এম.বি.বি.এস এ যখন চান্স পেলাম না তখন সত্যি মনটা খারাপ হয়েগিয়েছিল। তারপর উচ্চমাধ্যমিকের মার্কসটা ঠিকঠাক থাকায় সাঁইথিয়ায় হোমিওপ্যাথি কলেজে চান্স পেলাম। বাড়ির সবার মনটা একটু খারাপ, একে তো এতোটা দূর কলকাতা থেকে তারপর আবার হোমিওপ্যাথি ডাক্তার! আমি এল্গিন রদে ডাঃ মজুমদারের নাম বললাম, কত দুর-দুরন্ত থেকে তার কাছে আসে, সবাই তো তাঁর দেখও পান না! আমার ভর্তির তারিখ পড়ল তেরোই সেপ্টামবর। মা একবার জিজ্ঞেস করল আর কোন ডেট নেই! মা কে বোঝালাম একবার ডেট মিস করলে পরের ডেটে আমাকে আর নেবে না। যাই হোক ১৩ তারিখে ৬.০৫ এর গণদেবতা এক্সপ্রেস ধরে সাঁইথিয়ায়র দিকে রওনা দিলাম। সাঁইথিয়ায় নেমে নন্দিকেশরী মন্দিরে গেলাম, মা বার বার বলেছিলেন ভর্তির আগে একবার প্রনাম করে আসতে। বেশ সুন্দর মন্দিরটা। মন্দিরের ভিতরে তেমন ভিড় নেই। আমার ভর্তি হতে প্রায় ২টো বেজে গেল। খাওয়াদাওয়া করে যখন হোস্টেলে গেলাম তখন প্রায় ৩টে বেজে গেছে। আমার রুম নাম্বারটাও পড়ল তেরো। আমি ঘরটা পাল্টে দেওয়ার জন্য বললাম, কিন্তু হোস্টেল ম্যানেজার বললেন এই বছরটা চালিয়ে নাও, পরের বছর দেখছি। কি আর করা যাবে ব্যাগ নিয়ে রুমে চলে গেলাম, একটু ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম।
II
ঘুম থেকে উঠতে ৯টা বেজে গেল, খেয়ে নিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। ভোরে উঠেছি , সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি ও করে ছিলাম, বিছানায় শোয়া মাত্রই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত ২টো নাগাদ একবার বাথরুম গেলাম। তারপর থেকে আমার আর ঘুম আসছে না। বিছায়ায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। হটাৎ করে জানলা দিয়ে একটা কালো বিড়াল ঢুকল। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। মিনিট দশেক পরে চোখ খুলে দেখি বিড়ালটা নেই। আমি উঠে তাড়াতাড়ি জানলা টা লাগিয়ে দিলাম। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে বিড়ালটা আবার ফিরে এল। আমি যা! যা! করে তাড়িয়েও দিলাম। কিন্তু বিড়ালটা কোন দিকদিয়ে পালালও সেটা বুঝতে পারলাম না। দরজা-জানলা বন্ধ। তাহলে কি অদৃশ্য হয়ে গেল! আমি কি ভুল দেখেছি! ঘরের টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে রাখলাম। ঘুম কিছুতেই আসছে না, জোর করে চোখ বন্ধ করে আছি! কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখি লাইট অফ্ ঘর আগের মতোই অন্ধকার। ভাবলাম লোডশেডিং হয়েছে, তারপর খেয়াল হল কারেন্ট চলে গেলে ফ্যান কেমন করে ঘুরছে! তাহলে কি টিউবটা ফিউজ হয়ে গেল! ফ্যান ফুল স্প্রিডে ঘুরছে তবুও আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, চাদরটা মাথা পর্যন্ত ঢেকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম, সকালে ঘুম ভাঙলো তখন ৯টা বেজে গেছে। উঠেই দেখি টিউবটা জ্বলছে। নীচে গিয়ে ম্যানেজারকে বললাম টিউবটার প্রবলেম আছে পাল্টে দিতে।
“পাল্টেও কোন লাভ নেই, এর আগে অনেক বার পাল্টেছি, ভোল্টেজ আপ-ডাউন করলে মাঝে মধ্যে এই রকম সমস্যা হবে” ম্যানেজার বলল।
“এখানে কি বিড়ালের উপদ্রব আছে”?
“তেমন বেশি নয়, দুএকটা আছে রান্না ঘরের চারপাশেই ঘুরে বেড়াই, তবে উপরে ওঠে না”।
কার্নিশ বেড়াল দু-তলায় উঠতে পারবে না, পাশে প্রাচীর বা কোনও অন্য বাড়ী নেই। তাহলে আমি কি ভুল দেখলাম! মনের ভেতরে একটা কিন্তু থেকেই গেল! ম্যানেজার কে আবার অনুরোধ করলাম রুমটা পাল্টে দিতে।
“এখনই সম্ভব নয়, এতো ভয় পেলে চলবে, ডাক্তারি পড়তে এসেছ, দু-দিন পরে মরা মানুষ কাঁটবে”! ম্যানেজার একটু ব্যঙ্গ করে বলল।
বুঝতে পারলাম একটু বেশি নার্ভাস হয়ে গেছি, একটু সামলে নিয়ে বললাম, ‘ঘরটাতে আলো বাতাস একটু কম ঢোঁকে তো তাই বলছিলাম।
III
মনে মনে স্থির করলাম এরপর এই রকম ঘটনা ঘটলে হোস্টেল ছেড়ে দেবো। সিনিয়ার দাদা-দের সাথে পরিচয় হল। তারাই মহালয়ের আগের দিন খাওয়ানোর দায়িত্ব নিল। খাওয়া হয়ে গেলে রামুদার সাথে গল্প করছিলাম। রামুদা এই হোস্টেলে প্রথম থেকেই আছেন। খুব ভালো রান্না করেন।
“এই হোস্টেলে তো র্যাদগিং হয় না, বেশ ভালো, আমি তো আসার আগে শুনেছিলাম মেডিক্যাল কলেজে খুব র্যােগিং হয়”। আমি রামুদা কে জিজ্ঞেস করলাম।
“বছর তিনেক আগে পর্যন্ত একটু আধটু হতো... এটা বলেই রামুদা থেমে গেল।
“মানে আগে হতো এখন হয় না? কিছু হয়েছিল রামুদা”?
“সে অনেক কথা অন্য একদিন বলব”।
“না রামুদা আজই বল না”। আমি অনুরোধ করলাম।
রামুদা বলতে শুরু করল, “তিন বছর আগে সুমন রায় নামে একটা ছেলে আসে। একদিন থার্ড ইয়ারের একটা ছেলে সুমনকে খুব বিরক্ত করছিল। সুমন রেগে গিয়ে এক চড় মারে। ও একটুতেই খুব রেগে যেত। সিনিয়ার ছেলেরা মিলে সুমনের বিচার করে! বিচারে ঠিক হয় অমাব্যসার রাতে সুমনকে হানাবাড়িতে গিয়ে একটা পাথরের উপর নিজের নাম লিখে আসতে হবে। মহালয়ার আগের দিন এই রকমই খাওয়ানোর ব্যবস্থা হল। রাত দুটোর সময় সুমনকে বলা হল হানাবাড়ি যেতে”।
“বাড়িটার নাম হানাবাড়ি কেন”? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“কুন্ডলার জমিদারদের আগে বাগানবাড়ি ছিল। জমিদারী চলে যাবার পর বাড়িটা এমনি পড়ে থাকে দীর্ঘ দিন। শোনা যায় স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিপ্লবীরা কখনও কখনও লুকিয়ে থাকত। আরও অনেক পরে নামকরা ডাকাতদের আস্তানা ছিল। দীর্ঘদিন পরিচর্যার অভাবে পুরো বাড়িটাই ভেঙে পড়ে। এমনিতেই বাড়িটা জঙ্গলের মধ্যে ছিল। এখনতো বাড়িটার ভিতরেই জঙ্গল হয়ে গেছে। জমিদারের বিরুদ্ধে যারা গিয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কিছুজন কে মেরে ঐ বাগানবাড়ীতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। এই হচ্ছে বাড়িটার ইতিহাস, তবে বাড়িটার নাম কে হানাবাড়ি দিয়েছে সেটা জানা নেই। এখন দিনের বেলাতেও বাড়িটাতে গেলে গা ছম্ ছম্ করে। শুধু মনে হয় কেউ যেন দেখছে”! যদিও আমি ভুত প্রেত মানিনা তাও আমার গলাটা একটু শুকিয়ে এলো। আমি আস্তে আস্তে বললাম, “সুমনদা কি গিয়েছিল”?
“না গিয়ে আর উপায় কী? আমি ওদের বারণ করলাম ওকে একা পাঠিয়ো না, কিছু অঘটন ঘটে যেতে পারে! কিন্তু কে কার কথা শোনে? ওরা বলল ডাক্তারি পড়তে এসেছে ভূতপ্রেতের ভয় পেলে চলবে! তাছাড়া সুমন সিনিয়ারের গায়ে হাত তুলেছে একটু তো শাস্তি পেতেই হবে”। রামুদা একটু থামল।
“মুখটা শুকিয়ে গেছিল বেচারার”!
‘রামুদা ছোটো থেকেই আমার ভূতের ভয়, ‘তুমি একটু যাবে আমার সাথে’ সুমন কাঁপা গলায় বলল।
“তুমি একটু এগিয়ে যাও তারপর আমি যাচ্ছি, তোমার সাথে এখন গেলে ওরা জানতে পারবে”।
সুমন চলে যাবার ১০ মিনিট পরে আমি আস্তে আস্তে হানাবাড়ির দিকে রওনা দিলাম। হানাবাড়ির সামনেই ময়ূরাক্ষী নদী বয়ে গিয়েছে। নদীর ধারে কাশফুলের গাছ। শরৎ-এর প্রায় শেষ, গায়ে একটু একটু ঠাণ্ডা হাওয়া লাগছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে হানাবাড়ির দূরত্ব খুব বেশি হলে ১০০ মিটার হবে। ভিতরে ঢুকতে কেমন কেমন লাগছে। আগে যে রাত্রি বেলায় হানাবাড়ি যায়নি তা নয়, তবে আজ যেন মন সায় দিচ্ছে না। আগে বয়স অল্প ছিল রক্তের তেজও ছিল, তারপর আজ আবার অমাবশ্যার রাত! বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন সুমন ফিরে এল না তখন মনটা অস্থির হয়ে উঠল। বাড়ী ফিরেও যেতে পারছি না আবার ভিতরে যেতেও... ।এভাবেই আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল, রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে, সময় তখন ৩টে সাড়ে ৩টে হবে, মায়ের নাম করে ভিতরে ঢুকলাম। চারিদিকে অন্ধকার ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, আমি জোরে জোরে সুমন! সুমন! করে চিৎকার করতে লাগলাম। বেশ কয়েকবার ডাকার পরও যখন কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না তখন মনে হল ও নিশ্চয় অন্য রাস্তা দিয়ে হোস্টেলে ফিরে গেছে! আমি আর জঙ্গলের মধ্যে না থেকে ফেরার মনঃস্থির করলাম। দু-পা এগোতেই, একটা হাত আমার পায়ে লাগল। তৎক্ষণাৎ টর্চের আলো জ্বাললাম সেই মুহূর্তে একটা দমকা হাওয়া আমার পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল। টর্চের আলো মুখে পড়তেই বুঝতে পারলাম, ‘সুমন’। এতক্ষণ যেন কেউ ওকে আগলে ছিল! আমি এই বুড়ো বয়সেই ওকে দু-হাতে তুলে হোস্টেলে নিয়ে এলাম। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার বলল, ‘হৃত রোগে মারা গেছে’।
“ সুমনদা কি নিজের নামটা লিখেছিল”? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ। তোমাকে একদিন নিয়ে যাবো! তারপর থেকেই অমাবশ্যার রাত্রে সুমনের আত্মা হোস্টেলে ঘোড়া ফেরা করে। আমি বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছি কিন্তু ও কারো ক্ষতি করে না”।
রাতে ঘুম আস্তে একটু দেরি হল, সেদিন আর কোনও ঘটনা ঘটেনি। দু-দিন পর পুজোর ছুটিতে বাড়ী চলে এলাম।
IV
এর পর তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এখন হোস্টেলে আমি সিনিয়ার। তেরো নম্বর রুমটাও পাল্টে নিয়েছি। কয়েকদিন ধরে রামুদা আসছে না হোস্টেলে। আজ আবার মহালয়ার আগের দিন, রাত্রে খাওয়া দাওয়ার তোর জোর শুরু হয়েছে। আমার দায়িত্ব মাংস কেনার। আমি এক ফাস্ট-ইয়ারের এক ছেলেকে নিয়ে মাংস কিনতে গেলাম। দোকানদার আমার পূর্ব পরিচিত। আমি রামুদার বাড়ী জিজ্ঞেস করাতেই বলল, কাছেই বাড়ী এখান থেকে ১০ মিনিট লাগবে। আমি মাংসটা জুনিয়ার ছেলেটা কে দিয়ে রামুদার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। রাত্রি ৯টা বাজছে। একবার মনে হল হোস্টেলে ফিরে যাই। ভাবলাম রান্না হতে তো ১২টা বেজে যাবে একবার ঘুরেই আসি! আমি দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে রামুদার গ্রাম ভবানিপুরের রাস্তায় নামলাম। গ্রামে মোড়াম দেওয়া রাস্তা, পোস্টে কোন আলো নেই! গ্রামে এমনিতেই গাছপালা বেশি তারপর আজ অমাবশ্যা। আমার সামনে ১০ফুট দূরে কে আছে দেখা যাচ্ছে না! ভাগ্যিস পকেটে ছোটো টর্চটা ছিল। হটাৎ করে একজন আমার নাম ধরে ডাকল, কে ওখানে? মিঠুন না? আমি একটু ভয় পেয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ। আপনি’?
“আমি রামু”।
“ও রামুদা তোমার খোঁজ নিতেই তো যাচ্ছিলাম। ভালই হল দেখা হয়ে গেল”। রামুদার গায়ে একটা লাল রঙের চাদর। চাদরটা মাথা পর্যন্ত ঢাকা।
“এখনও তো তেমন শীত পড়েনি শরীর কি খুব খারাপ? গায়ে চাদর নিয়েছ”?
“ওই র কি কয়েকদিন ধরে যা ভুগলাম’।
“ঠিক আছে তুমি বাড়ী যাও আমিও হোস্টেলে ফিরে যাই”।
“চলো তোমাকে একটু এগিয়ে দিই, যা অন্ধকার রাস্তা ভুল হয়ে যেতে পারে”!
কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর রামুদা বলল, “মনে পড়ে তিন বছর আগে এই মহালয়ার আগের দিন রাতে সুমনের গল্প শুনে কেমন ভয় পেয়ে গেছিলে? এখনও ভূতের ভয় আছে নাকি”?
“ভূত প্রেত বলে তো মেডিক্যাল সাইন্স মানে না, সবই তো মনের ভয়”। আমি বললাম।
“তাহলে আজকে একবার যাবে হানাবাড়ি? এখনও ওখানে সুমনের আত্মা ঘোড়া ফেরা করে”!
“রামুদা কি যে বল না! আত্মা বলে কিছু নেই, আচ্ছা আজকে একবার দেখেই আসি সুমনদার আত্মা কে”।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছি, পাশেই ময়ূরাক্ষী নদীর বাঁধ, নদীর অপারেই আমাদের কলেজ। জঙ্গলের ভিতরে খুব বেশি কথা বলছি না। আমার সুমনদার কথা মনে পড়ল। হটাৎ করে হৃত- রোগে আক্রান্ত হয়ে ছিল। হটাৎ করে রক্ত চাপ বেড়ে গেলে এটা হয়। সুমনদা কি কিছু দেখে ছিল? হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেই পাথরটার কাছে চলে এসেছি। এবার রামুদা ভাঙা গলায় বলল, ‘এই পাথর টাতেই সুমন নাম লিখেছিল’। টর্চ মারতেই দেখি লেখা আছে ‘সুমন রায়’। আমি সুমনদাকে দেখি নি কিন্তু মনে হচ্ছে, সুমনদা আমার আসে পাশেই আছে। আমি রামুদা রামুদা করে চিৎকার করে উঠলাম। অন্ধকারে আমি রামুদার মুখটা ঠিক দেখতে পায়নি। টর্চ মারতেই দেখি লাল রঙের চাদরটা ঝুলছে আর কেউ নেই! এরপর আমার আর কিছু মনে নেই যখন চোখ খুললাম দেখি সাঁইথিয়া হাসপাতালে ভর্তি আছি। হোস্টেলে ছেলেরা সেই রাতেই আমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসে। হাসপাতালের বেডেই জানতে পারলাম রামুদা দুদিন আগেই মারা গিয়েছে।