রাজীব হাসান শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার একটি গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অংকের শিক্ষক ।
অবশ্য তাকে দেখলে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক মনে হয় না , বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা , মাঝারি গঠন , সবার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলেন । সবাইকে সাহায্য করেন সাধ্যমত, নিঃঅহংকার ভালো মানুষ এই রাজীব হাসান স্যার , তিনি স্কুলের ছাত্র শিক্ষক সবাই প্রিয় । বিয়ে করেন নি এখনো , বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে পারবেন কিনা এটা স্কুলের সবার মনে প্রশ্ন , কিন্তু কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করে না রাজীব হাসানকে ভদ্রতার খাতিরে ।
এ অন্ঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজ করে। এজন্য এরা সহজ সরল। শরীয়তপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বহ্মপুত্র নদী আর আছে পদ্মার শাখানদী। এখানে বুড়ির হাট মসজিদটি ইসলামী স্হাপত্যকলার নিদর্শন এর জন্যে বিখ্যাত । আর আছে মহিষারের দীঘি । চাঁদ রায় , কেদার রায় নামের জমিদার ভাইয়েরা এখানে কয়েকটা দীঘি খনন করেন পানীয় জলের জন্যে । জ্যোত্স্না রাতে অনেক সুন্দর লাগে এই দীঘির চারপাশ। এখানকার মানুষের উপরে ধর্মের অনেক প্রভাব । কি হিন্দু কি মুসলমান সব ধর্মের মানুষই তাদের ধর্মের অনুশাসন মেনে চলে । আবার বাংলা নববর্ষ পালন করে সবাইকে নিয়ে , হিন্দু -মুসলমান একসঙ্গে ।
রাজীব হাসানের খাওয়া দাওয়া নিয়ে তেমন একটা বায়না নেই। তাদের পৈত্রিক একটা বাড়ি আছে সেখানেই থাকেন । এই বাড়ি না থাকলে চাকরি করা একটু মুশকিল হত, তাদের বাড়িতে আছেন জলিল চাচা আর চাচী। চাচার বয়স বেশি হলে পঞ্চাশ ষাট হবে , চাচীর একটু কম হবে হয়তো , রাজীব হাসান এই দুজনের উপরে নির্ভরশীল , বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম এনারা সামলে নেন। রাজীবের বাবাই ওনাদের জন্য এই ব্যবস্থা করে গেছেন ,যাতে উনি মারা যাবার পর এই নিঃসন্তান দম্পতির থাকার কোনো কষ্ট না হয়।
সকালে গোসল করে খেয়ে বের হয়ে যান, দুপুরের খাবার জলিল চাচা সাইকেলে করে নিয়ে আসেন স্কুলে । বিকেলে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার সময় বাড়িতে এসে একটু চা খেয়ে ছেলেদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে যান। কোন কোন দিন ব্যাডমিন্টন ও খেলা হয়। এই খোলা মাঠে খেলা ঢাকার ছেলে মেয়েরা পায় না, এমন শান্ত পরিবেশ , পরিষ্কার বাতাসও ঢাকায় নেই । রাজীব হাসান এর মাঝে মধ্যে মনে হয় ঢাকার বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণও কম। শরীয়তপুরে দিনরাত খারাপ কাটছে না তার । বাসায় ফিরে খাওয়ার পর স্কুলের খাতা দেখে রাখতে রাখতে দশটা বেজে যায় ,তারপর টিভিতে খবর দেখেন রাতেই ঠিক করে রাখেন পরের দিনের পাঠ্য সুচী। অংক প্রতিদিন করাতে হয় , তার একটানা ক্লাস থাকে দুটো পর্যন্ত । তাকে চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেনীর অংক করাতে হয়। আবার কোচিং করাতে হয় ক্লাস এইটের ছাত্র ছাত্রীদের সপ্তাহের তিন দিন ।
শুক্রবার একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠেন তিনি । চা খান । জলিল চাচা বাজারের থেকে কি কি আনতে হবে এইসব জিজ্ঞেস করেন , কি খেতে চান এটা ও জানাতে হয় , সকালে নাস্তা খেয়ে আবার চা খাচ্ছেন , এমন সময় জলিল চাচা এসে বলেন , 'ভাইয়া , একটা পোলা আইছে , আপনারে কি যেন কইতে চায় । '
' কে আসছে ? নিয়ে আসেন ?'
জলিল চাচা একটা ছেলে কে ঘরের ভিতরে আসতে বলল, একটা ১০ -১১ বছরের ছেলেটা , চোখে মুখে কান্না আর ভয়ের চিহ্ন ।
রাজীব হাসান জিজ্ঞেস করলেন , ' তুমি ক্লাস ফোর এর সৌরভ না ? কি সমস্যা বলতো ?'
সৌরভ রাজীবকে বলল , 'স্যার , তাসরিফ আমার বন্ধু স্যার , ও মোবাইল চুরি করে নাই স্যার '
' মোবাইল চুরি ? আমার ছাত্র কেন মোবাইল চুরি করতে যাবে ?' রাজীব হাসান অবাক হয়েছেন এই কথা কিভাবে কেউ বিশ্বাস করবে ।
' জী স্যার , আজকে সকাল বেলায় তাসরিফকে ওর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে সাঈদ তালুকদারের লোকরা । ' সৌরভ বলা শুরু করল একটু থেমে , ' ওই ব্যাডা দুবাই না কই জানি থাহে , কয়দিন আগে আসছে গ্রামে বেড়াইতে ।'
' মোবাইল চুরির ঘটনা ঘটেছে কবে ' রাজীব হাসান জানতে চাইলেন ।
' গত সপ্তাহে , আমি আর তাসরিফ স্কুল ছুটির পরে সাঈদ তালুকদারের ভাই এর ছেলে জাহিদ এর লগে খেলতে গেছিলাম, সন্ধ্যার সময় চইলা আসছি । ওরা তাসরিফরে গাছের লগে বাইন্ধা পিটাইতাছে , ও মইরা যাইবো , আপনি আমার সঙ্গে সাঈদ তালুকদারের বাড়িতে চলেন । '
রাজীব হাসান সাঈদ তালুকদারের বাড়িতে গিয়ে দেখলেন , তাসরিফকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারা হচ্ছে কিন্তু সাঈদ তালুকদারের কাজের কেউ প্রতিবাদ করছে না , সে এই এলাকার একজন মার্কা মারা লোক এই কারণে সবাই তাকে ভয়
পায়। তাসরিফের ছোট্ট শরীর রক্তাক্ত হয়ে আছে । রাজীব তার বাধন খুলে মাটিতে শুইয়ে দিলেন । তাকে দেখে তাসরিফ কান্না জড়িত কন্ঠে বলল , ' স্যার আয়না পড়ায় আমার ছবি দেখা গেছে বলে আমাকে ধরে এনে গরুর রশি দিয়ে বাইন্ধা রাখে । আমি চুরি করি নাই, আমি চোর না বার বার কইছি , তারপর ও তারা আমারে পিটাইছে। '
তাসরিফের মা নুরজাহান বেগম বললেন , ' মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমার ছেলেডারে ওরা এমন কইরা মারল , আমরা গরীব বইলা আমাগর পাশে কেউ দাড়ায় নাই । এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়া আমার স্বামী ও বড় পোলাডাও মাইর খাইছে । '
স্হানীয় একজন মেম্বার এসেছেন ঘটনা শুনে । তিনি রাজীব হাসানকে বললেন , ' বাড়ি থেকে একটা আই ফোন চুরি হয়েছে বলে সঈদ তালুকদার তিনি অভিযোগ করেছেন । এই কারণেই ঔ শিশুসহ তার বাবা আর বড় ভাইকে বেঁধে রাখা হয়েছে । আয়না পড়ায় তার নাম উঠেছে বলেই আমরা দরবার করে ১৫০০০ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দিয়েছি । '
রাজীব হাসান বললেন , ' সাঈদ তালুকদার সাহেব , আপনি কিভাবে বুঝলেন যে তাসরিফই আপনার মোবাইল ফোন টা চুরি করেছে ?'
সাঈদ তালুকদার বললেন , ' আরে এইটা এমনকি , মোবাইল ফোন টা সবখানে খুঁজছি , সসবাইকে জিজ্ঞাসা করছি .. তারপর আটদিন পর আমার এক আত্মীয় বলল যে , আয়না পড়া দিয়ে হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়., তাই আমরা একটা আয়না কিনে এনে মজিদ ফকিরের কাছ দেই আয়নাটা পড়ানোর জন্যে , আয়নাটা পড়ায় নিয়ে আসা হয় । আয়নার মধ্যে আমরা দেখলাম ও চুরি করেছে । তাই ওর পরিবারের সবাইকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটান হয়েছে । '
রাজীব হাসান এবারে বললেন , ' আপনারা তাসরিফকে দেখতে পেয়েছেন আয়না পড়ায় এটা কি বিশ্বাস যোগ্য ? এই ছোট্ট বাচ্চার পক্ষে কি সম্ভব আপনার বাড়িতে ঢুকে আপনি কোথায় আপনার মোবাইল রেখেছেন সেটা জেনে তারপর ফোন টা চুরি করা ? সে আপনার ঘরে ঢুকে ফোন নিলো আবার নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো আর আপনার বাড়ির কোন লোক তাকে ধরল না ? তাকে বেরিয়ে যেতে দিল ?'
সাঈদ তালুকদার এর উত্তরে কিছুই বললেন না । তাকে নিরত্তর দেখে রাজীব হাসান আবারও বললেন , ' কি হল উত্তর দিন , সে কি তাহলে অদৃশ্য অবস্হায় চুরি করতে এসেছিল যে আপনারা কেউ ই তাকে মোবাইল নেবার সময় ধরতে পারলেন না । এখন আয়না পড়ার সাহায্য নিয়ে তাকে ধরতে হচ্ছে । '
রাজীব হাসান সবার দিকে তাকিয়ে বললেন , 'আমি তাসরিফকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাচ্ছি । আর আপনাদের সবাইকে বলছি , ' আয়না পড়া , চাল পড়া ইত্যাদি পদ্ধতিতে চোর ধরার চেষ্টা না বিজ্ঞান সম্মত না ইসলাম সমর্থিত। বরং এর মাধ্যমে যদি কাউকে চোর সাব্যস্ত করা হয় , তাহলে এটা হবে বিনা প্রমাণে কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া । যা একটি শাস্তি যোগ্য অপরাধ । '
যনড়িয়া থানার তদন্ত কারী অফিসার বললেন , ' এ প্রক্রিয়ায় চোর ধরার কোন সুযোগ নেই । তাছাড়া কেউ যদি এধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে , তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে । '