প্রত্যাবর্তন

স্বপ্ন (জানুয়ারী ২০১৮)

Jamal Uddin Ahmed
  • ১৭
বাম হাতটা তুলে নিয়ে ঘনিষ্টভাবে তাকায় রাশেদ। কব্জির উপর দিকে দাগটা। লালচে। গোলাপিও বলা যায়। পাশে পড়ে আছে একটি বড় সাইজের লাল গোলাপ। পাপা মিলাঁ নামে একটি বিদেশি জাত আছে। হয়তো সে জাতেরই হবে ফুলটা। রাশেদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ফুল থেকেও কি রঙ বেরোয়? এটাই কি তাহলে ভেনাসের পায়ের রক্ত? আবার তাকাতে গিয়ে দেখে রঙটা লালও না গোলাপিও না, কেমন কালচে মতো। কিন্তু রঙ নিয়ে ভাববার সুযোগ কোথায়?
জানালার ওপাশটায় বড় পাতাবাহারের গাছটার সাথে গা লাগিয়ে বাসন্তীরঙ শাড়িপরা একটা নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে। রাশেদ চমকে ওঠে। এখন কি রাত – শারদীয় পূর্ণিমার? চারিদিক কেমন ফকফকা। নাকি ঊষালগ্ন? চাপাস্বরে রাশেদকে ডেকে সাড়া না পেয়ে গোলাপটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মেরেছে মেয়েটা। লেগেছে গিয়ে রাশেদের কব্জির উপরে। ফুলের আঘাত! এতেই কাজ হয়েছে। রাশেদ ধড়মড় করে উঠে একবার ফুলের দিকে আর একবার হাতের দিকে তাকিয়ে ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থায় বিড়ালের মতো লাফ দিয়ে উঠে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কোন শব্দ হয়নি।
এরকম আমস্মিক আপাতভূতুড়ে পরিবেশে রাশেদের স্বরযন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। সে বোবার মতো মাথা ঘুরিয়ে ঘরের ভতরেবাইরে অসংলগ্নভাবে তাকাচ্ছে। চৌকোনো ঘরটাকে ষড়ভুজী মনে হচ্ছে। আরেকবার ভাবছে, এই পাতাবাহার গাছটা এলো কোত্থেকে।
চারটা বেতের চেয়ার, একটা ছোট টেবিল আর একটি ডিভানজাতীয় বেড – এই হলো রুমের আসবাব।দেয়ালে ছবি টানানো আছে দু’টি।একটি পরলোকগত বাবা-মার।অন্যটা স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ রাশেদের পারিবারিক গ্রুপ ছবি। বছরদশেক আগের ছবিটা কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবার প্রাক্কালে সাজুগুজু অবস্থায় তোলা। ছবিটি ক্লিক করে দিয়েছিল রাশেদের বন্ধু শাহেদ। রুমে ঢোকার মুখে চোখে পড়ে এমন জায়গায় বড় ফ্রেমে বাঁধানো রোকসানার নিপুণ হাতে তৈরি একটা এমব্রয়ডারি। রুমটা বৈঠকখানা হিসেবে বরাদ্দ হলেও এর ব্যবহার বহুবিধ। কদাচিৎ মেহমান এলে এ রুমেই থাকার ব্যবস্থা হয়।ছেলেমেয়ের গৃহশিক্ষকরা এ রুমে বসেই পড়াতেন। এখন আর গৃহশিক্ষকের ঝামেলা নেই। ছেলেমেয়ে দুটোই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে।
জানালার রডের শিকটা ধরে দাঁড়ানো অবস্থায় একবার সাহস করে আগন্তুক মেয়েটির দিকে আড়চোখে তাকায় রাশেদ।
‘কেমন আছো, শব্দকর?’
শব্দকর! শব্দটাতো পরিচিত মনে হচ্ছে। আরে এ অভিধাতো রাশেদের নিজেরই সৃষ্টি। হঠাৎ করে এই পলিচাপা নামটা এই মেয়েটি কেমন করে, কোথা থেকে পেলো? কণ্ঠস্বরটা পুরো ধরাও গেলো না। মেয়েটা কে? এমনিতেই তার হাত-পা কাঁপছে, ঠোঁটে এসে কোন শব্দ স্থির হতে পারছে না।তবুও সাহস করে রাশেদ তার দৃষ্টিটাকে নারীমূর্তির ওপর স্থির করার চেষ্টা করলো।
‘কী? চিনতে পারছো না?’ বলে মেয়েটি তার ভুরু নাচালো।
দৃষ্টি আর শ্রুতির মিশেলে মেয়েটির যে অবয়ব তৈরি হলো রাশেদ তা বিশ্বাস করতে সাহস পেলো না। তার দৃষ্টিটা আবার সরে এলো হাতের লাল ছোপের ওপর। ফুলের রঙ কীভাবে হাতের ওপর বসে গেলো কথাটা ভাবতে গিয়েও ভাবনাটা স্থির করতে পারলো না।ভয়টা যেন আরেকটু জেঁকে বসলো এজন্য যে অবিশ্বাস্যভাবে এ যে জিনাতের কণ্ঠ, চেহারা, চাহনি। এক সময়কার উদীয়মান কবি, গীতিকার রাশেদ ছদ্মনাম নিয়েছিলো ‘শব্দকর’। সৃষ্টির নেশায় তখন তার দিবস-রজনী তরঙ্গবিক্ষুব্ধ। তবে অনেকের মতোই রাশেদের সেই তরঙ্গমালা জোয়ার রচনা করতে পারেনি।এজন্য শাহেদের খুব একটা খেদ নেই। জিনাত ছিল তার একনিষ্ঠ পাঠক ও শ্রোতা; প্রেরণাদাত্রী ও সমালোচক। কিন্তু ও কেন জিনাত হতে যাবে? জিনাত কুড়ি বছর আগে তার জমাখরচের খাতা বন্ধ করে অন্য জগতের বাসিন্দা হয়েছে।
জিনাত এবার বিদ্রুপের সুরে বললো, ‘কাঁপছো কেন? আমিতো সেই জিনাত।খলখল স্রোতস্বিনী – মনে নেই?’
‘কিন্তু জিনাত মানে তুমিতো সেই কবে......’ রাশেদ চেষ্টা করেও বাক্যটা শেষ করতে পারে না।
‘না আমি মরিনি। জিনাত মরে নাই।‘ জিনাত যেন নিশ্চিত করতে চাইলো।
রাশেদের মাথা চক্কর দেয়।সে স্থিত হওয়ার চেষ্টা করে। কেমন গোলকধাঁধায় পড়লো সে! জিনাত যদি না হবে তবে অই মেয়ে তার শব্দকর নামটি পেলো কোথায়? আর ‘খলখল স্রোতস্বিনী’? তার মনে পড়ে, গানটি যেদিন সে লিখেছিল তার পরদিন বিকেলে শাহ্বাগের মোড়ে চা খেতে খেতে হন্তদন্ত হয়ে পকেট থেকে ভাঁজকরা কাগজটি জিনাতের সামনে তুলে ধরে বলেছিল, দেখো দেখো কেমন হলো লিরিকটি – তোমাকে নিয়ে লিখেছি। জিনাত বরাবরের মতো গানটির অস্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে শব্দ করে হেসে উঠলো, আচ্ছা, তাহলে আমার চরিত্রচিত্রণ করেছ – খলখল স্রোতস্বিনী!
জিনাত আবার বললো, ‘হ্যাঁ গো শব্দকর, আমি সেই জিনাত।‘ মনে হলো সে এক পা সামনে এগিয়ে এসেছ। ‘জানতে খুব ইচ্ছে হলো তোমার খলখল স্রোতস্বিনী কি শেষ পর্যন্ত সুরের মালা পরেছিল। তাই চলে এলাম।‘
ভয় কাটছেনা রাশেদের। সময়টা কি ভোরের ভাগে না নিশুতি রাতের ভাগে আছে বুঝতে পারছে না। মফস্বলের শহরতলীটা ঘুমে কাই হয়ে পড়ে আছে যেন। মনে হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এই দু’টিমাত্র প্রাণী ছাড়া আর কেউ নেই। ঘোরলাগা দু’জন ধুলিচাপা বইয়ের পাতা উল্টাতে বসেছে। রাশেদের নেশাটেশার অভ্যাস নেই। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেটে দু’এক টান মেরেছে। মদগাঁজাতো ছোঁয়ইনি। সারা জীবনে আট-দশ ক্যান বিয়ার খেয়েছে, তাও বড়মাপের অনুষ্ঠানে – কিনে নয়। তাহলে এই ভূতুড়ে আবহের মধ্যে সে ঘুরপাক খাচ্ছে কেন? তবু সাহস সঞ্চয় করে জিনাতসদৃশ মেয়েটাকে আহবান জানালো, ‘ভেতরে আসবে? বসে কথা বলি।‘
‘নাহ্‌, আমি বসতে আসিনি। এখানেই ভালো লাগছে।‘
‘ওহ...’ বলে রাশেদ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যেন না এলেই ভালো। এটা কি জিনাত, নাকি জিনাতের ভূত?
‘বললে নাতো, তোমার গানের কী হলো শেষ পর্যন্ত।‘ জিনাতের কন্ঠস্বর স্নিগ্ধ স্বাভাবিক।
আরে নাহ্। শেখ সাদী খানতো পাত্তাই দিলো না। ওরা তো বড় মাপের সুরকার। পরে নতুন একজন গানটি বসবে বসবে বলে আর শেষ পর্যন্ত......এইটুকু বলে রাশেদ আবিষ্কার করলো সে কেমন গড়গড় করে কথা বলতে পেরেছে। তবে শেষ পর্যন্ত যে গানের পিছনে পিছনে দৌড়াবার কারণ ও মানসিকতা তার ছিলো না সে কথা বলার কোন মানে হয়না। সে বরং সাদামাটা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা তোমার যদি কোন দুর্ঘটনা না-ই ঘটে থাকবে তবে এতদিন কোথায় ছিলে? সবাই জানে শফিকের সাথে তোমার বোঝাপড়া হচ্ছিল না, তাই একদিন সেন্টমার্টিন যাবার পথে স্টিমারের পেছন দিক থেকে সমুদ্রে লাফ দিয়েছো। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও......’ বলে দু’হাতের তালু উল্টিয়ে শুন্যতাবাচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।
জিনাত এলোচুলের গোছা আঙ্গুলে জড়াতে জড়াতে ধরাগলায় বললো, ‘মরতে চাইলেই কি মরা যায় বলো।‘ তারপর প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো, ‘তোমার রাতজেগে লেখা গান-কবিতাগুলো পড়ার লোভ কি আর সামলানো যায়?’ একটু থেমে থেকে আবার বলে, ‘এখনতো নিশ্চয় অনেক বড় কবি হয়ে গেছো, তোমার লেখার জন্য পিছুপিছু ঘোরে লোকজন!’
বিস্ময়ের ঘোর না কাটলেও অনেক স্বাভাবিক হয়েছে রাশেদ। এতক্ষণ তার মাথায় এ প্রশ্নটা ঢোকেইনি যে কুড়িবছর সময় পেরিয়ে গেলেও জিনাত সেই আগের মতো রয়ে গেছে – সেই মুখ, সেই চুল, সেই চোখের চাহনি – বয়সের কোন ছাপই নেই চেহারায়। এটা কী করে সম্ভব? সে নিজেওতো আগের মতো নেই। সহপাঠী কারো সাথে কদাচিৎ রাস্তাঘাটে দেখা হয়ে গেলে কেউ কাউকে সহজে চিনতে পারে না। অথচ জিনাত......। সে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে তুমি ছিলে কোথায়?’
‘থাকবো কোথায়? তোমাকে খুঁজতে খুঁজতেইতো সময় পার হয়ে গেল।‘ একটু রগড় করে কথাটা বলে একটা লম্বা শ্বাস ফেললো জিনাত। ‘বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে একদিন তুমি উধাও। কত করে খুঁজলাম সব জায়গায়। আদাবর, টোলারবাগ এলাকার তোমার দু’একটা ছাত্রকে চিনতাম আমি – ওদের জিজ্ঞেস করলাম। কেউ কিছু বলতে পারলো না।‘ সে বলেই চললো, ‘বছরখানেক পর ফার্মগেটের ফুট ওভারব্রীজের ওপর তোমার বন্ধু শাহেদের সাথে দেখা হলে তার কাছ থেকে যা জানলাম তারপর আর তোমাকে হন্যে হয়ে খোঁজার কোন যুক্তি থাকলো না।‘ এ পর্যন্ত বলে আবার প্রসঙ্গ পাল্টায়, ‘যাক সেকথা, নতুন কী লেখালেখি করছো, শব্দকর, শোনাবে নাকি?’
রাশেদ এবার বেকায়দায় পড়ে গেলো। লেখালেখিতো কবেই কোথায় গেছে। মেয়েটা জিনাত হোক আর ভূত হোক, বিস্মৃতির ধুলোবালি মাখা ঝাঁপিটা সে এখন কীভাবে নাড়াচাড়া করবে? কীভাবে জিনাতের কাছে মানবিকভাবে উপস্থাপন করবে তার মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের আকুতির কথা। বস্তুত তার মায়ের সইয়ের মেয়ে রোকসানাকে ঘরে না তোলে উপায় ছিলো না তার। মুমূর্ষ মায়ের সামনে তার জীবনযুদ্ধ, শিল্পসাহিত্য, প্রেমভালোবাসা ইত্যাদি উপস্থাপন করারই সুযোগই ছিলো না। হলে কী হবে,প্রচণ্ড মানসিক চাপে সেই যে সে মাটিতে বসে পড়েছিল সেখান থেকে আর উঠে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি।এ যে এক যুদ্ধ, নিজের সাথে – কাউকে জানানো যাবে না, কেউ কোন সাহায্যেও আসবে না। বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ অর্থহীন হয়ে পড়লে কার্যত সে স্বেচ্ছানির্বাসিত হয়ে পড়ে। মফস্বলের বাড়িটিই তার একমাত্র ঠিকানা হয়ে উঠলে পারিবারিক-পারিপার্শ্বিক চাপ আর প্রাত্যহিক চাহিদার মিথস্ক্রিয়ায় একটি সরকারি ব্যাংকে চাকুরি নেয়ার পর তার প্রাকবৈবাহিক জীবনের অধ্যায় জিনাতসমেত চিরকালের জন্য লকারে চলে যায়। এসব কথা আজ বিশ বছর পর আলোচনা পর্যালোচনা করা নিরর্থক এবং বিব্রতকর এ কথা বুঝতে পেরে রাশেদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বুকের ওপর আচম্বিতে প্রকাণ্ড এক পাথরখণ্ড যেন আপনাআপনি চেপে বসে।
পরক্ষণে চাপমুক্ত হওয়ার সর্বাত্মক একটা চেষ্টা করে রাশেদ বললো, ‘জিনাত, আমার পরিস্থিতিটা জানলে হয়তো আমার উপর তোমার এতো ক্ষোভ থাকতো না।‘
‘না না, তোমার উপর আমার কোন ক্ষোভ নেই’,জিনাত কণ্ঠস্বর নামিয়ে বললো।‘হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়ে গেলতো, তাই আসা।‘
আশেপাশে এখনো কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। সময়টাও থেমে আছে না-রাত না-দিনের মাঝামাঝি। রাশেদ এই পরাবাস্তব ঘটনার কোন মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছে না। জিনাতের সলিলসমাধির পর সময়ের দমকা হাওয়ায় স্মৃতির ছাইভস্ম অজ্ঞাতেই উড়ে গেছে। সংসারের দেয়ালে পরতে পরতে লেগেছে জীবনের পলেস্তারা। একসময়ের স্বপ্নসাথী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া জিনাত কেন যে ঝরেপড়া ছাত্র রাশেদকে ধমনীর সাথে বেঁধে রাখতো সেই উন্মত্ত দিনগুলোতেও সে তা বুঝতে পারতো না। প্রাইভেট টিউশনি করা, মেলা-প্রদর্শনীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টলে কাজ করা, বিদ্যার ঠেলাগাড়িকে বেগবান করার জন্য নৈশকলেজে অনিয়মিত ক্লাস করা এই ছিল তার নিরামিষ জীবনের রুটিন। যা একটু আনন্দের উৎস ছিল তা অই গান-কবিতা লেখার প্রচেষ্টা। কাঠখড় বিস্তর পুড়িয়ে কোন কোন সৃষ্টি আলোর মুখ দেখলেও তার মূল পাঠক-শ্রোতা ছিল জিনাতই। জিনাতের প্রবল আগ্রহ আর প্রেরণাই ছিল তার ঘোড়ারোগের স্বার্থকতা।
‘শোনাবে না একটা কবিতা?’
জিনাতের কথা ঘোরাচ্ছন্ন শাহেদকে আবার একটা ধাক্কা দেয়।
‘বেলীফুলের গন্ধ পাচ্ছি......’ আরো কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না জিনাত। শুধু ঠোঁট দু’টি বাঁকা করে একটু হাসলো।
একথায় আরোও দুর্বল হয়ে পড়লো রাশেদ। হ্যাঁ, বেলী রাশেদের খুবই পছন্দের ফুল। শাহবাগ, ফার্মগেট, মানিকমিয়া এভেন্যু যেখানেই বেলীফুলের মালা পেত কিনে নিত জিনাতের জন্য। এটাই হয়তো তার ভালোবাসার সর্বোত্তম প্রকাশ ছিল। জিনাতও সাথে সাথে মালাটি পেঁচিয়ে নিত তার চুলে। কথাটা সে ভুলেই গিয়েছিলো এতদিনে। জিনাতের কথায় তার নাকেও সুবাসটা লাগলো মনে হয়। কিন্তু এখানে বেলীফুল কোথায়?
জিনাত অনামিকা দিয়ে আলতো করে চোখের কোণটা মুছলো নাকি?
সময়টা এখনো স্থির হয়ে আছে। রাশেদের ভয়-বিস্ময় এখন স্মৃতির কুয়াশাচ্ছন্ন পথ বেয়ে আবেগকাতর হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ রহস্যতো ভেদ করাই যাচ্ছেনা, জিনাত কোথা থেকে কেমন করে এল! এখন জিনাতকে নিয়ে সে কী করবে? সে ভূত দেখছেনা তো? ভূত হোক আর নাই হোক এই গোলমেলে উপাখ্যানের শেষতো করতে হবে।
রাশেদ আবার কৈফিয়তের সুরে বললো, ‘জিনাত, আমি দুঃখিত। আমার কিছু করার ছিল না কিংবা অনেক কিছুই করার ছিল। অন্তত আমার অপারগতাটা তোমাকে জানাতে পারতাম।‘ রাশেদের গলাটা ভারি হয়ে এলো, ‘আমার মাকে আমি অনেক ভালোবাসতাম, আমি ছাড়া আমার মায়ের কেউ ছিল না।‘
‘তোমার কোন দোষ ছিল না। এটা আমাদের নিয়তি।‘ জিনাত আঁচলে মুখ মুছে স্থিরচোখে রাশেদের দিকে তাকালো। তারপর খোলা চুলগুলি বাঁদিক থেকে ডানদিকে এনে দু’হাত দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো, ‘শফিক সন্দেহপ্রবণ ছিল। আমিতো তাকে নিঃসঙ্কোচে বলেছিলাম, আমি একজনকে ভালোবাসতাম। সে এই সত্যভাষণটা সহ্য করতে পারলো না। অচিরেই সে মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। সুযোগ পেলেই সে আমাকে নোংরাভাবে খোঁচা দিত। একসময় অসহ্য হয়ে পড়লে আমি তাকে বলেই দিয়েছিলাম, এ জন্মেতো হলোনা, অন্য জন্মে আমি রাশেদের কাছেই যাব।‘ একটু থেমে বললো, ‘শেষ পর্যন্ত ওর সাথে আর থাকাই হলোনা।‘
রাশেদ বাকরুদ্ধভাবে শুধু শুনেই গেল। তবে এ মুহুর্তে তার নিজেকে একটু অপরাধী অপরাধী মনে হতে লাগলো। তার নিশ্চয়ই কিছু দায়বদ্ধতা থাকা উচিৎ ছিলো। এতো সহজে শামুকের মতো খোলের ভেতর ঢুকে যাওয়া কোন পুরুষালি কাজ না। চেষ্টা করলে সে ঠাণ্ডামাথায় পরিস্থিতিটা সামাল দিতে পারতো। এখন আর কী বলার আছে জিনাতকে একটা উজবুকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানসপটে বিয়োগান্ত ঘটনার চিত্রনাট্য দেখা ছাড়া।
জিনাত হঠাৎ করে জানালার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। রাশেদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘শব্দকর, সত্যি করে একটা কথা বলোতো। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’
রাশেদ এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এমনিতেই সে বিব্রত। জিনাতকে যে সে প্রচণ্ড ভালোবাসতো একথার প্রমাণ সে দিতে পারেনি। এখন তাকে কাপুরুষ বললেও তার প্রতিবাদ করার কোন শক্তি নেই। স্ত্রী-সন্তানের যে মায়াজালে সে এখন বন্দি এ অবস্থা থেকে কেমন করে দৃঢ় উচ্চারণে সে বলবে, হ্যাঁ জিনাত, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসতাম? কী উত্তর দেবে সে কথা ভাবতে ভাবতে মনে হলো সে অবশ হয়ে পড়েছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়াতে বুঝতে পারলো চোখদু’টিতে পানি জমেছে।
‘বুঝেছি, এরকমই হয়। সময়ই সব বদলে দেয়। তোমাকে কিছু বলতে হবে না।‘ জিনাত নিজেই আবেগের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো।
তড়াক করে, অপ্রত্যাশিতভাবে, রাশেদ বলে উঠলো, ‘না না জিনাত, বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ভালোবাসি, এখনো ভীষণ ভালোবাসি। আমি কাজটা ঠিক করিনি। আমার আরোও সাহসী হওয়া উচিৎ ছিল।‘
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিনাত বললো,’পারবে? পারবে প্রমাণ দিতে?’
‘বলো, কী করতে হবে?’ রাশেদ সাহসী উত্তর দিলো।
জিনাত তার ডান হাতটা রাশেদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আমার হাতটা ধরো।‘
রাশেদ তার বিশ্বাসে প্রোথিত জিনাত বেঁচে নেই এই প্রতিষ্ঠিত সত্য বেমালুম ভুলে গিয়ে রোবটের মতো জিনাতের হাত চেপে ধরলো। তার বোধের মধ্যে আর কোন অতীত নেই, কোন বর্তমান নেই। প্রায়শ্চিত্ত করার এটাই যেন একমাত্র মওকা।
‘তুমি যা বলেছো তা যদি সত্যি হয় তবে চলো। আমার সাথে বেরিয়ে পড়ো। এখান থেকে শুরু হোক।‘ জিনাত দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বলে গেলো।
‘তাই হোক’, বলে ভূত-ভবিষ্যৎ কিছুই না ভেবে রাশেদ সামনের দিকে কদম ফেললো। কিন্তু এ কী! সে তো এগোতে পারছেনা। জানালার শিক, পাকা দেয়াল তাকে আটকে রেখেছে। সে ক্রমাগত ঠেলেই যাচ্ছে আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, ‘দাঁড়াও, জিনাত দাঁড়াও......।’ কিন্তু তার চিৎকার গলা থেকে বেরুচ্ছে না; জিনাতের হাতটাও তার হাত থেকে ছুটে গেছে। রাশেদ শত চেষ্টা করেও জানালা আর দেয়ালের আগল ভেঙ্গে বেরোতে পারছে না।
রাশেদের এই পাগলামি দেখে জিনাত চিৎকার করে উঠলো, ‘অ্যাই, তুমি কী করছো...?’ বলে সে আবার ফিরে এসে রাশেদের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো।
রাশেদ হুড়মুড়িয়ে বিছানায় উঠে বসতেই রোকসানা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘কী বিড়বিড় করছো? সাড়ে আটটা বাজে। বাজারে যেতে হবে না?’
তাইতো। আজ ছুটির দিন।বাজারে যেতে হবে। তারপর বাঁহাতের কব্জির উপরে তাকিয়ে দেখলো লাল দাগটা এখনো আছে। কিন্তু আশেপাশে কোন গোলাপফুল খুঁজে পেল না।




আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Tahmina Alom Mollah আমরা যা পাই না, বা পেয়ে হারিয়ে ফেলি সেটাই আমরা স্বপ্নে ফিরে পাই; আর সেই স্বপ্নই আমাদেরকে বেঁচে থাকতে অনুপ্রনিত করে। লিডারের লেখা নিয়ে "no comments".
মাইনুল ইসলাম আলিফ এক কথায় অসাধারণ গল্প।অসাধারণ উপস্থাপনা।গল্প যে কত সুন্দর করে বলা যায় আপনি দেখিয়ে দিলেন।দুর্ভাগ্য যারা আপনার গল্পটা পড়তে পারেনি।শুভ কামনা আর ভোট রইল।আমার পাতায় আমন্ত্রণ।আসবেন সময় করে।
ভালো লাগেনি ২৫ জানুয়ারী, ২০১৮
এমন করে বলেছেন, আমি লজ্জাই পেয়ে গেলাম। অনেক ধন্যবাদ। নিশ্চয়ই সময় করে আপনার বাড়ি ঘুরে আসবো।
ভালো লাগেনি ২৫ জানুয়ারী, ২০১৮
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া অপেক্ষার চেয়ে এবারের গল্পটি আরো ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ। আমার গল্পটি শুনার জন্য আমন্ত্রন বন্ধু।
ভালো লাগেনি ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭
ধন্যবাদ জানাতে দেরি হয়ে গেল। ক্ষমাপ্রার্থী।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৮

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৫৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪