বাড়ীটা মেদিনীপুর শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে । একটু এগোলেই জঙ্গল শুরু হয়েছে । এখন রাত প্রায় নটা । বাড়ীটার একটা ফাঁকা ঘরের মাঝখানে একটি কেরোসিনের কুপি ( কেরোসিন দ্বারা জ্বালানো কম আলোর বাতি ) টিমটিম করে জ্বলছে । কুপিটার চারিদিকে ওরা সবাই গোল হয়ে বসেছে । রাখালদা উঠে দাঁড়িয়ে আধো অন্ধকার ঘরের পরিবেশটা পরখ করে নিয়ে , গম্ভীর ভাবে বললেন -- তোমরা নিশ্চয় উদগ্রীব হয়ে আছো , কেন হটাৎ করে আজকে এই জরুরী মিটিংটা ডাকা হয়েছে ?
১৯৭০ সাল । সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এক অস্থির অবস্থা । প্রায় প্রত্যেক মানুষ সবসময় এক ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে । খবরের কাগজ খুললেই শুধু গুলির লড়াইয়ের সংবাদ । দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার -- " সশস্ত্র বিপ্লবই আনতে পারে মুক্তির পথ " , শ্রেনী শত্রুরাই সমাজের ক্ষতিকারক " ইত্যাদি নানা ধরনের দেয়াল লিখন ........। কমদামের সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে রাখালদা বর্তমান সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে এক জ্বালাময়ী ভাষণের শেষে আসল কথাটা বললেন -- কমরেড , আমাদের সময় আসন্ন । আর দেরী করবার সময় নেই । সেন্ট্রাল কমিটির নেতৃবৃন্দের থেকে সেই রকম নির্দেশ আমাদের কাছে এসেছে । শ্রেনীশত্রুদের চিহ্ণিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার । এই শ্রেনীশত্রুদের মধ্যে যেমন আছে ভূস্বামী , জোতদার , মহাজন তেমনি রয়েছে রাজনীতিবিদ , পুলিশ এবং আরও অনেকে । এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলার পর একটু থেমে আর বেশ চিন্তিত ভাবে বললেন -- আমরা আমাদের নিজেস্ব " সোর্স " মারফত গোপনে খবর পেয়েছি আমাদের জঙ্গলের ভিতরে যে গোপন ডেরাটি ( জায়গা ) রয়েছে , আগামী ২১শে ডিসেম্বর রাত্রিবেলা সেখানে বিরাট এক পুলিশের দল সশস্ত্রবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করবে । আমরাও সশস্ত্র হয়ে প্রস্তুত থাকব আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে একে মোকাবিলা করবার জন্য । দরকার হলে .....রাখালদার কথাটা শুনে উপস্থিত সকলের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন বয়ে গেল । রাখালদা আরও একবার পরিবেশটা বুঝে নিয়ে সরাসরি নির্মলকে বললেন -- নির্মল , আমরা চাই আমাদের এই অপারেশনে তুমি প্রধান দায়িত্বে থেকে এটিকে সফল ভাবে কার্যকর কর । তোমাকে বা তোমার সঙ্গে যারা থাকবে তাদের কি করতে হবে সেটা আমি তোমাদের বুঝিয়ে বলছি ।
রাখালদার থেকে সব শোনার পর নির্মলের মনে একটা প্রশ্ন , একটা দ্বন্দ বাড়ে বাড়েই ঘুরে ফিরে আসছিল -- দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এক সুন্দর সমাজব্যবস্থা স্থাপন করবার নামে এটাই কি সঠিক পথ !! এই ঘটনায় সামিল হয়ে সত্যি কি সমাজের কোন উপকার হবে !! নির্মলের মনের প্রশ্ন বা দ্বিধাকে আচঁ করতে পেরে রাখালদা নির্মল আর অন্যদের নানা ধরণের যুক্তি দিয়ে বোঝালেও , নির্মলের মনের প্রশ্নটা থেকেই গেল । উপর তলার পার্টির নেতৃবৃন্দের নির্দেশ মেনে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ থেকেও এই অপারেশনে থাকতে রাজি হলো ।
মিটিং শেষ করে নির্মল যখন বাড়ীতে ফিরল তখন অনেক রাত । বাড়ীতে সবাই ঘুমিয়ে পরেছে । শুধু তার মা তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে না খেয়ে বসে রয়েছে । শীর্ণকায় শরীর নিয়ে মা বললেন -- এত রাত পর্যন্ত তুই কোথায় থাকিস বাবা ? ভাল করে পড়াশুনাটাও করছিস না । বাড়ীর কোন খবরও রাখিস না , রোজ অনেক রাত করে ঘরে ফিরিস । বাড়ীতে তোর দুটো অবিবাহিত বোন । তোর বাবা কত টাকা মাইনে পায় আর আমাদের সংসারটা কি ভাবে চলছে সেটাও তুই ভাল করেই জানিস । তুই মেধাবী ছাত্র বলে কত কষ্ট করে তোর বাবা তোর ইঞ্জিনিয়ারিং এর পড়াশুনার খরচ চালাচ্ছে । একটাই আশা , তুই ভালভাবে পড়াশুনা শেষ করে চাকরী পেয়ে আমাদের সংসারটার একটু হাল ধরবি । আর তাছাড়া তোর বাবারও তো বয়স হচ্ছে , শরীরটাও কয়েকদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না । আর এটাও জানিস , তোর বাবা যে জায়গায় কাজ করে , বর্তমানে এক ভয়ঙ্কর রাজনীতির টানাপড়েনের জন্য তাঁকে প্রায়ই রাতের ডিউটিতে যেতে হয় । আসলে তোর বাবা তোকে খুব ভালবাসে । তোকে নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন .... । অনেক রাত হয়েছে , এবার খেয়ে শুয়ে পর । আর একটা কথা , আমাদের মনে একটাই প্রশ্ন -- যে শুধু পড়াশুনা ছাড়া আর কিছুই জানত না , সে কি ভাবে , কাদের প্ররোচনায় এইরকম এক ভয়ংকর রাজনীতিতে জড়িয়ে পরল ?
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মল আর সবাই রাত্রে জঙ্গলের মধ্যে যে পথটা দিয়ে পুলিশের দলটা তাদের গোপন ডেরাকে আক্রমণ করতে যাবে তার কিছুটা আগেই জঙ্গলের গাছের আড়ালে পজিশন নিয়ে লুকিয়ে অপেক্ষা করে আছে । একটা সময় শুরু হলো গুলির লড়াই । এরই মধ্যে নির্মল আবছা অন্ধকারে বুঝতে পারলো তার চালানো পিস্তল থেকে গুলি লেগে একজন পুলিশের লোক এক করুণ আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পরলো । আবছা অন্ধকারের দারুণ লুটিয়ে পরা লোকটার মুখটাকে ভালকরে দেখবার আর অবকাস পাওয়া গেল না । জীবনে এই প্রথম একজনকে গুলি করে হত্যা করলো । হাতটা তার থরথর করে তখনও কাঁপছে । এরই মধ্যে অবস্থার বেগতিক বুঝে নির্মল আর তার দলবলেরা অন্ধকার জঙ্গলে নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল ।
আগেরদিন রাতের ঘটনার পর নিজের মধ্যে এক তীব্র অন্তদ্বন্দের প্রশ্ন নিয়ে ক্লান্তিতে প্রায় অবশ শরীরটা নিয়ে কোনরকমে বাড়ীতে ঢুকে খবরটা শুনে মনে হোল সারা আকাশটা যেন মাথার উপরে ভেঙ্গে পরল । পুলিশের দল অনেক আগে থেকেই তার আসার অপেক্ষায় লুকিয়ে ছিল । মূহুর্তের মধ্যে বিরাট পুলিশ বাহিনী এসে পুরো বাড়ীটিকে ঘিরে ফেললো ।
আজ ২১শে ডিসেম্বর । কিন্তু তার কাছে এই দিনের ঘটনার কথা রোজই তার মনকে এক তীব্র যন্ত্রনায় ঠেলে দেয় । দেখতে দেখতে প্রায় ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে । নির্মলের বয়স এখন প্রায় ৬৫ বছর । বাবার বড় বাঁধানো ফটোটায় মালাটা পরাতে গিয়ে আবারও মনের মধ্যে ভেসে ওঠে সেই রাতের ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা । সশস্ত্র বিপ্লব করবার নামে একদিন রাতে নিজের অজান্তেই তার চালানো গুলিতেই জঙ্গলের মধ্যে মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পরেছিল তার নিজেরই বাবা .....। এই মানসিক যন্ত্রণা রোজ দিনে-রাতে তাকে ঠুকরে ঠুকরে খায় । দীর্ঘদিন জেলে থাকার দারুন তার জীবনটাই একেবারে শেষ হয়ে গেল । বাবার মৃত্যুর পর তাদের সংসারটাই প্রকৃতপক্ষে একেবারে ভেসে গেল । নিজেরও হোল না ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আর সংসার জীবন করা ।
সবসময় একটা প্রশ্নই তার মনের মধ্যে জেগে থাকে -- একদিন সব কিছু ভুলে , বাবা - মার কথা অবগ্যা করে যে মহৎ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে , পার্টির নীতিকে ভালবেসে স্বপ্ন দেখেছিল -- এক শোষণহীন সমাজব্যবস্থার। সেদিন কিছু নেতার ভুল নীতির জন্য পার্টিটাই দ্বিখন্ডিত হয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আর তার মত অনেক সদস্যদের জীবনটাই চিরতরে শেষ হয়ে গেল আর যারা বেঁচে থাকল তাদের জীবনের অধিকাংশ সময়টাই জেলের অন্ধকার খুটুরিতে কাটাতে হলো ।
এখন নির্মলের মনে হয় যে শ্রেণীর বিরুদ্ধে ছিল তাদের লড়াই , তারা আজও বহাল তবিয়তে সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । যখনই বাবার ফটোটার সামনে এসে দাঁড়ায় , মনে হয় বাবা তাকে প্রশ্ন করে -- নির্মল , তুই একাজ কেন করলি বাবা ??
১২ আগষ্ট - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৪৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪