লালী গাছের কাঁঠাল

বৃষ্টি ও বিরহ (আগষ্ট ২০২১)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • ১৯
প্লেট সাজিয়ে এনে টেবিলে রেখে মামুন কাঁঠালের গুণগান আরম্ভ করে, ‘আরে, তুমি যদি কাঁঠালের মর্ম বুঝতে তাহলে আম ছেড়ে কাঁঠাল ধরতে। তোমার তো অমৃতে অরুচি।’

পিংকি ফোঁসফোঁস করতে করতে বলে, ‘বাপ-পুত মিলে কচু পোড়া খাও, আমাদেরকে টেনো না।’

মামুন বলে, ‘শোন, কাঁঠালের পুষ্টির খবর রাখ? থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্ক, নায়াসিন….’

‘হয়েছে হয়েছে।’ পিংকি মামুনকে থামিয়ে দেয়। ‘হকারদের মত ক্যানভাস অনেক করেছ।’

তখন আর কী করা। মামুন ছেলেকে বলে, ‘আয় বাবা, আমরাই খাই।’

পলটু এক্ষেত্রে সব সময় চুপ করে মিটিমিটি হেসে কাঁঠাল গিলতে থাকে। কারণ এসময় কোনো কথা বলা যাবে না; মায়ের মেজাজ গরম।

মধুমাসে বাঙালিদের আমের দিকেই ঝোঁক থাকে বেশি । ইদানীং বেশ কিছু প্রজাতি যেমন যোগ হয়েছে তেমনি আমের চাষও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। পাহাড়ি এলাকায়ও এখন আমের বাগান তৈরি হয়েছে, তাই বাজারে আমের ঘাটতি নেই। কিন্তু মামুনের প্রিয় ফল কাঁঠাল। পিংকির ঝাড়ি খেলেও সপ্তাহে অন্তত একটা কাঁঠাল সে নিয়ে আসবেই।

পিংকি কাঁঠাল ছোবেই না, তাই স্ত্রীর বকাঝকা খেয়ে মামুনকে নিজ হাতেই কাঁঠাল ভাঙতে হয়। মায়ের মতো মেয়ে রিনিরও কাঁঠালের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই। তবে আম হলে মা-মেয়ে দুজনই গাপুসগুপুস করে খায়। পলটু আবার বাপের মত কাঁঠাল-পাগল। কাঁঠাল ভাঙ্গার সময় সে এসে বাপের কাছে বসে দলের ভারসাম্য রক্ষা করে। হাতে-মুখে আঠা মেখে গপাগপ সে একটার পর একটা কোয়া গিলতে থাকে। আর ওদিকে তার মা রাগে গজগজ করতে থাকে।

অবশ্য কাঁঠাল যে পিংকির খুবই অপছন্দ এমনটি নয়। মাঝেমধ্যে শখ করে দুয়েক কোষ সে-ও খায়। কিন্তু মামুনের মতো খোর সে নয়। আকাশটা কাল হলেই মামুনের একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে আসে। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। মচমচে মুড়ির সাথে মাখিয়ে তারিয়ে তারিয়ে তার কাঁঠাল খাওয়ার দৃশ্যই অন্যরকম। আর সাথে তো ছেলে পলটু আছেই।

লাগোয়া ফ্ল্যাটের রহমান ভাই মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। চিন ভারত থাইল্যান্ড থেকে বিভিন্ন ধরণের গিফট আইটেম আমদানি করেন এবং বিভিন্ন পার্টির কাছে পাইকারি দামে বিক্রি করেন। সেই সুবাদে বছরে অন্তত দু’তিনবার এদেশ ওদেশ করেন। বয়স পঞ্চাশের মত হলেও খাটতে পারেন তরুণদের মতো। মামুনের মতো তিনিও কাঁঠালভক্ত। তিনি বলেন, ‘আরে মামুন সাহেব, দেশ-বিদেশের ফল তো আর কম খাওয়া হল না। কিন্তু কাঁঠালই আমার ফেভারিট।’ সুস্বাদু কাঁঠাল ঘরে এলে মাঝে মাঝে তিনি মামুনকে ডেকে নিয়ে যান। কাঁঠাল খেতে খেতে রহমান ভাই রসিয়ে রসিয়ে বিভিন্ন বিদেশি ফলের গল্প করেন।

একটি বড় সফটওয়্যার ফার্মের অ্যাকাউন্টসে কাজ করলেও মামুনের খুব একটা বিদেশ যাওয়া হয়নি। বিয়ের কিছুদিন পর দশদিনের ছুটি নিয়ে সস্ত্রীক ভারতের কলকাতা, দিল্লী, আগ্রা, আজমির, জয়পুরে একটা ঝড়ো-ভ্রমণ করা হয়েছে বটে। কিন্তু এতে আয়েশ মেটেনি। চলতি পথে যেখানে যেটুকু পেরেছে পক্ষিনেত্রে দেখেছে, ছবি তুলেছে এবং যে খাবারে মন ধরেছে তা একটু চেখেছে। আর ফলমূলের তেমন বৈচিত্র্য না থাকলেও দিল্লীতে অল্পদামে কিছু আপেল আঙুর খেয়েছে। আর একবার সে অফিসের খর্চায় ব্যাংকক গিয়েছিল এক সপ্তাহের এক প্রশিক্ষণে। ওই যাত্রায় তার উৎফুল্ল হওয়ার অনেক কারণই ছিল। কিন্তু প্রশিক্ষণের চিপায় পড়ে বহুশ্রুত ব্যাংককের আসল রং রূপ উপভোগ করার সুযোগই পায়নি। প্রশিক্ষণের শেষদিন বিকেলে দৌড়ঝাঁপ করে কিছু শপিং করতে গিয়েই সময় চলে যায়। অবশ্য নতুন ফল হিসেবে কিছু রাম্বুটান, ড্রাগন ফ্রুট, মিষ্টি তেঁতুল ইত্যাদি সাথে করে নিয়ে এসেছিল। পরে এ বাসা ভাড়া নেয়ার পর রহমান ভাইয়ের সাথে পরিচয় হলে সে আরোও অনেক ফলের তথ্য জানতে পেরেছিল। তাদের বাসায় অল্পবিস্তর দিয়েছেনও রহমান ভাই। তবে ডুরিয়ান ফল শুধু একবারই তিনি দিয়েছিলেন।

একদিন ডুরিয়ানের একটি কোষ নিয়ে এসে রহমান ভাই পিংকির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভাবী, পলিথিন দিয়ে মুড়ে দিলাম, সাহেব বাসায় এলে খুলবেন, এক ধরণের বিদেশি কাঁঠাল। আপনিও একটু চেখে দেখবেন, খুব মিষ্টি।’ পিংকি হাসিমুখে সেই মহামূল্যবান বিদেশি ফল গ্রহণ করে বলল, ‘থ্যাংক ইউ রহমান ভাই।’ কিন্তু পরক্ষণে সেটি ফ্রিজে রাখতে যেয়ে সে কেমন এক বোটকা গন্ধ পেল।

মামুন বাসায় আসার পর ফলের পোটলা খোলা মাত্রই এর উৎকট গন্ধে লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়ে যায় তার বাসায়। পিংকি বমি করে ফেলে আর কি। যদিও মামুন ডুরিয়ানের অন্যান্য গুণসহ এর অ্যান্টিওক্সিডেন্ট প্রপার্টির কথা বুঝাতে চেষ্টা করেছে বহুভাবে, পিংকি রাগের চোটে মূল্যবান ফলের কোষটি ছুঁড়ে ফেলেছিল ময়লার ঝুড়িতে। মূলত সেদিন থেকেই পিংকি কাঁঠালের প্রতিও অ্যালার্জিক হয়ে পড়ে।

ঝুম বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বড়মামা এসে হাজির হয়েছেন মামুনের বাসায়। সাথে তাঁর ব্যাগ তো আছেই, বোঝা হিসেবে নিয়ে এসেছেন দুটি মাঝারি সাইজের কাঁঠাল। মানিকগঞ্জ থেকে বাসে করে এসে কল্যাণপুরে নেমেছেন। তারপর একটি রিক্সা নিয়ে ভাগ্নের বাসায় পৌঁছেছেন। ভাগ্যিস ছুটির দিন হওয়াতে মামুন বাসায়ই ছিল। সে টানা হেঁচড়া করে কাঁঠাল দুটি উপরে নিয়ে এসে মামার ওপর এক চোট নিল, ‘ঢাকা শহরে কি কাঁঠালের অভাব পড়েছে মামা; আপনি অসুস্থ মানুষ, এতদূর থেকে এগুলো টেনে নিয়ে আসার কোনো মানে হয়?’

বড়মামা জানেন মামুন কাঁঠালের পাগল। ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় আসবেনই যখন তখন ভাগ্নের জন্যে নাহয় একটু কষ্ট করেই লালী গাছের দুটো কাঁঠাল নিয়ে আসার কথা তাঁর মনে হল। আর এমনটি যে তিনি প্রথমবার করেছেন তা নয়। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে আগে কখনও ঢাকায় এলে প্রিয় ভাগ্নে মামুনের জন্য তিনি কাঁঠাল-আনারস নিয়ে এসেছেন। মামুনের ধমকের জবাব দিতে তিনি পান খাওয়া দাঁত বের করে বলেন, ‘লালী গাছের কাঁঠাল। তুই না খাইলে অসুবিধা নাই, আমার দাদাভাই খাইব।’ ইতিমধ্যে পলটু এবং রিনি এসে দাদুকে জড়িয়ে ধরেছে।

মামুন খাবে না মানে; আলবৎ খাবে। মামার বাড়ির সবচেয়ে মজার কাঁঠাল লালী গাছের কাঁঠাল। খাটো, ছড়ানো শাখা-প্রশাখার অনেক পুরনো গাছ। সুগন্ধি কাঁঠালের কোষগুলি একটু লালচে। এজন্যই বোধ হয় গাছটির নাম হয়ে যায় লালী গাছ। কিলবিল করা অনেকগুলো মামাতো ভাইবোনের টানেই হয়তোবা ছোটবেলা থেকেই সুযোগ পেলেই মামুন বুলেটের মতো মামার বাড়ি ছুটে যেত। আর ফলের মরশুমে তো কথাই নেই। কাঁঠাল ছাড়াও আম জাম লিচুও আছে মামার বাড়িতে। তবুও সবসময়ই তার প্রিয় ফল কাঁঠাল।

বড়মামা তিন-চার মাস পরপর ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় এলে অন্য কোথাও না গিয়ে মামুনের বাসায়ই ওঠেন। এতে তারা বিরক্ত হয় না বরং খুশিই হয়। পলটু আর রিনি তো আনন্দে রীতিমত লাফায়। পিংকিও যথেষ্ট করে মামা-শ্বশুরের জন্য। মামার জন্য ভাল খাবার-দাবারের আয়োজন করে; জোর করে দুয়েক দিন ধরেও রাখে। মামাও তাদের প্রাণ ঢেলে ভালবাসেন।

পাশের বাসার রহমান ভাইও লালী গাছের কাঁঠালের স্বাদ চেনেন। মামুনের বড়মামা এই বৃষ্টির দিনে যে কাঁঠাল নিয়ে এসেছেন তা রহমান ভাই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। অতএব সুস্বাদু গাছপাকা কাঁঠালের একটা অংশ যে তার বাসায় যাবে এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। এদিকে পিংকিও আজ তেমন নাক সিটকাচ্ছে না। কাঁঠালখোর না হলেও ওই মার্কামারা কাঁঠালের দু’চার কোষ সে আগ্রহ নিয়েই খায়।

মামা একাই যেতে পারতেন। কিন্তু ছুটির দিন বলেই মামুনও সাথে গিয়েছে ডাক্তারের কাছে। মামা মূলত হার্টের রুগি। দুটি বড় ব্লক আছে আর্টারিতে – ৭০% ও ৮৫%। আগের ডাক্তার বলেছিল ষ্টেন্টিং-এর কথা। কিন্তু মামা রাজি হননি। এখন তিনি ‘বিনা অপারেশনে হার্টের চিকিৎসা’র পদ্ধতিতে ডাঃ রফিকের চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে বেশ ভালই ছিলেন এতদিন। তবে কিছুদিন ধরে পেটের সমস্যায় বেশ ভুগছেন। কয়েকবার ওষুধ পরিবর্তন করা হলেও সমস্যাটি থেকেই যাচ্ছে। এবার তাঁর ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন একজন মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে যেতে। সৌভাগ্যক্রমে ডাঃ রফিকের সহায়তায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সাথে দেখাও করে এসেছেন তারা।

বড়মামা দৃশ্যত কোনো অস্বস্তি প্রকাশ না করলেও মামুন একটু ঘাবড়ে যায়। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এণ্ডোসকোপি করাতে বলেছেন। এবং প্রয়োজন হলে বায়োপসিও করাতে হতে পারে। মামার টাকাপয়সার সমস্যা নেই। সয়সম্পত্তি আছে। তাছাড়া তাঁর বড় ছেলে মানিকগঞ্জের বড় ব্যবসায়ী, ছোট ছেলে আছে ইতালিতে । মামুনের ভাবনার কারণ অন্য। ডাক্তার বায়োপসির কথা বলল কেন? তবে কি মামার কোনো জটিল সমস্যা আছে?

বড়মামার নিয়ে আসা দ্বিতীয় কাঁঠালটি পেকেছে। এণ্ডোসকপির জন্য মামার গলায় একটু ব্যথা আছে, তাই তিনি রাতে ভাত খাবেন না বলেছেন। কিন্তু মামুন অনেক সাধাসাধি করায় অবশেষে বললেন, ‘ঠিক আছে, বৌমা ঘিয়ে ভাজা মুড়ি নিয়ে আস, কাঁঠাল দিয়া খামু।’ এই জিনিসটা মামা পছন্দ করেন ঠিকই; তাই বলে ডিনারের খাবার ঘিয়ে ভাজা মুড়ি? এটা বড়মামার স্বাভাবিক আচরণ নয়। আজ তাঁর এণ্ডোসকোপি করতে গিয়ে বায়োপসিরও স্যাম্পল নিয়েছে ডাক্তার। তাই মামুনের মন খুবই বিষণ্ন; পিংকিরও। পিংকি ইতিমধ্যে পলটু-রিনিকে ভাত খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছে। মামা ভাত খাবেন না তাই মামুন-পিংকিও খায় নি। তারা বলেছে, ‘মামার সাথে বসে আমরাও গল্প করতে করতে কাঁঠাল খাব।’

বাইরে মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে দমকা হাওয়া। দূর আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুতও চমকাচ্ছে। পিংকি কাঁঠাল মুড়ির সাথে মামার জন্য এক গ্লাস দুধও এনে রেখেছে ডাইনিং টেবিলে। সদাহাস্য মামা আজ খুব একটা হল্লা করছেন না। মামুনের ধারণা তিনি হয়ত একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ডাক্তার বলেছে বায়োপসির রিপোর্ট আরোও দুদিন পর পাওয়া যাবে। তখন সমস্যা বোঝা যাবে।

মামা কাঁঠাল খেতে খেতে বলেন, ‘জান বউমা, এই কাঁঠালগাছটা অনেক পুরানা। আমার বাবার হাতের লাগানো গাছ।’

‘খুব মজার কাঁঠাল। আমি তো কাঁঠাল খাইই না, কিন্তু আপনার লালী গাছের কাঁঠাল আমার খুব পছন্দ, মামা’, পিংকি বলে।

বড়মামা বলেন, ‘তোমাদেরে আগে একটা কথা কইয়া লই; তোমরা আমার জন্য এত চিন্তা কইরো না। অসুখ-বিসুখ মানুষের হয়। জন্মাইলে মরতে অইব, এইটাই নিয়ম। হায়াত মউতের খবর আল্লাহ্ ভাল জানেন।’

‘না না মামা। আমরা ঠিক আছি। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার তেমন কিছু হয়নি, ইনশাল্লাহ ভাল হয়ে যাবেন।’ মামুন বলে, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন; আপনার নাতি-নাতনির সাথে খেলাধুলা করেন। রিপোর্ট পাওয়ার পর চিকিৎসা শেষ করে তবে যাবেন।’

মামা হাত নেড়ে মামুনকে বাধা দিয়ে একটু মুচকি হাসেন। পরে বলেন, ‘এই কাঁঠাল গাছের ডালে তুই বান্দরের মত ঝুইলা আনাম কাঁঠাল খাইতি, মনে আছে?’ বলে, মামা হা হা করে হেসে ওঠেন।

মামুন বুঝার চেষ্টা করে এটা কি মামার প্রসঙ্গ পালটাবার ছল। সে বলে, ‘হ্যাঁ মামা, শুধু আমি কেন; সালাম ভাই, সাত্তার – আমরা সবাই মিলেই তো বাঁদরামি করতাম।’

মামার খাওয়া হয়ে গেলে তিনি হাত ধুয়ে এসে ড্রয়িংরুমের জানালার পর্দা সরিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকেন। দোকান থেকে কিনে আনা একটা পানের খিলি মামার হাতে তুলে দিয়ে পিংকি বলে, ‘খুব আরামদায়ক আবহাওয়া না মামা? চলেন, আমরা সোফায় বসে গল্প করি।’

মামা পান চিবোতে চিবোতে সোফায় হেলান দিয়ে বসেন। মামুন ও পিংকি মামার উলটা দিকের সোফায় বসে। মামাকে আজ অন্যরকম গুটানো মনে হচ্ছে। তিনি চোখ নিমীলিত করে বলেন, ‘গত রাইতে তোর নানারে স্বপ্নে দেখছি।’

মামুন মামার কথা শুনে একটু ভড়কে যায়। সে পিংকির মুখের দিকে তাকায়। পিংকির চোখেও এক ধরনের অস্বস্তি। মামুন তবুও বলে, ‘আচ্ছা! তো নানার সাথে কী কথা হল, মামা?’

‘নাহ্, তেমন কিছু না। কইল, কিরে বাজান, কই থাকস, তোরে অনেকদিন দেখি না।’ মামা চোখ খুলে একটু মুচকি হেসে বলেন, ‘কয়, তুইতো বুড়া হইয়া গেছস, চিনা যায় না।’

পিংকি বলে, ‘নানী সাথে ছিলেন নাকি, মামা?’

মামা বলেন, ‘না, তয় মিনারে দেখলাম…।’ একথা বলে মামা আবার চোখ বুজলেন। এবং বেশ কিছুক্ষণ আর কিছু বললেন না।

মিনার প্রসঙ্গ উঠলে মামুনের সাধারণত কিছু বলার থাকে না। মিনার কথা পিংকিরও জানা। অন্য সময় হলে পিংকি সহমর্মিতামূলক কোনো কথা বলত। কিন্তু আজ আর মামার কথার ওপর মন্তব্য করতে ভরসা পাচ্ছে না।

পরদিন সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে বসেই মামা বললেন, ‘মামুন, তোর লগে আমিও বাইর হইয়া যামু?’

পিংকি বলে, ‘কী বলেন, মামা?’ সাথে মামুনও লাফ দিয়ে ওঠে, ‘আপনার রিপোর্ট পাইনি, চিকিৎসার আগামাথা কিছুই ঠিক হয়নি। এসব কী বলছেন, মামা?

বড়মামা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেন, ‘না রে, রিপোর্ট তুই আইনা রাখিস। আমার মন মানতেছে না। আমার বাবার কবরটা দেখবার মন চাইতেছে।’

মামুন বলে, ‘এইতো দু’চারদিন, তারপর চলে যাবেন।’

মামা তাড়াহুড়া করে ডিম-পাউরুটি মুখে পুরতে পুরতে বলেন, ‘আমার যাইতেই অইব। আমার মাইয়াটারেও দেখছি, লালী গাছের নিচে দাঁড়াইয়া আছে।’ মামার গলা ধরে আসে, চোখও চিক-চিক করে, ‘লালী গাছের কাঁঠাল সে-ও খুব পছন্দ করত।’

মামুন ভাল করেই জানে, লালী গাছের কাঁঠাল মিনার অনেক প্রিয় ছিল। শুধু কাঁঠালই নয়, মিনার আরোও অনেক প্রিয় অপ্রিয়র খবর মামুন জানত, যা অন্যরা হয়ত জানেনি।

বড়মামাকে গাবতলীতে নিয়ে বাসে উঠিয়ে দিয়ে মামুন অফিসের উদ্দেশে রওয়ানা করে। মামার এসব অদ্ভুত আচরণে তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। তার মনে হয় মামা হয়ত ভেবে নিয়েছেন তাঁর বড় ধরণের কোনো অসুখ হয়েছে; হয়ত তাঁর সময় আর বেশি বাকি নেই। কিন্তু রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলাও যাচ্ছে না। তার আরোও খারাপ লাগছে মিনার প্রসঙ্গ চলে আসায়। মামুন সব সময়ই মিনার ছবি মাথা থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছে। নিজ থেকে সে কখনও মিনার কথা বলে না, পিংকির কাছেও না। তাদের বিয়ের এক সপ্তাহ পর মিনা লালী গাছের ডালে কেন গলায় ফাঁস পরেছিল তার রহস্য আজও অজানা; একটা চিরকুটও সে লিখে যায়নি।

বাসায় ফিরে এলে পলটু-রিনি ‘দাদা কোথায়, দাদা কোথায়’ বলে মামুনকে জড়িয়ে ধরে। ওদের মা মিথ্যে করে বলেছিল, ‘দাদা ডাক্তার দেখিয়ে তোদের আব্বুর সাথে চলে আসবে।’ তাই মামুনকেই সামাল দিতে হল এই বলে যে, দাদা আরোও কাঁঠাল নিয়ে আসার জন্য বাড়িতে গেছেন; দুদিন পরেই আবার চলে আসবেন।

মামুন ফ্রেশ হয়ে এলে পিংকি চা নিয়ে আসে। সঙ্গত কারণে দুজনেরই মন খারাপ। একে তো মামার স্বাস্থ্যবিষয়ক উদ্বেগ, উপরন্তু তাঁর অনাকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নদর্শন সার্বিক পরিবেশকে গুমোট করে দিয়েছে। পিংকি মামুনকে জিজ্ঞেস করে, ‘মামীর সাথে কথা হয়েছে তোমার?’

মামুন বলে, ‘না, মামীর সাথে হয়নি, তবে সালাম ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। তারও মনটা খারাপ হয়ে গেছে। রিপোর্ট আসার পর সে-ই মামাকে নিয়ে আসবে বলেছে।’

পিংকি সাথে সাথে বলে, ‘আল্লাহ্ মাফ করুক, খারাপ কিছু যেন না হয়।’

‘হ্যাঁ, দোয়া করো’, মামুন বলে।

কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর পিংকি আবার প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, বোকা মেয়েটা কেন এমন কাজ করল? কাউকেই কিছু বলল না। একজন মানুষও কি জানে না কী হয়েছিল ওর?’

পিংকির কথায় মামুনের মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। কোনো ভূমিকা ছাড়া বললেও মামুন ঠিকই বুঝতে পারে, মিনার কথাই বলছে পিংকি। সে স্থির চোখে পিংকির দিকে তাকাল এক পলক। তারপর বলল, ‘আমি জানি।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী ভাবনার একদম গভীর থেকে বেরিয়ে অনুভুতির সুন্দর উপস্থাপন ! একরাশ মুগ্ধতা শুভেচ্ছা জানবেন I
আপনার ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল। অনেক ধন্যবাদ।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪