১
-মামা আর দিয়েন না, মরে যাব । মামা আর দিয়েন না, মরে যাব ।
এভাবেই চিৎকার করছিল ১২ বছরের এক শিশু । তার চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসছিল । শিশুটির চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসলেও মন গলেনি মোটরসাইকেল গ্যারেজের মালিক শরীফ এবং কর্মচারী মিন্টু আর অদূরে দাড়িয়ে তামাশা দেখা বিউটির ।
শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হওয়া স্বত্বেও শিশুরা বিভিন্ন সময় শিশু শ্রমে বাধ্য এবং বেশিরভাগ সময় তারা নির্যাতিত । এই পৃথিবী শিশুর জন্য নিরাপদ নয় । কোথাও না । এমনকি মসজিদ ও নয় । মসজিদে ছোটদের কোলাহলের অভিযোগ তুলে বড়রাই বেশি কোলাহল করে । স্নেহ করার পরিবর্তে ধমকায় । অথচ নবী মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, " সে আমাদের দলভূক্ত নয়, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না । " নবী মোহাম্মদ ( সঃ ) নামাজ পরতেন আর তাঁর নাতি হাসান ও হোসাইন তাঁর পিঠে চড়ে খেলতেন । তবুও তিনি তাদের প্রতি কখনো রাগ করেন নি ।
শিশুটির নাম ছোট । এটি তার আসল নাম নয় । ছদ্ম নাম । আসল নামের প্রয়োজন নেই । পৃথিবীর কেউ কোন প্রশ্ন করবে না । অভিযোগ ও করবে না । প্রকৃতি ও না । তার একটি নাম দেওয়া দরকার । তাই তার নাম দিলাম ছোট । এটাই তার উপযুক্ত নাম । কেননা সে সবসময় ছোট ছিল । সে বড় হতে পারে নি । বড় হওয়ার অধিকার তার ছিল না । এই সমাজ, এই পৃথিবী তাকে বড় হতে দেয় নি । ছোট তাই কোনোদিন অভিযোগ ও করে নি ।
ছোট যে গ্রামে বাস করত তার নাম রসুলপুর । পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট এক নদী । ছোট যেমন ছিল শান্ত, ভদ্র তেমন ছিল দুরন্ত । পড়ালেখা, খেলাধুলা, দৌড়ঝাপ সব মিলিয়ে তার জীবন চলছিল ভালই । কিন্তু তার এই ভাল তার ছোট জীবনে সইলো না ।
জাহিদ তার সহপাঠী এবং ভাল বন্ধু । তারা দুজনেই চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে । দুজনেই ভাল ছাত্র । জাহিদদের আর্থিক অবস্থা খুব ভাল কিন্তু ছোট'র আর্থিক অবস্থা ভাল নয় । বাবা দিনমজুর । দিন আনে দিন খায় । ছোট 'র প্রায় স্কুল যাওয়া হয়না । জাহিদ বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে ছোটকে ডাকে,
- ছোট, স্কুলে যাবি না?
ছোট কাঁদো কাঁদো স্বরে জবাব দেয়,
- না রে, আজ স্কুলে যাব না ।
- কেন? কি হয়েছে?
ছোট কোনো জবাব দেয়না । নিরবে চোখের পানি ফেলতে থাকে আর চিন্তা করে এভাবে আর কতদিন চলবে?
ওর মা লাকি বেগম জবাব দেয়,
- ও আজ স্কুলে যাবে না । কলম শেষ হয়েছে । কলম কেনার টাকা নেই । ঘরে কোনো চাউল নেই । আজ কোনো রান্না হয়নি । সকাল থেকে কিচ্ছু খায় নি ।
জাহিদ ছোট ' র হাত ধরে বলে,
- চল আমাদের বাসায় । আজ আমাদের বাসায় খাবি । আমার কলম তোকে দিব । সেটা দিয়ে লিখবি ।
- না যাব না ।
জাহিদ তাকে জোর করে ওর বাসায় নিয়ে যায় । সেখানে খাওয়া করে দুজনে স্কুলে যায় । স্কুল থেকে ফিরে ছোট তার মাকে বলে,
- মা, ভাত দাও ।
- স্কুল ড্রেস খুলে আয় । আমি ভাত বাড়ছি ।
তার মা মাছ দিয়ে ভাত দেয় । ছোট ভাত খায় আর বলে,
- মা আমরা কখন ধনী হব? কখন আমাদের ঘর থেকে অভাব চলে যাবে?
- অভাব চলে যাবে, বাবা । তুই ভাল করে লেখাপড়া কর । বড় হয়ে তুই চাকরি করবি । তখন আমাদের আর অভাব থাকবে না ।
- মা আমরা গরীব কেন?
- কে বলল আমরা গরীব? গরীব হল তারা যাদের হাত নেই, পা নেই, বোবা, অন্ধ, প্রতিবন্ধী । আমাদেরতো হাত, পা, নাক, কান সবই আছে ।
ছোট আর কথা বাড়ায় না । চুপচাপ ভাত খায় ।
২
ছোট 'র বাবা নুর আলম একজন দিনমজুর । দিন আনে দিন খায় । যেদিন কাজ থাকে না সেদিন অনেক কষ্টে তাদের জীবন চলে । চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছোট সংসারের হাল নিজের কাঁধে তুলে নেয় । কাজের জন্য সে পার্শ্ববর্তী জেলা শহরে আসে । কাজ নেয় একটি মটরসাইকেল গ্যারেজে ।
গ্যারেজের মালিক শরীফ খুবই রাগী এবং বদমেজাজী । সবসময় সে কর্মচারীদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করে, নির্যাতন করে, মারধর করে এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে ।
গ্যারেজের মালিক শরীফ দুপুর বেলা গ্যারেজে এসে দেখে ছোট নাই । রাগে শরীফের রক্ত মাথায় উঠে । সে চিৎকার করে ডাকে,
- ছোট, ছোট, কোথায় গেলি?
ছোট দৌড়ে এসে জবাব দেয়,
- আসছি মামা । ছোট গ্যারেজের মালিক শরীফকে মামা বলে ডাকে ।
শরীফ আরও রেগে যায় । জিজ্ঞাসা করে,
- কোথায় গিয়েছিলি?
- প্রসাব করতে ।
- প্রসাব করতে এত সময় লাগে? একথা বলেই ছোট 'র গালে ঠাশ করে চড় বসিয়ে দেয় আর অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে । এটা নতুন কিছু নয় । এটা তার অভ্যাস । যখন তখন সে কর্মচারীদের গায়ে হাত তুলে এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে ।
ছোট ' র এসব সহ্য হয়না । সে ছোট তাই কিছু করতে পারেনা । সে গরীবের ছেলে তাই সে নিরবে চোখের পানি ফেলে । তার মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন । কবে সে বড় লোক হবে? কবে অভাব দূর হবে? তার প্রশ্নের কোন উত্তর নেই । শরীফ আবার ধমকায় । ছোট দাড়িয়ে না থেকে নিজের কাজে যায় ।
৩
আর কত নির্যাতন সহ্য করবে ছোট? তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় অন্য গ্যারেজে কাজ নিবে । যেই কথা সেই কাজ । সে অন্য একটি গ্যারেজে কাজ নেয় । সে আর শরীফের গ্যারেজে কাজ করতে আসে না । শরীফ তার অন্য কর্মচারী মিন্টুকে জিজ্ঞাসা করে,
- মিন্টু, ছোট কাজে আসে না কেন?
- ছোট তো অন্য গ্যারেজে কাজ নিয়েছে ।
- কি? অন্য গ্যারেজে কাজ নিয়েছে? শরীফের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরে । সে রাগে কড়মড় করতে করতে বলে, ওর আগে দেখা পাই । তারপর মজা দেখাব । আমার এখানে ভাল লাগে না, সে অন্য গ্যােরজে কাজ নিয়েছে আমাকে না বলেই । আগে ওর দেখা পাই, তারপর মজা দেখাব ।
ছোট যে গ্যারেজে কাজ নিয়েছিল সেই গ্যারেজের মালিক খুবই ভাল । সে শরীফের মত কর্মচারীদের মারধর করেনা, অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেনা । এখনে ছোট ' র দিন ভালই চলছিল । কিন্তু তার এই ভাল থাকা সহ্য হল না শরীফের । একদিন সকালে ছোট সাইকেল চালিয়ে শরীফের গ্যারেজের সামনে দিয়ে কাজে যাচ্ছিল । শরীফ দেখে ফেলে । আর যায় কোথায়?
- ঐ ছোট, দাড়া । শরীফ তাকে ডাকে।
ছোট পিছনে তাকিয়ে দেখে শরীফ । ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে যায় ।
- দাড়া বলছি, দাড়া ।
শরীফ আর তার কর্মচারী মিন্টু দুজনে মিলে ছোটকে ধরে আনে তার গ্যারেজে । শরীফ জিজ্ঞাসা করে,
- তুই আমাকে না বলে অন্য গ্যারেজে কাজ নিলি ক্যান?
ছোট কথা বলে না, ভয়ে চুপসে গেছে । সে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে ।
- এবার মজা দেখাচ্ছি । একথা বলে ছোটকে বিবস্ত্র করে । মিন্টু তাকে জাপটে ধরে এবং শরীফ মোটরসাইকেলের হাওয়া দেওয়া কম্প্রেসারের নল ছোট ' র পায়ু পথে ঢুকিয়ে বাতাস দিতে থাকে । আর ছোট চিৎকার করে বলে,
- মামা আর দিয়েন না, মরে যাব । মামা আর দিয়েন না, মরে যাব ।
- অন্য গ্যারেজে কাজ নেওয়ার মজা বুঝ ।
- মামা আর দিয়েন না, মরে যাব । ছোট চিৎকার করতেই থাকে । তবুও শরীফের মন গলে না। মিন্টুর কানে এই চিৎকার পৌঁছে না । শরীফের মা বিউটি বেগম দূর থেকে দাড়িয়ে সার্কাস দেখে আর হাসে । কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না । এভাবেই চলে কিছুক্ষণ । এরপর ছোট নেতিয়ে পরে । তার শরীরে অতিরিক্ত বাতাস প্রবেশের কারণে নাড়ী ভূড়ি ছিড়ে যায় । মুখ ও সারা দেহ ফুলে যায় ।
এরপর অবস্থা বেগতিক দেখে শরীফ বাতাস দেওয়া বন্ধ করে । সে ছোট ' র পেট থেকে অতিরিক্ত বাতাস বের করার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয় । সাথে সাথে ছোটকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয় । সেখান থেকে তাকে ফেরত দেওয়া হলে তাকে ভর্তি করানো হয় জেলা সদর হাসপাতালে । ছোট ' র এক বন্ধু তার বাড়িতে খবর দেয় । খবর পেয়ে তার মা লাকী বেগম ছুটে আসে হাসপাতালে তার কাছে । তার অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
- বাবা, কি হয়েছে তোর?
- মা আমি বাঁচব না, মা । আমি মরে যাব ।
- বাবা, খুব কষ্ট হচ্ছে তোর ।
- মা আমার সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা করছে । আমি বাঁচব না মা । শরীফ আমার পেটে নল দিয়ে অনেক বাতাস দিয়েছে ।
ছোটকে ঐ হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয় ঢাকায় নেওয়ার জন্য । কিন্তু মাইক্রোবাসে উঠার সময় সে মারা যায় । তার মা বিলাপ করতে থাকে আর উপস্থিত জনতাকে প্রশ্ন করে,
- কি অপরাধ করেছিল আমার বুকের ধন?
উৎসুক জনতা নির্বাক চেয়ে থাকে । তাদের কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই ।
ছোট 'র মা লাকী বেগম একদিন স্বপ্নে ছোটকে দেখে বলে,
- বাবা ছোট, বাড়িতে আসবি না?
- না মা । আমি আর বাড়িতে যাব না । আমি এখন বড় লোক । আমার আর কোন অভাব নেই । এখানে সুন্দর বাড়ি, সুন্দর বাগান । বাগানে অনেক ফুল ফল । আমি সারাদিন খেলা করি । এখানে কেউ আমাকে মারে না । কেউ অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেনা । এখানে গ্যারেজ নেই । গ্যারেজে কাজ করতে হয়না । আমি বাড়ি যাব না, মা ।
লাকী বেগম চিৎকার করে উঠে ঘুম থেকে । সে বিশ্বাস করতে পারে না যে, ছোট আজ পৃথিবীতে নেই । ছোট ছোটই থেকে গেল । সে আর বড় হতে পারল না । লাকী বেগম আশায় থাকে যে, তার ছেলেকে হত্যাকারীর ফাঁসি কার্যকর হবে ।
আজ প্রায় আট মাস হল ছোট হত্যার। তার মা লাকী বেগম টিভিতে সংবাদ শিরোনাম শুনতে পায়, " ছোট হত্যার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির মৃত্যুদন্ড মওকুফ ।"