নাদের খানের শেষ ক’দি

পার্থিব (আগষ্ট ২০১৮)

Jamal Uddin Ahmed
  • ৩৫
নাদের খানের শেষ ক’দিন
জামাল উদ্দিন আহমদ

কান্দুমোড়ল ছাল ওঠা সাইড ব্যাগ বগলেচাপিয়ে নদ্দাবাসষ্ট্যাণ্ডে নেমে কালা চাঁদপুর রাস্তা ধরে গুলশানের দিকে এগুতে এগুতে মাঝখানে বিসমিল্লাহ্ হোটেল এণ্ড রেষ্টুরেন্টে ঢুকে একটা মোগলাইয়ের অর্ডার দিয়ে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ঘামে ভেজা পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগেএমন একটি খালি চেয়ারে বসল। মোগলাই পরোটা টেবিলে পৌঁছতে পাঁচ থেকে দশ মিনিটও লাগতে পারে এটা সে জানে। তাই এই ফাঁকে সাইডব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে বিকল চেইনের স্লাইডারটাকে মাঝখান থেকে একপাশে টেনে নিয়ে ব্যাগ থেকে একগাদা কাগজ বের করে। সবগুলোই ফটোকপি। দক্ষিণ খানের দারুল উলুম মাদ্রাসার পিছন দিকে এক দাগে সাড়ে তিন বিঘা জমির সন্ধান পেয়েছে সে। কাগজ গুলো সবই সেই জমির খতিয়ান, দলিল, তফসিল, পর্চা এসবের ফটোকপি। মোগলাই খাওয়া শেষ করে গরুর দুধের এককাপ গরম চা খেয়ে সে গুলশানমুখী পথে নামবে। গন্তব্য ইউনাইটেড হসপিটাল। এই ক’মিনিটের মওকায় তর্জনীর মাথা জিভের ডগায় ভিজিয়ে ভিজিয়ে কাগজ গুলো আরেক বার উল্টে পাল্টে দেখে নিচ্ছে।

নাদের খানের পুরনোও বিশ্বস্থ লোক কান্দু মোড়ল – ঝানু জমির দালাল।খান সাহেবের রমরমা অবস্থা যখন ছিল না, তখন থকেই সে তাঁর অনুসঙ্গি । খান সাহেবের সম্পদের তালিকা এত দিনে খাতার ভেতরে-বাইরে উপচে পড়লেও কান্দু মোড়লের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি । বহু কষ্টে একটা ঠিকানা করতে পেরেছে টঙ্গীর বোর্ড বাজারের দিকে , এই যা । কাজের বেলা, অকাজের বেলা পড়ে আছে খান সাহেবের পিছনে । এ অসিলায় কোনো মতে দিন ওপার করে দিচ্ছে ।

কিন্তু আজ কান্দু মোড়লের মনটা ভারি ।ফোনটা নাদের খানের পরিবর্তে যখন ম্যাডাম ধরে বললেন ‘কান্দু ভাই আমার বড় বিপদ’, তড়াক করে উবু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কান্দু বলল ‘কি কইলেন ম্যাডাম ?’ তার পর হতাশা ভরা গলায় ‘ ওআল্লাহ্’ ‘আচ্ছা’ ‘জ্বে’ ‘আমি আইতাছি’ এসব কথা উচ্চারণের আগে পরে মিসেস খানের ভয়ার্ত কণ্ঠের কথা বার্তা শুনতে শুনতে এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে দেখে তার বউ দুচোখ বিস্ফোরিত অবস্থায় হাকরে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । কান্দু স্যান্ডেলের ফিতা ঠিক করার জন্য আবার উবু হতে হতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার হাসপাতালে, আমার আই তেদেরি অইব ।‘

স্যারেরএ অবস্থায় ছাল ওঠা ব্যাগসাথে নিয়ে আসাহাস্য কর জেনে ও কান্দু ব্যাগটা নিয়ে এসেছে । আজ তার স্যারের বাসায় দক্ষিণ খানের কাগজ পত্র নিয়ে যাবার কথা ছিল।তিনি হাসপাতালে বুকের ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ঠিকই, তবে অবস্থা কতটা গুরুতর তা ম্যাডাম নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।অবস্থা সহনীয় পর্যায়ের হলে কান্দুকে ডেকে পাঠাতে পারেন এটা সে জানে।অতীতে আরোও দুয়েক বার এর কম ঘটেছে । হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে শুয়েই সহায় সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যের খোঁজ খবর নিয়েছেন । আজও যদি এমনটা হয় তাই মনে করে কান্দুব্যাগটাও সাথে করে নিয়ে এসেছে।

ছোট ছেলে নাদের খানকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে । ইতি মধ্যে নাদের খানের মেয়ে, জামাইও এসে পৌঁছে গেছে।কান্দু হাসপাতালে পৌঁছে স্যারের খোঁজ খবর নিয়ে একটু হাউমাউ করে কেঁদেছে । তার কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম এসে পৌঁছালে কান্দু লাফ মেরে তাঁর সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে অসহায়ের মত বলে ‘ম্যাডাম আসছেন ?’ কান্দুর কথার জবাব না দিয়ে ব্যস্ত সমস্থ হয়ে মেয়ের দিকে, জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেসকরলেন, ‘কী অবস্থা এখন?’

জামাইকে ততউদ্বিগ্ন মনে হল না । সে তার স্ত্রীর দিকে তাকাল। স্ত্রী অর্থাৎ
নাদের খানের বিদেশ পড়ুয়া এবং অঘটন ঘটন পটিয়সী মেয়ে টুম্পা জানাল, ‘আছে, আই সিইউতে। আউট অফ রিস্ক। টেস্ট ফেস্ট করে কালকে জানাবে কী করতে হবে।‘

মিসেস খান বললেন, বুম্রাংগ্রাডে নিয়ে যাওয়া যায় না? তোরা কি ওদের জিজ্ঞেস করেছিলি?
- করেছিলাম। ডাক্তার বলেছে মুভ করানো যাবে না। টুম্পা বলল।
- ওরাতো বলবেই। কোন ডাক্তার? আগারওয়াল?
- হ্যাঁ, ও-ইতো বেস্ট এখানে। আব্বুকেতো ও-ইতো দেখে।
- সেন্স আছেতো? তোরা কথা বলেছিলে? মিসেস খান স্বভাবতই টেনশনে আছেন।
- আম্মু তুমি এত অস্থির হয়োনাতো। আব্বু কথা বলেছেন আমাদের সাথে। টুম্পা আরোও কী যেন স্মরণ করার চেষ্টা করে। ও হ্যাঁ – মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বলল – কান্দু চাচা। কান্দু চাচা এসেছে কি না জিজ্ঞেস করল।
কান্দু মোড়ল টুম্পার পেছনে দাঁড়িয়ে মা-মেয়ের কথোপকথন শুনছিল । সে দৌঁড়ে সামনে এসে বলল, ‘কী বলছে, মা? স্যারে কী বলছে?’
‘না তেমন কিছু না , এমনি –‘ টুম্পা হয়ত আরোও দু’চার শব্দ বলে কথা শেষ করত, কিন্তু সে মুহুর্তে মিঠুন তার পিঠে খোঁচা দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলে টুম্পা স্বামীর দিকে ঘুরে বলল, ‘কী?’

মিঠুন শাশুড়িকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলে টুম্পার হাত ধরে হসপিটালের বাইরে দিকে চলে এল । শিপলুও আপু দুলাভাইয়ের সাথে বেরিয়ে আসতে চাইলে মিঠুন বলল, ‘তুমি আম্মার কাছে থাক, আমরা আসছি।‘
টুম্পা বলল, ‘কী ব্যাপার ?’
মিঠুন সিগ্রেটের প্যাকেটটা পকেট থেকে বেরকরে আবার কী মনে করে পকেটে ঢুকিয়ে টুম্পার আরো ও একটু ঘনিষ্ট হয়ে একটু বিরক্ত মুখে বলল , ‘ব্যাপারটা তোমাকে অনেক বার বলেছি । নতুন করে আরকী বলব ?’
টুম্পা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মিঠুনের মুখের দিয়ে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল , কিন্তু কিছু বললনা ।
মিঠুন এবার টুম্পার কাঁধের উপর হাত রেখে বলল, ‘ডাক্তার যা-ই বলুক আব্বার অবস্থা আউট অব ডেঞ্জার না । আগেও ষ্ট্রোক করেছে দুবার , প্রেশার হাই , কিডনীর প্রবলেম , প্রোস্টেটম্যালিগন্যান্ট হয়ে পড়েছে কিনা কে জানে।‘
স্বামীর কথা এটুকু শেষ হতেই টুম্পা অস্থিরতার সাথে বলল, ‘এখন আমরা তাহলে কী করব ?’
মিঠুন সাথে সাথে হাত উঁচু করে টুম্পাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, ‘শোন শোন, আমাদের ঘাবড়ালে চলবে না । দেশের বেস্ট হসপিটাল এটা । আমরা তাদের ভি আই পি ক্লায়েন্ট । তারা তাদের বেস্টটাই দিতে চেষ্টা করবে । আমাদের হাতে এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই এমুহুর্তে ।‘
টুম্পার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়লে মিঠুন আবার তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ঘাবড়ে গেলে চলবেনা । মনে সাহস রাখতে হবে । তবে আমি অন্য একটা কথা বলতে চেয়ে ছিলাম।‘
- কী কথা ?
- জন্ম-মৃত্যু আল্লাহ্র হাতে ।আল্লাহ্ না করুন, আব্বার যদি কিছু একটা হয়ে যায় –‘
- না-না, এমন অলক্ষুনে কথা বলনা... টুম্পা কেঁদে ফেলে।
- শোন শোন, আমি যা বলতে চাইছি – তোমরা দুই ভাই বোন । আব্বার ভূসম্পত্তি কোথায় কী আছে তার সবটা তোমরা জাননা । আমি তাঁর রিয়েল এস্টেট বিজনেসের এমডি হিসেবে যত টুকু জানি তোমাদের কান্দু চাচাও তা জানেনা । সব জমির দালালি তো সে করেনি ।এছাড়া ট্রাভেল এজেন্সি, মানিলন্ডারিং আরোও কী সব – আমিও দিকটার খবর বেশি রাখিনি ।
- এমুহুর্তে এসব কথা আসছে কেন ? টুম্পা অধৈর্যের মত বলে।
- তোমাকে কবে থেকে বলে আসছি –
- হবে, হবে।টুম্পা বিরক্ত হয়ে পড়েছে । আব্বু সুস্থ হয়েনিক, প্লিজ এমুহুর্তে আব্বুকে বাঁচিয়ে তোল ।

কান্দু মোড়ল কে ম্যাডাম পাঁচশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘কান্দু ভাই তুমি এখন চলে যাও , তবে মোবাইল অনকরে রাখবে । প্রয়োজন হলে রাতেই তোমাকে ডাকব ।‘ কান্দু চোখ মুছতে মুছতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির পথ ধরেছে।তার আগে অবশ্য সে ম্যাডামকে তার আজকের নির্ধারিত সাক্ষাতের বিষয় বস্তু সংক্ষেপে বলেছে ।একথাও বলে গেছে, স্যার যদি হঠাৎ কোন ফাঁকে জিজ্ঞেস করে বসেন তবে যেন ম্যাডাম তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন যে সব কিছু ঠিক আছে , চিন্তার কোন কারণ নাই ।

মিঠুনকে নিয়োগ দেবার সময়ই নাদের খানের মনে একটা গোপন ইচ্ছা জেগে উঠেছিল । বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, হ্যাণ্ডসাম, প্রমিজিং ইয়াংম্যানকে হাত ছাড়া না করার জন্য বেতনের অংক নির্ধারনের ভার মিঠুনের হাতেই ছেড়ে দিয়ে ছিলেন । সে যা চেয়েছে তিনি তাতেই তিনি রাজি হয়ে গেছেন। সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ড্রাইভার সহ একটা গাড়িও তার নামে বরাদ্দ করেছেন। সেই থেকেই মিঠুন বাড়তি কদর সহ চাকুরি করলেও বেশ কিছু পরে সে বসের মনের ইচ্ছাটা আঁচ করতে পেরেছিল ।

নাদের খান জোর করে বাসায় এসে পড়েছেন গত রাত্রে । পাঁচ দিন মাত্র ছিলেন হাসপাতালে । দ্বিতীয় দিনেই ডাক্তার আগারওয়াল মিসেস খানকে ডেকে বলেছেন , ষ্টেন্টিংই মিডিয়েটলি করতে তো হবেই , তারপর ও বেশ কিছু দিন হাসপাতালে থাকতে হবে । ডায়াবেটিস তো আছেই , ক্রিয়েটেনিন সহ প্রোস্টেটের মারাত্মক সমস্যা আছে । মিসেস খান বলেছেন, ‘যা করতে হয় আপনি করে যান; আমাকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।উই ট্রাষ্টইউ ডক্টর ।‘ ডাক্তার আগারওয়াল মাথা নেড়ে বলেছেন, ‘আইনো।‘ কিন্তু গোল বাঁধিয়েছেন নাদের খান নিজেই । একটু ভাল বোধ করতেই বাসায় যাবার জন্য পাগল হয়ে গেছেন । শেষ পর্যন্ত সবার কথা অমান্য করে বণ্ডসই করে রিলিজ নিয়ে এসেছেন । এসেই প্রথম কল করেছেন কান্দু মোড়ল কে। সে জন্য সেই সকাল থেকেই কান্দুখান সাহেবের বেডরুমে মাথার কাছে গদি আঁটা টুলের উপর বসে রয়েছে। মিসেস খান বিরক্ত হলেও নাদেরখান কান্দুকে ছাড়ছেন না । আস্ত আস্তে কথা বলছেন তিনি, আর কান্দু জ্বে জ্বে বলে মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছে । কীসের এত জরুরি কথা সে দিকে ম্যাডামের আগ্রহ না থাকলেও তিনি মাঝে মাঝে কান্দুমোড়লের জন্য চা-নাস্তা পাঠাচ্ছেন ।

হাসপাতাল থেকে রিলিজনিয়ে আসার সময় টুম্পা-মিঠুন সেখানে উপস্থিত ছিলনা । ট্রাভেল এজেন্সীর ম্যানেজার জব্বার সাহেব এবং নাদেরখানের দুজন বিজনেস পার্টনার এসে ছিল । তবে কারুর সাহায্যের দরকার পড়েনি । ছেলে শিপলুকে নিয়ে মিসেস খান সব ম্যানেজ করেনিয়েছেন । মাতাকে রাতেই ফোন করে জানিয়ে ছিলেন বটে, তবুও টুম্পা আসেনি । একটা ফোনও করেনি । জামাই-মেয়ের সাম্প্রতিক গতিবিধি মিসেস খানের কাছে কেমন কেমন লাগছে। লাগলেও এ ব্যাপারে নাক গলানোর সুযোগ তাঁর সঙ্গত কারণেই কম।

কান্দু দুপুরে না খেয়েই প্রায় জোর করে চলে গেছে। ম্যাডাম জোরাজুরি করলেও স্যার কিছু বলেননি। কান্দুর হাতে অনেক কাজ। কান্দু চলে গেলে সবার চাপাচাপিতে নাদের খান একটু স্যুপ খেয়ে চোখ বুজে পড়ে রইলেন। বিকেলের দিকে টুম্পা স্বামীসহ হাজির। নাদের খানের রুমে ঢুকল বটে দুজনই।কিন্তুকোন কথা না বলেই আবার হুট করে বেরিয়ে গেল। নাদের খান দেখলেনও তাদের। মিঠুন শিপলুর রুমের দিকে গেল আর টুম্পা হন্তদন্ত হয়ে তার মাকে খুঁজতে লাগল।

মা টুম্পার সব কথা শুনে বললেন, ‘আচ্ছা বল, এখন কি এসব কথা বলার সময় হল ?’
- এখন নয় তো কখন ? তুমি কি নিশ্চিত আব্বু এযাত্রায় টিকে যাবে?’
- কী বাজে কথা বলছিস? মিসেস খান রেগে উঠলেন মেয়েরওপর।
- আচ্ছা আম্মু তুমি বুঝতে চেষ্টাকর।শিপলু কি আব্বুর রিয়েল এস্টেটের সাম্রাজ্য সামলাতে পারবে ? আমি পারব ? তুমি পারবে ? জমিজমা, হাউজিং এসবের নাড়ি নক্ষত্র মিঠুনের নখদর্পণে।সে এমডি । আব্বু দায়িত্বটা তার হাতে ছেড়ে দিলেও তো আমরাই ভোগ করব।ট্রাভেল এজেন্সী আর অন্য ব্যবসা গুলো নিয়ে অতো সমস্যা নেই; আমিও গুলো সম্মন্ধে জানি, শিপলুও শিখে নিতে পারবে । আমরা কাগজ পত্র সব তৈরি করে এনেছি।তুমি শুধু আব্বুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করে ফেল।

মিসেস খান মেয়ের হৃদয়হীন আচরণে কষ্ট পেয়েছেন বটে । আবার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে মেয়ের কথাই ঠিক । স্বামীর এ সাম্রাজ্য দেখবেকে? শিপলু এক বছর পরই উনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েই এত বড় বোঝা মাথায় নিতে পার বেসে অসম্ভব । জামাই-এর উপর ভরসা করার এটা একটা বড় যুক্তি। এর বাইরের যুক্তিটাও কম বড়নয় । অসচ্চল পরিবারের ছেলে বলেই মিঠুন সব জেনে শুনে তাঁদের মেয়েকে বিয়ে করতে স্বাচ্ছন্দে রাজি হয়েছে । ভাগ্য ভাল, ও ইনচ্ছারঅ্যামেরিকান ছেলেটা যদি অন্য মেয়ের দিকে ঝুঁকে না পড়ত, তবে কি খান সাহেবের সাধ্য ছিল মেয়েকে ষ্টেটস থেকে ফিরিয়ে আনার । মান সম্মান তো গেছেই, আর হাইয়ারষ্টাডি...।দেশে নিয়ে আসার পর তড়িঘড়ি করে বিয়েটাসে রেফেলার ফলে বিষয়টা ততচাউরহয়নি।তাইসব কুল রক্ষা করতে হবে।মিঠুনকে চটানো মোটেও ঠিক হবেনা । মিসেস খান অবশেষে স্বামী কে বোঝানো রদায়িত্ব নিয়ে ইনিলেন।

কান্দু সালমা বেগমের কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলে, ‘আপা, কাইন্দেননা, স্যারের জন্য দোয়া করেন । ইনশাল্লাহ তিনি ভাল হয়ে যাবেন।আর চেকটা তাড়াতাড়ি ব্যাংকে জমা দিয়েদেন।‘ সালমা বিশ লক্ষ টাকার চেকটা হাতে নিয়ে কাঁদতেই থাকে। কোন কথা বলতে পারেনা। এই ফাঁকে সালমার বাবা আলতো করে চেকটা তার হাতে তুলেনেন।কান্দু নিজের বাসায় খাওয়া দাওয়া করে রেষ্টনিয়ে সন্ধ্যার দিকে সালমার বনশ্রীর ফ্ল্যাটে এসেছে।গোপনে বিয়ে করার আগেই নাদের খান নিজের বানানো কোন এপার্টমেন্ট থেকে নাদিয়ে অন্য এক কোম্পানী থেকে এই ফ্ল্যাটটি সালমার নামে কিনে দিয়েছেন ।সালমা তার বাপ-মাকে নিয়েই এই ফ্ল্যাটে থাকে।বিয়ের মোহ রানা হিসেবে পঞ্চাশ লক্ষটাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দিয়েছেন । তাদের চলার জন্য সঞ্চয় পত্রের সুদের টাকাই যথেষ্ট । তবে সেটা কায়তাদের কখনও হাত দিতে হয়নি । নাদের খান সুযোগ পেলেই বনশ্রীতে ছুটেযান সঙ্গে অঢেল খাবার দাবার সহ । সালমাকে আদরও করেন খুব । দেখতে সুশ্রী মেয়েসে।বাঁজা বলে আগের বিয়েটি টেকেনি।বাপের ঘাড়ে বসে থাকতে থাকতে এক সময় নাদের খানের অফিসের কাষ্টমারসার্ভিসেএকটা চাকুরির সুযোগ পায় । সেখান থেকেই সূত্রপাত।চাকুরিছেড়েদিতেহয়েছেবিয়েরআগেআগেই – তা প্রায় দু’বছর।নিজের লোকদের মধ্যে ড্রাইভার কাশেম আর কান্দুমোড়লই শুধু এ সম্পর্কের কথা জানে।কান্দুর তো প্রশ্নই ওঠেনা, আর কাশেমের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে সে কোথাও মুখ খুলবে।আজকের দীর্ঘ অধিবেশনে নাদেরখান জমিজমানিয়ে কোন কথা বলেননি কান্দুর সাথে। তাঁর যত দুশ্চিন্তা সালমাকে নিয়ে।তাঁর কিছু হয়ে গেলে কান্দু যেন সালমাদের খোঁজ খবর রাখে এ অনুরোধই বারবার করছিলেন তাকে। এরই ফাঁকে একসময় বিশলক্ষ টাকার চেকটি গুঁজে দিয়েছিলেন কান্দুর হাতে।

শিপলুর মনটা ভীষণ খারাপ। আব্বু গতরাতেই মিঠুনের নামে লিখে দিয়েছেন টুশি রিয়েল এস্টেট কোম্পানী। ব্যাপারটা আরোও খারাপ হতে পারত যদিনা আব্বুর অবস্থা ডিটরিয়েট করত। নাদের খানকে ভোরবেলাতেই হাসপাতালে আনা হয়েছে। এখন আইসিইউতে আছেন। মিসেস খান, মিঠুন, টুম্পা সবাই উদ্বেগের মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন। ষ্টাফদের সবাইকে মানা করা হলেও জব্বার সাহেব মানা না শুনেই চলে এসেছেন। কোন ফাঁকে কান্দু মোড়লও এসে হাজির হয়েছে। মাঝে মাঝে তাকে চোখ মুছতে দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ ডাক্তার আগারওয়াল এসে বললেন, ‘আপনাদের একটা কথা বলা দরকার। মিষ্টার খানের কেইসটা কমপ্লিক্যাটেড। সাডেনলি তাঁর কিডনী ফেইল করেছে। আমরা ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করেছি। এখনই কিছু বলা যাচ্ছেনা।‘ মিসেস খান প্রায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেই ডাক্তার আগারওয়াল তাঁকে থামিয়ে দিলেন, ‘নো নো নো, কাঁদবেন না, আমরা আটমোষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কীপ প্যাশেন্স। দোয়া করুন।‘

ডাক্তার চলে গেলে ভীষণ হুলুস্থুল আরম্ভ হয়। একজন কাঁদলে আরেকজন প্রবোধ দেয়। কেউ আত্মীয়ের কাছে ফোন করে, কেউ অফিসের খোঁজ নেয়। মিসেস খান চোখ মুছতে মুছতে ডাক্তার আগারওয়ালের কাছে ছুটোছুটি করেন। জব্বার সাহেব এক কোণে গিয়ে কাদের সাথে যে আতংকিত কন্ঠে কথা বলেন বোঝা যায়না। মিঠুন এ অবস্থার মধ্যেও ঘন ঘন বাইরে গিয়ে সিগ্রেট ফুঁকছে। একমাত্র কান্দু মোড়ল মাথা নিচু করে একটি চেয়ারে বসে অঝোরে কাঁদতে থাকে।

সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে আরোও জনাবিশেক লোক হাসপাতালে এসে জড়ো হয়। এদের মধ্যে আত্মীয়, বিজনেস পার্টনার, অফিস স্টাফ এমন কি দুজন প্রতিবেশীও আছে। কমবেশি সবাই খান পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে। কোনকিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করছে। খান সাহেবের স্তুতিও করছে কেউ কেউ। কেমন করে, কী হয়েছিল – এসব প্রশ্নতো হাসপাতালে ঢোকার সাথে সাথে সবাই করেছে। যতই সময় পেরুচ্ছে সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা আরোও প্রকট হচ্ছে।

প্রতিবেশীরা বেশ আগে চলে গেলেও রাত ন’টা অবধি বাকি সবাই অধৈর্য হয়ে ভাল কিছু শোনার অপেক্ষায় বসে আছে। ইতিমধ্যে মিঠুন ও টুম্পা অভ্যাগতের চা-কফি খাইয়ে ভদ্রতা দেখিয়েছে। এত চাপের মধ্যেও তাদের দুজনের মুখে হাল্কা হলেও একটা প্রশান্তির প্রলেপলেগে আছে। মিসেস খানও এতক্ষণে স্থবির হয়ে পড়েছেন। চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে হয়ত মনে মনে দোয়া পড়ছেন। এরই মধ্যে হঠাৎ করে ডাক্তার আগারওয়াল ছুটে এলেন। মুহুর্তে সবাই তাকে ঘিরে ধরল। কিন্তু কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। ডাক্তার কয়েক মুহুর্ত পরিস্থিতি নিরীক্ষণ করে বললেন, ‘স্যরি, মিষ্টার খানকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে হয়েছে। দোয়া করতে থাকুন।‘ কথা শেষ করেই ডাক্তার আগারওয়াল দ্রুত লিফটে উঠে গেলেন।

মিসেস খান মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাঁধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। উপস্থিত অন্যরা শিপলুকে জড়িয়ে ধরে মিথ্যে প্রবোধবাক্য শোনাতে লাগল। অফিস স্টাফদের মুখে একটা হতাশার ছায়া দেখা গেল।

কিন্তু এসব হুল্লোড়ের মধ্যে কান্দু মোড়লকে দেখা যাচ্ছে না। সে কি তবে বুঝে গেছে তার কান্না শোনার লোক এখানে কেউ নেই। তাই তার তার কান্নার নিঃসরণ ঘটাতে অন্য কোথাও গেছে?



আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ARJUN SARMA পড়লাম, বর্ননা খুবই সুন্দর। বাস্তব চিত্র. সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ সংখ্যার 'খোকা' ও মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। আমার বিশেষ সংখ্যার গল্পটা পড়ে কেমন লেগেছে জানাবেন। ভালো থাকুন।
ধন্যবাদ, দাদা, গল্পদুটি আপনি পড়েছেন বলে। বক্ষ্যমাণ গল্পের ফন্টগুলো আমার স্ক্রীনে এলোমেলো দেখাচ্ছে। আপনার ভাল লেগেছে, তাই খুশি হলাম। 'খোকা' গল্পটি যদিও লিখেছি আমি, তবু পাঠক হিসেবে যতবার পড়েছি, আমাকে কাঁদতে হয়েছে। গল্পে বাস্তবের কিছু ছায়া আছেতো। আপনার ছাপানো গল্পটি যে গক'র বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তা জানার সুযোগ হয়নি আগে। জেনে ও পড়ে ভাল লাগল।
মাইনুল ইসলাম আলিফ সুন্দর গল্প।শুভ কামনা আর ভোট রইল।আসবেন আমার গল্প আর কবিতার পাতায়।
আপনাদের ভাল লাগাই আমার পরম পাওয়া; আর কোন প্রত্যাশা নেই। ধন্যবাদ।
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত জামাল ভাই , আশা নিরাশার পার্থিব ঘটনা । ভাল লাগল । অনেক শুভকামনা রইল ।
অনেক ধন্যবাদ, দাদা। সাথে থাকবেন।
Mokbul Hossain জামাল ভাই, সত্যি চমৎকার একটা লিখা!!! ভীষন ভালো লাগলো, এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম। সুন্দর লিখার জন্য অনেক ধন্যবাদ শুভ কামনা রইলো
আমার একজন বোদ্ধা পাঠক তৈরি হল, এতেই আমি আনন্দে লাফাচ্ছি।
Tahmina Alom Mollah আমি এলোমেলো বর্ণগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে পড়তে পেরেছি।আপনার দুঃচিন্তার কারণ নাই। আপনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদ থাকুন।শুধু সাহিত্য নয় নিজের শরীর স্বাস্থ্যের প্রতিও যত্নশীল হবেন আশা করি।
বলেছি না, আপনি আমার পরম শুভাকাঙ্ক্ষী। আমার নিরাপত্তা এবং সুস্থতার জন্য দোয়া করবেন।
Tahmina Alom Mollah আপনাকে যথার্থ মূল্যায়ন করার মানসিক সাধ আমার থাকলেও ভাষাগত সাধ্য আমার নাই। আমি ভীতু, তটস্থ আর ... !!
আপনি আবারও প্রথম পাঠক। খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ শুভাকাঙ্ক্ষী। লেখাটি পড়েছেন এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। রাগ লাগে, গক লেখাটাকে লেজেগোবরে করে ফেলেছে। বর্ণগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে; পাঠকের পড়তে কষ্ট হবে।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

নাদের খান বেহিসেব সহায়সম্পত্তির মালিক। পার্থিব সুখ, সম্পদ, প্রতিপত্তি অনন্তকাল ধরে ভোগ করে যাওয়া মানুষের এক সহজাত তাড়না। নাদের খানও তার উর্ধে নয়। কিন্তু জীবনপাত করে দেওয়া পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত পার্থিব আয়োজন অন্তিমকালে কোন কাজে আসেনা, আবার নিজেরও থাকেনা তা জানার পরও মানুষ যেন পুরো পৃথিবীটাকেই নিজের হাতের মুঠোয় পেতে চায়। আরোও বেশি সুখের সন্ধানে সালমাদের কাছে যেতে হয়। নাদের খান মৃত্যুর আগেই জেনে গেছে তার আপনজনরাও তার প্রয়াণ নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নয় যতটা তার সম্পদ নিয়ে। মানুষের জীবনের পার্থিব আশা-নিরাশা আর জটিলতার একটা চিত্র আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে এই গল্পে।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪