নক্ষত্রের আলো

দাম্ভিক (জুলাই ২০১৮)

এলিজা রহমান
  • ৬৬
মাহফুজ আলম একজন কিডনির ডাক্তার । সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হওয়ায় তিনি সকাল দশটা থেকে দুটো পর্যন্ত রোগী দেখেন সপ্তাহে তিনদিন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১১টা বারটা বেজে যায় । তিনি দুটো থেকে চেম্বারে বসেন । একটা সেমিনার আছে আজকে তার বাংলাদেশের মানুষ কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছে এই বিষয়ের উপর ।তিনি মনে মনে হাসলেন , সবাই জানে যে বিদেশে ডাক্তার দেখানো তে দুটো লাভ বিদেশে ভ্রমনও করা হয় ডাক্তারও দেখান হয় । তারা দেশে ফিরে ওখানকার ডাক্তারদের ভাল ব্যবহারের খুব প্রশংসা করেন । কিন্তু দেশে ফিরে ওষুধ খেয়ে আর সেবা পেয়ে তারা যে সুস্হ হয়ে যান সেটা আর মনে রাখেন না । বাংলাদেশের ডাক্তারদের ভুল ট্রিটমেন্টের বিপরীতে ভারতীয় ডাক্তারদের ভাল ব্যবহারে রোগী ভিষন খুশি হন নিঃসন্দেহে ।
গাড়িতে যেতে যেতে মাহফুজ আলম ভাবছিলেন মনে মনে , যারা এমবিবিএস ডিগ্রি নেন তাদের মেডিকেল এথিকস পড়ান হয় । সেখানে বলা হয় , ডাক্তারদের স্হান রোগীর পায়ের কাছে , রোগীর প্রতি তুমি এ্যামপ্যাথি বা সহানুভুতি দেখাবে সিমপ্যাথি বা করুনা নয় । ডাক্তার আর রোগী নিয়ে অনেক জোকস আছে । একটা এখন মনে পড়ল , একজন ডাক্তার রোগীকে বিছানায় শুইয়ে অনেকক্ষন ধরে পা টিপে টিপে পরীক্ষা করছিলেন । রোগী মজা করে বললেন ," ডাক্তার সাহেব পা ধরছেন কেন ?' ডাক্তার ও রসিকতার সুরে বললেন ," ও একটু পরেই তো 'জবাই' করা শুরু করব তাই আগেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি ।' তার হাসির শব্দে ড্রাইভার বলল ,' স্যার কিছু বললেন ? '
' না , কিছু না । চল ।'
তিনি এখন যাচ্ছেন হাসপাতালের দিকে। গাড়িতে এসি ,হাসপাতালে এসি , নাহলে এতক্ষন জ্যামে বসে থাকতে কষ্ট হত । সকাল বেলায় রোদের উত্তাপ কম । এবার ঈদে সবাইকে নিয়ে ইউরোপ ট্যুর করবেন ঠিক করছেন । ছেলে এবার ও'লেভেল পরীক্ষা দিয়েছে , মেয়েটা পড়ে ক্লাস ফাইভে । তাঁর দুটো ফ্ল্যাট আছে এলিফ্যান্ট রোডে , আর একটা ডুপ্লেক্স কিনবেন পূর্বাচলে ।

মাহফুজ আলম হাসপাতালের একজন সিনিয়ার ডাক্তার । তাছাড়া রাজনৈতিক খুঁটির জোরে তিনি দাম্ভিকভাবে হাসপাতালে চলাফেরা করেন । তিনি এমন একজন প্রভাবশালী ডাক্তার যার কারনে তাঁর সহকর্মী ডাক্তার ,নার্স, রোগী এমনকি রোগীর আত্নীয় স্বজনরাও ভয় পায় তাঁকে ।

হাসপাতালের চেম্বারে ঢুকে তিনি রোস্টার দেখলেন, চা খেয়ে তারপর রোগী দেখা শুরু করেন । একবার এক রোগী ভিজিটের টাকা কম দেওয়াতে তিনি সেই রোগীর প্রেসক্রিপশন ছিড়ে ফেলেছিলেন , কিছু কিছু মানুষ ডাক্তারদের ভিজিটের ব্যাপারে এমন ভাব করে যেন তাঁকে দেখাতে এসে রোগীর টাকাটা জলে গেল । অথচ বিদেশে গেলে তো ওনারা সেই সব ডাক্তারদের ভিজিটের টাকা দিয়েই চিকিৎসা নেন ,সেখানে নিশ্চয়ই ওনাদের ফ্রিতে চিকিৎসা করা হয় না ।

একজন একজন করে রোগী দেখতে দেখতে একটা বেজে গেল । মাহফুজ আলম দুপুরের খাবার খেয়ে চেম্বারে যাবেন । তারপর যাবেন সেমিনারে ।

আজকে মাহফুজ আলম হাসপাতালে এসেছেন একজন সিরিয়াস রোগী দেখতে । হাসপাতালে পৌঁছে দেখলেন অনেক রোগীর ভিড় । বাংলাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে । প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সের রোগী ডায়ালাইসিস করার জন্য হাসপাতালে আসে ।বাংলাদেশে প্রায় দুকোটি মানুষ কোন না কোনভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত । মহিলারাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেক বেশি। হেলেডায়ালাইসিস , পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস এবং কিডনি সংযোজন হল কিডনি অকেজো রোগের চিকিৎসা । আর একটা চিকিৎসা হল সিএপিডি পদ্ধতিতে চিকিৎসা । এই পদ্ধতির ক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর পেটের মধ্যে ছিদ্র করে বাইরে থেকে একটা ব্যাগ যুক্ত করে দেন ,যা ফ্লুইডের মাধ্যমে রক্ত পরিশোধনের কাজ করে । পরে রোগী নিজের ঘরে থেকে শুধু ফ্লুইড দিয়েই এই চিকিৎসা চালিয়ে নিতে পারে । সিএপিডি বা কন্টিনিউয়াস এমবুলেটার পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস পদ্ধতিটা জনপ্রিয় করার জন্য মাহফুজ আলম এর মতন কয়েকজন চিকিৎসক চেষ্টা করে যাচ্ছেন । এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে এর ফ্লুইড যেটা তা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় এবং সরকারকে কর প্রদান করতে হয় ।সরকার যদি যে কর আছে তা তুলে দিতেন অথবা দেশেই এই ফ্লুইড উৎপাদনের ব্যবস্হা করে দিতেন তাহলে অনেক রোগী এই সিএপিডি সুবিধা নিতে পারত । অনেক চিকিৎসক বলছেন , একজন কিডনি অকেজো রোগী যন্ত্রের মাধ্যমে ডায়ালাইসিস করে যতদিন বাঁচেন সিএপিডি করে একই সময় বা তারও বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারেন ।
মাহফুজ আলম হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে রোগীর চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে বলতে হাসপাতালের রিসিপশনে দেখলেন গ্রাম্য চেহারার মাঝবয়সি একজন লোক স্ট্রেচারের উপর শুয়ে আছে অার তার পাশে ১৪-১৫ বছর বয়সের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে । মাহফুজ আলমকে দেখে ছেলেটি তাঁর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে । সবাই তটস্হ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় ,কারন সবাইর জানা আছে মাহফুজ আলম কেমন প্রকৃতির মানুষ । টাকা ছাড়া তিনি কোন রোগীর চিকিৎসা করেন না ।
ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে " আমার আব্বার কিডনি অকেজো হয়ে গেছে ডাক্তার সাহেব । আমার আব্বার চিকিৎসার জন্য আমাদের যা কিছু ছিল সব কিছু শেষ করে ফেলেছি । আমাদের আত্নীয় স্বজনরাও অনেক সাহায্য করেছে আমাদের । আমরা গরিব মানুষ । আব্বার চিকিৎসা করাতে না পারলে আমার আর পড়াশুনা করা হবে না । আমার আব্বার স্বপ্ন আমি যেন আপনার মত একজন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে পারি । আমার আব্বাকে বাচান স্যার । উপরে আল্লাহ আর নিচে আপনি। আপনি আমার আব্বার বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্হা করে দেন দয়া করে । আমার আব্বা স্বপ্ন দেখে আমাকে একজন ডাক্তার বানানোর ,সেই স্বপ্ন কি পূরন হবে না ? ' ছেলেটা আর কথা বলতে পারে না । ওর মা কান্নার স্বরে বলল ,' আমরা অনেক আশা নিয়ে ঢাকায় আপনার কাছে আসছি স্যার । আমার ছেলে মুরাদ ক্লাসে ফার্স্ট হয় , এইবার ক্লাস নাইন থেকে টেন এ উঠার পরীক্ষায় অংকে একশতে একশ আর বিজ্ঞানে নব্বই পাইছে । ওর স্কুলেত মাস্টার সাররা ওরে নিয়া অনেক আশা করেন যে স্কুলের নাম উজ্জ্বল করব , এখন ওর আব্বার চিকিৎসা না হইলে ওর তো আর লেহাপড়া হইব না , গার্মেন্টসে ঢুইকা পড়তে লাগব পেটের জন্য , ওর আব্বা সরকারি কলেজের দপ্তরির কাজ করে । সুস্হ না হইয়ে তো কাম করবার পারব না । তখন মুরাদ ছেলে হয়ে সংসার দেখব না পড়াশুনা করব ? ও তো তাইলে আর ডাক্তার হইতে পারতো না ? ওর আব্বার স্বপ্ন পূরন করতে পারব না আর ।'' মুরাদের মা কোলের ছোট মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কানতে লাগল।
মুরাদের আব্বাও চোখে পানি নিয়ে অসহায়ভাবে চেয়ে রইল ডাক্তার মাহফুজ আলমের দিকে ।

হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স , স্টাফরা একটা অপ্রীতিকর পরিস্হিতির জন্য তৈরি হচ্ছিল । কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাহফুজ আলম বললেন ,' মুরাদ তোমার আব্বার চিকিৎসা এই হাসপাতালেই হবে এবং একদম ফ্রিতে ।'
এইকথা শুনে অন্য একজন ডাক্তার বললেন ,'কিন্তু স্যার আমাদের হাসপাতালে তো ফ্রিতে চিকিৎসা হয় না , করার নিয়ম নেই ।'
ডাক্তার মাহফুজ তাকে ধমক দিয়ে বললেন ,'এতদিন ছিল না বলে কি কোনদিন সেটা করা যাবে না ? আজ থেকে হবে এবং তাড়াতাড়ি রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্হা করেন ,যান ।'
সবাই অবাক হয়ে গেল ডাক্তার মাহফুজ এর দাম্ভিক আচরনের পরিবর্তন দেখে । হাসপাতালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ডাক্তার এর কড়া নির্দেশে হাসপাতালে মুরাদের আব্বার চিকিৎসার কোন ত্রুটি হল না ।
বিনা চিকিৎসায় কোন রোগীকে যেন না রাখা হয় এই নিয়ম চালু করলেন ডাক্তার মাহফুজ আলম ।
তিনি জানেন , অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় তিনি আর তাঁর ভাই মামা বাড়িতে আশ্রিত থেকে লেখাপড়া করেছেন। টিউশনি আর স্কলারশিপের টাকা আর মায়ের ব্যাংকের চাকরি দিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে । ছোটবেলায় কস্ট করেছেন বলেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মুরাদের কি হবে ভবিষ্যত । তাই ওর আব্বার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্হা করেন ।
১৫দিন পর । মুরাদরা ফিরে যাচ্ছে টাঙ্গাইল ।
মাহফুজ আলম বললেন ,' মুরাদ তুমি ভাল করে লেখাপড়া করবে । আমি চাই তুমি ডাক্তার হও ।তোমার পড়াশুনার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় হলে আমার কাছে আসবে । ' আর রোগীকে বললেন ,'আপনি আমিষ আর চর্বিযুক্ত খাবার কম খাবেন । মাংস খাবেন ,কিন্তু চর্বি একদম না । শরীরে যেন পানি না জমে সেজন্য খাবারের পরিমান নিয়ন্ত্রনে রাখার চেষ্টা করবেন । আর বাজারের থেকে কেনা কোন ধরনের পানীয় একবারেই খাবেন না । ডায়ালাইসিসের সময় কিছু রক্ত আর আমিষ চলে যায় । তাই সেসময় আপনি একটু বেশি পরিমানে মাছ , মাংস , ডিম , দুধ খাবেন ,এটা মনে রাখবেন দয়া করে । আপনার উপর কিন্তু আপনার ছেলের ভবিষ্যত নির্ভর করছে ।' হেসে বললেন মাহফুজ আলম ।

ঈদে সবাইকে নিয়ে ইউরোপ ট্যুর করবেন ভেবেছিলেন মাহফুজ আলম । মুরাদদের সাহায্য করতে গিয়ে সেটা আর করতে পারলেন । তাঁর ছেলেমেয়েরা মন খারাপ করেছে ঠিকই কিন্তু অন্য একটি ছেলের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তাই বা কম কি ? ডাক্তার মাহফুজ আলম মনে মনে ভাবলেন , অন্যের উপকার করলে যে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায় তা একটা সফল অপরেশন করার চেয়ে কোন অংশে কম না ।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এলিজা রহমান আমি জানি যে আমি ভাল লিখি না । যারা কষ্ট করে আমার লেখা পড়েছেন তাদের সবাইকে আমার অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা ।
এলিজা রহমান কৃতজ্ঞতা জানাই । অাপনার জন্য শুভেচ্ছা রইল ।
ফেরদৌস আলম ভালো লিখেছেন। সামনে আরও ভাল লিখেনন সে আশা করি।
নাঈম রেজা ভাল লিখেছেন
এলিজা রহমান thanks a lot , apner comments er jonno , apner likha golpo ta khub valo hoyche , shuveccha roilo .
নুরুন নাহার লিলিয়ান ডাক্তার মাহফুজ আলম মনে মনে ভাবলেন , অন্যের উপকার করলে যে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায় তা একটা সফল অপরেশন করার চেয়ে কোন অংশে কম না ....ভাল লিখেছেন ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মাহফুজ আলম শুধু একজন ভাল ডাক্তার ছিলেন , পরে তিনি বুঝলেন ভাল ডাক্তার হলেই শুধু হয় না একজন ভাল মানুষও হওয়া প্রয়োজন । চিকিৎসা একটা মহান পেশা , মানুষই এই পেশাকে মহান করে এবং কলংকিত করে ।

১১ অক্টোবর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ২৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী