আর্বতন

পার্থিব (আগষ্ট ২০১৮)

এলিজা রহমান
  • ৪৯
এখন বাজে সকাল সাড়ে সাতটা । সুজন আহমেদ অফিসে যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্টে দাড়িয়ে আছে । বাস কখন আসবে কে জানে ? দেরী করে অফিসে পৌছালে তো আবার বসের ঝাড়ি আর অন্যদের মুখ টিপে হাসি আর উপদেশ ।
সুজন আহমেদ একটা প্রাইভেট কোম্পানীর একজিকউটিভ অফিসার । আজকে বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল , কাজের চাপে মাকে ফোন করাই হয় নি । মা এর শরীর এখন কেমন কে জানে । মা থাকেন ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার নামপাড়া গ্রামে , মায়ের জন্য সুজন প্রতিমাসে বেশ টাকা পাঠায় সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র । ওর বড় ভাইয়ের স্ত্রী মানে সুমনা ভাবী খুব ভাল ,মায়ের অনেক যত্ন করে । মা ফোন করলেই শুধু ওর বিয়ের কথা বলেন । মা তো বুঝেন না , আজকাল সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলে বউ পাওয়া যায় না । আজকের দিনে মানুষ কোন অবস্হান থেকে এসেছে এটা ম্যাটার করে না কোথায় পৌঁছাল , কত উপরের লেভেলে উঠতে পারল এটাই বিবেচ্য বিষয় । সুজনের এমবিএতে ভাল রেজাল্ট ছিল , তারপরও অফিসে অনেক কম্পিটিশন রয়েছে , ভাল কাজ করা ছাড়াও লবিং হয় , পুশিং বেকিং , পলিটিক্স সবকিছু নিয়েই চাকরি করছে সে আজ পাঁচ বছর ।

অফিসে যাওয়ার পথে বাসে বসে সে ভাবছিল মাকে ভালবাসি কথাটা বলা হয় নি কোনদিন । বাবা মারা গেলেন গতবছর , তাকেও কথাটা বলা হয়ে উঠে নাই । ময়মনসিংহ যেতে দুঘন্টা লাগবে । এছাড়া অফিস থেকে ছুটিও দিতে চায় না । পৃথিবীতে মা ছাড়া নিঃস্বার্থভাবে আর কেউ ভালবাসে না । অফিসে পৌছাল ১০টার দিকে কয়েকদিন বৃষ্টিতে ভিজে অফিসে আসতে যেতে হওয়ায় জ্বর জ্বর বোধ হচ্ছে সুজন আহমেদের । বায়িং হাউসের সাথে কাজ করে সুজনের প্রতিষ্ঠান , প্রজেন্টেশনের কাজটা করে না রাখলে বায়ার পেতে দেরি হবে আর কপালে জুটবে বসের ঝাড়ি তাই জ্বর নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে । অফিসের পিয়ন চা আর বিস্কিট দিয়ে গেল , সকাল থেকে কিছু খাওয়াই হয় নি । লান্চ আওয়ার পর্যন্ত সে একটানা অনেকক্ষন কাজ করল। এখন মাথা ব্যাথা করছে তার । একজন কলিগ জিজ্ঞাসা করল ,"অাপনার শরীর খারাপ নাকি ? আমার কাছে এক পিস কেক আছে খাবেন ?" ভাল লাগছে না বলে সে রিভিউস করেছে । কবে যে গ্রামের বাড়িতে যেতে পারবে সে , কতদিন মায়ের হাতের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজি খাওয়া হয় না । জ্বর নি য়েই আজকে সে অনেক কাজ করেছে , মায়ের মত কেউ জিজ্ঞেস করে না ,' কি খাবি ?' ' ঝাল পিঠা বানাই দিমু ?' ওষুধ নিয়ে কেউ দাঁড়ায়ও থাকে না । বনানীর ফ্ল্যাটে সুজন সকালে নিজেই কফি বানিয়ে নেয় ,ডিম পোচ অার পাউরুটি দিয়ে নাস্তা করে , মাঝে মাঝে ফ্রোজেন পরাটাও কিনে এনে খায় । কাপড় চোপড় লন্ড্রিতে দেয় , সপ্তাহে দুদিন একটা কাজের মহিলা এসে ফ্ল্যাটটা পরিষ্কার করে দিয়ে যায় ।
অফিসের জানালার কাঁচে বৃষ্টির পানি জমছে । বাইরে আস্তে আস্তে দিনের আলো নিভে আসছে । শহরের বৃষ্টি উপভোগ করা যায় ঘরের ভিতরে বসে । সুজনের মতন যাদের অফিসে যেতে হয় , তাদের তো বৃষ্টি হলে বাসায় ফেরা একটা যন্ত্রনা । একে তো রাস্তায় নামলেই পানিতে রাস্তা সয়লাব আর কোন সিএনজি , ট্যাক্সি ,রিকশা কিছুই পাওয়া যায় না । বৃষ্টি হলেই রিকশাওয়ালারা ভাড়া বাড়ায় দেয় । ওদের বা দোষ কি , খারাপ রাস্তায় চালাতে তো ওদের ডাবল খাটনি হয় । উবারে একটু সুবিধা হয়েছে সুজনের ।

সুজন আহমেদ ভাবছিল , ত্রিশালে ওর নামপাড়া গ্রামের বাড়ির কথা । বৃষ্টি তে মাঠে , পুকুরে , খিরো নদীতে মাছ ধরা , নৌকায় ঘুরে বেড়াতে কি ভালই না লাগত । সুজন ভাবছিল কালকে সকালে কুরিয়ারে মায়ের ওষুধ আর টাকা পাঠিয়ে দেবে । নিজে যেতে পারলে সব চেয়ে ভাল হত ।

সুজনের মনে পড়ল নামপাড়া গ্রামের শুকনি বিলের কথা । এই বিলের পাশে একটা বটবৃক্ষ আছে , এই গাছের নীচে বসে কবি নজরুল ইসলাম বাঁশিতে সুর তুলতেন । এটির নাম এখন হয়েছে নজরুল বটবৃক্ষ । বিদ্রোহী কবির জীবনের সঙ্গে ত্রিশালের নামটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে । ত্রিশাল বাসস্ট্যান্টের পাশেই নজরুল একাডেমী । কবির স্মৃতি বিজড়িত দরিরামপুর হাইস্কুলটিই এখন নজরুল একাডেমী বানানো হয়েছে । সুজন একবার গিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে । এখানে চারুকলা ভবনের পাশে একটা ভাসমান রেস্টুরেন্ট আছে সিন্ধু সাগর নামে । নজরুল ইসলাম ক্লাস সেভেন ও এইটে পড়েছেন দরিরামপুর হাই স্কুলে । কবি নামপাড়ায় যে বিচ্যুতিয়া বেপারির বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতেন সেটা এখন নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র, এই কেন্দ্রের মূল ভবনে রয়েছে কবি নজরুল পাঠাগার ও সংগ্রহশালা । যে দারোগা সাহেব কবিকে আসানসোল রুটির দোকান থেকে নিজের কাজির শিমলা গ্রামে নিয়ে এসেছিলেন সেখানে এখন একটা দুতলা বিশিষ্ট নজরুল পাঠাগার ভবন তৈরী করা হয়েছে । কবিকে তার জীবদ্দশায় কোন বাধনে বেধে রাখা না গেলেও তাঁর স্মৃতিকে ত্রিশালের কবিভক্ত মানুষজন ঠিকই বেঁধে রেখেছেন ।

উবারে বাসায় যেতে যেতে সুজনের মনে হল সকালে মায়ের জন্য ওষুধ আর টাকাগুলো কুরিয়ার করে দিতে অফিসে যাওয়ার আগেই । তাহলে মা সেগুলি সন্ধ্যার আগেই পেয়ে যাবে । মাকে পরে ফোন করে জেনে নিতে হবে সেগুলি পেয়েছেন কিনা ।
রাস্তায় পানি জমে অনেক জ্যাম হয়ে আছে । বাসায় যেতে যেতে দশটা বাজবে আজকে । রান্নার ঝামেলায় না যাওয়ার জন্য বনানীতে এসে কিছু খাবে । তারপর গোসল করে ঘুমাাতে হবে ।

কুরিয়ার করতে যাওয়ার জন্য িকশায় বসে আছে সুজন । বনানী কবরস্হানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখল একটা এমবুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে কবরস্হানের সামনে । একজন মহিলা আর দুজন ভদ্রলোক নেমে এলেন এমবলেন্স থেকে । তাঁরা এমবুলেন্স থেকে একটা কফিন নামাল । মহিলা না বলে মেয়ে বলাই ভাল , অল্প বয়সী শ্যামলা মতন মেয়েটি কাঁদতে কঁাদতে বলছিল ," মা তুমি এত তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলে ? আমি তো এতিম হয়ে গেলাম ।আমি ফিরে এসে কেন তোমাকে আর দেখতে পেলাম না । আল্লাহ আমার মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও ।"
বলে সে ক্রমাগত কাঁনতে থাকে । সবাই মৃত মহিলাকে দাফন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল । কি মনে করে সুজনও রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কবরস্হানে ঢুকে পড়ল । সে দেখল , সদ্য কবরস্হত মহিলার কবরের উপরে হাত রেখে মেয়েটা কান্নাকাটি করছে । কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না । সুজন জানতে পারল যে , মৃত মহিলা ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই থাকতেন ।এই ছোটমেয়েটা দুবছরের জন্য সে দেশের বাইরে গিয়েছিল পড়াশুনা করতে ।
তার ফিরে আসার কথা ছিল আজকে , আর গতকাল রাতে হার্ট ফেইল করে ঘুমের মধ্যেই মহিলা মারা যান । ছেলের বউ সকালে চা দিতে এসে দেখল মা উঠছেন না । তখন সবাই এসে দেখে যে উনি আর নেই । মা এর সঙ্গে আর দেখা হল না বলে মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে । মায়ের মৃত্যতে সে মেয়েটা একদম ভেঙে পড়েছে । পড়াশুনার জন্য সে মায়ের সঙ্গে থাকতে পারে নি , এই দুঃখে সে কান্না থামাতে পারছে না ।

সুজনের হঠাৎ করে নিজের মায়ের কথা মনে হল । তার মা তো বেঁচে আছেন ,যতদিন মা আছেন ততদিন মায়ের সঙ্গেই সময় কাটান উচিত ,সেবা করা ,কাছে থাকা দরকার । আসলেই তো যারা তোমাকে ভালবাসে ,যাদের নিয়েই পরিবার তাদেরকে অবশ্যই সময় দেয়া উচিত দেরি হয়ে যাওয়ার আগে। যাতে পরে আফসোস করতে না হয় ।
সুজন আহমেদ ঠিক করল কুরিয়ার নয় , এই শুক্রবারেই সে ময়মনসিংহ যাবে মায়ের কাছে । সুজনের হঠাৎ করে মনে পড়ল ভগবৎ গীতার একটা বানী । সেখানে বলা হয়েছে খালি হাতেই আপনি জন্মেছিলেন এবং সেই অবস্হাতেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন । মৃত্যুর পর আপনি আপনার সাথে কোন পার্থিব সম্পদ নিয়ে যেতে পারবেন না । সন্ঞ্চিত সম্পদ বাড়ানোর চিন্তাই আমরা সারাজীবন করি , একবারও মনে পড়ে না এই টাকা, জমি ,বাড়িঘর কিছুই আমাদের সঙ্গে যাবে না । পরিবারের আপনজনদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ন কিছুই নেই এই পার্থিব দুনিয়াতে । ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে চান্দিনা পর্যন্ত
কয়েক জায়গায় বৃষ্টির পানি জমেছে , এইজন্য বাসটা অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হল গাড়িগুলো আস্তে আস্তে পার হচ্ছিল। সুজন আহমেদ সকাল ৬টায় বাসে উঠেছে যাতে তাড়াতাড়ি ত্রিশাল পৌঁছাতে পারে , বাসে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে সে গান শুনতে লাগল , "পথের ক্লান্তি ভুলে ,স্নেহভরা কোলে মা গো বল কবে শীতল হবো , কতদূর আর কতদূর বল মা ? "

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাইনুল ইসলাম আলিফ গল্প ভাল লেগেছে।শুভ কামনা আর ভোট রইল।আসবেন আমার গল্প আর কবিতায়।
অসংখ্য ধন্যবাদ অাপনাকে মাইনুল ইসলাম আলিফ ৷ অবশ্যই অাসব অাপনার পাতায় ৷
এলিজা রহমান বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত দাদা ,আপনি অনেক অনেক ভাল লিখেন ৷অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর মন্তব্য করার জন্য ৷
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত গল্পের বিষয়বস্তু ভাল লেগেছে । অনেক শুভকামনা রইল ।
ফেরদৌস আলম বেশ ভালো লাগলো গল্পটা। মা তো মা'ই। তার তুলনা অন্য কিছুতে হয় না।
এলিজা রহমান অনেক অনেক ধন্যবাদ । আপনার জন্য শুভেচ্ছা মিলন বনিক দাদা ।
মিলন বনিক গল্পটা ভালো লাগলো..ত্রিশালে কবি নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর মনোমুগ্ধকর বর্ণনা সত্যিই ভালো লেগেছে.....
মিঠুন মণ্ডল ভাল হয়েছে...

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

পরিবারের প্রিয়জনদের সময় না দিয়ে আমরা পার্থিব দুনিয়ার জন্য সময় দেই । টাকা পয়সা উর্পাজন করাই সবকিছু নয় , পরিবারের মানুষের সঙ্গে সময় কাটান , সুখে দুঃখে তাদের পাশে থাকার কথাও সেটাও মনে রাখা দরকার ।

১১ অক্টোবর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ২৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪