করোনা

অসহায়ত্ব (মে ২০২০)

এস জামান হুসাইন
  • ৬৫

২০২০ সাল।

অসহায় পৃথিবী থরে থরে সাজানো লাশ গুনছে । প্রতি মূহুর্তে কোন না কোন বনি আদম এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে । সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী লক্ষাধিক অসহায় মৃত্যু । বেসরকারি রিপোর্ট সরকারি রিপোর্টের দশগুণ হবে । প্রতি মুহুর্তে লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে । ভয়ে লাশ গুলোর সৎকারও হচ্ছে না সঠিক ভাবে । হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে ফিরছে রোগী । হাসপাতালে রোগী ভর্তি নিচ্ছে না । ডাক্তাররা পিপিই না পাওয়ার অভিযোগে মৃত্যু আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন । মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন লাশ রেখে পালিয়ে যাচ্ছে । বিনা যুদ্ধে, বিনা নোটিশে পুরো পৃথিবী আজ গৃহবন্দি ।

কোভিড ১৯ বা করোনা ভাইরাস । আতঙ্কের নাম । ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান প্রদেশে প্রথম এই মরণঘাতী ভাইরাসের দেখা মেলে । ধীরে ধীরে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পরে এই ভাইরাস । কোন বর্ডার মানে না; লাগে না কোন পাসপোর্ট । ধনী দেশ; গরীব দেশ এই ভাইরাসের কাছে সমান । ভয় করে না কারও চোখ রাঙানি; কোন এটম বোমা বা পারমাণবিক অস্ত্র ।

রোজভেল্ট । দুনিয়া কাঁপানো সবচেয়ে বড় আমেরিকান রণতরী । দাপিয়ে বেড়িয়েছে সাগর - মহাসাগর, কাঁপিয়েছে সারা বিশ্ব । প্রায় চার হাজার সৈনিক - সেনাপতি থাকতে পারে । এর উপরিভাগ ছোট খাটো একটা বিমানবন্দর। এখান থেকেই ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিমান উড্ডয়ন করেছে । হত্যা করেছে লক্ষ লক্ষ বনী আদম। আজ এই রণতরী সাগরেই ভাসছে । কিনারায় আসতে পারছে । কারণ করোনা । পৃথিবীর কোন শক্তিই তাদের কাবু করার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু প্রকৃতির অস্ত্র করোনার কাছে এই রণতরী অসহায় । তাদের কপালে চিকিৎসা ও নেই!

করোনা বিস্তার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা হল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ; মিনিমাম তিন ফুট দূরত্ব । কাঁচের দেয়ালের এ পাশে স্বামী, ও পাশে স্ত্রী । কত কাছাকাছি! স্বামী তার স্ত্রীকে স্পর্শ করতে পারছে না! কারণ স্ত্রী করোনায় আক্রান্ত । কি ভয়ানক দৃশ্য! কি অসহায় অবস্থা! আমি আমার একমাত্র তিন বছর বয়সী ছেলে রাইয়ানকে নিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারি না । অবুঝ! অফিস থেকে রুমে ঢোকার সাথে সাথে বাবা বলে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরবে । ওকে বুঝাই,
বাবা! বাইরে অসুখ তুমি আমাকে এখন জড়িয়ে ধর না ।
ও আমার কথায় মন খারাপ করে মাথা নিচু করে কেঁদে কেঁদে বলে,
আমি তোমার সাথে কথাই বলবো না। তুমি আমাকে ধরতেই দিচ্ছ না ।
আমি হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ভালোভাবে হাত ঘষে ওর হাত ধরে বলি,
বাবা! তুমি শুধু আমার হাত ধরবে । আর জামা কাপড় পাল্টানোর পর আমাকে ধরবে ।
ঠিক আছে, বাবা! আমি শুধু তোমার হাত ধরব, বাবা ।

দেশব্যাপী চলছে লকড ডাউন বা সঙ্গনিরোধ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান এবং ওষুধের দোকান ছাড়া সবকিছুই বন্ধ । সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে । সাধারণ মানুষ সাধারণ ছুটিকে ঈদের ছুটি বা আনন্দের ছুটি মনে করছে; মানছে না লকড ডাউন । পুলিশ এবং আর্মি মাঝে মাঝে জনাকীর্ণ এলাকায় ক্রিকেট খেলছে । প্রশাসন করছে ব্যাটিং জনগণ ফিল্ডিং । শুধু চার ছক্কা; নো রান আউট; নো এক দুই রান। মুহুর্তের মধ্যে হাট - বাজার ফাঁকা । বাইরে পুলিশ আর ঘরে হোম কোয়ারেন্টাইন। পুলিশ অনেককেই ধরে নিয়ে গেছে । আমার অফিস থেকে ফিরে আসতে দেরী হওয়ায় পাশের বাসার ভাবি মজা করে আমার ছেলেকে বলছে,
রাইয়ান ! তোমার বাবাকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে ।
আমার ছেলে একথা শুনে খুবই কান্না করে ওর মাকে বলছে,
আম্মু ! বাবাকে ফোন দাও । আন্টি বলছে বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে । আমি এখন কি করব?
ওর আম্মু আমাকে ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলে তারপর ও শান্ত হয় । আমি অফিস শেষ করে নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার করে বাসায় ফিরি । বাসায় ঢোকার সাথে সাথে হ্যান্ড সেনিটাইজার হাত পরিষ্কার করে নেই এবং ডেটল দিয়ে বানানো জীবাণু নাশক স্প্রে দিয়ে সারা শরীর স্প্রে করে নেই । আমার ছেলে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে,
বাবা! বাবা! আন্টি বলছে, " তোমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে " আমি এখন কি করব, বাবা!
আমি ওকে শান্তনা দিয়ে বলি,
না বাবা! আমি অফিসে ছিলাম । তোমার আন্টি তো তোমার সাথে মজা করেছে ।
না, না ! আন্টি পঁচা কথা বলেছে।

অফিস বন্ধ থাকায় বেশ কয়েক দিন থেকে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছি । বাপের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ থাকলেও করোনার কারণে যাওয়া হয় নি। সারাদিন বাসায় থাকি। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য বাজারে যাই । বাজার শেষ করে দ্রুত বাসায় ফিরি । চুল অনেক বড় হয়েছে, অনেক দিন ধরে কাটানো হয় না। বের হলাম চুল কাটানোর জন্য । ব্লেড নিয়ে এসেছি । নরসুন্দরের দেখা না হলে ন্যাড়া হব বাসাতেই। বাজারের ভিতর গলিতে ঢুকলাম । নরসুন্দরের দোকানের শাটার অর্ধেক খোলা । আমি বললাম,
ভাই! চুল ছাঁটানো যাব?
হ্যাঁ সূচক সম্মতি জ্ঞাপন করে বলল,
বসেন।
এরপর দোকানের শাটার বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ চুল কেটে দিল । আমিও চুপচাপ বাসায় চলে এলাম ।

বাসায় আমার সদস্য তিন জন মাত্র । আমরা স্বামী- স্ত্রী আর একমাত্র ছেলে । স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন । ছেলেকে দূরে সরে থাকতে বললে সে বলে,
আমি তোমার পাশেই থাকব।
কেন?
তুমি যে আমাকে অনেক চুমু দাও । বাজারে নিয়ে যাও। আমাকে অনেক ভালবাসো । চুল কাটাতে নিয়ে যাও। আমার সাথে খেলো।
ও আমার কাছে এসে চুমু খেয়ে বলে,
বাবা! তুমি অনেক ভাল, তাই না? বাবা ।
শুনো, বাবা! এখন বাইরে অসুখ । করোনা ভাইরাস । এখন চুমু খেতে হয় না। এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে উম্মা---- বলে চুমু খেতে হয় ।
ও অভিমান করে দূরে গিয়ে মাথা নিচু করে কেঁদে কেঁদে বলে,
তুমি শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে চুমু খেতে বলো। আমি তোমার সাথে কথাই বলবো না, বন্ধুত্ব রাখব না ।
বাসায় ছোট বাচ্চা ও একাই। তাই ওর বন্ধু বলতে আমি আর ওর মা।

সারাদিন বাসায় বসে বোরিং লাগছে । বিকেল বেলা ছেলেকে নিয়ে ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে সময় কাটাই। রাস্তার পাশেই বাসা । রাস্তায় চলছে ভ্যান, অটো রিকশা আর বিভিন্ন ধরনের মানুষ । কারও মুখে মাস্ক আছে, কারও মুখে মাস্ক নাই। সাধারণ মানুষের কাছে করোনা বড়ই অসহায় । আর জীবন জীবিকার কাছে সাধারণ মানুষ অসহায় ।

হোম কোয়ারেন্টাইনের একটা সময় কাটে ফেসবুকে । ছেলে থাকে পাশেই। অনাহারীর ছবি দেখে ছেলের প্রশ্ন,
বাবা! কি হয়েছে ওর?
বাবা! বাইরে অসুখ । করোনা ভাইরাস । খেতে পারছে না ।
ওরা খায় না কেন?
ওদের খাবার নেই, তাই ওরা খায় না ।
ওদের খাবার নেই কেন?
করোনা ভাইরাসের জন্য সব কিছু বন্ধ । কাজ নেই । তাই ওরা খাবার কিনতে পাচ্ছে না, খেতেও পাচ্ছে না ।
তুমি একটা নিমুট (রিমোট) কিনে আনবে । আমি নিমুট দিয়ে করোনা ভাইরাস ভেঙ্গে ফেলব। তাহলে আর কেউ মারা যাবে না; রক্ত বের হবে না ।
ঠিক আছে, বাবা ।
বিভিন্ন জায়গায় লাশ পরে আছে । মাটিতে পরে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শুয়ে কাতরাচ্ছে অনেকেই। করোনা সন্দেহে মানুষ ভয়ে কাছে যাচ্ছে না । ছেলে আবার জিজ্ঞাসা করে,
ওর কি হয়েছে, বাবা?
ও মারা গেছে, বাবা । করোনা ভাইরাসে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে ।
অসহায়ের মত তার করুণ প্রশ্ন,
তাহলে তুমিও কি মারা যাবে, বাবা?
এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার জানা আছে অথবা জানা নেই! তার অসহায়, অবুঝ মনকে শান্তনা দিয়ে বললাম,
না, বাবা! আমরা মারা যাব না!,,,,,,,,,,

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী মনোমুগ্ধকর লিখনী, ভালো লাগলো। সবাইকে নিয়ে এই মহামারীতে সাবধানে থাকবেন ও ভালো থাকবেন। শুভকামনা প্রিয়।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ক্ষুদ্র করোনা ভাইরাসের কাছে দুনিয়ার সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র, সকল ক্ষমতা অসহায় । বিষয়ের সাথে মিল রেখে আমার এই গল্প ।

০৭ অক্টোবর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৭৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪