ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে অবনীর জীবনেও সূচনা হতে চলেছে এক নতুন অধ্যায়ের। কলেজের প্রথম দিন আজ। কত শত দিনের রেকর্ড ভেঙ্গে গত রাতে ১০টা না বাজতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।
চোখ খুলল অবনী। পর্দার ফাঁক দিয়ে ঢোকা মৃদু আলোয় চোখ পড়তেই ফোনটা হাতে নিলো সে। ৬টাও বাজেনি এখনো। এখন উঠে পড়ার কোন মানেই হয়না। অতঃপর কাথা মুড়ি দিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে মেয়েটি। বৃথা চেষ্টা। আজ আর ঘুম হবেনা তার, কিছুক্ষন যেতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল সে।
কি আর করার? বিছানা থেকে নেমে পড়লো অবনী। হাতমুখ ধুয়ে ফিরতেই চোখ পড়লো রুমের মাঝে রাখা পুরনো আয়নাটির দিকে।
মুহূর্তের জন্য হাসি ফুটল তার মুখে। তারপর দীর্ঘশ্বাস। আজ যেন প্রতিদিনের চেয়ে বড় দেখাচ্ছে তাকে। অথচ সেদিনই যেন মায়ের হাত ধরে প্রথম স্কুলে পা রেখেছিল সে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলি হারিয়ে যায় চোখের পলকে। অবনীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। সকাল সাড়ে ৮টা। অবনীর পড়নে সাদা কামিজ ও পাজামা। লাল ক্রসবেল্ট। সাথে একই রঙ্গের স্কার্ফ। দুই বেণীর সাথে ভীষণ মানিয়েছে। বাবার হাসিটা দেখেই তা বুঝে নিল সে। নতুন ব্যাগটি নিয়ে রওনা দিল কলেজের উদ্দেশ্যে। অবনী মিশুক প্রকৃতির মেয়ে। নতুন বান্ধবিদের নিয়ে ভালই কাটলো প্রথম দিনটি। বেশ কিছু মাসও কেটে গেল একইভাবে।
(২)
"মেহেরিন জামান।" "প্রেসেন্ট স্যার" অবনী রায়। কোন জবাব আসে না। অ্যাই অবনী অ্যাই। প্রেসেন্ট দে।” পাশ থেকে আস্তে করে তাকে ধাক্কা দেয় মেহেরিন। প্রায় লাফ দিয়ে ওঠে অবনী।
“উম। প্রেসেন্ট স্যার!”
আজ বেশ কিছুদিন ধরেই এমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে মেয়েটি।
ক্লাসের পর।
“আন্টি-আঙ্কেল কে বলেছিস ব্যাপারটা?” প্রশ্ন মেহেরিনের ।
“না।” কিছুক্ষন চুপ থাকার পর উত্তর দেয় অবনী।
“ছেলেগুলো কি বলে রে?”
“কিছু বলেনা। এমনি বিরক্ত করে।”
ছেলেগুলি কিছু বলেনা, কথাটি মোটেও সত্য নয়। ইচ্ছে করেই তা গোপন করে অবনী। কারণ কথাগুলো ঠিক মুখে আনার মত নয়।
“কেউ একটু পানি মার আমার গায়ে। সুন্দরীর রুপের আগুনে তো পুড়ে গেলাম রে!”
সাথে সাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বখাটে গুলো। আর উচ্চারন করে কিছু অশ্রাব্য শব্দ।
না শোনার ভান করে সেখান থেকে এক প্রকার পালিয়ে আসে অবনী।
(৩)
নিজের রুমে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে থাকে অবনী। কলেজ আজ বন্ধ। কিন্তু কোচিং ক্লাস রয়েছে বিকেলে। ফিরতে নিশ্চিত সন্ধ্যা হবে। একা বাড়ি ফেরাটা মোটেও নিরাপদ নয়। আবার তার মাকেও কিছু বলা যাবেনা। হার্টের রোগী তিনি। এমনিতেই মেয়েকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় থাকেন। তাই সবকিছু খুলে বলতে গেলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাটাই বেশি।
সামনে পরিক্ষা। ক্লাসও বাদ দেওয়া যাবেনা।
অনেক ভেবে সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে।
সন্ধ্যা ৭টা।
ধীর পায়ে এগোতে থাকে অবনী। সূর্য ডুবেছে অনেক আগেই। আজ ক্লাসে যাওয়াটাই ঠিক হয়নি, মনে মনে আক্ষেপ করতে লাগল সে।
গলিটার সামনে আজ কেউ নেই। তবে কি চলে গেছে ছেলেগুলো? হয়ত বা তাই হয়েছে, এই ভেবে কিছুটা সাহস পেল অবনী। হাটার গতি বাড়িয়ে দিল সে। গলিটা পিছনে ফেলে আসতেই ভুল ভাঙল তার।
চায়ের দোকানে আড্ডা জমিয়েছে বখাটেগুলো। অবনীর দিকে চোখ পড়তেই এক সাথে শিস দিয়ে উঠে দু-তিন জন। স্তব্ধ হয়ে যায় মেয়েটি।
চায়ের কাপ রেখে অবনীকে ঘিরে দাড়ায় বখাটেরা। চায়ের দোকানী নীরব দর্শক।
"আরে সোনা, সারা বিকেল তো তোর অপেক্ষাতেই কাটিয়ে দিলাম।" বলে অবনীর কাঁধে হাত রাখতে যায় একজন।
দ্রুত সরে যায় সে। কিন্তু পালানোর পথ নেই। হাতগুলো এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে।
(৪)
“মেহেরিন, কি হবে আমার?"
জবাবে দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। "সব ঠিক হয়ে যাবে রে, অবনী। ধৈর্য ধর। তাও ভাল শয়তানগুলো বেশিদূর এগোতে পারেনি। তোর চিৎকার শুনে লোকগুলো এগিয়ে না আসলে কি হত বলতো?"
"জানিনা।"
“ছেলেগুলোকে তো শুনলাম পুলিশে ধরেছে। এবার কিছু ঘুষ খেয়ে ছেড়ে না দিলেই হল।”
“হুম।”
"কলেজে কবে আসবি আবার?"
"বলতে পারিনা।"
"কেন?"
এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়না অবনী। "মেহেরিন, আমার কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবেনা তো?"
"বন্ধ হবে কেন!"
এই প্রশ্নেরও কোন উত্তর অবনীর কাছে নেই। "রাখি রে। পরে কথা হবে।"
ফোন রেখে দেয় সে।
ইতিমধ্যে সেদিনের ঘটনাটি পুরো এলাকায় রটে গেছে। নানান লোকের নানান কথায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন অবনীর বাবা।
কে যেন এসেছে বাসায়। ড্রয়িং রুম থেকে আওয়াজ আসছে অবনীর কানে। নিজ ঘর থেকে বের হয়ে আসে সে।
তার জ্যাঠা এসেছেন। অবনীর বাবার চাচাতো ভাই তিনি। বাবা বসে আছেন সাথে। আড়াল থেকে তাদের কথা শুনতে থাকে অবনী।
“এই মেয়ে তো বংশের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশাবে।” কর্কশ গলায় মন্তব্য করেন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আসা এই আত্মীয়।
চুপ করে থাকেন অবনীর বাবা।
“একটাই তো মেয়ে। তাকেও একটু দেখে রাখতে পারিস না? ছি ছি ছি। কি কাণ্ডটাই না করে বসল! তোকে ভাল একটা বুদ্ধি দিচ্ছি, আর কিছু ঘটানোর আগে মেয়েটার বিয়েটা দে।”
“এখানে ওরই বা কি দোষ?”
“থাক থাক। মুখ নেড়ে আর কথা বলতে হবেনা। এবার বুঝলাম এত প্রশ্রয় তাকে দেয়টা কে!”
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু আড়াল থেকে বের হয়ে এসে তাতে বাঁধ সাধে অবনী। তাকে দেখে চমকে ওঠে উভয়ই।
“আপনাকে যথেষ্ট সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতাম আমি।” অবনীর গলা থেকে যেন আগুন ঝরতে থাকে। “এই সম্মান আজ বহুগুন বেড়ে যেত, যদি আপনি এ গলার জোর ছেলেগুলোর বাবা মার সামনে দেখাতেন।”
উঠে দাড়ায় অবনীর বাবা। “এই অবনী কি হচ্ছে এসব? এক্ষুনি তোর ঘরে যা।”
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এবারের বিষয় 'লাজ' যার আভিধানিক অর্থ লজ্জা কিংবা সংকচ। 'নির্লজ্জ' গল্পটির প্রধান চরিত্র অবনী কলেজ পড়ুয়া এক সাধারণ মেয়ে। তার কলেজ জীবনের শুরুতে সব কিছু ভালই যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু মাস যেতেই শুরু হয় কিছু বখাটের উপদ্রব। এক সন্ধ্যায় কোচিং থেকে ফেরার পথে তার উপর আক্রমণ হয়। ঘটনাটি পুরো এলাকায় রটে যায়। সমাজের কিছু নিচু মানসিকতার লোক দায়ী করতে থাকে অবনীকেই। এ ব্যাপারে মাত্রা ছাড়িয়ে যায় অবনীর জ্যাঠা। অবনী চুপ থাকেনি, করেছে প্রতিবাদ। তাকে 'নির্লজ্জ' বলা হলে সে নিজের ভিতর অনুভব করে এক নতুন তেজ। কিছুদিন পরেই সকল প্রকার লজ্জা,সংকচ ও দ্বিধা কে পরাজিত করে সে আবার ফিরে যায় তার স্বাভাবিক জীবনে। সমাজের দেওয়া তথাকথিত 'নির্লজ্জ' নামের পরোয়া করেনি সে।
গল্পটি কে এবারের বিষয়ের সঙ্গে তাই সমঞ্জস্যপূর্ণ বলা যেতে পারে।
০৪ অক্টোবর - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।