রাতের যাপসা আঁধার প্রায় কেটে গেছে। নিকোষ কালো অন্ধকার আত্মসমর্পন করেছে পবিত্র প্রভাতের কাছে। চারদিকে পাখির কিচির মিচির ডাকে আর ভোরের ঘন আবীরে চেয়ে গেছে নাফ নদীর আশ-পাশ সহ সাবরাং এর নয়াপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট। রিমঝিম বৃষ্টির লুকোচুরি খেলার মধ্যেও পূর্ব দিগন্তে ধীরে ধীরে সোনালী সূর্য উঁকি দিতে থাকে। ভেজা সবুজের আড়ালে নদীর বুকে জলের ঝিকিমিকি তরঙ্গে দৃষ্টি আটকে আছে কিছু অতন্দ্র প্রহরীর। ঠিক এমন সময় বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বিজিবির লক্ষ ভেদ করে সাবরাং এর নয়াপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ভেলা চড়ে পনের বিশজনের একদল রহিঙ্গা শরণার্থী মায়ানমার থেকে নাফ নদী পাড়ী দিয়ে এপাড়ে অনুপ্রবেশ করে। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড কোন রকম বাধা না দিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ। তাই তাদেরকে সাবরাং হারিয়াখালীর অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। তারপর প্রাথমিক চিকিৎসার পর সবাইকে পূনরায় রহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে বিশ বাইশ বছরের একটি মেয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে তাকে চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিফ্ট করা হয়। মেয়েটির মুখে কোন কথা নেই, নামটিও জানা হয়নি। পরনে জীর্ন শীর্ন ছেঁড়া ফাটা আধা পুরান শেলোয়ার কামিজ। মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েটি ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ থেকে গড় গড় করে গাল বেয়ে পানি পড়ছে। মেয়েটির প্রতি আমার মায়া হলো। ওকে এভাবে একা হাসপাতালে ছেড়ে যেতে মন চাইছেনা। তার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই মন থেকে দায়িত্ব নিয়ে তার ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করি। ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করি, ওর কি হয়েছে? ওর এমন অবস্থা কেন? ডাক্তার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেরে জানান যে মেয়েটি অন্তসত্তা। তিনি আরো জানান অনেক দিনের অনাহার ও অনিদ্রায় মেয়েটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে সে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক অসুস্থ এবং দূর্বল। এখন তার অনেক বিশ্রাম, ভালো খাবার, চিকিৎসা ও সেবার দরকার। আশা করি দিন দশকের মধ্যে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে তার ভিতরে অনেক রোগের বাসা বাধার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো থেকে সেরে উঠতে সময় লাগতে পারে। ডাক্তারের মুখে মেয়েটির ব্যাপারে কথাগুলো শুনে আমার অনেক খারাপই লাগলো। মনে মনে স্থির করলাম ওর সেবা-যত্ম করে ওকে ভালো করে তুলবো। সবার আগে যেটা করা দরকার সেটা হলো ওর জন্য কয়টা ভালো জামা কাপড় নিতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে বের হই এবং একটা দোকান থেকে মাঝারি মানের দু’জোড়া জামা নিয়ে আসি।
আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যমান মনে করি। কারণ আমি খুব কাছ থেকে রহিঙ্গা শরণার্থীদের সেবা করতে পেরেছি। এজন্য আমি সবার আগে আমার পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে আমার মা-বাবাকে যারা আমাকে আত্ম-মানবেতার সেবায় নিবেদিত প্রাণ হতে শিক্ষা দিয়েছে। তারা আমাকে শিক্ষা দিয়েছে কিভাবে অসহায় গরীব দুঃখী মানুষের সেবা করতে হয়। আমার মত আমার বাবাও ছিলেন একজন অবসর প্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। সে সুবাধে আমিও বাবার পছন্দমত বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জোয়ান পদে যোগ দেই এবং গত ২৫শে আগষ্টের পর থেকে কক্সবাজারে উখিয়ায় অনিকেত অসহায় রহিঙ্গা শরণার্থীদের রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং মনে মনে এদের সাহায্য সহযোগিতার জন্য আমার সকল সামর্থ উৎস্বর্গের প্রতিজ্ঞা নেই।
দু’দিন পর নামহীন অচেনা অজানা মেয়েটির মুখে কথা ফোঁটে। পানি পানি বলে কাতরাতে থাকে। একজন সেবাকর্মী অবস্থা লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে তার মুখে দেয়। আমি তখন তার পাশেই দাঁড়ানো, ও পলকহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার অপাঙ্গে বিন্দু বিন্দু জল আটকে আছে। সেবা কর্মী ওর কুশল জিজ্ঞেস করে এবং তার নাম জানতে চায়। ও তোতলানো মুখে অস্ফুটে হা-মি-দ উচ্চারণ করে থেমে যায়। আমরা বুঝেনি তার নাম হামিদা। ও আরও কিছু বলতে চায় কিন্তু পারেনা। আমি তার মুখ থেকে কথা শুনতে ব্যাকুল হয়ে থাকি। ও অস্পষ্ট ভাবে দু’একটা কথা বললেও আমি তার ভাষা বুঝতে পারিনা। এভাবে সকাল ঘনিয়ে বিকেল, সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের পালাক্রমে ও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে। আমি প্রতিদিনই আমার কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার খোঁজ খবর নেই। ডাক্তার আর নার্সের সাথে তার ব্যাপারে যোগাযোগ রাখি। আমি তাড়াতাড়ি তার সুস্থ হওয়ার জন্য দোয়া করি।
পাঁচ দিন পর হামাদি যখন মোটামুটি সিষ্টি পার্সেন সুস্থ। আমি তাকে কুশলে জিজ্ঞেস করি। এখানে আপনার আত্মীয় স্বজন কে আছে, আপনি কার কাছে উঠবেন? আপনার পরিবার বা কারো কোন নম্বর থাকলে আমায় দিতে পারেন, আমি খোঁজ নিয়ে আপনাকে তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিব। আপনার স্বামীও বা কেমন মানুষ ওতো একবারের জন্য এখানে আপনার খোঁজ নিতে আসেনি। আমার মাথায় ধরেনা এক সাথে এত মানুষ আসছে অথচ একটা মহিলা এমন অবস্থায় আছে জেনেও ওরা কীভাবে থাকতে পারে। এতক্ষন আমি দম আটকে কথাগুলো বলে যাই। আমার মুখ থেকে কথাগুলো শুনার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হামিদা বলে-এখানে আমার কেউ নেই। না বাপ-মা, না ভাই, না স্বামী। আমি একা এখানে আমার আত্মীয় কিংবা আমার আপনজন বলে কেউ নেই। আমারতো বিয়েই হয়নি, আমি স্বামী পাবো কোথায়? হামিদা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে আর হাঁফাতে হাঁফাতে কথাগুলো বলে যায়। আমি কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমি বুঝতে পারিনা, আমি কিভাবে হামিদাকে তার সন্তান সম্ভবার কথাটি জানাই। এক পর্যায়ে কোন বনিতা না করে বুকে সাহস নিয়ে তাকে বলে ফেলি। তাহলে আপনার গর্ভের সন্তানটা! হামিদা বেবাচেকা খেয়ে অসহায়ের মত কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দুচোখ দিয়ে টর টর করে পানি পড়তে শুরু করে। হামিদার প্রতি লক্ষ্য করে আমার এমন মনে হলো আমার কথা শুনে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। অনেকক্ষণ পর হামিদার মুখে কথা ফোঁটল। হামিদা বল্লো সে এক দূর্ভাগ্যের ফসল। হামিদার মুখ থেকে কথাটা শুনার পর আমার মাথাটা একটা চক্কর দিয়ে উঠল। আমি দাঁড়ানো থেকে বসে গেলাম। আমি জানতাম না এমন একটা খুশির সংবাদ হামিদার কাছে এত বড় দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। আমার মাথায় যেন ঠাডা পড়ে। আমি আমার ভাষা হারিয়ে ফেলি। আমি যেন বোবা হয়ে যাই। আমার সারা শরীর অবস হয়ে আসে। আমি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলি। আমি বুঝতেছিনা আমি কি দিয়ে হামিদাকে সান্তনা দিব।
হামিদা তার করুন ইতিহাসের বর্ণনা দেয়। আমি হামিদার মুখের ভাষা খুব একটা বুঝিনা, তবু যতটুকু তার মুখ থেকে শুনি। তাতে বুঝতে পারি বীরঙ্গনা হামিদা ভাগ্যের কাছে নির্মমভাবে পরাজিত। আমি হামিদার মুখ থেকে শুনি হামিদা বলতে থাকে-আরাকান প্রদেশের রাখাইনের ছোট্ট একটা গ্রামে আমাদের বসবাস। আমরা দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। আমরা সবাই একই পরিবারে বাস করতাম। এক সন্ধ্যায় একদল বৌদ্ধ জোয়ান আমাদের বস্তিতে হানা দেয়। আমার বড় দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। আমার মা-বাবাকে আমার সামনে হত্যা করে। আমি এমন দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন দেখি সাত-আটটা যুবতী মেয়ের সাথে আমিও একটা ঘরে বন্ধী। এরপর থেকে প্রতিদিন আমাদের ওপর অমানবিক যৌন নির্যাতন চালানো হতো। এতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী, দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশ, রাখাই বৌদ্ধ ও অপরাপর এথনিক গ্রুপের মিলিশিয়ানরা আমাদেরকে লেহ্যর মত ভোগ করতে থাকে। এভাবে ৪৫ দিন পর্যন্ত আটকে রেখে আমাদের ওপর অমানসিক যৌন নির্যাতন চালানো হয়। এমনকি নির্যাতনের পর অনেক মেয়েকে হত্যা করা হতো। এক রাতে আমি কোন রকম প্রাণ বাঁচিয়ে ঐ আস্তানা হতে পালিয়ে আসি। তারপর রহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে যোগ দিয়ে রাখাইনের মংডুর ধংখালীর বালুচর সীমান্তে গত দু’মাস ধরে এপাড়ে আসার জন্য অপেক্ষা করি। হামিদার মুখ থেকে এমন লোম হর্ষক নৃসংশ ঘটনার বর্ণনা শুনে সহ্য করতে না পেরে আমি কেঁদে ফেলি।
রাত আনুমানিক বারটা। মাত্র ঘুমের ঘরে দু’চোখ এক করলাম। ঘুমে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসতে না আসতে আমি স্বপ্ন দেখি। দেখি কক্সবাজার উখিয়া ত্রান কেন্দ্রে আমরা কয়েকজন সহকর্মী ত্রান বিতরণে সাহায্য করি। সামনে কর্দমাক্ত মাঠ, তারমধ্যে টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছে। হতভাগা রহিঙ্গা শরণার্থীরা সারিবদ্ধভাবে কাদা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা একে একে তাদের হাতে ব্যাগবর্তী ত্রানের প্যাকেট তুলে দিচ্ছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি। হঠাৎ সামনে আমার চোখ পড়ে। আমি দেখতে পাই, কাদা মাখামাখি হয়ে ময়লা শরীর নিয়ে হামিদা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার চোখে মুখে অসস্তির চাপ লক্ষ্য করি। বলতে না বলতে দেখি সে অজ্ঞান হয়ে মাঠে পড়ে যায়। আমরা কয়েকজন তাকে তুলে অস্থায়ী সেবা কেন্দ্রে নিয়ে যাই। তার চোখে মুখে পানি চিটিয়ে জ্ঞান ফিরাতে চেষ্টা করি। কিছুক্ষনের মধ্যে সফলও হই। জ্ঞান ফিরে হামিদা আমাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচামেচি করে কাঁদতে শুরু করে। আর বলতে থাকে, দয়া করেন,দয়া করেন, আমাকে দয়া করেন, আমারে ছেড়ে যাবেন না। আমারে এ জানোয়ারদের হাত থেকে বাঁচান। বলতে বলতে হামিদা পূনরায় অজ্ঞান হয়ে আমার কোলে লুটিয়ে পড়ে। এমন সময় স্বপ্নের মধ্যে হামিদার চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে জেগে খাটের উপর বিছানায় আমি নিজেকে আবিস্কার করি। দেখি আমার শরীর মৃদ্যু কাঁপতে আর ঘামতে থাকে। বুকে হাত দিয়ে লক্ষ্য করি আমার বুকের ভিতর ধড়ফড় করছে। আমি বুঝতে পারি বিপন্ন হামিদাকে নিয়ে এতক্ষন আমি স্বপ্ন দেখতেছি।
রাত ১টা হতে ৪টা আমার আর কিছুতেই ঘুম আসছেনা। কিছুতেই আর দুটি চোখের পাতা এক করতে পারছিনা, বার বার শুধু হামিদার কথা মনে পড়ছে। স্বপ্নের মাঝে হামিদার করুন চিৎকার আমার কানে ভেসে আসছে। তার অসহায় মলিন মুখের ছবিটা আমার দুচোখে ভাসছে। হামিদা অনূঢ়া অথচ সন্তান সম্ভবা। নিষ্ঠুর নিয়তির কি চরম খেলা। হামিদার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। তার জঘন্য পরিস্থিতি আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে তার সাথে-তো আমার কোন সম্পর্ক নাই। নাই কোন পূর্ব পরিচয়ও। তবে কেন তার জন্য আমার এমন লাগছে। তবে কি হামিদার জন্য আমার করুনা হচ্ছে। তবে আর যাই হোক, মুখে আর মনে যাই বলিনা কেন, তার জন্য আমার মনে এক ধরনের মায়া জমে গেছে। তার পাশে দাঁড়াতে বিবেক তাড়া দিচ্ছে। তাকে দেখতে মন চটপট করছে। আর ঘুমাইনি, সারারাত হামিদার ভাবনায় জেগে আছি। কিন্তু কথায় আছেনা অপেক্ষার রাত দীর্ঘ হয়। রাততো আর শেষ হচ্ছেনা। কখন ভোর হবে, কখন হামিদাকে দেখতে পাবো? তাকে সান্তনা দিয়ে তার ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা বলবো। তার অতীত বিস্মৃতির কথা ভুলে যেতে অনুরোধ করবো। দরকার প্রয়োজনে তার নতুন স্বপ্নের আমি রাজ সাক্ষী হয়ে থাকবো। আমি হামিদাকে নতুন করে বাঁচার আশ্রয় দিব। ও চাইলে আমার নিজের হাতে তার চোখের কালিমাখা জল মুচে দিব। ওকে কালিমা মুক্ত করে তুলবো। হামিদা চাইলে আমি তার গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব নিবো। সে আমার স্ত্রৈন হবে। এতে-তো আর আমার পাপ হবেনা বরং পূন্যই হবে। ভাবনাগুলো ভাবতে ভাবতে ভোরের শীতল সুবাতাস আমার গায়ে এসে মিশে যায়। দূর থেকে পাখির ডাক আর মোয়াজ্জিনের সুমধুর আজানের মিষ্টি সুর কানে ভেসে আসে। খুব দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। বাথরুমে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে একটা শার্ট হাতে নিয়ে পরতে পরতে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
হাসপাতালে পৌঁছে হামিদার সামনে দাঁড়াতেই মনে সস্তি আসে। আমি লক্ষ্য করি আমাকে দেখার পর হামিদার চোখে-মুখে আন্দ খেলে যায়। হামিদাকে জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন? সে মুখে কিছু না বললেও মাথা নেড়ে সায় দেয় ভালো আছে। আমি হামিদার ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে কথা বলি। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি ওর অবস্থা কেমন? ডাক্তার আমাকে বলে ওর অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক বেটার। ওর মানসিক অবস্থারও আগের চেয়ে অকে ইনপ্র“ভ হয়েছে।
হামিদা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আজই প্রথম হামিদাকে এত হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। হামিদাকে আজ পরিপূর্ণ সুবদ বালিকার মত লাগছে। এর আগে তাকে অনেক কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হলেও আজই প্রথম তাকে মনের চোখ দিয়ে এত কাছ থেকে দেখছি। শান্ত-শ্রীষ্ট হামিদা। গায়ের রঙ শ্যাম উজ্জল বর্ণের। একবারেই সাদা মাটা নিঃস্পাপ চেহারা। ছিমছাম তার দেহের গঠন। কাজল মায়ার দুটি চোখ, যখন তখন যারে তারে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। রাকা সদৃশ কপালের চিত্র। চিকন দুটি ঠোঁটের আড়ালে দুসারি সরল দাঁতের দৃশ্য বড়ই অপূর্ব। সরল চিকন হাত পায়ের আঙ্গুল গুলো। তার কমর অবধি দীঘল কালো কেশ। যেন অমাবশ্যা রাতে মেঘেরা খেলা করে। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির মিডিয়াম শরীর। জীর্ণ শীর্ণ পোষাকেও দারুন। না জানি অলংকার সাজে কেমন লাগে। আমি তার ওপর থেকে কিছুতেই চোখ দুটি ফিরাতে পারছিনা। আমি ধীরে ধীরে হামিদার প্রতি আসক্ত হয়ে যাই। তাকে আমার মনে স্থান দিয়ে ফেলি। আমি তাকে ভালো বাসতে শুরু করি। সে আমার কাছে হয়ে ওঠে আমার কাছের এক আপনজন। আমি কোন বনিতা না করে অকপটে হামিদাকে বলে ফেলি। হামিদা আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমি তোমার এবং তোমার গর্ভের অনাকাঙ্খিত সন্তানের দায়িত্ব নিতে চাই। আশা করি তুমি অমত করবেনা। আমি দেখতে পাই অসহায় হামিদার নিঃস্পাপ দুটি চোখের কোনে হ্যাঁ সূচক এক নতুন স্বপ্নের হাতছানি। বেঁচে থাকার এক প্রবল আকুতি। তার চুপ থাকাই বলে দেয় এখনি তার সামনে তাকানোর সময়। তার কাছে মনে হয় অপেক্ষমান আলোর পিছনে ছোটা বোকামী। নতুন প্রভাতের জন্য অপেক্ষা করাই শ্রেয়। সুতরাং আমি মনে করি, এবার হামিদার সামনে তাকানোর পালা।
আমি আমার চারপাশ ঝেড়ে ফেলে নিজের বিবেক কে জানান দিই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমি অসহায় হামিদার পাশে দাঁড়াবোই। আমার সমাজ আমার পরিবার কিভাববে? তারা মেনে নিবে কি নিবেনা? তা আমি মহসীনের জানার বিষয় নয়। আমি দেশ সেবায় নিয়োজিত। আমি মানব সেবায় এক বিবেকবান প্রাণ। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এক সৈনিক। আজ বার বার আমার একজন শিক্ষকের একটি কথা আমাকে মনে করিয়ে দেয়-
A satisfied life is better than a
successful life. Because our success
is measured by other. But our
satisfaction is measured by our
own soul, mind and heart.
তাই আমিও মানব সেবায় না হয় নিজেকে উৎস্বর্গ করবো। একজন রহিঙ্গা শরণার্থী নারীকে সাহায্য করবো। তাকে আমি আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিব, পরিচয়হীন তার গর্ভের সন্তানকে আমি আমার সন্তানের পরিচয়ে মানুষ করব।
ঠিক পনের দিন পর হামিদা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। আমি তাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে না নিয়ে সোজা নিয়ে আসি কাজী অফিসে। তারপর ধর্মীয় ভাবে ইসলামী মোতাবেক আমি তাকে বিয়ে করি এবং আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে একটি ভাড়া বাসায় তুলি। সে দিনের পর থেকে সুখে-দুঃখে হামিদা আমার বুকে মাথা গুচে এবং আগামী দিনের নতুন স্বপ্ন রচনা করে। ছয় মাস পর হামিদা একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। আমরা দুজনেই মিলে ঠিক করে তার নাম রাখি আজাদ। আজাদ আমাদের সংসারে হেসে খেলে মানুষ হতে থাকে।
-ঃ সমাপ্ত ঃ-
১৭ অক্টোবর - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪