মেঘের কোলে রোদ হেসেছে

প্রত্যাশা (আগষ্ট ২০২০)

Jamal Uddin Ahmed
  • ৩৭৮
‘শেষ কর; চা-তো পানি হইয়া গেছে।’ রিপন তাড়া দেয়।

মিলন কাপের দিকে তাকায়। এখনও অর্ধেক কাপ চা বাকি আছে। সে সিগ্রেটে টান দিয়ে আরেক চুমুক চা খায়।
সদর রাস্তা থেকে রসুলপুর, পিছনতলা, পরীরবিলগামী স্থানীয় সরকারের রাস্তার মোড়ে নিদান আলীর চা-মনোহারী-মুদির ককটেল দোকানে গ্রামের লোকের জলসার মোক্ষম সময় বিকেল থেকে মধ্যরাত অবধি। প্রবীণ গুটিকয় থাকলেও নওজোয়ানদের সমাগমই বেশি – কেউ বেকার, কেউ অর্ধ-বেকার। মিলন প্রায় প্রতিদিনই বাল্যবন্ধু-কাম-স্কুল সহপাঠী রিপনকে নিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে নিদান আলীর দোকানে চক্কর মেরে যায়। তার দোকানের চায়ের একটা সুনাম আছে। অল্পবয়সী কর্মচারী মাখনা যে মূলত চা-খোরদের সামলায় সে এতদিনে মালিকের চা বানানোর কায়দা-কানুন রপ্ত করে ফেলায় নিদান আলী নিশ্চিন্তেই মনোহারী-মুদির দিকে মনোনিবেশ করতে পারে।
রিপনের তাড়া খেয়ে আরোও দুই চুমুকে চা শেষ করে সিগ্রেটে শেষ টান দিয়ে একটু কাশতে কাশতে মিলন বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ায়।

আজ হাটবার। মা ফর্দ আর টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আড্ডায় বইসা যাইস না।’

রিপন বরাবরের মত বিরক্তি নিয়ে বলে ‘তোরে কতবার কইলাম এই কুত্তার ধোনটা ছাড়; টানবি আর কাশবি।’
এসব বাজে কথায় মিলনের কোনো বিকার ঘটে না। দামি সিগ্রেট কেনার মত পকেটের জোর তার নেই। তাই চোরাইপথে আসা সাশ্রয়ী বার্মিজ মার্বেল সিগারেট দিয়েই চালিয়ে নেয়। তবে খুক খুক করলে রিপনের মত আরোও কেউ কেউ নিষেধ করে। স্কুলের জুনিয়র শিক্ষক সুলতানাও প্রায়ই বলে, ‘মিলন স্যার, আপনি ওটা বাদ দিতে পারেন না?’

শিক্ষক কিংবা ছাত্রদের সামনে মিলন ধূমপান করে না। তবে ক্লাস নেয়ার ফাঁকে টয়লেটে ঢুকে বেদম টানে সর্বোচ্চ দুটি সিগ্রেট সে খায়। হেড স্যারও কথাচ্ছলে একদিন বলে ফেলেছেন, ‘আপনি একজন ইনটেলিজেন্ট লোক; আপনার অনেক কিছু করার আছে। স্বাস্থ্যটা ভাল রাখুন।’ মিলন লজ্জা পেয়ে দুয়েকবার চেষ্টা করে দেখেছে; এবং ব্যর্থ হয়েছে। সুলতানা ম্যাডামকে সে বলেছিল, ‘দেখবেন, এই রমজানেই ইতি।’ কিন্তু না, সে কথা রাখতে পারেনি। ইফতারের পরই সে নিকোটিনের টানে নির্লজ্জের মত নিদান আলীর দোকানের দিকে হাঁটা ধরেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের চাকরিটা কোটার ভিত্তিতে খুব সহজে হয়ে গেলেও মিলন সেটা বলতে গেলে শুধু পেটের দায়েই গ্রহণ করেছিল। জমিজিরেত যেটুকু আছে তা খুঁড়ে খেলে দিন গুজরান করা যায় বটে। কিন্তু প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক বাবা হঠাৎ হার্টফেল করে অক্কা পেলে ছোটবোন ও মায়ের দায়িত্ব উচ্চমাধ্যমিক না-পেরোনো মিলনের ঘাড়ের উপর এসে পড়ে। পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়লেও আত্মীয়স্বজনের চাপাচাপিতে সে বিজ্ঞান নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দেয়। এমন সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মচারী এক আত্মীয়ের জোরাজুরি এবং সহযোগিতায় মিলন বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির দরখাস্ত করে এবং শেষপর্যন্ত তার চাকরি হয়েও যায়। মায়ের পিড়াপীড়িতে সে ঢাকায় গিয়ে চাকরিতে যোগদান করে। মাস দুয়েক ওই আত্মীয়ের সরকারি কোয়ার্টারে থাকলেও পরে খিলগাঁওয়ের একটি মেসে অন্য কয়েকজন সহকর্মীর সাথে থাকতে আরম্ভ করে।

সুলতানা ম্যাডাম মিলনের বছর চারেকের ছোট হবে; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইংরেজিতে অনার্স করে কিছুদিন আগে শ্রীনগর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। মিলনেরও বেশিদিন হয়নি; বছর দেড়েক আগে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে তারই পুরনো বিদ্যাপীঠে জয়েন করেছে। পুরনো দুজন শিক্ষকের অনুমোদনে স্কুলের ম্যানেজমেন্ট কমিটি মিলনকে নিয়োগ দিয়ে দেন। শিক্ষক হিসেবে সে ইতিমধ্যে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছে। তবে সবার মত সুলতানা ম্যাডামের কাছেও মিলনের ব্যাপারটা গোলমেলে। সম্পর্ক সহজ হবার পর বিভিন্ন সুযোগে তাদের দুজনের মধ্যে অনেক গল্পগুজব হয়েছে। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন স্কুলমাঠে শামিয়ানার নিচে বসেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মিলনকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছে সুলতানা ম্যাডাম। সাধারণ্যে এটা প্রশ্নবোধকই বটে যে সরকারি একটা চাকরিতে ঢুকে কষ্ট করে নাইট কলেজে ডিগ্রি পাশ করে যখন প্রমোশন পাওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করেছে তখন সে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে গ্রামের স্কুলে এসে অল্প মাইনের মাস্টারির চাকরি নিতে গেল কেন। ওখানে আরোও অনেক উপরে ওঠার সুযোগ ছিল; এখানেতো শেষদিন পর্যন্ত ছাত্র পড়ানোই কাজ। প্রাইভেট টিউশনি না করলে ভদ্রভাবে চলাই মুশকিল। ব্যাংকের চাকরি মিলনের ভাল লাগে না, একথা সুলতানা ম্যাডাম মেনে নিতে পারে না। আরে বাবা পদ যা-ই হোক, ভাল বেতনের সম্ভাবনাময় সরকারি চাকরি; পাগলামি করে সেই সোনার হরিণ চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসার কি কোনো মানে হয়?

পুরনো শিক্ষক বিমল পুরকায়স্থ ও খবীর উদ্দিন এখনও মিলনকে ছাত্রের দৃষ্টিতেই দেখেন। বিমল স্যার বলেছেন, ‘যা হবার হয়ে গেছে, এখন এটাতে থিতু হও; বিয়ে-টিয়ে করতে হবে না? বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলে, কয়েকটা টিউশনি করলে ভালভাবেই চলে যাবে।’

মিলন সেকথা জানে, শিক্ষকতাকে ধ্যান-জ্ঞান করে নিলে আর্থিক সমস্যা তেমন হবে না। কিন্তু এ পেশাও তার খিদে মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। সে বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও যে সাহিত্যমনস্ক ছিল একথা তখনকার ছাত্র-শিক্ষক সবাই জানত। স্কুলের দেয়াল পত্রিকায়, স্কুল ম্যাগাজিনে বিভিন্ন বিষয়ে তার লেখা শিক্ষকদের প্রশংসাও কুড়িয়েছে। তার নিজের মনেও সুপ্ত ইচ্ছা ছিল, বড় হয়ে লেখালেখির কোনো পেশায় নিজেকে জড়াবে। কিন্তু ভাগ্য তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কেরানীর চেয়ারে নিয়ে বসিয়েছে। খবীর উদ্দিন স্যার তার অতৃপ্তি আঁচ করে বলেছেন, ‘লেখালেখির প্রতি যদি তোমার এতই ঝোঁক ছিল তবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গেলে কেন? সাহিত্য-সাংবাদিকতা পড়তে।’

বাজার থেকে ফেরার পথে মিলন তার ঢাকা জীবনের টুকরো টুকরো গল্প শোনায় রিপনকে। রিপন এসএসসি পাশ করে পারিবারিক ইটের ভাটার ব্যবসায় ঢুকে মোটামুটি ভাল অবস্থানেই আছে। মিলন ফিরে আসার পর থেকে অবসর সময় তার সাথেই কাটাতে পছন্দ করে সে। রিপনের তেমন কোনো গল্প নেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্কুলজীবনের বিভিন্ন স্মৃতি তর্পণ করে। আর স্কুলের কথা বলতে গিয়ে মিলনের সহকর্মী সুলতানা ম্যাডামের কথা টেনে এনে মিলনকে আলতো টোকা দেয়।

মিলন মুচকি হেসে বলে, ‘তুই কী বলতে চাস তাতো বুঝি। কিন্তু মজার খবর কি জানস?

‘কী?’

‘লতিফাও মাস্টারি চাকরি নিসে।’ একটু হেসে নিয়ে মিলন বলে, ‘ডাইনে গেলে মাষ্টার, বামেও তাই।’

রিপন বলে, ‘সেতো মাস্টারিই করে, তুই না বলছিলি?’

‘এইটা আলাদা, সরকারি, প্রাইমারি টিচার।’ মিলন বলে, ‘নাইটে যখন আমার সাথে পড়ত তখন সে চাচার বাসায় থাইকা দিনের বেলা একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়াইত।’

‘তো, এখন তোর খেয়াল কী?’, রিপন জিজ্ঞেস করে।

মিলন বিরসভাবে বলে, ‘এইসব নিয়া ভাবতেছি না এই মুহূর্তে।’

‘তার মানে?’ রিপন বলে, ‘তোর বয়স কি কম অইছে? শায়লারে বিয়া দিছস চাইর বছর আগে। চাচী আর কতদিন সংসার টানবো?’

কথা সত্য। ছোট বোন শায়লার বিয়ের পর থেকেই মা তাড়া দিচ্ছেন মিলনকে। সে চাকরি ছেড়ে আসায় মায়ের মন খারাপ হলেও স্বস্তি পেয়েছেন এই ভেবে যে মাস্টারিতে পয়সা কম পেলেও ছেলেটাতো কাছে থাকবে। এখন ছেলেকে বিয়ে দেয়ার জন্য তিনি আদাজল খেয়ে নেমেছেন। কিন্তু মিলনের মাথার ঘূর্ণন থামছে না। সে একটি মেসেজের অপেক্ষায় আছে। কামাল ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু শোনার পর অন্য ভাবনা।

রুটিন করে প্রতিদিন আধাঘণ্টা ইন্টারনেট অন করে মিলন, ঘুমানোর আগে। ফেসবুক-মেসেঞ্জারের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাই মূল কারণ। মেসেঞ্জারে লতিফার সাথে একটু ঘনঘন চ্যাটিং হয়। লতিফা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি সত্যিই আর ঢাকায় আসবেন না?’ একসাথে নাইটে পড়লেও সে মিলনের চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। সহপাঠী হয়েও সে মিলনকে কখনও ‘তুমি’ বলেনি। এতে অন্যরা একটু মুখ টিপে হাসতোও। তারা যতটুকু ঘনিষ্ঠ হয়েছিল তাকে আধুনিক সংজ্ঞায় প্রেম বলা যাবে না। তবে মিলনের চলে আসার সিদ্ধান্তে লতিফা যেভাবে বিচলিত হয়েছিল এবং নিউমার্কেটের একটি রেস্তোরাঁয় বসে চোখ মুছেছিল তাতে মিলন বেশ কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। বিদায়ের সময় সে অবশ্য বলেছিল, ‘বলা যায় না, আবার চলে আসতে পারি; আমার একটা স্বপ্ন আছে।

আজ মেসেঞ্জার খুলে লতিফার বার্তাটি পড়ে মিলনের ভেতরটা একটু মোচড় দিয়ে ওঠে। সে লিখেছে, ‘এই দেড় বছরে আপনি আসি আসি করে একবারও ঢাকায় এলেন না। এরই মধ্যে আমি কতকিছু করে ফেলেছি – বি.এড শেষ করলাম, প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরিও পেয়ে গেলাম। এখন মা সমন জারি করেছেন বাড়িতে যাবার জন্য, জানিনা কেন। আমি বলেছি, আমার চাকরির পোস্টিং হয়ে গেলেই চলে আসব।’

পরদিন স্কুলে সুলতানা ম্যাডাম মিলনকে দুবার জিজ্ঞেস করেছে, ‘আপনাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ নাকি?’ মিলন বলেছে, ‘না, রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তাই।’ সুলতানা ম্যাডাম কিছু একটা বলতে উদ্যত হয়েও থেমে যায়। তারপর সে ঠোঁটের কোণে এক দুর্বোধ্য হাসি চেপে ধরে ক্লাসের দিকে চলে যায়।

সুলতানা ম্যাডামকে নিয়ে মিলন কখনও সিরিয়াসলি ভাবেনি। তবে সহকর্মিদের কৌণিক দৃষ্টি দেখলে সে বুঝতে পারে তারা তার এবং সুলতানার মধ্যে কোনো যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করছে। প্রায় সমবয়সী এবং ঘনিষ্ঠ আতিক স্যার কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছে, ‘শুনলাম শুভ কাজটা সেরে ফেলবেন, পাত্রী খুঁজছেন?’ মিলন স্বাভাবিকভাবেই বলে, ‘কে বলেছে এসব?’ কে বলতে পারে তা মিলন জানে। প্রায় সব শিক্ষকই মিলনের সহপাঠী এবং বাল্যবন্ধু হিসেবে রিপনকে চেনে। রিপনকে একা পেলেও তারা কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। রিপন যে শিক্ষকদের সাথে ভাব বিনিময়ের সময় বন্ধুর বিয়ের প্রসঙ্গ আনবে এবং সুলতানার প্রতি ইঙ্গিত করবে এ ব্যাপারে মিলন নিশ্চিত। এবং রিপনের খোঁচাখুঁচিতেই ইদানীং মাঝে মাঝে সুলতানা ম্যাডাম তার ভাবনায় এসে ভর করে।

কামাল ভাইয়ের সাথে মিলনের পরিচয় হয়েছিল দৈনিক শুভদিন পত্রিকা অফিসে। নাইটের সহপাঠী মকবুল পত্রিকার প্রশাসন বিভাগে কাজ করে জানতে পেরে মিলনের পুরনো রোগটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই মকবুলই একদিন তাকে বার্তা সম্পাদক কামাল ভাইয়ের কাছে নিয়ে যায়। ব্যস্ত কামাল ভাই এরিনমোর টোবাকো দিয়ে বিড়ি বানিয়ে খান। তাঁর রুমে ঢুকলে একটা মায়ামদির ভাব এসে যায় যে কারুর। তাঁর কোনো ভাবগাম্ভীর্য নেই। চটাং চটাং কথা বলেন। জুনিয়র সহকর্মিরা হাতে করে নিউজ আইটেম কম্পোজ করে নিয়ে এলে ফটাফট তা দেখে দিচ্ছেন; প্রয়োজনে কলম দিয়ে একটু খোঁচা মেরে দিচ্ছেন। এসব দেখে মিলনের আক্কেলগুড়ুম অবস্থা হলেও কামাল ভাইয়ের আন্তরিক আচরণে সে ধীরে ধীরে সহজ হয়ে ওঠে।

কামাল ভাই যদিও মিলনকে ভূতের বেগারির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরিতে কামড় খেয়ে পড়ে থাকার উপদেশ দিয়েছেন তবুও তার নাছোড় বান্দামির জন্য বলেছেন, ‘ঠিক আছে, এক কাজ কর, তোমার কাজের কিছু স্যাম্পল দেখিয়োতো আমাকে।’

মিলন মিনমিন করে বলল, ‘কামাল ভাই, অনেক হাবিজাবিতো লেখার চেষ্টা করেছি; আপনি আমাকে নির্দিষ্ট করে কোনো একটা সাবজেক্ট দেন।’

‘ঠিক আছে, ঢাকার ফুটপাতের অব্যবস্থাপনা নিয়ে একটা ফিচার লিখে আন’, কামাল ভাই বললেন।

মিলনের কপাল ভাল। ফিচারটা কামাল ভাইয়ের পছন্দ হয়ে যাওয়ায় তার পত্রিকার কোনো এক সংখ্যায় ফিলার হিসাবে তা ছাপিয়ে দেন। মিলন খুশিতে আটখানা হয়ে কামাল ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কি কিছু লিখতে পার?’

‘ছোটগল্প, প্রবন্ধ এসব কিছু লিখেছি আগে।’

কামাল ভাই বললেন, ‘এগুলো আমার কাছে দিয়ে যাও, ছাপানোর যোগ্য হলে আমি চেষ্টা করব কোথাও দেয়া যায় কিনা। কিন্তু আবার বলছি, কাগজে চাকরি করার কথা মাথা থেকে একদম মুছে ফেল; এই অনলাইনের যুগে রিপোর্টারের চাকরিতে পোষাবে না।’

সম্ভাবনাময় সরকারি চাকরি করলেও মিলনের মাথার পোকাটা সব সময় কুটকুট করে কামড়ায়। সপ্তাহান্তে কারণে অকারণে কামাল ভাইয়ের সাথে সে দেখা করবেই। সেই সুবাদে পত্রিকার অনেক লোকের সাথেই পরিচয় হয়েছে। কয়েকটি কাগজে কামাল ভাই তার দুয়েকটা লেখা ছাপিয়ে দিয়েছেন। কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায়ও বিভিন্ন ধরনের কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এসবের পরেও কোনো পত্রিকায় স্থায়ীভাবে জড়িত হতে না পেরে সে বেশ হতাশ হয়ে পড়ে। রাগের বশে একদিন হুট করে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বসে এবং বাড়িতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। যাবার আগে কামাল ভাইকে বলে যায়, ‘কামাল ভাই, গ্রামের স্কুলে মাস্টারির একটা অফার আছে – চলে যাচ্ছি। কিন্তু আপনার সাথে যোগাযোগ থাকবে।’ কামাল ভাই স্থির চোখে মিলনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার মত পাগল আমি কোনোদিন দেখিনি।’

বেশ কিছুদিন ধরে লতিফার মেসেজ পাচ্ছে না মিলন। তাকে অনলাইনেও দেখা যাচ্ছে না। তাই মনটা কেমন কেমন করছে। কামাল ভাইয়ের সাথে অবশ্য মাঝে মাঝে কথা হয়। তিনি রগড় করে বলেন, ‘ভালইতো আছ, এখন ব্রেন পরিষ্কার করে মাস্টারিতে মন দাও।’ কিন্তু সে যে মাস্টারি নিয়ে তৃপ্ত আছে মিলনের কথা থেকে তা বুঝা যায় না। কয়েকদিন আগে কামাল ভাই বলেছেন, ‘মিলন, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, দেখি তোমাকে কোনো ভাল সংবাদ দিতে পারি কিনা।’ একথা শোনার পর থেকে মিলন অস্থির হয়ে আছে।

বেশ ক’দিনের মানসিক চাপ কাটিয়ে মিলন স্কুলে গিয়েছে।সারাদিনই একটা ভাবালুতাইয় কেটেছে তার।ফেরার সময় অবধি খেয়াল হয়নি যে সুলতানা ম্যাডাম আজ একটি বারও তার সাথে কথা বলেনি। হঠাৎ সুলতানা ম্যাডামের নিস্পৃহ মুখের দিকে তাকিয়ে মিলন বলে, ‘কী আশ্চর্য! আমিতো ভাবলাম আজ আপনি অ্যাবসেন্ট।’

সুলতানা বিরস বদনে বলে, ‘আপনি ব্যস্ত ছিলেন, তাই হয়ত খেয়াল করেননি।

‘ব্যস্ত নয়, আমি এক অস্বস্তিকর দোলাচলে আছি’, মিলন বলে।

‘মানে?’

‘দুটো খবর আছে আমার কাছে: একটি ভাল লাগার, আরেকটি ঈষৎ কষ্টকর।’ একটু থেমে মিলন বলে, ‘আচ্ছা আগে খারাপ লাগারটা বলি। আমার এক খুব ভাল বন্ধু মানে বান্ধবীর বিয়ের কার্ড পেয়েছি – হোয়াটসঅ্যাপে।’

‘এটাতো খুশির খবর।’ সুলতানা বলে, ‘অবশ্য ঘনিষ্ঠ কেউ যদি হয়…’

মিলন বলে, ‘না, তবে ঘনিষ্ঠ হতে পারত, একসাথে কিছুদিন পড়াশোনা করেছি, ভাল জানাশোনা আছে, এটুকুই।’

‘ও তাই?’ একথা বলতে গিয়ে সুলতানার চোখে এক ঝিলিক আলো খেলে যায়। সাথে সাথে সে আবার বলে, ‘আর ভাল লাগারটা?’

‘সেটা অন্যদিন বলব।’ বলে, মিলন বাড়ির পথে রওয়ানা হয়।

মনটা ফুরফুরে থাকায় রিপনকে সন্ধ্যায় তার বাড়িতে আসতে বলেছিল মিলন। সে এসেছে। চা খেতে খেতে মিলন রিপনকে বলল, ‘যাউক, একটু হাল্কা হওয়া গেল।’

‘কী রকম?’

মিলন বলে, ‘কামাল ভাই এতদিন পরে একটা উপকার করছে। আমি এখন বাড়িতে বইসা দুইটা অনলাইন পত্রিকার কন্ট্রিবিউটার হিসাবে কাজ করমু। সম্মানী কী দিব জানিনা, কিন্তু একটা মনের মত কাজতো পাওয়া গেল। মাস্টারির পাশাপাশি করা যাবে।’

রিপন বলে, ‘তার মানে তুই মাস্টারিতে স্থায়ী হইয়া গেলি। কিন্তু তোর লতিফার কী অইব?’

‘লতিফারও সুখবর আছে।’ চাকরিতে জয়েন করার আগেই তার বিয়া ঠিক অইয়া গেছে – কার্ড পাঠাইছে।’

‘কী!’ রিপন চমকে ওঠে। ‘তাইলেতো আমি একটা বিরাট ভুল কইরা ফালাইলাম।’

মিলন বলে, ‘তুই আবার কী করলি?’

‘গতকাইল বাসে উঠার লাইগা সুলতানা ম্যাডাম অপেক্ষা করতেছিল। ভালমন্দ জিজ্ঞেস করার পর তোরে নিয়াও একটু রস করছিল আর কি: কী, আপনার দোস্তের মতিগতি কী? গ্রামে থাকবে, নাকি আবার রাজধানীতে চলে যাবে?’ এতটুকু বলে রিপন থামে।

মিলন বলে, ‘বুঝলাম, কিন্তু তুই কী ভুল করলি।’

‘আমি তোর উপর বিরক্ত হইয়া বলছি: জানিনা, কুনু সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা, বিয়াশাদীও করেনা; ঢাকায় কুন মাইয়ার লগে সম্পর্ক আছে, চলেও যাইতে পারে।’

‘আচ্ছা! এখন বুঝলাম।’ স্কুলের সুলতানার মেঘাচ্ছন্ন মুখ মিলনের চোখে ভেসে ওঠে। এবং পরক্ষণে যে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সেটাও মিলনের চোখ এড়ায়নি। এখন তার মনে হচ্ছে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের ক্ষীণাঙ্গী মেয়ে সুলতানা আসলে দেখতে খারাপ না। চেহারাও বেশ মিষ্টি। কিন্তু আগেতো এসব তেমন করে তার চোখে পড়েনি। ভাবনার ঘোরে সে একটা সিগ্রেট ঠোঁটে পোরে।

রিপন চা শেষ করে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, ‘তোর আর বুঝাবুঝির দরকার নাই।’ মিলনের সিগ্রেটের দিকে তাকিয়ে সে আবার বলে, ‘পারলে …নাহ, আর খারাপ কথা কমু না। কুনু লাভ নাই।’ তারপর গলা উঁচু করে মিলনের মা’কে ডাকতে থাকে, ‘চাচি, কইগো; গ্যঞ্জামতো আরেকটা লাইগা গেল, দেখি কাইল সুলতানা ম্যাডামের সাথে কথা কইতে পারি কিনা।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অসাধারণ  দারুণ প্রকাশ । বাহ নিপুণ  রচনাশৈলী ভীষণ ভালো লাগলো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী