কামনার সাতরং

কামনা (আগষ্ট ২০১৭)

শৈলেন রায়
  • ২৩
রাস্তার এপাশে দাঁড়িয়ে ভাবছে শৈলেন রায়, ঐপাশে যাবে কিনা। ঐপাশের এলাকাটা, সহজ বাংলায় যাকে বলে বেশ্যাখানা, শুদ্ধ বাংলায় পতিতালয়। শৈলেন এর আজ মন ভালো নেই, কিন্তু পতিতালয়ে যাওয়ার পেছনে কারন সেটা না। এইখানে যে মেয়েগুলো থাকে, তাদের জীবনটা শৈলেনের কাছে একটা রহস্য মনে হয়। এই মেয়েগুলো, নিজের শরীর ঘন্টার জন্য তুলে দিচ্ছে কারো হাতে, আজ এর হাতে, কাল ওর হাতে। প্রতিদিন নতুন নতুন মানূষ, নতুন নতুন অত্যাচার। এরপর রংচঙ্গে সাজ দিয়ে আবার দাঁড়িয়ে থাকে নতুন খদ্দরের আশায়। এদের মনের মাঝে কি চলে? খুব জানতে ইচ্ছে করে শৈলেনের । কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়না, কারন সমাজের চোখে সে ভদ্রলোকের ছেলে। সে চার দেওয়ালের মাঝে কোন মেয়ের কাছে নিজের শরীরের চাহিদা পুরন করতে পারে, কেউ কিছুই বলবে না। কিন্তু পতিতালয় নামের এই জায়গাটাতে যখন সেই একই চাহিদা পয়সা দিয়ে পূরন করতে যাবে, তখন সেটা সমাজের চোখে অনেক বড় অপরাধ। একই দৃশ্য যখন সাজানো ডিষ্টেম্পার করা ঘরের মাঝে চিত্রায়িত হচ্ছে, তখন শারীরিক ক্ষুধা, আর সেটাই যখন বেশ্যালয় নামের প্রতিষ্টানে প্রাতিষ্টানিক ভাবে চিত্রায়ত হচ্ছে, তখন সেটা মহা সামাজিক অপরাধ।
আজ আর দ্বিধা দন্দে ভুগছে না শৈলেন। সোজা গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। দুই পাশে সারি সারি চাটাই দিয়ে তৈরী ঘর। কিছু ঘরের সামনে কড়া রঙ এর সাজ দিয়ে কতোগুলো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ঘরের দরজা বন্ধ। দুইপাশে তাকিয়ে হাঁটতে থাকলো শৈলেন। সে আসলে জানে না সে কি চায়। হটাৎ একটা লুঙ্গি পড়া লোক এগিয়ে এলো। তার কথা শুনে বুঝলো ভদ্র ভাষায় সে একজন এজেন্ট, বাংলায় মাগীর দালাল। তার কথার কিছুই শৈলেনের কানে যাচ্ছে না, সে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। লোকটা তার কাছে টাকা চাইলো, সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিলো। লোকটা তাকে টেনে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। হাতের মধ্যে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে গেলো। একটা প্যাকেট। একটাতে রয়েছে জন্মনিরোধক,। ঘরের এক কোনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শৈলেন। চারপাশে জীবনের অনেক চিহ্ন ছিটিয়ে রয়েছে। একটা আলনায় কিছু জামা কাপড়। এক কোনে একটা ছোট টেবিল, তার ওপরে একটা আয়না, সস্তা দামের কিছু কসমেটিকস। খুব কড়া রঙ এর লিপিষ্টিক, চুলে বাঁধা ফিতে। এসব দেখতে দেখতেই ঘরের দরজা খুলে গেলো। একটা মেয়ে ঘরে ঢুকলো। দেখেই বুঝলো শৈলেন, একেই টাকা দিয়ে কিছুক্ষনের জন্য অর্জন করে নিয়েছে সে।
মেয়েটাকে দেখে বয়স আন্দাজ করার উপায় নেই। চেহারা আর চলাফেরা দেখে মনে হয় ১৯-২০’র বেশি হবে না। কিন্তু কথা শুনে মনে হয় জীবনের অনেক বড় একটা অংশ অনেক কম বয়সেই দেখে ফেলেছে সে। শৈলেনের দিকে এগিয়ে এলো মেয়েটা ধিরে পায়ে। সে জানে এই লোকটার হাতে তার নিজেকে সঁপে দিয়ে হবে কিছুক্ষনের জন্য। তবে শৈলেন তাকে এড়িয়ে দরজার দিকে যাচ্ছিলো। পেছন থেকে মেয়েটা তার হাত টেনে ধরলো।
চলে যাচ্ছেন যে?
মেয়েটার কথা শুনেই তমাল বুঝলো, মেয়েটা পড়ালেখা করেছে। শুদ্ধ ভাবে বাংলা বলছে। ভদ্র ঘরের মেয়ে। সেই সাথেই একগাদা প্রশ্ন উঁকি দিলো শৈলেনের মনে।
আমি চলে যাচ্ছি।
যাবেন না প্লিজ। আপনি এখনি বের হয়ে গেলে মনসুর আমাকে টাকা দেবে না।
মনসুর?
যে আপনার কাছ থেকে টাকা নিলো। সে এখানকার দালাল। আপনি বের হয়ে যাওয়ার অর্থ আপনাকে আমি ঠিকমতো আনন্দ দিতে পারিনি। এরপর সে আমাকে আর ভালো কোন কাষ্টোমার এনে দেবে না। প্লিজ, চলে যাবেন না। আপনি টাকা দিয়ে আমাকে কিনে নিয়েছেন এক ঘন্টার জন্য। আপনার চাহিদা পূরন করে যান।
আমার কোন চাহিদা নেই তোমার কাছে।
তাহলে এখানে কেন আপনি? এটা ভালো যায়গা নয়। এখানে যারা আসে, তারা চাহিদা পূরনের জন্যই আসে।
আমি তো বললাম, আমার কোন চাহিদা নেই।
নেই ঠিকাছে। কিছুক্ষন বসুন। এরপর বের হয়ে যাবেন।
এগিয়ে গিয়ে বিছানার এক কোনে বসলো শৈলেন। এতোক্ষনে মেয়েটাকে ভালো করে লক্ষ করলো শৈলেন। চেহারায় একটা লাবন্য আছে, বা বলা চলে যেটুকু বাকি আছে। কোন শিক্ষিত ফ্যামেলীর মেয়ে বোঝাই যাচ্ছে।
নাম কি তোমার?
সুমি।
আমি সর্বজ্ঞানী না হলেও এতোটুকু নিশ্চিত বলতে পারি, সুমি তোমার আসল নাম নয়।
না নয়, তবে সেটা গুরুত্বপূর্ন নয়। গুরুত্বপূর্ন হলো, আমি সুমি নামেই পরিচিত এবং আমি একজন বেশ্যা !
তোমার কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে তুমি পড়ালেখা করেছ। এখানে কিভাবে এলে?
দেখুন, আপনি টাকা দিয়েছেন আমার দেহের জন্য। আমি কে কি, সেটার সাথে আপনার কোন দরকার নেই।
আমি টাকা দিয়েছি তোমার জন্য, মানে তোমাকে আমি এক ঘন্টার জন্য কিনে নিয়েছি। আমি তোমার দেহ দিয়ে স্বাদ মেটাবো নাকি গালগপ্পো করবো, সেটা আমার ব্যাপার।
তাতো বটেই। আমি তো একজন বেশ্যা, আমাকে শুতে বললে শুতে হবে, গল্প করতে বললে গল্প করতে হবে।
এভাবে না নিলেও চলে ব্যাপারটা। তুমিও একজন মানুষ।
হয় আপনি অনেক বড় একজন গাধা, নয়তো বিশাল বড় মিথ্যেবাদী। মানুষত্য টাইপের জিনিস এই বেশ্যালয়ের দেওয়ালের বাহিরের জিনিস। এর ভেতরে শুধু টাকা, দেহ আর মৃত মানূষের কারবার।
সত্যিকথা বলো, তুমি কে?
আমি? আমার আসল নাম রেহানা। লালমনির হাট সরকারী কলেজের ছাত্রী ছিলাম। একদিন প্রাইভেট শেষ করে বাসায় ফেরার সময় কয়েকজন অতিরিক্ত ভালো মানব সন্তান আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এরপর তিন দিন রাত ধরে তারা আমার অনেক আদরযত্ন করে। বেশি আদরযত্নের ঠেলায় মরতে বসেছিলাম। মেডিকেল এর সামনে ফেলে যায়। তাদের আদর যত্নে গায়ে কাপড় ছিলো না। তাই এক ডাক্তার চেকাপ এর সময় আবার খানিকটা আদর যত্ন করলেন। বললেন কাউকে যাতে তার আদরের কথা না বলি। বললে সে আমার স্যালাইন এ বিষ মিশিয়ে দেবে। বাবা মা আসলেন অনেক পরে খবর পেয়ে। এর মধ্যে অনেকেই আদর যত্ন করার চেষ্টা করলেন, পারেনি। কোর্টে কেস হলো, প্রতিদিন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমাকে বর্ননা দিয়ে হতো সেই তিন রাতের। প্রতিপক্ষের আইনজীবি আমাকে প্রশ্ন দিয়ে খোলা আদালতে ধর্ষন করতেন। আমি শুধু জবাব দিয়ে যেতাম। আমাকে জবাব দিতে হতো, সেই তিন রাত আমি উপভোগ করেছিলাম কিনা? আমার অনেক কথার পরেও সব শেষে প্রতিপক্ষের আইনজীবি প্রমান করার চেষ্টা করলেন, আমি আসলে খারাপ ড্রেস পড়ে ছিলাম। তাই সেই সব ভদ্র মানব সন্তান একটু সমাজ সেবা করেছে।
তারপর?
এরপর আর কি? এই দেশে আপনি দেওয়ালের পেছনে দুইশোজনের সাথে শুলেও আপনি নিজেকে সতি প্রমান করতে পারবেন, খোলা ময়দানে কেউ আপনার ওড়না টান দিলে পরের দিন আপনি আড়ালে আবডালে মাগী শব্দটা শুনতে পাবেন। সবাই আপনার রেট জিজ্ঞেস করবে। রাতে ফ্রী আছেন কিনা জিজ্ঞেস করবে। মামলাটা কোর্টে এখনো ঝুলে আছে। বাসায় এসে অনেকেই আদর যত্ন করার চেষ্টা করলো। প্রতিবেশীরা বললো আমার জন্য তাদের উঠতি বয়সের ভদ্র ছেলেরা খারাপ হয়ে যেতে পারে। রাগে দুঃখে পালিয়ে এলাম। পড়লাম মনসুর এর হাতে। এখানে এনে তুলে দিলো। শেষ পর্যন্ত মাগীই হয়ে গেলাম। এখন কাউকে রেট বলতে হয়না। ঐসব মনসুর সামলায়।
এখান থেকে চলে যেতে পারতে? থেকে গেলে কেন?
আপনি অনেক বড় বোকা। আপনি সেটা জানেন। বেশ্যালয় এর মেয়েদের সমাজে কোন দাম নেই। আপনি সমাজের বড় লোকদের সাথে শুলে আপনাকে সোসাইটি গার্ল বলবে। ছোটলোকদের সাথে শুলে আপনি বেশ্যা হয়ে যাবেন জনাব। বেশ্যাদের বুকে হাত দিয়ে সবাই চায়, কিন্তু বুকে আগলে রাখতে কেউই চায় না।
এখান থেকে যেতে চাও?
কে নিয়ে যাবে? আপনি?
যদি বলি আমি?
বেশ্যাদের কপাল এতোতা ভালো হয়না জনাব। আমার জীবনের গল্প শুনে এখন আপনার হয়তো খারাপ লাগছে, কাল রাতে আমার সাথে শোয়ার সময় ভাববেন, এ তো একটা বেশ্যা। পরশু যখন কেউ আপনাকে বলবেন একজন বেশ্যাকে ঘরে এনে রেখেছেন কেন, তখন ঠিকই জুতা মেরে তাড়িয়ে দেবেন। কিংবা যদিও বা সত্যিই আপনি ভালো মনে আমাকে বের করে নিয়ে যান এখান থেকে, আমি আমার নিজেকে চিনি। আমি শরীর বিক্রি করি। এই শরীরটা এতো বেশি বার বিক্রি করেছি যে, এর ওপর আমার নিজের নিয়ন্ত্রন নেই আর। আমি একটা রোবট এখন।
আমার সাথে যাবে?
না, আপনার সাথে গেলে যদি আমার সামনে অনেক সুন্দর দিন অপেক্ষা করে, তবুও যাবো না। কারন আপনাকে ঠকাতে তো পারবো না। বাজারের মেয়ে হতে পারি, কিন্তু সবাইকে পাওনাটা দিতে জানি। আপনার পাওনা আপনাকে দিতে পারবো না আমি।
আর কোন প্রশ্ন করলো না শৈলেন। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। গেট দিয়ে বের হয়ে গেলো শৈলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলো শৈলেন, সমাজের চেয়ে বড় পতিতালয় আর কোথায় আছে?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
অমিত বাগচী শেষ লাইনটা!!
জসিম উদ্দিন আহমেদ গল্প ভাল লাগল। ভোটসহ শুভেচ্ছা। চালিয়ে যান।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী গল্পটা পড়ে ভালো লেগেছে এ জন্য- যে বড় পতিতালয় আমাদের সমাজ, বেশ্যাদার নয়। শুভেচ্ছা রইল জনাব সে সাথে ভোট ও....
আমার পাতাই আমন্ত্রণ রইল
Bokul একটা সিগারেট ধরিয়ে হাটতে হাটতে ভাবতে লাগলো সে ...... ভালো লেগেছে
শৈলেন রায় ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মন্তব্যর জন্য
মোঃ মোখলেছুর রহমান জীবনের অনেক বড় একটা অংশ অনেক কম বয়সে দেখে ফেলেছে সে, অসাধারন বচন,প্রকাশ ভঙ্গি। ভোটের মাধ্যমে সন্মাননা রইল।

১৪ মে - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪