আমেরিকার শিকাগো শহর । " ইউনিয়ন " রেলওয়ে স্টেশন । একেবারে ঝকঝকে - তকতকে স্টেশন চত্বর । ট্রেনটি একেবারে ঘড়ি ধরে ঠিক সময় স্টেশন থেকে ছেড়ে দিল । আমার গন্তব্য স্থল -- " ব্লুমিংটন নরমাল " স্টেশন । দুরন্ত গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে । দুপাশে দেখা যাচ্ছে সুন্দর সুন্দর সাজানো গোছানো ছোট বড় নানা ধরনের বাড়ী । কোনটার সামনে আবার নানা ধরনের ফুলের গাছ । আবার কখনো গাছ গাছালিতে ভরা জঙ্গল । একে একে সুমিট , জোলিয়েট , দায়িয়েট , পনটিয়েক স্টেশনগুলিকে অতিক্রম করে " ব্লুমিংটন নরমাল " স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলাম । দুর থেকে দেখতে পেলাম -- গেটের সামনে আমার আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন - " হার্ডসন সাহেব " । পুরোনাম - হার্ডসন ওয়েলম্যান । আমাকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরে বললেন -- চল , বাড়ীতে চল । সেখানে গিয়ে প্রাণখুলে গল্প করা যাবে । তুমিতো জানো আমি তোমার কথা আমার স্ত্রীকে বলেছি । তিনিও তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন , তোমার সঙ্গে , তোমাদের দেশ সম্পর্কে গল্প করবার জন্য । মিনিট পনেরোর মধ্যে আমরা হার্ডসন সাহেবের বাড়ীতে পৌঁছে গেলাম । বিরাট বাড়ী সামনে অনেক জায়গা নিয়ে প্রসস্থ লন ( Ranch - style house) মিসেস হার্ডসন হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে আমাকে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গেলেন । ভালো ভালো নানা ধরনের খাবারের সাথে বিভিন্ন বিষয়ের উপর গল্প করে দিনটা বেশ সুন্দর ভাবে কেটে গেল । তাঁদের সুন্দর আতিথিয়তা,আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম ।
শিকাগো শহরে বিশাল এক শপিং মল । বিভিন্ন জিনিসের হরেক রকমের সম্ভার । প্রচুর লোকজন এখানে আসেন শপিং করবার জন্য। প্রধান ফটকের সামনে একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যেক লোকজনকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করেন আর শপিং করবার ট্রলিটি এগিয়ে দেন। সময় কাটানোর জন্য প্রায় রোজ সন্ধেবেলা এই শপিং মলে এসে নানা ধরনের নতুন নতুন জিনিসপত্র দেখবার সাথে সাথে আমার হাঁটাহাঁটির পর্বটিও ভাল ভাবে সমাধা হোত । রোজ এখানে আসবার ফলে শপিং মলে ঢোকবার বেরোবার জন্য ফটকের সামনে দাঁড়ানো সদা হাস্যময় এই হার্ডসন সাহেবের সঙ্গে আমার ভালভাবে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল । বয়েস প্রায় ৭০ এর কাছাকাছি । কিন্তু চলনে বলনে তিনি যেন চির যুবক। প্রথম পরিচয়ে তাঁর সুন্দর ব্যবহার,তাঁর কোমল হৃদয় আমার মনকে জয় করে নিয়েছিল। ক্রমে ক্রমে তাঁর সঙ্গে আমার এক কোমলতার মেলাবন্ধন তৈরী হয়ে গিয়েছিল । কথাবার্তার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম কাজের সুবিধার জন্য তিনি শিকাগোতে থাকেন । তাঁর নিজের বাড়ী ব্লুমিংটন শহরে । সেখানে মিসেস হার্ডসন একাই থাকেন । গল্পের ছলে তাঁর থেকে জানতে পেরেছিলাম -- তাঁদের পূর্ব - পুরুষেরা ছিলেন ক্রীতদাস প্রথার ঘোরতর বিরোধী । আমেরিকায় আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁরাও সক্রিয় ভাবে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন । আরো কত নানা ধরনের গল্প এই দেশ সম্পর্কে ।
একদিন কৌতূহল বশত সরাসরি হার্ডসন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম -- এই বৃদ্ধ বয়সে এত কষ্ট করে কেন কাজ করেন ? তিনি শুধু একটু হাসলেন । জানতে পারলাম প্রকৃত কারনটা । নিজের অবস্থা খুবই সচ্ছল । তাঁর দুই ছেলে প্রতিষ্টিত ডাক্তার । পরিবার নিয়ে একজন নিউইয়র্কে আর একজন বোস্টনে থাকে । ছুটি-ছাটাতে তাঁরা মা বাবার কাছে আসে । সময় পেলে তাঁরাও ছেলেদের কাছে যান । নিজে চাকরি থেকে অবসর নেবার পর এই শপিং মলে কাজ করছেন । এখান থেকে যে ডলার উপার্জন করেন তার পুরোটাই প্রতিমাসে একটি ক্যান্সার হাসপাতালে গরীব মানুষদের চিকিৎসার জন্য দান করে দেন , শুধু তাই নয় , প্রত্যেক সপ্তাহে এখানকার কাজের ছুটির দিনে হাসপাতালের বিভিন্ন কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে । লোকটির প্রতি শ্রদ্ধা , ভালোবাসার টানে উনি আমার কাছে ছিলেন একেবারে নিজের আপনজন । প্রায় রোজই মলে গিয়ে ওনার সঙ্গে কথা বলার পর মনটা খুব ভাল লাগতো । কোন কারনে শপিং মলে যেতে না পারলে মনটা ছটফট করতো হার্ডসন সাহেবের সঙ্গে কথা বলার জন্য । পরে দেখা হলে আমরা মলে না আসার কারন জিজ্ঞাসা করতেন । প্রায়ই বলতেন -- সব ধর্মেই ঈশ্বর বিরাজমান । বিভিন্ন ধর্মের মানুষ তাঁকে বিভিন্ন নামে স্মরণ করে । জাতিভেদ বিচার না করে মানুষকে ভালবাসো , মানুষের সেবা করো , মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বিরাজ করেন । ঈশ্বর যতদিন কাজ করবার শক্তি দেবেন , ততদিন তিনি এইভাবে মানুষকে ভালোবেসে সেবার কাজ করে যাবেন ।
হার্ডসন সাহেবকে যেদিন বললাম -- এবার আমি আমার নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছি । উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার হাত দুটো চেপে ধরে বললেন -- তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে , তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভাল লাগতো । ভাল থেকো । নিজের দেশে ফিরে গিয়ে আমার কথা যেন ভুলে যেওনা । আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখো । অনুভব করলাম আমাদের দুজনের চোখেই জল ।
নিজের দেশে ফিরে এসে হার্ডসন সাহেবের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম । হটাৎ করেই একদিন খবর পেলাম হার্ডসন সাহেব হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহা বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে অন্য জগতে চলে গেছেন । নিজের অজান্তেই দুগাল ভরে অশ্রু নেমে এলো । মনে হলো এক পরম আত্মীয়কে হারালাম । হারালাম এমন একজন কোমল হৃদয়ের মানুষকে যাঁর হৃদয়টি ছিল শুধু কোমলতায় ভরা । তিনি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেও আমার হৃদয় থেকে কোনদিনও হারিয়ে যাবেন না ।
কাজী নজরুল ইসলামের কথায় ---
" তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু । আমরা অবোধ , অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু ।। তোমার মতই তোমার ভুবন চির পূর্ণ , হে নারায়ণ ! দেখতে না পায় অন্ধ নয়ন তাই এ দুঃখ প্রভু ।। "
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু
ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ সুন্দর মানসিকতারই পরিচয় দেয়। --- চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বৃদ্ধ বয়সেও কাজ করে উপার্জন করে তার পুরোটাই গরীব মানুষদের চিকিৎসার জন্য দান করে দেওয়াটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। --- হঠাৎ করে মৃত্যুর খবর পাওয়া খুব বেদনাদায়ক। অনেক ভাল লাগল গল্পটি। আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা রইলো। ভাল থাকবেন।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।