নীলু

মা (মে ২০২২)

মিঠুন মণ্ডল
  • ৩৭
দুপুর বেলায় ভাত খেয়ে একটি গল্পের বই আমার চাই। অন্য বাঙালী মহিলাদের মতো পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে বা বাংলা সিরিয়াল দেখে আমার সময় নষ্ট করতে ভালো লাগে না। যদিও আমাদের বাড়িতে কেবল নেই তাই সিরিয়াল দেখার অভ্যাসটা আর তৈরি হয়নি। নীলু যখন ছোটো ছিল তখন একটু আধটু পড়ত। তারপর পড়ার চাপে গল্পের বই পড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। একদিন আমি রবি ঠাকুরের একটা উপন্যাস পড়ছিলাম।
নীলু কলেজ থেকে ফিরে আমার কোলে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি পড়ছ মা’? আমি বললাম ‘চোখের বালি’ পড়ছি, তুই পড়বি’?
নীলু বলল, ‘তোমার প্রিয় রবি ঠাকুরের মতো আমার কি অফুরন্ত অবসর আছে মা, ভদ্রলোক যদি সারা জীবন সাহিত্য চর্চা না করে বিজ্ঞান সাধনা করতেন তাহলে দেশের অনেক উন্নতি হতো’। ‘বাংলা সাহিত্য তো কিছুটা হলেও পিছিয়ে যেত’।
নীলু কোল থেকে মাথা তুলে বলল, ‘তাতে কি এমন ক্ষতি হতো? আগে তো ভাতের দরকার, তারপর তো সাহিত্য’!
আমি বুঝলাম ছেলের সাথে তর্ক করে লাভ নেই। রবি ঠাকুরকে তাঁর জীবিত কালেই তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরাই কম সমালোচনা করেন নি। কখনও তাঁর লেখা নিয়ে কখনও আবার তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। তাঁর সাথে, তাঁর বউদির কি সম্পর্ক ছিল তা নিয়ে আজও এলিট সম্প্রদায়ের সো কলড্ সফিস্টিকেটেড লোকেদের ড্রয়িং রুমে কফির কাপে ঝড় উঠে। রবি ঠাকুরকে বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স নীলুর হয়নি।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তোকে খালি পেটে বিজ্ঞান চর্চাও করতে হবে না, কখন খেয়েছিস, চল জল খাবার খেয়ে নিবি।

নীলু যখন বলল, ‘মা আমি থিসিস জমা দিয়েছি, তখন যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার ছোট্টো নীলুর পি এইচ ডি হয়ে গেল। এই তো কয়েকদিন আগেই বায়না করতো আজ আমি টিফিন নিয়ে যাবো না। রোজ রোজ রুটি আলু ভাজা ভালো লাগে না। আজ আমায় দুটাকা দাও ঘুগনি কিনে খাবো। ক্লাস টেন পর্যন্ত নীলুর একটাই টিউশন মাষ্টার ছিল। উনিই অঙ্ক, ইংরাজী পড়িয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে আমার কাছে আসত বাংলা আর ইতিহাস পড়তে।নীলু তখন দশম শ্রেনীতে পড়ে, একদিন আমার কাছে এসে বলল, ‘মা আমাকে একটু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনটা পড়াবে। আমি বিনয় বাদল দিনেশ, এই তিন জন যুবক কিভাবে মহাকরণে ঢুকে ইংরেজদের সাথে লড়াই করেছিল বোঝাছিলাম তখন নীলুর চোখ মুখের ভাবই পাল্টে গিয়েছিল। যেন সে এখুনি ইংরেজ বধে নেমে পড়বে!
পড়ানোর মাঝ পথেই আমাকে থামিয়ে বলল, ‘বিনয় বাদল দিনেশ এক দুঃসাহসিক কাজ করেছিল কিন্তু ওঁদের আর একটু প্ল্যানিং এর দরকার ছিল। তিনটে দেশি রিভালবার নিয়ে মহাকরণে এতো জন পুলিশের সাথে লড়াই করা যায়’?
আর একদিন সন্ধ্যে বেলায় নীলু এসে বলল, ‘মা আমাকে ছোটো গল্পের সংজ্ঞাটা একটু বুঝিয়ে দেবে’? ‘খুবই কম সংখ্যক চরিত্র এবং শেষ হইয়াও হইল না শেষ এই অনুভূতিটাই হল ছোটো গল্পের প্রধান লক্ষণ’। তারপর আমি রবি ঠাকুরের বলাই পড়াতে শুরু করলাম। পড়ানোর মাঝ পথেই আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা বলাইটা কি ক্যাবলা ছিল। গাছের পাতা ছিঁড়লে ওর কষ্ট পাওয়ার কি আছে? কষ্ট পেলে গাছ পাবে। আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। নীলু হয়তো একটু অপ্রস্তত হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে তারপর বলো।

তিন বছর আগে নীলু এস এস সি দিয়ে স্কুলে চাকরী পায়। আমার বুকটা গর্বে ভরে গিয়েছিল। সবাই আমাকে বলবে নীলু মাষ্টারের মা। বেশ ভাবতেই ভালো লাগছিল। কিন্তু নীলু যখন এসে বলল স্কুলের চাকরীটা করতে চায় না, রিসার্চটাই চালিয়ে যেতে চায় তখন আমি কি বলল বুঝতে পারছিলাম না।
ও আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছিল, ‘বল মা, তুমি কি চাও? তুমি চাইলে আমি চাকরীটা করতে রাজী আছি’।
তোর পি এইচ ডি র স্যার কি বলে? স্যার তো রিসার্চটাই চালিয়ে যেতে বলছে। স্যারেদের কথা ছাড়ো। তুমি যেটা বলবে সেটাই শেষ কথা। তুমি কি চাও মা’? আমি চায় তুই অনেক বড়ো হও। অনেক নাম হোক তোর। এর জন্য স্কুলে চাকরী ছাড়তে হলে ছেড়ে দে। তাছাড়া পি এইচ ডি র পরও তো স্কুলে আসতে পারবি। এখন যদি স্কুলে না জয়েন করি তাহলে আর আমি স্কুলে ফিরব না। আমি পি এইচ ডির পর কোন রিসার্চ অর্গানাইজেশন এ জয়েন করব। কোন কলেজে চাকরী পাবি না। না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ভবিষ্যতের কথা ছাড়ও এখন আমি কি করব সেটাই বলো। তুই পি এইচ ডি টাই শেষ কর। নীলু বিকেলের ট্রেনে কলকাতা ফিরে গিয়েছিল। সেদিন রাতে আমার ঘুম হয়নি। বার বার মনে হচ্ছিল যদি নীলুকে চাকরীটা নিতে বলতাম! যেদিন পিউন নিয়োগপত্রটা দিয়ে গেল সেইদিন খুব হাসি পাচ্ছিল। এই তো কয়েকদিন আগে আমার হাতে মার খেয়েছে! ও স্কুলে ছেলেদের বকলে, ছেলেরা শুনবে? কিভাবে যে ছেলেগুলো পড়াবে ভগবান জানে? আর কত কি মনে এসেছিল! নীলুকে যদি চাকরী টা নিতে বলতাম, ও হয়তো আমার মুখ চেয়ে চাকরীটা করত কিন্তু ওর স্বপ্নটা ভেঙে যেত। মা হয়ে এটা কি করে করতে পারি? আমার স্বপ্ন গুলো তো প্রায় কিছুই পূরণ হল না, অন্তত ছেলের স্বপ্নটা পূরণ হোক!

পি এইচ ডি থিসিস জমা দেওয়ার পর নীলু বাড়ী আসছে। সকাল থেকেই কি রান্না করব ভাবছি? ১১ টার মধ্যে ঢুকে যায় কিন্তু এখন প্রায় ১২ টা বাজে নীলুর দেখা নেই।আরও কিছুক্ষণ পর নীলু ল্যাপটপের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে গুটি গুটি পায়ে আসছে।
‘কি রে এতো দেরী হল? ট্রেন লেট ছিল নাকি’?
‘ট্রেন ঠিক সময়েই ঢুকিয়েছে কিন্তু বাসে যা ভিড়! একটা বাস ছেড়ে দিয়ে পরেরটাই এলাম’।
‘এটা তো কলকাতা নয়, যে ঘন ঘন বাস চলবে। যাকগে কি খাবি বল? আজ মাংস আনায়নি, ইলিশ আনিয়েছি। ভাপা ইলিশ খাবি না ঝোল’?
‘মা তোমার সব রান্নাই ভালো লাগে। তুমি যাই রান্না করো আমার কাছে অমৃত হয়ে যায়’।
‘তোকে আর বাড়িয়ে বলতে হবে না, এই সব ফুল ঝুড়ি কথা তোর বউ কে শোনাবি খুশি হবে। কী রে কাউকে পছন্দ করেছিস নাকি? আগে থেকে বল, বাড়ীতেও দুএকজন আসছে’।
‘না আমি কাউকে কথা দিই নি, তবে তুমিও এখন কাউকে কিছু বোলো না। সামনের দুবছর আমি বিয়ে করব না’।
‘সেতো ঠিকই, আগে একটা চাকরী জোগাড় কর তারপর তো বিয়ে। চল খেয়ে নিবি কখন সেই ট্রেন এ চেপেছিস’।
মাস চারেক পর রাত্রি তখন ৯টা হবে, নীলুর ফোন এলো।
‘মা কেমন আছ’? ‘ভালো। তুই কেমন? নতুন কোন খবর আছে নাকি’?
‘হ্যাঁ ওই জন্যই তো তোমাকে ফোন করলাম’।
‘ও তাই! কোথাও চাকরী পেয়েছিস? কলকাতা না কলকাতার বাইরে’?
একেবারে দেশের বাইরে, তবে চাকরী নয়, পোষ্ট ডক্টরেটে যাচ্ছি, ইউ এস এ এর একটা ইউনিভার্সিটিতে’।
‘দেশে কোথাও কিছু পেলি না? না মা, আমি যে ফিল্ডের উপর কাজ করেছি, দেশে সুযোগ খুব কম’।
‘হুম’। কবে যাবি’?
‘সামনের দু মাসের মধ্যেই যেতে বলেছে’।
‘বাড়ী কবে আসছিস’?
‘খুব তাড়াতাড়ি আসব। যাবার আগে কয়েকদিন বাড়ীতে থেকে থাকব’।
ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মা হওয়ার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতাম ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করব। আজ যখন নিজের প্রতিভা পরিশ্রমে যোগ্য হয়ে উঠেছে তখন আমারই তো সব চেয়ে বেশি খুশি হওয়া উচিৎ । কিন্তু মনটা যেন কেমন উদাস হয়ে যাচ্ছে! বুকের ভিতরে একটা চিনচিনে ব্যথা আর চোখে জল চলে আসছে।একটা সময় রবীন্দ্র রচনা সমগ্র নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছি । এখন মনে হচ্ছে বেকার সাহিত্য চর্চা। তিনি যদি সাহিত্য চর্চা না করে বিজ্ঞানের কথা ভাবতেন! আমাদের দেশ যদি অনেক উন্নতি করত তাহলে আমার ছেলেকে তো দেশ ছাড়তে হতো না। সারা রাত নানা রকম দুঃসচিন্তা করে ভোরের দিকে সেই রবীন্দ্রনাথের বলাই এর কথা মনে পড়ল। মানুষের জীবনে কিছু দুঃখ থাকে যা সম্পূর্ণ তা নিজের। এটাকে কাউকে বোঝানোও যায়না ভাগ করাও যায় না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী সুন্দর উপস্থাপন করেছেন।

২৬ জুলাই - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪