রূপকথার জন্য মেঘবালিকা

আঁধার (অক্টোবর ২০১৭)

বিনায়ক চক্রবর্তী
  • ১৫
বেশ কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছে কথাটা। ...যে, আমি আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছি।

'আমি' মানে একটি মেয়ে, যার বয়স একুশ বছর। যার নাম, ধরা যাক --- মেঘবালিকা? আমার বন্ধুরা অবশ্য আমায় 'ডিপ্রেশন' বলে ডাকে। 'বন্ধু' শব্দটা লিখতে গিয়ে বাড়তি ক'সেকেন্ড সময় নিলাম কি? তা নিই, ওরা আমার বন্ধুই। যেদিন আমায় হস্টেল থেকে ছাড়িয়ে এখানে নিয়ে আসা হল, সেদিন কি কম কষ্ট পেয়েছিল ওরা? দেখেশুনে আমি তো - হাঁ! ওরাও যে অমন ছিঁচকাঁদুনে হতে পারে তা জেনে অবশ্য মজাই লাগছিল একপ্রকার!

সত্যি বলতে কী, আমায় পাগলাগারদে পাঠানো হবে শুনে প্রথমটায় যত না হতভম্ব হয়ছিলাম, তার চাইতে ভয় পেয়েছিলাম কয়েকশো গুন বেশি। ঠাট্টার ভয়। নাদিয়া আজিজা অভিনন্দা অলিভিয়া-রা এমন খোরাকের সন্ধান পেলে কী আওয়াজটাই না দেবে আমায়!

অথচ ফোনের ওপাশে বাবা এমন নির্লিপ্তি নিয়ে কথাটা জানিয়েছিলেন যেন --- "তৈরি থেকো তাহলে, কাল আমরা পিকনিকে যাচ্ছি কিন্তু!"

আমার গলা চোক করছিল। ভুলেও ভাববেন না যেন আমি কাঁদছিলাম! সেরকম নরম লুতুপুতু মনের মেয়েই নই আমি। পুরো তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে বসেছিলাম। আসলে, কথাটা ধরতে একটু সময় লেগেছিল আমার। তারপর শান্ত স্বরেই বলেছিলাম, "গরমের ছুটিটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে হয়না বাবা? আমি বাড়ি গেলে তারপরেই না হয়..."

ওপারের মানুষটা নির্বিকার ভাবে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। লোকটা আসলে এরকমই।

আমি কত করে বলেছিলাম এই কলেজটায় ভর্তি হব না। ইঞ্জিনিয়ারিং মাথাতেই ঢোকে না আমার। শুনলে তো? বাবা চোখ পাকিয়ে উত্তর দিয়েছিল,

- "তাই বলে তুমি কোনো গেঁয়ো কলেজে বাংলা অনার্স পড়বে নাকি? লোকজনের কাছে বাপ-মাকে আর কতখানি বেইজ্জত করলে শান্তি হবে তোমার?"

আমি ভারী লজ্জিত হই। সত্যিই তো।

আমার বাবা, সংবাদ-পত্রের ভাষায় - খুব বড় মাপের একজন বিজনেস ম্যাগনেট। বাড়িতে মন্ত্রী-আমলাদের আনাগোনা লেগেই আছে। আর মা'র কথা তো ছেড়েই দিলাম। মাকে সারাক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। অনেকগুলো উইমেন'স লিব সোসাইটির সম্পাদিকার দায়িত্ব। তাছাড়া, সারাবছরই পার্টি। আমার মা খুব ভালো হোস্টেস কিনা।

উফফ্‌! দিনুকাকা না থাকলে যে কী হত আমার! দিনুকাকাই নিজের হাতে আমাকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়েছে। সরকারি স্কুল। অবৈতনিক। বাংলা মিডিয়াম। সেইজন্যেই কি না ঠিক জানি না, ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের একটুও সহ্য হয় না আমার। ওই নাকউঁচু ডাঁট, ওই মিথ্যে ভড়ং, ওই ফাঁপা কথাবার্তা --- না, একদম না। এখানে চুপিচুপি একটা কথা আপনাদের জানিয়ে রাখি। কাউকে বলবেন না যেন আবার! আমি যে বাবার পছন্দের ওই প্রাইভেট কলেজে যেতে চাইছিলাম না - তার মূল কারন আসলে এটাই। আমার ভাইকেই দেখেছি তো। রাজধানী শহরের নামজাদা এক প্রাইভেট স্কুলে পড়ে। ছুটিতে যখন বাড়ি আসে, কিছুতেই আমার সাথে মিশতে পারে না! মিশবে কী করে? আমি পাত্তা দিলে তো! ওই অন্তঃসারশূন্য কালচার দিয়ে আমার সাথে গল্প জমানো এতই সহজ? আমার সাথে? যে মাধ্যমিকের আগেই তিন-বাঁড়ুজ্যের রচনা-সমগ্র গুলে খেয়েছে?

ভাই জানিস, তোকেই বলছি রে, ক্ষমা করতে পারবি? তোর এই দিদিটাকে? আমি না আসলে- খুব, খুব হিংসুটে। তার চে' বেশি অহংকারী। আর তার থেকেও ঢের বেশি বোকা একটা মানুষ। জানিস, কলেজে এসে প্রথম প্রথম যখন কারো সাথে মিশতে পারতাম না তখন আমার খুব তোর কথা মনে পড়ত। আমাদের কথা। আমার রুমমেটরা সারাক্ষন আমার মজা ওড়াত। আমার শুদ্ধ বাংলা, আমার ভাঙা ভাঙা ইংরেজি --- এ নিয়ে অষ্টপ্রহর হাসাহাসি। এই যে 'অষ্টপ্রহর' বলে ফেললাম এইটে ওদের কানে গেলে আর দেখতে হত না! তুই নিজেও কি মুখ চেপে হাসছিস না? বুকে হাত দিয়ে বল তো?

ধুর! তালগোল পাকিয়ে ফেলছি সব। কী যেন বলছিলাম? হ্যাঁ। আমি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছি।

এই অ্যাসাইলামটাতে নাকি খাবারের সাথে খুব অল্প করে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। যাতে এখানকার পেশেন্টদের মধ্যে আ-স-তে আ-স-তে মস্তিস্ক-বিকারের লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে। সত্যিকারের লক্ষণ। আপনারা জানেন কিছু? শুনেছেন এ ব্যাপারে?

কেন জানি না, আমার আজকাল এইরকম সব ভাবনাই মাথায় আসে। ভয় করে খুব। মাথাটাও দিনকে দিন কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ছে। পুরানো কিছু মনে করতে গেলেই খুব কষ্ট হয়। রোজ সকালে একটা খবরের কাগজ দিয়ে যায় আমাদের। সেটা পড়তেও ইচ্ছে করে না আমার। আমি সারাদিন শুধু একটা ফোটো অ্যালবামের পাতা উল্টে যাই। আমার ছোটবেলার। যদিও আমার একটাও ছবি নেই এখানে। দেখবেন? এই দেখুন, ওরা প্যারিস বেড়াতে গিয়েছিল। বাবা ভাইকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন --- এই যে। পাশে যে অপরূপ সুন্দরী ভদ্রমহিলা হেসে কুটিকুটি --- উনি কিন্তু কোন বিদেশিনী নন। আমার মা। কী ফর্সা, তাই না?

বাবা আসলে ভাইকে খুব ভালবাসেন। কথায় কথায় বকা দেন না।

বাবা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? এখানে আমার একদম ভাল্লাগে না। সারাদিন একলাটি বসে থাকতে হয়। এখানে যে গল্প করার জন্য অভিনন্দা অলিভিয়া-রা নেই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি আমায় বাড়ি নিয়ে যেতে কবে আসবে? তুমি কি আমাকে একটুও ভালবাস না বাবা?

আচ্ছা, কালো মানুষরাও কেন কালোদের এত ঘৃণা করে বলতে পারেন?






আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এশরার লতিফ ভালো লেগেছে গল্পটা। লেখার হাত যে সাবলীল ও পরিপক্ক তার আঁচ সহজেই পাওয়া যায়।
এখানে, আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে আপনি একজন। ফলে আপনার থেকে এ-রকম মন্তব্য, আমার জন্য সত্যিই উৎসাহব্যঞ্জক। :)
মোঃ মোখলেছুর রহমান নিজেকে গল্পে কচি খোকাই মনে হয়, ভাল বলা ছাড়া কোন উপায় নেই। শুভকামনা রইল ।
সেলিনা ইসলাম বেশ গভীরত্ব আছে গল্পে। পাঠককে অনেককিছুই ভাবতে বাধ্য করেছে। শেষের প্রশ্নটাই যেন পুরো গল্পের সারমর্ম। কোন এক লেখায় পড়েছিলাম-'মানুষের রক্ত মানুষে খায়,খেয়ে রং বদলায়!'গল্পে যেন কথাটার প্রভাব আছে। গল্পের থিম অনেক ভালো। তবে গল্পটা আরও কিছুটা সহজ করে লিখলে পাঠকের বুঝতে সহজ হত। গল্প বেশ চিন্তার খোরাক দিয়েছে! কিন্তু পাঠকের এত সময় কোথায় মাথা খাটাবার! ভাবনার ডালপালা সময়কে বেশিক্ষণ আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়নি,পাছে মেঘবালিকার মত অবস্থা হয় যদি। শুভকামনা রইল।
একদমই তাই। শেষ লাইনটা পড়ার পর ফিরে পড়লে বা একটু ভাবলেই পুরো গল্পটার সাথে কানেক্ট করতে খুব একটা অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। :)
সুস্মিতা সরকার মৈত্র গল্পের বিষয়বস্তু যতটা ভালো লাগলো, গল্পটা ততটা নয়। কে জানে, হয়তো গোল গল্পের পাঠক আমি, তাই! গল্পটা যেন আরেকটু গুছিয়ে লেখা যায়। গল্পের মূল চরিত্রের অপ্রকৃতস্থার কারণে গল্প অগোছালো হবে, এটা হয়তো নিতে পারলাম না। আর, একদম শেষে মনে হল আর একটু বিস্তার হতে পারতো। মতামত কিন্তু একান্তই ব্যক্তিগত। কিছু মনে করো না প্লিজ। আর এই প্লিজ লিখে মনে হল, 'চোক' শব্দটা খুব বেমানান লাগছে না, তবে 'দমবন্ধ' লিখলেও বেমানান হতো কি?
উম, ২০১৭-তেই 'প্লিজ' আর 'চোক'-কে এক সারিতে বসানো উচিৎ হবে কি? প্রথমটা আমাদের মুখের বা লেখার কথায় যতখানি অপরিহার্য, বলা ভালো- প্রচলিত হয়ে উঠেছে, দ্বিতীয়টা বোধহয় ততখানি নয়। তাছাড়া বাংলা মাধ্যমের কোন ছাত্রছাত্রীকেও আমি ও-কথাটা হুটহাট ব্যবহার করতে শুনিনি। এটা গেল একটা। দ্বিতীয়ত, "কিছু মনে করো না, অনুরোধ রইল।" আর "কিছু মনে করো না, কেমন?"--আপনার মন্তব্যের নিরিখে এ-দুটোর মধ্যে যে পার্থক্য দাঁড়াবে, সেটাই গল্পটার ন্যারেটিভের নিরিখে 'দমবন্ধ' আর 'ঢোক গেলার' মধ্যে থাকবে বলে আমার মনে হয়। এই মনে হওয়াটা অবশ্য প্রবলভাবেই আপেক্ষিক। মানে, অন্য কেউ গল্পটা লিখলে তাঁর বিবেচনা অন্যরকম হতেই পারে। বাকিটা আর কী! ভাবলাম, কোথায় বেশ বাহবা টাহবা দেবেন--একটু পরাবাস্তব এলিমেন্ট মেশালেই প্পুরো কাফকা! :p তা না। উল্টে...! যান যান। ফেলেই দেবো ভাবছি গল্পটা। :(
মোঃ আক্তারুজ্জামান আপনি খুব ভালো লেখেন। বর্ণনাভঙ্গি খুবই চমৎকার। কিন্তু আমার মনে হয় এই গল্পের মূল বক্তব্যটা খোলাসা হয়ে ধরা দেয়নি। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ। :) হ্যাঁ। গল্পটা পরে একসময় মেরামত করার ইচ্ছে রইল।
মোঃ নিজাম গাজী দারুন লেখনী। ভোট রেখে গেলাম। আমার পাতায় আমন্ত্রণ।
কাজী জাহাঙ্গীর বাব্বাহ, বেশ বোদ্ধা বোদ্ধা লেখকের সাহচর্য্যে এসে বুঝনতে পারছি আসলে আমি কত কাঁচা। মাথাতে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। ‘বেশ ডিপ থট এর লেখা’ এটুকু বলে বিদায় নিলেই যেন বাঁচি। অনেক শুভকামনা থাকল। এমন চিন্তার খোরাক দেওয়ার জন্য । ভাল থাকুন।
ধন্যবাদ। :) লেখক অনেক কিছু জানতেই পারেন। জানাটা উচিৎও। কিন্তু লেখায় যদি গভীর পাণ্ডিত্য জাতীয় কিছুর ছাপ থেকে যায় তবে তিনি ব্যর্থই। :(
মনজুরুল ইসলাম simple and organized description. Felt not a single pressure to read.Theme is extra-ordinary. you could enhance the story. overall nice.good luck.
ধন্যবাদ। :) আচ্ছা, আপনার পরামর্শ মাথায় রাখব। :)
সাইফুল বাতেন টিটো ভালো লেগেছে। শুভকামনা।
ফেরদৌস আলম মেঘবালিকা তো বেশ লাগলো দাদা। আপনার লেখার হাত সত্যিই অনেক শক্তিশালী। সামনে অনেক বড় কিছু হয়তো করবেন-সেই শুভকামনা ও প্রত্যশাও রাখছি।
হ্যাঁ, চেষ্টা করতে দোষ কী! অনেক ধন্যবাদ ফেরদৌস দা। :)

০৩ জুন - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪