জল-তছনছ

বর্ষা (আগষ্ট ২০১১)

তমসা অরণ্য
  • ২৭
  • 0
  • ১৪
১)
পেছনের উম্...ম্মা, উম্..ম্মা শব্দে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। রিক্সার হাতল থেকে এই বুঝি হাতটা ফসকে গেল কিংবা প্যাডেল থেকে কখন যে পা’টা হড়কে পড়ে! শরীরের প্রায় ফিকে হয়ে আসা শক্তিটাকে তবু সে চাঙ্গা করে নিতে চাইছে মনের সমস্ত জোর খাটিয়ে।

“ইয়া মা’বুদ, এমন মুছিবতে মাইনষ্যেও পড়ে!”

ঝুম বৃষ্টির মধ্যেও শরীর থেকে ঘাম ঝরেই মিলিয়ে যাচ্ছে আসমানী জলের তড়িৎ সম্মোহনে। কপাল বেয়ে লম্বা করে খানিকটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ল মুখের ভেতর। বিকট রকম নোনতা স্বাদে মুখ বেঁকিয়ে আসতে চাইল। ওদিকে পেছনে তখনও হঠাৎ হঠাৎ বড় বড় করে নিঃশ্বাস পড়ছে। সাথে সেই বিরক্তিকর একটানা গা জ্বালানো শব্দ। ভেজা লুঙ্গিটা ক্রমশ দু’পায়ের উরুর দিকের ফাঁকটায় গা গোলানো রকমভাবে আঠাল হয়ে উঠছে। ঠিক কতক্ষণ নিজেকে ধরে রাখতে পারবে ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করে বেলায়েত। আর বৃষ্টিমুখর ফাঁকা রাস্তার সান্ধ্য আলোয় খুব ধীরে প্যাডেল চালিয়ে এগুতে থাকে।


২)
প্রচন্ড ব্রেক কষে হঠাৎ রিক্সাটা থেমে যায়।

“ওই হা*য়ার পো, দিসিলি তো ফালায়া.. ”

ভীষণ রকম ভয় খাওয়া দৃষ্টি নিয়ে রিক্সার হুডটা কোন রকমে চেপে ধরে রাখতে রাখতে প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়ে প্যাসেঞ্জার রোমিওটি গর্জে ওঠে। বেলায়েত কোন রকমে টাল সামলে রিক্সা থেকে নেমে উত্তর দেয়,

“রিসকা আর যাইব না।”

থতমত অবস্থাটা সামলে উঠতেই আরও জোরে খেঁকিয়ে ওঠে যুবকটি,

“মগের মুল্লুক? যাইব না মানে! হইসে কি?”

বেলায়েত প্যাডেলের দিকটা আড়াল করে নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে সমস্যা বোঝার ভাণ করতে থাকে। আর কাঁপা কাঁপা হাতে ইচ্ছে করে হেঁচকা টানে চেইনটা ফেলে দেয়।

“কঠিন পেজগি লাগছে, ছার..”

এরপর গম্ভীরভঙ্গিতে নানা রকম উল্টা-সিধা বুঝিয়ে কোন রকমে কাঁঠালের আঠা দু’টোকে রিক্সাছাড়া করে।


৩)
বাইরে অস্থিরভঙ্গিতে দুদ্দাড় রকম প্রচন্ড শব্দে বেড়ায় চাপড় পরছে।

“ক্যাডা?”

কাঁপা কাঁপা গলায় ভয় খাওয়ানো আকস্মিকতার প্রচন্ডতায় বাচ্চা দু’টাকে বুকের কাছ থেকে সরিয়ে সন্দিহানভাবে কাঠের ম্যাড়ম্যাড়ে চৌকি থেকে নামতে নামতে আর্তনাদ করে ওঠে রাহেলা। উত্তরের জন্যে বিস্ফোরিত চোখে উদ্বিগ্ন কান পেতে অপেক্ষা করতে থাকে।

“আ-আআমি..”

ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে অনেকটা উত্তেজিতভাবেই তাড়া খাওয়া উত্তর আসে বেড়ার ওপাশ থেকে। বাচ্চার বাপের গলা শুনে নিশ্চিত হয় রাহেলা; ধরে প্রাণ ফিরে আসে। এলোচুলটা একহাতে পেঁচিয়ে নিতে নিতে অন্যহাতের বৃত্তাকার গোছার ভেতর গুঁজে দেয়। এরপর দ্রুত হাতে আড়াআড়ি থাকা মোটা বাঁশটা সরিয়ে বেড়া খুলে ধরতে না ধরতেই.. একটা প্রকান্ড শক্তির পশু দপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। আকস্মিক আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূড় রাহেলার চিৎকারের জন্যে মুখ খুলতে নেওয়া আলতো ঠোঁটের উপর শক্ত করে চেপে বসে কামনায় উত্তপ্ত পুরু-পান্ডব ঠোঁট। প্রতিবাদ করতে চাইছে ভীষণভাবে শরীর নাড়িয়ে। দু’হাত দিয়ে জন্তুটার লোমশ বুকটা দূরে সরানোর বোকাটে চেষ্টাও চলে কিছুক্ষণ। কিন্তু.. দুঃশাসনের নগ্ন কামনার আগুনে যেন ঘিয়ের যোগানে ব্যস্ত অসুরীয় শক্তি। বাঁধা পেয়ে অন্ধ-আক্রোশে শ্বাপদটা রাহেলার হাত দু’টো নিজের পেশিবহুল বাঁ হাতে চেপে ধরে দৃঢ়ভাবে। এরপর এলো-পাথাড়িভাবে অন্যহাতে টেনে-টুনে খুলে ফেলতে থাকে শাড়ি। ব্লাউজটা হ্যাঁচকা এক টানেই মাঝ থেকে ছিঁড়ে গুঁজে দেয় এ যুগের দ্রৌপদীর মুখে। এবার চকচকে চোখে ভীষণভাবে উঁইঢিবিটা মুচড়ে দিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করতে থাকে নারকীয় বিভৎসতায়। দু’টো শরীরের আদিম প্রমত্ততায়, এলো-পাথাড়ি হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ির ক্ষিপ্রতায় ক্ষীণ আলোয় মাটির মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে টিনের গেলাস; গড়িয়ে গিয়েই ছড়িয়ে পড়ে জল। তবু কোত্থাও কারো ভ্রুক্ষেপটি পর্যন্ত নেই! অকথ্য যন্ত্রণায় সমস্ত শরীর কুঁকড়ে আসতে চাইছে। প্রকান্ড জন্তুটা প্রচন্ড প্রমত্ততায় প্রবল থাবায় থাবায় আঁচড়ে-কামড়ে দিতে থাকে। আস্তে আস্তে রাহেলার প্রতিরোধের আগুনে জল পড়ে, প্রতিবাদী শরীরটা প্রতিরোধ হারায়। অতঃপর নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে, নিরুপায় রাহেলার নিশ্চুপ সমর্পণ।


৪)
দুপুর থেকে বিকেল-সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হই হই করে সেই যে ঝমঝমানীর ঢল ঝরছে তো ঝরছেই। বাইরে কুকুরের ডাকটা পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। শহরের এত্ত এত্ত নেড়ি কুত্তাগুলো আজ গেল কই! দুর্বল টিনের চালার উপর বেরহম বর্ষার একটানা বৃষ্টি-মাদল বিষম শব্দের কাড়া-নাকাড়া আর বজ্রের দ্রিম-দ্রাম-দড়াম-দড়াস-ঠাস ডামা-ডোলে বড় রাস্তার বাস-ট্রাকের প্যাঁ পোঁ আওয়াজেরও নির্বাসন বুঝিবা!
চোখের জল দু’ধার বেয়ে হিমছড়ির ঝর্ণার মত গড়িয়ে গড়িয়ে কানের কাছে জমতে থাকে ফোঁটায় ফোঁটায়। আর বড় বড় নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে রাহেলার দুরুদুরু বুক চিরে তীব্র থেকেও সুতীব্রভাবে। কুপির আলোয় অদ্ভুতুরে আলো-আঁধারিময় জল-তছনছ বর্ষার বিড়ম্বনামুখরতায় ইলাস্টিক সময়ের হাত ধরে প্রহর এগোয়। তবু বেলায়েত সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে দিতে থাকে বৌ নামক হাড্ডিময় মাংসপিন্ডটির সুরঙ্গপথের অতল গহবরের গহীন থেকে গহনান্তরে। দীর্ঘক্ষণের পাশবিক সহবাসের ক্লান্তির পর ঢিমে তালের উত্তেজনার আলস্যে আলগা হয়ে আসা বেলায়েতের হাতের গড়িয়ে পরার অবসরে, রাহেলার হঠাৎ ছুটে যাওয়া ডান হাত খুব করে খামচে ধরে পাষন্ড স্বামীর তেল-চিটে পিঠ। রাগে “খা*কি, *গি” --সহ চাপাকন্ঠে ভিসুভিয়াসের মত জ্বলে উঠে একগাদা অশ্রাব্য গালাগালে পিঠের যন্ত্রণাটা সামলে নিতে নিতে আবারও আরও তীব্রভাবে নিম্নাঙ্গসহ নিজেকে রাহেলার গুপ্তাঙ্গে চেপে ধরল। বিকট একটা চাপা গোঙ্গানীতে তড়পে উঠল রাহেলা। বেলায়েতের সমস্ত শরীরে তখন চিতাগ্নি; গন্ধহীন মাদকতায় জ্বলছে ভেতর-বাহির, জ্বালিয়ে যাচ্ছে রাহেলাকেও।

“অই মা রে...”

তিন বছরের ছোট্ট বাচ্চাটা হঠাৎ জেগে গিয়ে ঘুমকাতুরে চোখ ডলে ভয় খাওয়ানো চেপ্টা অন্ধকারে কুপির টিমটিমে আলোয় দু’টা পশু মতন কি যেন কি’র গর-গরে গোঙ্গানীমুখর জাপ্টাজাপ্টি দেখে ক্যাঁ করে কেঁদে ওঠে। চমকে ওঠে বেলায়েত। এক ঝটকায় শরীর থেকে শরীর আলগা করে কোনমতে কোমড়ের কাছটায় পড়ে থাকা লুঙ্গির খোঁট বাঁধতে বাঁধতে বেড়া ঠেলে দে ছুট।


৫)
মাওলা ব্যাপারীর রিক্সার গ্যারেজটা পার হয়ে দৌড় ছেড়ে এবার আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করল সে। পা দু’টো যেন আর চলতে চাইছে না। শরীরে বিশ্রীরকম কাঁপুনি ধরে গেছে। পা টেনে চলতে চলতে করিমের বন্ধ চায়ের দোকানের সামনে এসে নড়বড়ে বেঞ্চিটায় কোন রকমে ধপ করে বসে পড়ে ভীষণ হাঁপাতে লাগল। চোখ জ্বালা-পোড়া করছে, মাথার ভেতরটা কেমন ফাঁকা.. সেকেন্ডখানেক পরপর পেরেক ঠোঁকা ব্যথায় কপালের ডানদিকটা টাঁটাচ্ছে। হাতের চেটোয় ভেজা গলা আর বুকের নিচটা মুছে নিল বেলায়েত। ঠোঁটের ধারটা কেমন যেন জ্বলছে। খানিকটা জিভ বের করে পরখ করতেই রক্তের নোনা স্বাদ। জ্বরকাতুরে অস্বস্তিতে জিভ দিয়ে বারবার শুঁকিয়ে আসা ঠোঁটটা ভিজিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। উদোম শরীরের অসহায়তায় আজকের বৃষ্টিমুখর বাতাসের জারটাও জেঁকে বসেছে। হঠাৎ দোকানের টংঘরটা একটু নড়ে উঠল যেন! কান খাড়া করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে বেলায়েত। কিন্তু.. শরীরে তখন পাথর-ভাঙ্গা খাটুনীর ক্লান্তি। বেলায়েতের ভীষণ ঘুম পাচ্ছে.. ঘুম.. বৃষ্টির ছাট এসে ভেজা শরীরটায় বিন্দু বিন্দু জলের আলপনা এঁকে আবার গড়িয়েও পড়ছে। আদিম প্রবৃত্তিটা জলের ছাটে ছাটে সেই কখন উধাও! কিন্তু পেটের ভেতরটা কেমন যেন গুলিয়ে আসতে চায়.. সচেতন ক্ষুধায় মোচড় দিয়েই অবচেতনে হড়বড়িয়ে দুপুরের ভাত-ডাল-তরকারি সব বৃষ্টির জলে মিশে যেতে থাকে। থকথকে বমিতে বুকে-পেটে মাখামাখি। ওদিকে বৃষ্টির প্রবলতায় আর আর সব থেকে চাপা পড়ে যেতে থাকে একটানা উম্..ম্মা, উম্..ম্মা শব্দ। মেঘ নিঙড়ে জলেরা প্রবলভাবে ঝরে পরতে থাকে, পরতেই থাকে; তবু বেলায়েত রমণীর শীৎকার শোনে.. শব্দেরা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়... আর থুতনিটা দুর্বলভাবে বুকের কাছে এক কাৎ হয়ে ঝুলে পড়ে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিজানুর রহমান রানা প্রতিরোধের আগুনে জল পড়ে, প্রতিবাদী শরীরটা প্রতিরোধ হারায়। অতঃপর নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে, নিরুপায় রাহেলার নিশ্চুপ সমর্পণ।
sakil আমি মুগ্ধ , বেশ ভালো লেগেছে .তবে সকল পাঠকের কথা চিন্তা করে লেখা উচিত . . শুভো কামনা রইলো
শাহ্‌নাজ আক্তার আসলে এত খোলামেলা গল্প পড়তে আমার একটু অসস্তি লাগে, যাই হোক খেটে-খাওয়া মানুষ দের নিয়ে লিখেছেন , সেজন্য ধন্যবাদ |
তমসা অরণ্য বন্ধু অদিতি, ধন্যবাদ!
তমসা অরণ্য ভাই শামীম আরা, ধন্যবাদ! কিন্তু কি ধরণের অপরিপক্কতা তা জানালে অভিযোগটা আরও জোরালো হত। আর আমিও নিজের ভাষাগত কোথাকার কি সমস্যা শুধরে নিতে পারতাম... :)
তমসা অরণ্য রনীল, আপনার পর্যবেক্ষক পাঠক মনের তারিফ করতেই হয়। সুন্দর ও সাবলীল মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ বন্ধু!
শামীম আরা চৌধুরী সেই এক চিরন্তন আদিমতার হিংস্র রুপ। ভাষার অপরিপক্কতা।
রনীল N/A UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL# যৌনতা/(অনিচ্ছাকৃত হিংস্রতা!), জীবন, বাস্তবতা ও সাহিত্য- সব খুব সুষমভাবে সাজিয়েছেন। বেলায়েত-রাহেলার সহবাসের বর্ণনাটি গল্পের প্রয়োজনে এসেছে বলেই মনে হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় বা আরোপিত মনে হয়নি। গল্পকারের প্রোফাইলটি প্রাইভেট... দুচোখের মাঝে লাল টিপের অবস্থান দেখে পারসোনাল পার্টিকুলারস সম্পর্কে একটা ধারনা করা যায়... সে হিসেবে বলব- বেলায়েতের চরিত্রটি বেশ ভালো পর্যবেক্ষণ করেছেন।

০৯ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪