দাঁড়া দাঁড়া…
কী, বাবা?
ঐযে, ঐ দ্যাখ… এত সুন্দর পাখি!
মাহী থামে। হুইল চেয়ারের হাতলে তার দুই হাত রাখা। বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করেও তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে আবার বাবার মুখের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকায় মাহী।
দেখতে পাচ্ছিস না? কী সুন্দর পাখি। ডানা মেলে উড়ছে…
পাখি? আশেপাশে কোনো সুন্দর পাখি দেখতে পায় না মাহী। দু’চারটা কাল রঙের খেচর ডাইভ দিয়ে ওড়াওড়ি করছে বাম দিকের পাহাড়ের গা ঘেঁষে। ওগুলো কাক কিংবা ফিঙে হতে পারে। তাহলে সুন্দর পাখি দেখলেন কোথায় বাবা?
ছেলের নিরবতা দেখে বাবা হতাশ হলেন। ‘বুজছি, তোর চোখে সমস্যা; চশমা পাল্টাতে হবে।’
হঠাৎ মাহীর খেয়াল হল, সাগরপাড়ের ফেরিওলাদের একজন পলিথিনের তৈরি রঙ্গিন ঘুড়ি উড়াচ্ছে। অনেক রকমের ঘুড়ি তার হাতের লাঠিতে ঝুলানো। পাখি অবয়বের ঘুড়িটি উড়িয়ে সে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছে। মাহী তখন বোদ্ধার মত বলল, ‘হ্যা বাবা, খুব সুন্দর পাখি। আমি দেখতে পাচ্ছি। চল চল, সামনে চল। আমি তোমাকে একটা কিনে দিই।
মাহী শুধু বাবাকেই নিয়ে এসেছে কক্সবাজারে। তিনি কারুর সাহায্য ছাড়াই ঘরের ভেতর এখনও হাঁটাচলা করতে পারেন। কিন্তু কোনো প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে হুইল চেয়ারে করে যেতে হয়। সে তুলনায় মা প্রায় অচল। বাথরুমে যেতে হলেও আমিনার মা’র ডাক পড়ে। আমিনার মা আর হাশেম নামের ছোকরা কাজের বাঁধা লোক; মাহীর বিধবা ও নিঃসন্তান ফুফুর তত্ত্বাবধানে তারা বাসার সব দায়িত্ব পালন করে। বার্ধক্যের সব জটিলতাই পেয়ে বসেছে মাহীর মাকে। চলাফেরার অসুবিধা ছাড়াও তাঁর মেজাজটা প্রায় সবসময় তিরিক্ষি থাকে। এ কারণে কক্সবাজারে মাকে নিয়ে আসার প্রশ্নই ওঠে না।
কক্সবাজার আসাটা বাবার আইসক্রিম খাওয়ার মতই একটা আব্দার। ডায়াবেটিস থাকলেও মাঝে মাঝে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য বাবা জেদ ধরেন। অবস্থা বেগতিক হলে হাশেম কাঠিওলা একটা আইসক্রিম এনে দেয়। সেটা তিনি পরম আনন্দে চাটতে চাটতে স্ত্রীর রুমের দিকে এগিয়ে যান। তারপর স্ত্রীর কানের কাছে মুখ এনে আস্তে আস্তে বলেন, ‘একটু খাবে?’ অমনি স্ত্রী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, ‘নষ্টামির আর জাগা পাও না...?’
ফোনে কথা বলার সময় বাবা বেশ ক’বার কক্সবাজার যাবার জন্য বায়না ধরেছেন, ‘আমার খুব ইচ্ছে করছে, আমাকে কক্সবাজার নিয়ে যাবি না?’ মাহীর মনটা নরম। বাবার কথা শুনে চোখ মুছতে মুছতে বলেছে, ‘কী যে বল বাবা, অবশ্যই যাব। এইবার এসে তোমাকে আর মাকে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাব। ’ তখনই বাবা তড়াক করে বলে উঠেছেন, ‘না না, তোর মাকে নেব না। আমার বারটা বাজিয়ে ছাড়বে। ’ বাবার কথা শুনে মাহী মুখ টিপে হেসেছে।
হাস্যকর হলেও বাবা-মা দুটি আলাদা রুমে থাকেন। রোগ-যন্ত্রণার কারণে মাহীর মা স্বামীর আহ্লাদেপনা সহ্য করতে পারেন না। সরকারী কলেজের প্রাক্তন প্রফেসর স্বামীর স্মৃতি বিভ্রমজনিত আচরন ও কিঞ্চিৎ অসংলগ্ন কথাবার্তা তাঁকে প্রায়ই খেপিয়ে তোলে। তাই ফুফুর পরামর্শমত মাহী এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। লালমাটিয়ার বাড়ি বিল্ডার্সকে দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট করিয়ে নেবার পর তার নিজের ভাগের পাঁচটি ফ্ল্যাটের একটিও সে বিক্রি করেনি। একটি বাবা-মার জন্য রেখে দিয়ে বাকি চারটি ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।
মাহীর বড়বোন চট্টগ্রামে শেকড়পোতা হয়ে আছেন। স্বামী হৃদরোগে পরলোকে যাওয়ার আগেও তার ঢাকায় আসার খুব একটা ফুরসৎ হত না। এখন পাড় ব্যবসায়ী তিন ছেলের যৌথ সংসারে চাবির গোছা সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। শুধু ফোনেই বাবা-মার খবর রাখেন, বছরে একবারও আসা হয়ে ওঠে না। আর ছোটবোন আমেরিকার কর্মবহুল জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আট বছরে শুধু একবারই দেশে এসেছিল। তবে মাহীর ব্যাপারটি আলাদা। সে ফ্রান্সের এয়ারবাস কোম্পানির প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বপূর্ণ কাজে থেকেও বাবা-মার প্রতি বিরল ভালবাসার টানে প্রতিবছর একবার দেশে আসবেই।
বাবার জন্য একটা পাখি-ঘুড়ি কিনে নিয়ে হোটেলে ফিরে আসার পথেও বাবা-মার এ বয়সের অদ্ভুত আচরণের কথা ভেবে মাহীর মুখে এক চিলতে বিষাদময় হাসি ফুটে ওঠে। সেই ছোটবেলা থেকেই বাবা-মার কর্তব্যপরায়ণ এবং আনন্দময় জীবনের দিনগুলি সে দেখে এসেছে। রুটিনবাঁধা জীবনেও কত সুখী ছিলেন তারা। ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে বাবা-মা দুজনই নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। আজ সময় কেমন নিষ্ঠুর রূপ পরিগ্রহ করেছে। জরা-ব্যাধির কঠিন ছোবল জীবনের সব রঙ ফ্যাকাশে করে দিয়েছে।
কক্সবাজার থেকে ফেরার দিন সকালে বাবাকে নিয়ে আরেকবার ইনানি বীচে যায় মাহী। ঝিরঝিরে হাওয়ার সকাল বেলাটা বাবার খুব পছন্দের। ভেজা বেলাভূমিতে ঢেউ এসে ছুঁয়ে যায় তাঁর পা যুগল। দূরের ঝাপসা পর্দায় কখনও ভেসে ওঠে ঘুমন্ত জাহাজ; কখনও দেখা যায় হেলেদুলে চলা দুয়েকটা সাম্পান। বাবা উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকেন সেদিকে। হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘নামি? একটু খেলে আসি ঢেউয়ের সাথে।’ মাহী বলে, ‘আজকে না বাবা, ঠাণ্ডা লাগবে। আরেকদিন।’
সাগরপাড়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় বাবা বলেন, ‘আচার খাব।’ মাহী বলে, ‘বাবা, এগুলো ভাল না, ক্ষতিকর রঙ দিয়ে বানানো।’ বাবা রেগে যান, ‘ধুর, তোর মা আর আমি কত খেয়েছি। নে নে, তোর মা’র জন্যও এক প্যাকেট নিয়ে যাব।’
ঢাকায় প্লেন থেকে নেমে উবারে করে বাসায় ফেরার পথেই বাবার পেট খারাপ করে। কোনোমতে বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই কাপড়চোপড় নষ্ট হয়ে যায়। হাশেম তাঁকে ধুয়ে-মুছে বের করে এক গ্লাস ওরস্যালাইন খেতে দেয়। এসবের মাঝেও ব্যাগ হাতড়ে তিনি বার্মিজ বরই আচারের প্যাকেটটি বের করে স্ত্রীর রুমের দিকে এগিয়ে যান। স্ত্রী বালিশে হেলান দিয়ে বসে পান চিবোচ্ছেন। একটু সুস্থ বোধ করলে তিনি মশলাদার পান খেতে ভালবাসেন। মাহীর বাবা উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘আজ কেমন আছ?’ মাহীর মা মাথা ঘুরিয়ে তাকান বটে, কিন্তু কিছু বলেন না। তবে স্বামীর হাত থেকে আচারের প্যাকেটটি কেড়ে নিয়ে একটু মুচকি হাসেন। তারপর প্যাকেটটি টেনে ছিঁড়তে চেষ্টা করেন। অমনি হইহই করে মাহী এসে মায়ের হাত থেকে প্যাকেটটি কেড়ে নেয়, ‘কী করছ মা? এটা পচা জিনিস। দেখছ না বাবা অসুখ বাঁধিয়েছে?’ বলে, বাপের দিকে বিরক্ত হয়ে তাকায়।
বাবা রাগ করে নিজের রুমে ফিরে গিয়ে গজগজ করতে থাকেন। ‘বেশি বোঝে! পণ্ডিত হয়ে গেছে! আমাদের শখের জিনিসটা খেতে দিবে না! দুধকলা দিয়ে সাপ পুষেছি।! আমাদের না খাইয়ে মারবে।!
ইতিমধ্যে মাহী মাকে বুঝিয়ে ফেলেছে, ‘মা, তোমাদের জন্য কত মজার মজার জিনিস এনেছি। খারাপ জিনিস খাবে কেন? বাবা না বুঝে ছেলেমানুষি করে। ’ মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। চোখের কোণে একটু জলও দেখা যায়। তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, ‘তোর বাপের মত ভাল লোক আর হয় না; বয়সের কারণে এখন মাথা ঠিক নাই।’
যাবার দিন সকালে মাহীর মনটা ভারী হয়ে আছে। প্রতিবারই যাবার বেলায় অমনটি হয়। পরের বার এসে তাদের দেখতে পায় কি না সেই শংকা মনকে দুর্বল করে দেয়। মায়ের জটিলতা আবার বেড়েছে। কোমর ব্যথার জন্য নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। ছেলেকে বিদায় দিতে হবে তাই আরোও বেশি উচাটন হয়ে পড়েছেন। একটু পরপর চোখ মুছছেন। মাহী বার বার প্রবোধ দিচ্ছে, ‘আরে কাঁদছ কেন, এইতো কদিন পর আবার চলে আসব। এবার তোমার নাতনিকে নিয়ে আসতে পারি। সে দাদার বাড়িতে আবার আসতে চায়।’ হঠাৎ মাহীর বাবার উদয় হয় রুমে। ‘মাহী জানিস, সুইস চকোলেট আমার খুব পছন্দ। আবার যখন আসবি, আমার জন্য সুইস চকোলেট নিয়ে আসবি। ’ মাহী একটু হাসতে চেয়েছিল, কিন্তু মায়ের খিটিমিটিতে তা আর হল না। মা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘দেখ বুড়ার আহ্লাদ! একটা ঝুনঝুনির কথাও বলে দাও না, বসে বসে খেলবে।’
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
জীবনের শ্রেষ্ঠ অপঙ্কিল সময় শিশুকাল। শিশুরা অবুঝ, তাই আদরণীয়ও বটে। প্রত্যেক মানুষ জন্মের পর শিশু থাকে। দীর্ঘ জীবনের পরিক্রমায় কেউ কেউ শেষবেলায় আবার শিশু চরিত্র ধারণ করে। সেটি সুখের এবং বেদনারও। এই গল্প সে রকম শিশুরই চরিত্র চিত্রণ করার সামান্য প্রয়াস ।
১৯ নভেম্বর - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
১৫৯ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৪৩
বিচারক স্কোরঃ ৩.০৩ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪