আমি আখতার ফারুক। এম এড করার পর একটা এমপিও ভুক্ত মাদ্রাসায় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে আছি। সমাজবিজ্ঞান পড়াই। কোন এক অজ্ঞাত কারণে ছাত্রছাত্রীরা আমাকে খুবই পছন্দ করে। ভয় থেকে কি না জানিনা । অনেক সময় ভয় থেকেও মানুষকে মানুষ শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হয়।
একটা ফাযিল মাদ্রাসায় প্রভাষক পদে নিয়োগ হয়েছিলো। কেন জানিনা, ম্যানেজিং কমিটি আমাকে নিয়োগ দিতে রাজি হননি। আমি ব্যক্তিগতভাবে হয়তো অতটা ভালো নয়, কিন্তু খারাপ বলা যাবে এরকম কোন আচরণও আমার মধ্যে কেউ সম্ভবত আজও লক্ষ্য করেনি। জিবনটাও খুব গোছালোভাবে সাজানো নয়। লক্ষ্য করলে হয়তো বুঝতে পারবেন, পাগলামির ভাবটা আমার ভেতর বাড়াবাড়ি পর্যায়ের।
ধুর! কি বলতে যাচ্ছিলাম আর বলছি কি! হ্যাঁ, রূপার কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
রূপা! হুমায়ূন আহমেদের হিমুর রূপা না। আমার রূপা। অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের রূপার সাথে তার প্রায় মিল। এটা সম্ভবত কাকতালীয় বা বকতালীয়।
আমি তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পাকাপোক্তভাবে একজন মানুষ। জিবন সংগ্রামের নানামুখী কষ্টের সাথে পরিচিত। রূপাও আমার ক্লাসমেট। হিন্দি সিরিয়ালের অবিশ্বাস্য রকম বাজারজাতে উঠতি বয়সি অধিকাংশ ছেলেমেয়ে রোমান্টিক রোমান্টিক। খুব কষ্ট করেও নি:সঙ্গ কাউকে মিলে না। বলতে গেলে তদবির করতে হয়। প্রেম করা যেন বাকি দশটা কর্তব্যের মধ্যে একটা।
রূপা ছিলো তামাটে গাত্রবর্ণ। গোলচেহারা। চোখের নিচে স্পষ্ট কালির দাগ দূর থেকে চোখে পড়ে। সাধারণত এরকম মেয়ের বাজারদর খুব কম। তবু রূপাকে আমার ভালো লাগত। কেন যদি বলতে বলেন, উত্তর হলো- জানিনা। কাউকে অকারণেও ভালো লাগতে পারে। রূপা হলো আমার অজ্ঞাত ভালো লাগার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ক্লাসে ব্্িরলিয়ান্ট হিসেবে আমার কদর বেশি। সবাই সমীহ করত। এমকি কয়েকজন টিচারও ¯েœহের চোখে আমাকে সম্মান করতো।
সঠিক সময়ে ক্লাসে উপস্থিত না হওয়ার কারণে একদিন সুবল স্যারের পিরিয়ডটা মিস করলাম। স্যারদের মধ্যে সুবল স্যারের লেকচারগুলো আমার বেশ ভালো লাগতো। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। স্যার নাকি প্রথম বয়সে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রচুর পড়াশুনা করতো। হয়তো ব্যস্তার মাঝে নিজের আশ্রয় খুঁজতো।
রূপাকে পেলাম ক্লাসের বাইরে করিডোরে ।
-রূপা। কালকে ক্লাসে ছিলি?
-হুঁ। সুবল স্যারের কি পড়িয়েছিল?
-পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শন। তোকে খুব খুঁজছিলো। কি না কি দরকার।
-ও!
আমি দ্রুত স্যারের সাথে দেখা করে আবার রূপার কাছে আসলাম। রূপা অবশ্য আজকে ভিষণরকম দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত।
-কিছু হয়েছে তোর? আমি অনেকটা বিব্রতভাবে জিজ্ঞেস করলাম।
রূপা অল্পক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বললো, না। কেন?
- তোকে খুব বিষণœ দেখাচ্ছে।
ফয়েজ ছিলো আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে রোমান্টিক মানুষ। প্রচুর হাসাতে পারতো। কথা বলার স্টাইলটা ছিলো, অনকেটা কলকাতার মানুষের মতো। সে কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে বললো, তোদের সম্পর্কে মাইরি আমার কোন এলেম ছিলো না। তলে তলে এতদূর- বল শালা মিষ্টি কখন খাওয়াবি। একেবারে জেনুইন ময়রার মিষ্টি। সিদ্ধিশ্বর মিষ্টি বিতান।
আমি রূপা দুজনই লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম। রূপা দ্রুত ক্লাস রুমে চলে গেলো। ফয়েজ আমাকে টেনে টেনে মিষ্টি খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে।
-শালা! একদম জেনুইন জিনিস ধরেছিস! কালো মেয়েদের ইজ্জত অটুট-
লজ্জায় আমিও আরও বেশি ভেঙ্গে পড়ছিলাম।
সপ্তাহ খানেক পরে রূপা নিজেই এলো আমার কাছে। চোখ দুটো ভীষণ রকম লাল। কিছুক্ষণ আগে বোধহয় কোথাও প্রচুর কেঁদেছে এ মেয়েটি। দেখলেই বুঝা যায়। অবশ্য কি কারণে মেয়েরা কাঁদে তা অনেক সময় মেয়েরাও তা ভালো করে জানে না।
- কি হচ্ছে এসব?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কি?
- ক্লাসে সবাই বলতেছে তোর সাথে আমার নাকি দহরম মহরম। প্রেম।
-কে বলেছে?
রূপা বিরক্ত হয়ে বললো, বললাম তো সবাই।
আমি বুকে সাহস রেখে বললাম, বলুক। তাহলে আরও সহজ।
-আরও সহজ মানে?
-মিথ্যা তো বলছে না। আমি ডান বাম ভালো করে দেখলাম, কেউ নেই। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বললাম, তুই কি আমাকে ভালোবাসিস না?
রূপা চোখ মুখ বড় করে অনেকটা মারার ভঙ্গিতে বললো, বলদ। বাসি না-
অনেকটা দৌঁড়ার মতোই দ্রুত সরে গেলো রূপা। ও চলে যাওয়ার পর, নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে। এতো বড়ো একটা কথা এতো সহজে বলতে পারবো, কোনদিন ভাবিনি। কিন্তু প্রতিক্রিয়া কি হবে- এই ভেবে আবার টেনশন শুরু হলো।
আরও মাসখানেক চলে গেলো। রূপা এখন আর আমার সাথে কথা বলে না। দেখলে দূর থেকে পাশ কেটে চলে যায়। আমার মাথাটা আরও বিগড়ে যায়। ভয়ও হয়। রূপা কি তাহলে আমাকে ভালোবাসে না? নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। অবশ্য ভালোবাসার জন্য আমার আহামরি কিছু নেই। পড়ালেখায় একটু ভালো, এই যা। বাড়ি, টাকা- কিছু নেই।
ক্লাসে একদিন খুব আনমনে বসে আছি। কেউ নেই। সকাল সকাল এসে ক্লাসে ঢুকে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কলেজের দপ্তরি এখানে ঘুমান বলে, ক্লাসরুম সকাল সকাল খুলে দেন। কি করবো বুঝতেছি না, রূপা আমাকে এভাবে এড়ায়ে চলার কারণ কি?
-তুই কখন এলি?
আমি চমকে উঠলাম। রূপা আমার সামনে দাঁড়ানো। এতো সকাল সকাল সে কোনদিন আসেনি।
-চমকে গেলি। নাকি? আমি দপ্তরি কাকার সাথে কথা বলে জেনেছি। তুই বেশ কিছুদিন থেকে সকাল সকাল ক্লাসে এসে বসে থাকিস। আরও কয়েকবার এসেছি। পেলাম না। ঘটনা কি?
আমি চোরের মতো মাথা নিচু করে থাকলাম। এ মেয়েটা এসব লক্ষ্য করছে ভেবে, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কিছু কথা বলা দরকার, কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। চুপ করে থাকা ছাড়া এখন আর কোন আশ্রয় নেই।
-বল? এই এদিকে তাকা- লাজবাবু-
রূপার স্পষ্ট খোঁচায় আমি আরও কুঁচকে গেলাম। নিজের সাথে জোর করে অনেকটা অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, বল।
- তুই না আমাকে ভালোবাসিস?
অতিমাত্রায় শান্ত মেয়েটি এমন পটপট করে কথা বলবে, কোনদিন কল্পনাও করেনি।
- বাসিস কিনা?
-বাসি।
- আমার বাড়িতে বল। আমার একটা সমাজ আছে। তোর সাথে আমার চলাফেরা দেখলে সবাই অন্যভাবে নেবে। আমাকে তো সমাজে বাঁচতে হবে। হবে না?
আমি চুপ করে আছি। এতক্ষণ যে লজ্জাটা আমাকে ঘিরে ধরেছিলো, এখন তা প্রায় কেটে গেছে। রূপা বলেই যাচ্ছিল- বাড়িতে মা আছে। বাবা নেই। নেই কেন, সেটাও বলছি। আরেকটা বিয়ে করে পালিয়েছে। ছোটভাইটা ক্লাস থ্রিতে। চলবে?
আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। সমাজ কখনও এরকম একটি মেয়েকে ভালো চোখে দেখবে না। বাবা তো মেনে নেবার প্রশ্নই আসে না। কি বলবো? সমাজকে এড়িয়ে যেমন বেঁচে থাকা যায় না, তেমন রূপাকে ছাড়াও আমি বাঁচবো না। আমার কাছে এমন কঠিন মুহূর্ত আর আসেনি। চোখ দিয়ে কান্না আসতে চাচ্ছে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করেও পারছি না। মনে ভাবলাম, সমাজকে সংস্কার করা যায়, কিন্তু রূপা তো দুটি নেই দুনিয়াতে। দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
-চলবে।
-তাহলে বাড়িতে প্রস্তাব পাঠা। পিছনে ঘুরঘুর করবি না। সমাজে আমার বেঁচে থাকাটা জরুরি।
রূপাকে কথা দিলাম, তাকে ছাড়া আমি নিরুপায়। কোন সমাজ, বাঁধা কিছুই আমাদের আটকাতে পারবে না। আমার কাছে ভালোবাসাটা চিরন্তন সত্য, সমাজ উপলক্ষ্য। অনেক তদবির করেও আমি পারলাম না। বাবা রাজিই হননি। উল্টো হুমকি দিলেন, বাড়াবাড়ি করলে, ত্যাজ্য করবেন। মা তো বার কয়েক বেহুঁশ হয়ে গেলেন। কসম খেলেন, এই মেয়ে যদি একান্তই আনতে হয় তাহলে তার লাশের উপর দিয়ে আনতে হবে।
আমি বাধ্য হলাম, রূপাকে ছাড়তে। আমি হেরে গেলাম। সমাজের আধিপত্যবাদের সংঘবদ্ধ প্রথার কাছে। দৌলত আর প্রতিষ্ঠিত সম্মানের কাছে।
এরপর আর কোনদিন রূপার সাথে দেখা করিনি। রূপা হয়তো ভাববে, আমিও আর দশটা পুরুষের মতো কাপুরুষ। ভালোবেসে হাত ধরতে যার কাছে, নূন্যতম চিন্তা হয়- তার নিকট ভালোবাসাটা পার্থিব, হৃদয়ের সেই প্রাগৈতিহাসিক জৈবিকতার উর্ধ্বে নয়।
শুনেছি, রূপা এখন তিন ছেলের মা। স্বামী স্টেটফোর্ডে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করে। সব সময় চাই, ভালো থাকুক। ওর ভালো থাকা খুব জরুরি। কিন্তু আমি হয়তো ওকে প্রতিদিন ভালো থাকতে দিচ্ছি না। নিশ্চয় আমাকে এখনও মনে আছে ওর!
অবশ্য ভুলেও যেতে পারে, জিবন মানুষটে একই বিষয়ে দু’বার ভাববার সময় খুব কম দেয়।
শুনলেন তো, রূপার কথা।
রূপার মতো আপনারাও ভাববেন না, আমি কাপুরুষ। আমার এই পরিস্থিতিতে দেখবেন আপনিও একই পথে হাঁটছেন। সমাজের নিয়মের কাছে আপনি নিতান্ত একজন শিশু। দাদার কথাই ধরেন না, তিনি তো সবসময় জোর দিয়ে বলতেন, ’সমাজ হলো একটা সমুদ্র। প্রতিটি মানুষ সেখানে এক একটি মাছ। পুরো সমুদ্রের কাছে একটি মাছের প্রয়োজন সামান্যই। কিন্তু একটি মাছের সমুদ্রকে অবশ্যই দরকার।’
আজ আপনাদের বলতে গিয়ে- রূপাকে খুব মনে পড়ছে। সেই তামাটে গাত্র বর্ণের মেয়েটি- যাকে ঘিরে একদিন আমি বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতাম। আজ দু:স্বপ্নেও ভাবি না আর সে কথা। রূপার কথা মনে আসলেই এখন দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে ফেলি। মনকে বলি, যা গেছে তা আসবে না। বলতে পারেন, অনেকটা স্বার্থপর। সেলফিশ।
তাছাড়া উপায় কি বলুন, কোন কিছু হারিয়ে অহেতুক দু:শ্চিন্তা করা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে মানায়? মানায় না।
অতএব, রূপাকে আমি সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম। জিজ্ঞেস করতে পারেন, রূপার কথা বলতে গিয়ে আমাকে অন্যরকম লাগছে কেন? অবশ্য সেটা আমিও জানিনা। না জানলেই তো ভালো। কি দরকার!
আচ্ছা কি মনে হয় আপনাদের, আমি কি সত্যি অপরাধ করেছি?
১৪ আগষ্ট - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“ডিসেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী