঁজ-খবর রেখেছে নিয়মিত। এমনিতেই সময় পেলে বিভাস হুট করে ছুটে এসে চাচা চাচীকে এক নজর দেখে যায়। তারাও বিভাসকে পরিবারের একজন হিসেবে দেখেন। চাচীর করোনা পজিটিভ ধরা পড়লেও ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়ার কারণে অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে যায়নি। তবে চাচীর পুরো পরিবারসহ বিভাসের মনের উপর বিভীষিকা ভর করেছিল বেশ কিছুদিন।

জাকির চাচার সাথে কফি খেতে খেতে বিভাস তার পুরনো আক্ষেপ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার বলেছিল। তা সে প্রতিবারই করে। তবে কিছুদিনের মধ্যে জাকির চাচা দেশে যাবেন শুনে সে তাকে চেপে ধরেছিল সেদিন। দেশের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে একটা জুতসই কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে বিভাস বলেছিল, ‘এবার বাবাকে ছাড়বেন না চাচা। আপনি ঠিকমত ধরলে বাবা এবার না বলতে পারবে না।’

জাকির চাচা বলেছেন, ‘দেখ বাবা, অতুল আমার ছোটবেলার বন্ধু। তোর বাপ অইলেও আমি তারে তোর চাইতে বেশি চিনি। ওয় ভীষণ গোঁয়ার। তুই তো অনেক কায়দা কইরা নিয়া আইলি একবার; রাখতে পারছস? কিছুদিন থাকলে তো গ্রীনকার্ড পাইয়া যাইত।’

‘বলবেন, মা মারা গেলে সে একা একা থাকবে কেমন করে?’ বিভাস বলে, ‘মায়ের তো অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। এখানে নিয়ে এলে তার ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারতাম অন্তত। আর আপনারা দুই বন্ধু এখানে পাশাপাশি থাকলে আবার হৈ হুল্লোড় করে সময় কাটাতে পারতেন।’

জাকির চাচা বলেন, ‘আমি কি আর কম বুঝাইছি। তারে কইছি যে তোর কাম করতে অইব না; শুধু স্যুটেড বুটেড অইয়া আমার সুন্দরবন রেস্টুরেন্টে গিয়া এক কোণে বইসা কফি খাইবি, আর আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে তোর লগে গল্প-গুজব করুম; উইকেণ্ডে তোর হাতে একমুইঠ কচকচে ডলারও ধরাইয়া দিমু। তবু হে মানল না। আর অহন তো আমি রিটায়ার্ড!’

বিভাস বলে, ‘না, এখন তো আর আপনাদের কাজের প্রশ্নই উঠে না। দুজনে চুটিয়ে আড্ডা দিতেন আর ঘুরে বেড়াতেন, এই আর কি।’

‘আগে যাই দেশে; আবার কইয়া দেখুম’, জাকির চাচা বলেন।

তখন চাচি গ্রিন টি’র কাপ হাতে নিয়ে কাউচে বসলে বিভাস বলে, ‘চাচীর অসুবিধা হবে না একা থাকতে?’

চাচি বলেন, ‘ক্যান? তোরা আছিস না? আর সাব্বিরের মাইয়া তো আইসা আমার লগে থাকব কইছে।’

সাব্বির জাকির চাচার ছোট ছেলে। দুই ব্লক পরে সে আলাদা বাসায় থাকে। ডাউন টাউনের সুন্দরবন রেস্টুরেন্ট এখন পুরোপুরি তার দায়িত্বে। জাকির চাচা কালেভদ্রে চাচিকে নিয়ে একটা চক্কর দিয়ে আসেন; অনেকটা কাষ্টমারের মত। স্টাফের চাপাচাপিতে কখনও কোনো স্পেশাল আইটেম একটু চেখেও দেখেন। তাছাড়া প্রায়ই সাব্বির রেস্টুরেন্ট থেকে বাবা-মা’র প্রিয় খাবার বাসায় পাঠিয়ে দেয় যাতে মাকে কষ্ট করে রান্না করতে না হয়। বড় ছেলে আমির সস্ত্রীক নিউ ইয়র্কে ইউএস পোস্টাল সার্ভিসে চাকরি করে। চাকরি করতে যেয়ে কুর্দি বংশোদ্ভূত নাযদার নামক সহকর্মীর সাথে ভাব হয়ে গেলে পরিবারের মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও আমিরের পিড়াপীড়িতে শেষপর্যন্ত শুভকর্ম সম্পন্ন হয়। দু’সন্তান নিয়ে তারা বেশ সুখেই আছে। আমির মাসে অন্তত একবার নিউ জার্সিতে বাবা-মাকে দেখতে যায়। স্ত্রী-সন্তান ফ্রি থাকলে তারাও আমিরের সাথে গিয়ে জাকির দম্পতির বাড়ি গুলজার করে আসে। ছেলেরা মোটামুটি কাছে থাকলেও মেয়ে ফাতেমা একটু দূরে থাকে; জামাইয়ের কর্মস্থল মিশিগানে। ওখানে অবশ্য পরিবারের অন্য সদস্যরাও আছে। তাই মা-বাবার অভাব খুব একটা বোধ করতে হয় না ফাতেমাকে।


দেশ-গেরামের নিরাপত্তা নিয়ে প্রবাসীরা শঙ্কিত থাকলেও জাকির হোসেন কোনোদিনই ওসব পাত্তা দেননি। দেশে এলেই পুরনো বন্ধুদের নিয়ে হৈহল্লা করে হাটে-বাজারে আড্ডা দিতে থাকেন। গরীব-দুঃখী এবং অসুস্থ কিছু বন্ধু সবারই থাকে। জাকির হোসেনেরও আছে। তিনি তাদের হাত খুলেই সহায়তা করেন। তাছাড়া অনেকের ছেলেকে রুটিরুজির জন্য বিদেশে পাঠানোর সময়ও জাকির হোসেন মোটা অঙ্কের অনুদান দিয়েছেন। তাই জাকির হোসেন দেশে এলেই এই বুড়ো বন্ধুরা নিজেদের কাজকর্ম ফেলে পুরনো দিনে ফিরে যায়।

অতুল আগেই বলে রেখেছিলেন আজকের আড্ডা সংক্ষিপ্ত করে সন্ধ্যায় জাকিরকে তার বাড়িতে যেতে হবে। কারণ, বৌদি জাকিরের পছন্দের পিঠা-পুলি বানাবেন; সাথে ভাপা পিঠা তো আছেই। আর রাতের খাবারে থাকবে হরেক পদের ভর্তা। তাছাড়া পুকুরে জাল ফেলে কিছু বনেদী দেশি মাছও তোলা হয়েছে; সেগুলো দিয়ে হবে নানা কিসিমের আইটেম।

জাকির রেগে গিয়ে অতুলকে বলেন, ‘তুই বৌদিরে কষ্ট দিতে গেছস ক্যান? বৌদি কি আর আগের মত আছে?’

‘আমার কি ঠেকা পড়ছে?’ অতুল বলেন, ‘বুড়ির ইচ্ছা হইছে তোরে খাওয়াইব; কষ্ট হইলে হউক।’

পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে বৌদির হাতের পিঠা-পুলি খেতে খেতে জাকির বলেন, ‘বৌদি, তোমার হাতের যাদু আগের মতোই আছে; খালি আমাগো মেশিন দুর্বল হইয়া গেছে, হা হা হা।’

বৌদি বলেন, ‘আর কত? তয় তোমার বন্ধু আমার থাইকা অনেক ভালা আছে।’

অতুল বলেন, ‘তা ঠিক। তোর বৌদি খুব তাড়াতাড়ি কাহিল হইয়া পড়ল।’

পুরো সময় ধরে দুই বন্ধু দেশ-দুনিয়া নিয়ে অনেক কথাবার্তা বললেন। একাত্তরে উন্মাতাল দিনে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও দুজনই যে দেশের জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন নতুন করে সেসব গল্পও আবার করলেন। তবে দেশের আজকের অবস্থার জন্য দুজনেরই যারপরনাই আক্ষেপ।

দেশে আসার সময় বিভাস অনুনয় বিনয় করে যে কথাটা তাকে বলেছিল তা যুতসই করে উপস্থাপনের মওকা খুঁজছিলেন জাকির হোসেন। তাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই কৌশলে আলোচনার সূত্রপাত করলেন। বন্ধু অতুলকে বললেন, ‘তোরে আইজকা কিছু সিরিয়াস কথা জিগামু; উলটাপালটা উত্তর দিস না।’

‘সিরিয়াস কথা? হেইটা আবার কী?’ অতুল বলেন।

‘আচ্ছা ক তো, তুই যে একা দেশে পইড়া রইছস, তোর ডর লাগে না?’

‘কী কইতে চাস?’

‘এই যে পূজার সময় দুষ্ট লোকেরা হাঙ্গামা বাধাইয়া দিল; সুযোগ পাইলেই দাঙ্গা ফাঙ্গা লাগাইয়া দেয়। এই সবের মাঝে তুই এইখানে পইড়া রইছস কেন?’ জাকির বলেন।

অতুল মাথা ঝাঁকান। বলেন, ‘তার মানে তুই কইতে চাস, ভিটামাটি সব তোর কাছে বেইচ্যা দিয়া পালাইয়া যাই?’

‘আরে পাগল, আমি কি তাই কইছি?’

‘তয় কী? বিটিশের সময় দুষ্ট লোক ছিল না? পাকিস্তানের সময় দুষ্ট লোক ছিল না? অনেকে দেশ ছাইড়া পালাইয়া গেছেগা ঠিকই, কিন্তু আমার বাপ তো যায় নাই। ক্যান, তোর মোদীর দেশে কি শয়তান লোক কম আছে? এই দেশ আমার, এই দেশের লাইগ্যা আমিও রক্ত ঝরাইছি। আমি কুত্থাও যামু না।’

জাকির কিছুটা বিব্রত হয়ে বলেন, ‘আমার কথা বুঝতে চেষ্টা কর। আমি কি তোরে পালাইয়া যাইতে কমু। তোগো একটাই পোলা। তারও তো মন চায় তোগোরে লইয়া থাকতে। যতদিন বাঁচবি একটু আরাম-আয়েশে কাটাইতে পারতি।’

‘হে বিদেশে গেছে ক্যা? আমি কি তারে বিদেশে যাইতে কইছি?’ অতুল বলেন, ‘তারে আর কী কমু; তুই নিজেই তো যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন কইরা আমেরিকায় যাইয়া রিফুজি অইয়া গেলিগা।’

জাকির বলেন, ‘আমি তো বাধ্য হইয়া দেশ ছাড়ছি। আর অতুল বিদেশে গিয়া কী দোষ করছে? সারা দুনিয়ার মানুষ কপাল ফিরানোর লাইগ্যা উন্নত দেশে যায়। ছেলেপিলেরা মানুষ হয়; কাম-কাজ, চিকিৎসার সুযোগ পায়। দেশে থাকলে কী করতে পারত?’

হঠাৎ টর্চ হাতে কালাম এসে হাজির হয় সে মুহূর্তে। বলে, ‘ভাইজান, চলেন। রাইত অনেক অইছে।‘

পুষ্পরাণী তখন হন্তদন্ত হয়ে বলেন, ‘এই কালাম, খাড়া।’ কাগজে পোটলা বেঁধে কয়েকটা ভাপা পিঠা কালামের হাতে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই গুলান নিয়া যা, তোর বউয়ের হাতো দিস।’

কালাম বলে, ‘খালি বউই খাইব? আমার কি ভাগ নাই বৌদি?’

পুষ্পরাণী হাসতে হাসতে বলেন, ‘চিন্তা নাই, তুইও একটা ভাগে পাইবি।’

জাকির বৌদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হতে হতে অতুলকে বললেন, ‘তোর লগে কথা শেষ অয় নাই। আরেক সিটিং দিমু। পচা সেন্টিমেন্ট নিয়া কুনো কথা কইবি না।’

অতুল বলেন, ‘বুজছি, তুই কী কইবি। যা, কাইল দেখা অইব।’

দুই দিন পর ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক নিজের বাগানের কিছু পাকা পেঁপে এবং কচি ডাব নিয়ে এসে হাজির হয় জাকির হোসেনের বাড়িতে। ছেলের বয়সী ফারুককে খুবই স্নেহ করেন জাকির। টানা দু’বারের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ফারুক। এলাকার উন্নয়নে তার নিঃস্বার্থ অবদান সুবিদিত। এই নষ্ট সময়ে এমন সমাজকর্মী খুবই বিরল।

জাকিরের পা ছুঁয়ে সালাম করে ফারুক বলে, ‘চাচা মনে কিছু কইরেন না, কাজের চাপে এতদিন আপনার সাথে দেখা করতে পারি নাই।’

‘আমি জানি; অতুল আমারে তুমার কথা কইছে। তুমি অনেক ভালা কাজ করতাছ, আল্লাহ্ তুমারে পুরুস্কার দিব। আমরাও তুমার লাইগা দুয়া করি।’

ফারুক বলে, ‘অতুল কাকা আমার সাথে আছে বইলা অনেক সাহস পাই।’

জাকির বলেন, ‘এইটা সত্য। অতুল দেশ-পাগল মানুষ!’

‘আমি কুনো ভালা কাজে হাত দিতে গেলে অতুল কাকা ঝাপাইয়া পড়ে।’ ফারুক বলে, ‘একটা গার্লস ইস্কুলের কথা উঠতেই অতুল কাকা স্বেচ্ছায় জমি দিয়া দিল। এমন মানুষ খুব কমই আছে।’

‘হে মানুষের লাইগা কাম করতে আনন্দ পায়’, জাকির স্বীকার করেন।

‘আপনি তো জানেন, তারে কত রিকোয়েস্ট করছিলাম আমরা, কিন্তু না, সে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিব না।’ ফারুক আক্ষেপ করে।

‘হে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পসন্দ করে, করুক।’ জাকির বলেন, ‘চেয়ারম্যানির লাইগা তুমাগো মত ইয়াং লোক দরকার।’


জাকির হোসেনের ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু তিনি এখনও বন্ধু অতুলকে বাগে আনতে পারেননি। বিভাস দুই একদিন পর পর ফোন করে আপডেট জানতে চায়। সেদিন ইউনিয়ন অফিসে বেড়াতে গিয়ে ফারুককেও বিষয়টা বিস্তারিত বলেছেন জাকির। ফারুক নিমরাজি হলেও মানবিক কারণে সে যেন অতুলকে একটু বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করায় সে কথা তাকে খুব জোর দিয়ে বলে এসেছেন তিনি। ফারুক ভাল করেই জানে, অতুল কাকা খুব শক্ত মানুষ; দেশ ছেড়ে তিনি আমেরিকা প্রবাসী হবেন এটা অসম্ভব ব্যাপার। তবু জাকিরকে বলে, ‘চেষ্টা কইরা দেখুম, চাচা।’

আমেরিকায় ফেরার আগের দিন অতুলের পুকুর ঘাটে গিয়ে জাকির কোনো কথা না বলে চুপচাপ তার পাশে বসেন। অতুল ছিপ থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার জাকিরের দিকে তাকান, কিন্তু কিছু বলেন না। আজ দু’জনেরই মন ভারী। একে তো আসন্ন বিচ্ছেদ, তার ওপর দুই বন্ধুর মধ্যে অনেক কথা কাটাকাটি চলছে। গত সন্ধ্যায় জাকির বৌদির হাতের চা না খেয়েই চলে গিয়েছেন। অতুলের একই কথা, ‘তোরা গেছস, যা; আমারে টানিস না।’

নীরবতা ভাঙ্গেন জাকিরই। বলেন, ‘বিভাস ফোন করছিল; খুব কানছে।’

অতুলের কোনো ভাবান্তর হয় না।

জাকির বলেন, ‘আচ্ছা, তুই কি দেশের বেবাকরে ফেরেশতা মনে করস? হেই দিন কি আছে? সম্পত্তির লোভে তোরে যদি কেউ গুম কইরা ফালায়? বামনবাড়িয়ার তাজুলের কথা মনে নাই?’

অতুল রোবটের মতো বলেন, ‘চা খাবি? কালকে তোর বৌদি খুব মন খারাপ করছে।’

জাকির অতুলের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘দেশে আসার আগে কাকুতিমিনতি কইরা কইয়া দিছে। ছেলেটার লাইগা কি তোগো একটু মায়া হয় না?’

অতুল হাত থেকে ছিপটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেন, ‘উঠ, একটু হাটি।’ তারপর জাকিরের হাত ধরে পুকুরের উত্তর পাড় ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকেন। পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণে পৌঁছা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলেন না।

অতুল দাঁড়িয়ে পড়লে জাকির প্রশ্ন করেন, ‘এইখানে কী?

অতুল তর্জনী দিয়ে মাটির দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘এইডা হইল আমার ঠিকানা। এইখানে আমার বাবা, ঠাকুরদা, পূর্বপুরুষ সবাইরে চিতায় তোলা হইছে। আমার চিতাও এইখানে পুড়ব।’

জাকির বুঝতে পারেন অতুল আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। তিনি বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘চল, চিতায় উঠার অনেক বাকি।’

দুই বন্ধু আবার নীরবে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরঘাটে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে পুষ্পরাণী কাঁসার পাত্রে দুই কাপ চা এবং চিড়াভাজা নিয়ে পুকুরঘাটে এসে হাজির হয়েছেন।

জাকির বৌদির দিকে তাকিয়ে হেসে দিলে তিনি বলেন, ‘আর তো খাওয়ানোর সুযোগ পামু না, শেষমেশ খাইয়া লও।’

জাকির বলেন, ‘আমার কপালই খারাপ। তুমরা আমেরিকায় চইলা আসলে রোজই খাইতে পারতাম।’

বৌদি কিছু বলেন না। তবে দেখে মনে হয় তার চোখ দুটি একটু আর্দ্র হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা জাকির সব সময়ই লক্ষ করেছেন যে দেশ ছাড়ার কথা বললেই অতুল মারমুখী হয়ে উঠলেও বৌদি অদ্ভুত নীরবতা পালন করেন।

অতুল ছিপটা হাতে নিয়ে আস্তে করে বলেন, ‘বন্ধু, তুই আমাকে যতই কঠিন মনে করিস না কেন, ছেলের লাইগা আমারও পরানটা পোড়ে।’ গামছা দিয়ে চোখ মুছে তিনি আবার বলেন, ‘হে তো বুঝে না, আমাগো সময় আর বেশি বাকি নাই। তারে কইস, একবার দেইখা যাইতে। তয় আমার শরিলডা আমি বিদেশের মাটিতে পুড়াইতে দিমু না।’

জাকির কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু বলতে পারেন না। তিনি বৌদির চোখের দিকে তাকান। ইতিমধ্যে বৌদির চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল টপ টপ করে মাটিতে পড়ে গেছে। ঘাটের দু’পাশের বাতাবিলেবু, নারকেল গাছ; উত্তর পাড়ের শিমুল, জারুল গাছ; পূব পাড়ের বাঁশবাগান; দক্ষিণ পাড়ের ঘন কলার বাগান, এমন কি পুকুরের কাল জল – সব যেন স্থির হয়ে থাকে কয়েক মুহূর্তেরে জন্য।

অতুল আবার মুখ খোলেন, ‘শেষ কথাটা কইয়াই ফালাই। কোনো তাজুল ফাজুল আমারে মারতে আইব না। আর মারলেও কিছু পাইব না। আমার অল্পবিস্তর যা কিছু আছে, সব দেশের লাইগা উইল কইরা রাইখা দিছি। এতে যদি জন্মভূমির ঋণ কিছুটা শোধ অয়।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৫৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪