ডাক্তার বলল, ‘নো মোর টেনশন।’
‘কোথায় তুমি দেখলে টেনশন আর হাবিজাবি…?’ মহসিন তালুকদার খেপে যান ডাক্তারের উপর; ডাক্তার জাফর, ছেলে তানভীরের বন্ধু, হাতযশ আছে হৃদরোগ চিকিৎসায়।
‘আঙ্কেল, ঘাবড়ানোর কিছু নেই।’ জাফর বলে, ‘আপনাকে আরেকটু রিল্যাক্সড মুডে থাকতে হবে।’
তালুকদার সাহেব, পঁচাত্তর পেরিয়ে ঈষৎ বিকল কলকব্জা নিয়ে দিব্যি ভাল, নাকের ডগায় বসানো চশমার উপর দিয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলেন, ‘আমি কি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত, নাকি জমিজিরেত নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছি, নাকি আমার নেতাগিরি করতে করতে নাভিশ্বাস উঠেছে?’
জাফর কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘আঙ্কেল, আপনি চাইলেতো এসবের যেকোনোটিই করতে পারতেন; তাতো করেননি; মেধাবী ছাত্র হয়েও সরকারি চাকরি করলেন না - খেটে খাবেন বলে গেলেন বিদেশি সংস্থায়।’
জাফর চেম্বারে যাবে তাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
মিসেস তালুকদার দ্রুততার সাথে জাফরকে নিচু কণ্ঠে স্মরণ করালেন, ‘ওই আইপ্যাড নাকি কি জানি ওটার কথাতো বললে না বাবা…।’
‘ও হ্যাঁ’, তালুকদার সাহেবের দিকে ঘুরে জাফর বলল, ‘আরেকটা কথা আঙ্কেল, আপনি কিন্তু প্রতিদিন আইপ্যাড খুলতে পারবেন না – সপ্তায় মাত্র একদিন।’
‘মানে?’ মহসিন তালুকদার একটু রেগে গেলেন বলে মনে হল।
জাফরের আর দাঁড়াবার সময় নেই। সে দরজার বাইরে যেতে যেতে বলল, ‘ওটা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর – আগেও বলেছি।’
তানভীর, মহসিন তালুকদারের একমাত্র ছেলে, স্যান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, বাপকে বুঝিয়েছে অনেক। বলেছে, ‘বাবা, আমরাতো প্রায় রোজই কথা বলি, বীথি আর ইতিও আপনার জন্য পাগল, তারপরও কেন আপনি শুধু শুধু ছবি নিয়ে পড়ে থাকেন?’
মহসিন তালুকদার তার স্বভাবগত কারণে ছেলেকে প্রায়ই দুয়েকটা ধমক লাগালেও অল্প সময়ের মধ্যে একে একে রুমানা ও ফারজানা এসে যোগ দেয় স্কাইপে: ‘বাবা!’ ‘মা কোথায়, দেখিনা যে!’ ‘কেমন আছেন বাবা?’ … দুই মেয়ে – রুমানা নিউ জার্সি, ছোট ফারজানা ফ্লোরিডার অধিবাসী, হইচই করে আইপ্যাড গরম করে ফেলে। মেয়েদের দেখলেই তালুকদার সাহেবের স্বর নেমে যায়, ‘তোরা ভাল আছিসরে মা?
সাধারণভাবে বলতে গেলে তালুকদার সাহেবের ভীতিকর তেমন কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। এ বয়সে যেসব অসুখ খুব অনায়াসেই শরীরে এসে আশ্রয় নেয়, যেমন, বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনীবৈকল্য, ইত্যাদি, সেগুলোরও প্রকট উপস্থিতি তার শরীরে নেই। তবে উচ্চ রক্তচাপের কারণে একটি ওষুধ নিয়মিত তাকে খেতে হয়; আর সাথে হার্টের সুরক্ষার জন্য সম্প্রতি আরেকটি ওষুধ যোগ করেছে ডাক্তার। মিসেস তালুকদারের মতে তার স্বামীবর যেভাবে বেছে বেছে খাওয়া-দাওয়া করেন এবং ফজরের নামাজের পর যে গতিতে হাঁটাহাঁটি করেন তাতে তার শরীরে রোগ এসে ঠাঁই পাওয়ার কথাই না; কিন্তু অবসরে এসে স্মৃতিতর্পণের আজব বাতিকই এসব ছোটখাটো শারীরিক সমস্যাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
তালুকদার সাহেবের অবসর গ্রহণের পরপরই তানভীর বাবা-মাকে প্রায় জোর করে আমেরিকায় নিয়ে যায়। কারণ হিসেবে দেখিয়েছে, তার ছোট মেয়ে ইতির জন্ম হয়েছে – দাদা-দাদি না দেখলে কি হয়! আর দ্বিতীয় কারণ হল, বাবা-মা ওখানে গিয়ে অ্যাপ্লাই করলে রুমানা তার স্বামী-সন্তান নিয়ে ইমিগ্র্যান্ট হওয়ার সুযোগ পাবে। কিন্তু তার গোপন উদ্দেশ্য ছিল বাবা-মাকে তার কাছে রেখে দেয়া। কেননা, ফারজানাতো ইতিমধ্যেই আমেরিকা-প্রবাসী – তানভীর তার প্রিয় ছাত্রের সাথে নিজের ছোট বোনের বিয়ের ঘটকালি নিজেই করেছিল; আর ক’বছর পর রুমানা যদি চলে আসে তবেতো বাবা-মা একদম একা হয়ে যাবেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় তালুকদার সাহেব জোর করে দেশে চলে আসেন – তিনি সস্ত্রীক হজ্জ করবেন। তানভীর বাবাকে বাধা দিতে পারেনি। তবে সাবধান করে দিয়েছে, হজ্জ শেষে আবার ফিরে আসতে হবে কিন্তু । নইলে রুমানার ইমিগ্রেশনের ব্যাপার আটকে যাবে। তাই তালুকদার সাহেব বাধ্য হয়ে আরোও দুবার আমেরিকা সফর করেছেন। কিন্তু রুমানা চলে যাবার পর তিনি মোচড় দিলেন যে যেহেতু সব ঝামেলা শেষ, এবার তিনি দেশের মাটিতে বসে আল্লাহ্-রসুলের নাম নিয়ে বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিবেন। ওই বে-আব্রু দেশে তার থাকার ইচ্ছা নেই।
বাবা বিদেশিদের সাথে কাজ করেছেন সারাজীবন, কেতাদুরস্ত থেকেছেন সবসময়, পশ্চিমা জীবনপদ্ধতি তার কাছে অচেনা নয়, তারপরও তিনি যে পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন পছন্দ করেন এটা তানভীরের অজানা নয়। মোটামুটি বড় অংকের মাইনে পেলেও সংসারের সিংহভাগ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কৃচ্ছ্রতার মধ্য দিয়ে তাঁকে পুরো পথ চলতে হয়েছে। নিজের পুত্র-কন্যাদের অনেক সাধ-আহ্লাদই পূরণ করতে পারেননি। তাজমহল রোডে একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট করতে পেরেই তিনি ধন্য। এই শেষকালেও তার নিজের ভাই-বোনদের সুবিধা-অসুবিধার খবর রাখতে হয়। তৃপ্তি এটুকুই যে আটপৌরে সংসারের মধ্যে থেকেও ছেলেমেয়েগুলো ভালভাবে পড়াশোনা করেছে। ভাগ্যগুণে ছেলেটার একটা স্কলারশীপ জোগাড় হওয়ায় পুরো পরিবারের উন্নত জীবন নিশ্চিত হয়েছে। এসব কিছু ভেবে তানভীর শেষপর্যন্ত বাবার স্বাচ্ছন্দ্যকেই প্রাধান্য দিয়েছে। বলে দিয়েছে, ‘ঠিক আছে, আপনারা যখন দেশে থাকতে চাইছেন, থাকেন, তবে মাঝে মাঝে আপনাদের আসতে হবে; তাহলে পরিবারের সবার সাথে দেখা হয়ে যাবে।’
জাফর তানভীরের ছোটবেলার বন্ধু। একই এলাকায় থেকেছে, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে একসাথে পড়েছে। তানভীরেরও ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল; কিন্তু সে আশা পূরণ না হওয়ায় ফার্মেসী নিয়ে পড়েছে। শেষপর্যন্ত দুজন দুদিকে চলে গেলেও বন্ধুত্ব এখনও অটল। জাফরের জন্যই বাবা-মার স্বাস্থ্য নিয়ে তানভীরকে একদম ভাবতে হয় না। কিন্তু ওই যে, বাবার আমন্ত্রণ করে আনা হাহাকার, দুঃখবিলাস। এটাকে দুঃখবিলাস নাকি নস্টালজিক ফেনোমেনন বলা যায়? জাফর রিল্যাক্সড মুডে থাকার কথা বললেও তালুকদার সাহেবের মন খারাপ হওয়া একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। জাফর চলে যাবার পর বিকেলটা তার ভাল কাটলেও মসজিদ থেকে মাগরেবের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরেই তিনি সেই আগের রুটিনে ফিরে যান।
একটু পর পর চোখ মোছেন মহসিন তালুকদার, কখনও একটা লম্বা শ্বাস ছাড়েন, চোখ দুটি লালচে। আলাদা কক্ষে থাকেন তিনি; তার টেবিলের উপর ক্বুরআন মজিদ ছাড়াও বেশ কিছু বই থাকে, আর আইপ্যাডতো আছেই। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর চা খেতে খেতে আইপ্যাড খুলে বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল ঘুরে আসেন, ভাল লাগলে কোনো কোনো ধর্মীয় বক্তার বয়ান শোনেন। তবে আহমেদ দীদাতের ভিডিও ক্লিপ পেলে মনোযোগ দিয়ে দেখেন। কিন্তু যে কাজটি তিনি নিয়ম করে করেন এবং যেটি তাঁর হালের সমস্যা তা হল গ্যালারী খুলে পুরনো দিনের ছবি দেখা।
তানভীর সবগুলো অ্যালবাম আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছিল। দাদা যখন ওগুলো আবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন তখন বীথি বুদ্ধি করে সবগুলো ছবি স্ক্যান করে দাদার জন্য কেনা আইপ্যাডে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর আইপ্যাডের উপর একটা ফুল-লেংথ ট্রেনিং দিয়ে দেখিয়ে দেয় স্কাইপ, হোয়াটসআপ, ভাইবার, ইউটিউব কীভাবে চালাতে হয়। সাথে বলে দেয়, ‘দাদাভাই, ছবির বস্তা নিয়ে তোমাকে আর ছোটাছুটি করতে হবে না; তোমার সব ছবি এই যন্ত্রের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তোমার যখন ইচ্ছা একটা টিপ মারবে, ব্যস, একসাথে সব বেরিয়ে আসবে।’ দাদা খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন, ‘তাই নাকি! দেখাতো, দেখি।’
মিসেস তালুকদার কী কাজে স্বামীর কক্ষে ঢুকতেই তালুকদার সাহেব হইহই করে উঠলেন, ‘অ্যাই অ্যাই দেখতো, দেখে যাও…’
‘কী দেখব, রোজইতো দেখাচ্ছেন।’মিসেস তালুকদার ছবি দেখতে দেখতে বিরক্ত। স্বামী একেকটা ছবি বের করে লম্বা করে তার ইতিবৃত্ত বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে চোখ মোছেন আর লম্বা নিশ্বাস ফেলেন। প্রথম প্রথম স্বামীর সাথে তাঁরও বুকটা ভারী হয়ে উঠত। কিন্তু ক্রমে স্বামীর এই অতীত-পরিক্রমণ একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়ে গেলে মিসেস তালুকদার তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়ে উঠেন।
‘আরে দেখইনা, তোমার ছেলে আরে আমি যখন শিশুপার্কের নাগরদোলায় চড়লাম, তোমার ছেলে উত্তেজনায় চিৎকার করছিল আর তুমি নিচে দাঁড়িয়ে ইয়াশিকা ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলছিলে… হা হা হা।’ একথা বলার পরপরই তালুকদার সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ আর্দ্র হয়ে এল, ‘কোথায় গেল সেই দিন! এই ছেলেটাই আজ কত্ত বড় বাবা হয়ে গেছে!’
এটাই তালুকদার সাহেবের নতুন রোগ। একটার পর একটা ছবি খুঁটে খুঁটে দেখবেন, চোখ মুছবেন, তারপর হাহুতাশ করবেন। সাথে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করবেন। ছেলেটা এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে একটা কম্পিউটারের আবদার করেছিল, কিন্তু তিনি দিতে পারেননি। ফারজানার বড্ড শখ ছিল পরিবারের সবাই মিলে দার্জিলিং বেড়াতে যাবে; তার স্কুলের অনেক বন্ধু দেশ-বিদেশের গল্প করত। কিন্তু তিনি হতভাগা বাবা, মেয়ের চাওয়াটাকে পূরণ করতে পারেননি। এখনতো এসব চাওয়া হাতের মোয়া; কিন্তু সে সময় কি আর ফিরে আসবে? এসব ব্যর্থতার কষ্টই ইদানীং তার বুকে পাথরের মত চেপে আছে।
প্রথম দিকে জাফর সুন্দর করে তাকে বুঝিয়ে বলেছে, ‘আঙ্কেল, আপনিতো আমাদের চেয়ে ভাল বোঝেন, জীবনের সব চাওয়া পূরণ হয় না। তারপরও আপনি একজন সফল মানুষ। আপনার সন্তানরা সবাই সচ্ছল; এখন তারা তাদের সব ইচ্ছাই পূরণ করতে পারে। আপনার আনন্দিত হওয়া উচিৎ। আপনি অতীতকে খুঁড়ে খুঁড়ে রক্তাক্ত করেন কেন?’
না, তালুকদার সাহেব ইচ্ছে করে কষ্ট অনুসন্ধান করেন না, জীবনের এ সময়ে এসে অতীত তাকে বড় বেশি করে টানে। তাই পুরনো ছবিগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করা তার একটা বাতিকে পরিণত হয়েছে। আর ছবির দিকে তাকালেই সেই সময়টা জীবন্ত হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রথম সন্তান হিসেবে তানভীরের উপরই ছিল সব মনোযোগ, তাই তাকে নিয়ে স্মৃতিও বেশি। স্মৃতি সুখেরই হোক আর দুঃখেরই হোক, তা বেদনাময়। তানভীরকে যতটুকু সময় দিয়েছিলেন তারা, রুমানা-ফারজানার জন্য ততটুকু দেয়া সম্ভব হয়নি। সেজন্যও একটা অপরাধবোধ তালুকদার সাহেবের মনে কাজ করে।
রুমানার দুই ছেলে, ওরা মোটামুটি বড় হয়েই বাবা-মার সাথে আমেরিকা গিয়েছে। তবে ফারজানার দুটি মেয়েই আমেরিকায় জন্মেছে, তাই তারা আমেরিকান জীবনপদ্ধতিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। রুমানার ছেলেরা ইতিমধ্যে কাজে-কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ফলে আন্তরিকতা থাকলেও দেশের সাথে যোগাযোগ স্বভাবতই কমে গেছে। তবে ফারজানার কিশোরী মেয়ে দুটি তাদের জীবন নিয়ে এত ব্যস্ত যে দেশের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেশীয় কেতায় যোগাযোগ করা শিখে উঠতে পারেনি; মা-বাবারা যখন দাদা-দাদি, নানা-নানির সাথে কথা বলে তখন বাধ্য হয়ে তাদেরকেও হাই নানু, হাই দাদু বলতে হয়। তবে তালুকদার সাহেবের সৌভাগ্য, তার দুই পৌত্রী বীথি আর ইতি দাদাকে খুব ভালবাসে। হোয়াটসআপে সবসময় তারা চ্যাটিং করে, কথা বলে।
তালুকদার সাহেব মাঝে মাঝে তার প্রিয় ছবি পাঠান বীথি ও ইতির কাছে। সেদিন পাঠিয়েছেন দু’টি। দুটোই তানভীরের। একটিতে সে বাপের পিঠে বসে ঘোড়া চড়ছে, অন্যটি গ্রামের বাড়িতে – বাপের কাঁধ ধরে পুকুরে সাঁতার শিখছে। বীথি ইতি ওয়াও, হা হা রিয়্যাক্টতো করেছেই, পরে লম্বা সময় ধরে দাদার সাথে কথা বলেছে।
বীথি বলেছে, ‘দাদাভাই, তোমাকে না ঘোড়া হিসেবে খুব সুন্দর লাগছে।’
‘তাই নাকি!’ দাদা গদগদ।
ইতি বলেছে, ‘দাদাভাই, তোমার সুইমিং-এর ছবিটা সুন্দর; তোমাকে হ্যান্ডসাম লাগছে।’
‘আচ্ছা!’ দাদা উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘কিন্তু জানিস সেদিন কী ঘটেছিল?’
বীথি ইতি দুজন একসাথে বলে, ‘কী ঘটেছিল?’
‘তোদের বাপ আমার কাঁধ ছেড়ে টুপ করে ডুবে গিয়েছিল।’একথা বলেই দাদাভাই চুপ হয়ে গেলেন।
দাদার কোনো আওয়াজ না পেয়ে ইতি বলল, ’তারপর কী হয়েছিল দাদাভাই?’
দাদা ধরা গলায় বললেন, ‘ভাগ্যিস, পুকুরটা অগভীর ছিল।’ তিনি যে এখন চোখ মুছতে মুছতে কথা বলছেন একথা তারা বুঝতে পারে।
পিতার নস্টালজিক ফেনোমেননের কথা তানভীর জেনেছে বন্ধু জাফরের কাছ থেকে। এটা নিয়ে দুজনই হেসেছে কিছুক্ষণ । জাফর বলেছে, ‘আসলে হাসাহাসির কিছু নেই, বেঁচে থাকলে আমাদেরও এমনটি হতে পারে।’ তানভীর বলেছে, ‘না, আমাদের এরকম কিছু হয়তো হবে না, আমাদের ইমোশনাল প্রোপার্টিজ কম।’ কিন্তু একথা বললে কী হবে। তানভীর বাবাকে তার বোনদের চেয়েও বেশি বুঝতে পারে। এই পরিণত বয়সে এসে সে যখন পিছন ফিরে তাকায় তখন সে নতুন করে তার বাবাকে উপলব্ধি করে: কেমন করে একজন আটপৌরে মানুষ বিরতিহীন জীবনযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন, নিজের অতৃপ্তি ও অনটন নিয়ে পরিবারের ছোটখাটো আবদার মেটাবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন। ছুটির দিনে সবসময় মাকে সাথে না নিতে পারলে ও তাকে নিয়ে বাবা ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। বুড়িগঙ্গায় নৌকা চড়িয়েছেন, লঞ্চ দেখিয়েছেন; সাভার স্মৃতিসৌধ, সোনারগাঁ, আরোও অনেক অনেক জায়গা। এসব কথা কখনও স্মরণ হলে তানভীরের চোখটাও ভিজে যায়।
হঠাৎ একদিন হন্তদন্ত হয়ে ফারজানা স্কাইপে বাবাকে কল দিয়ে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিল, ‘বাবা, আপনার শরীর কেমন? মা কেমন আছেন?’
তালুকদার সাহেব চমকে গিয়ে বললেন, ‘কীরে, এমন করছিস কেন? তোর শরীর ভালতো?’
ফারজানা কিছু বলবার আগেই, টুং টুং শব্দ করে প্রথমে তানভীর এবং পরে রুমানা স্কাইপে যোগ দিল।
তানভীর কোনো ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি বলল, ‘তোরা কি বাবাকে বলেছিস?’
ফারজানা বলল, ‘না।’ তারপর মাকে স্ক্রীনে দেখে সে জোরে ডাক পাড়ে, ‘মা…।’
‘ঠিক আছে, মা-ও এসে গেছেন যখন আমি বলি।’তানভীর ফারজানাকে থামিয়ে দিয়ে খুব গম্ভীরভাবে বলল, ‘মা-বাবা খুব ভাল করে শোনেন…’
তানভীর সময় নিয়ে করোনা নামের এক মহামারীর প্রাদুর্ভাব এবং বিশ্বজুড়ে তার দাপটের কথা বাবা-মাকে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলে। বাবা মাঝখানে একবার তানভীরের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘অলি-আউলিয়ার বাংলাদেশে ওসব আসবে না।’ তবে তানভীর ভালভাবে বুঝিয়ে বলেছে যে এই ভাইরাস ভাললোক মন্দলোক কাউকে চিনে না। খুব শিগগিরই বাংলাদেশেও সে আক্রমণ করবে, অতএব সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
অচিরেই ছেলের কথাকে সত্য প্রমাণ করে করোনা যখন বাংলাদেশেও ঝাঁপিয়ে পড়ল তালুকদার দম্পতি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। সচরাচর টেলিভিশন না দেখলেও এখন নিয়ম করে তালুকদার সাহেব কোভিড-১৯-এর আপডেট দেখেন এবং দোয়াদরুদ পড়তে থাকেন। ছেলেমেয়েদের সাথে দৈনিক একাধিকবার ফোনে কথা বলেন এবং তাদের খোঁজ নেন। তাদের উপদেশমত এখন আর ঘর থেকে বের হন না। জরুরি কাজে বেরোলে মাস্ক পরেই বাইরে যান। মসজিদে যাওয়াও বাদ দিয়েছেন কিছুদিন ধরে। ইদানীং ফটো অ্যালবাম দেখা প্রায় বাদ দিয়েছেন; তার চেয়ে বেশি মনযোগী হয়েছেন ছেলে-মেয়েদের সাথে কথা বলাতে। এখন রাত-বিরেতে হোয়াটসআপে কিংবা ভাইবারে কল করে বসেন একবার ফারজানাকে নয়তো রুমানাকে, আরেকবার তানভীরকে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে করোনার বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির কথা জেনে নিয়ে তাদের বুঝিয়ে বলেন; সাথে করোনা-মুক্তির বেশ কিছু দোয়াও তাদের শিখিয়ে দেন। বিশেষ করে মশলাসেদ্ধ পানির উপকারিতা এমনভাবে গুরুত্ব দিয়ে বোঝান যে মনে হয় তিনি এ চিকিৎসায় একজন বিশেষজ্ঞ। অনেক সময় বেখেয়ালে ওদের ঘুমের সময়ে কল দিয়ে বসলেও ছেলে-মেয়েরা কিছু মনে করে না। তবে হ্যাপী আর লিপি – ফারজানার মেয়ে, ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়।
গত চারদিন ধরে তালুকদার সাহেবের গায়ে জ্বর। শুকনো কাশিও আছে, সাথে বুকে ব্যথা। গতকাল পিপিই পরে জাফর এসে দেখে গেছে। নিয়মিত দুটি ওষুধের সাথে প্যারাসিটামল ও কাশির সিরাপ দিয়ে গেছে। অভয় দিয়ে সবাইকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলতে বলেছে সে। যদিও সে বলেছে ভয়ের কিছু নেই তবুও মিসেস তালুকদার ও রাহেলা – বাসার একমাত্র পরিচারিকাকে গরম পানি চিকিৎসা চালু করতে উপদেশ দিয়েছে; নিরাপদ দূরত্বে থেকে তালুকদার সাহেবকে খাবার দাবার পরিবেশন করতে বলেছে। তালুকদার সাহেবকে বলেছে, ‘আঙ্কেল, আপনি ভাল হয়ে যাবেন; মনে সাহস রাখবেন। তবে আমরা চিকিৎসক হিসেবে সবাইকে ঝুঁকি এড়াবার কথা বলি। তাই আপনারা সবাই ঘরে মাস্ক পরবেন; আর আপনি রুমেই থাকবেন; ঘরের সবাই বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোবেন; গরম পানি খাবেন, লবণমেশানো গরম পানি দিয়ে কুলকুচা করবেন। আশা করি আপনি সেরে উঠবেন।’
জাফরের কথা শুনে তালুকদার সাহেব কাতর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘তবে কি আমিও…’
‘আরে না না, আপনার তেমন সিরিয়াস কিছু হয়নি।’ জাফর সাহস দিয়ে বলল, ‘যাতে খারাপ কিছু না হয় সেজন্য সাবধানতা, এই আরকি। আর আমিতো সব সময় খোঁজ রাখব।’
জাফর চলে গেলে তালুকদার সাহেব স্ত্রীকে মশলা দিয়ে পানি ফোটানোর পদ্ধতি শিখিয়ে দেন এবং দূরত্ব বজায় রাখার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তারপর বিছানা থেকে উঠে গিয়ে তার আইপ্যাড অন করেন। শরীরে জ্বর নিয়েও তিনি বেশ কিছুদিন পর ফটো গ্যালারী খোলেন। পুরনো দিনের ছবিগুলো আবার একটা একটা করে দেখতে আরম্ভ করেন। কোনো কোনো ছবি ওপেন করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন; তখন তার চোখটা ঝাপসা হয়ে ওঠে। হঠাৎ একটা ছবির দিকে তিনি গভীরভাবে তাকিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে তানভীরকে স্কাইপে কল দেন।
ক্যালিফোর্নিয়ায় সবে ভোর হয়েছে; তানভীর তখনও বিছানায়। বাবার কল দেখে সাথে সাথে রিসিভ করে। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে সবাই শঙ্কার মধ্যে আছে। ফোন বেজে উঠলে বুকটা ধক করে ওঠে। সে বলে, ‘স্লামালেকুম বাবা! কেমন আছেন?’
‘ভাল, ভাল। তোরা সবাই কেমন আছিস?’
‘আমরা ভাল; আপনার শরীর একটু খারাপ ছিল শুনেছিলাম; এখন কেমন? আর মা কেমন আছেন?’ তানভীর জিজ্ঞেস করে।
‘তোর মা-ও ভাল। শোন, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় যেদিন তুই পাশ করলি, মনে আছে?’
তানভীর একটু ভাবনায় পড়ে গেল। স্কুল নিয়ে আবার কী হল? সে বলল, ‘জ্বী বাবা, মনে আছে।’
‘তুই যে তখন লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠেছিলে; মনে আছে? আমি-না সেই ছবিটা…’ তালুকদার সাহেবের গলা ধরে আসায় আর কিছু বলতে পারলেন না।
তানভীর বুঝে গেল এটা বাবার ওই নতুন উপসর্গ। বাবার এই উপসর্গকে আগে পাত্তা না দিলেও সেও এখন অল্প অল্প স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। সে বলল, ‘এবার দেশে আসলে আমরা সবাই মিলে পুরনো জায়গাগুলো বেড়াতে যাব। মাকে একটু দেন না, কথা বলি।’
‘তোর মাকে আমি দিতে পারব না। তুই ডাইরেক্ট ফোন কর।’
‘মানে? মা কোথায়?’
তালুকদার সাহেব বলেন, ‘জাফর আমার রুমে আসতে ওদের মানা করে গেছে।’
তানভীরের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। সে বলল, ‘বাবা, আপনি লাইনে থাকুন।’ তারপর সে তার মাকে সরাসরি ফোন করে বিস্তারিত শুনে প্রায় কেঁদে উঠল।
মিসেস তালুকদার ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই; জাফর বলেছে সেরে যাবে।’
তানভীর বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তার চোখের সামনে আমেরিকা কীভাবে নাস্তানাবুদ হচ্ছে সে দেখতে পাচ্ছে। বয়স্ক রুগিদের ঝুঁকি সম্বন্ধে সবাই জানে। সে এ অবস্থায় কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
মায়ের সাথে কথা শেষ করে বাবাকে প্রবোধ দেয়ার ভান করে তানভীর বলল, ‘বাবা আপনি চিন্তা করবেন না। ইনশাল্লাহ আপনি ভাল হয়ে যাবেন। আমি এক্ষুনি জাফরের সাথে কথা বলব।’
তালুকদার সাহেব কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে চোখ মুছলেন। তারপর বললেন, ‘না, আমার জন্য কোনো চিন্তা নেই; আমি তোমাদের কথা ভাবছি……আবার তোমাদের সাথে আমার কবে দেখা হবে…।’
তানভীর বলার মত কিছু খুঁজে না পেয়ে চুপ করে থাকল। বাপও এ প্রান্তে আইপ্যাডের সামনে নীরব বসে রইলেন।