অপরিচিতা

নববর্ষ (এপ্রিল ২০১৮)

শৈলেন রায়
  • ৩৮
দেউতিরহাট অটো স্টান্ডে.....
একটি মেয়ের দিকে আমি দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে আছি । মেয়েটি সুন্দর বা অন্য কোন কারণ নয় । আমার মনে হচ্ছে মেয়েটিকে আমি চিনি সে আমার পূর্ব পরিচিত কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না মেয়েটি আসলে কে ? সাহস করে যে মেয়েটি কে জিজ্ঞেস করবো সেই উপায় নেই । . হঠাৎ করে মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে আসছে মনে হচ্ছে সে আমাকে চিনতে পেরেছে । নিশ্চয়ই কথা বলবে । .

-- এই যে মিস্টার আমি অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি আপনি আমার দিকে ভ্যাবলা কান্তের মতো তাকিয়ে আছেন, কারণটা জানতে পারি ? . মেয়েটির কথা শুনে আমি আসলেই ভ্যাবলা কান্ত হয়ে গেছি । তার এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলা যায় ভেবে পাচ্ছি না । . -- না মানে আপনাকে আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছিলো, তাই তাকিয়ে ছিলাম । .

-- সব মেয়েদের বুঝি আপনাদের পরিচিত মনে হয় ? কেন ? এমনটা না করলে হয় না ! কই আপনাকে তো পূর্বে আমি কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না । .

-- কিন্তু আমি আপনাকে অবশ্যই দেখেছি । দেখেছি বললে ভুল হবে আপনি আমার বেশ পরিচিত ।

. -- আজকে গাঁজা মনে হয় একটু বেশি খেয়েছেন তা না হলে একটি অপরিচিত মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে গুল মারতে পারতেন না । যান এখান থেকে আর কখনও মেয়েদের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না আর যদি এমনটা করেন তবে ইভটিচিং এর মামলা করে দিব । . কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা ! শুনেছি সুন্দরী মেয়েরা অহংকারী হয় কিন্তু রগচটা বা অভদ্র হয় না কিন্তু এ দেখি সব গুণে গুণান্বিত । .

আমি এখন রাস্তা দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটছি আর বারবার মনে করার চেষ্টা করছি মেয়েটি আসলে কে ? আদৌ কি মেয়েকে আমি চিনি নাকি সবটাই আমার অবচেতন মনের ভুল। যাক সে কথা পরদিন বিকালে বাসে করে এতিমখানা থেকে বাড়ি ফিরছি।বাসে জানলার ধারে জায়গা পেলাম।তাকিয়ে রাস্তার লোকজন দেখছি উদাস দৃষ্টি মেলে।বাস শিমুলতলা ছাড়িয়ে সবে শাপলা সিনেমা ছাড়িয়ে যাবে আমার চোখ গতকালের মেয়েটাকে দেখে আটকে যায়।উগ্র সাজ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে একজনের সঙ্গে কথা বলছে।জানলা দিয়ে মুখ বের করে জোর গলায় ডাকলাম,এই যে শুনুন?

মেয়েটা একবার তাকিয়ে হন হন করে বিপরীত দিকে হাটতে থাকে।সঙ্গে লোকটি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।বাস থামতেই আমি নেমে দ্রুত মেয়েটাকে ধরতে হাটতে থাকি।মেয়েটা মনে হচ্ছে হাটার গতি বাড়িয়ে দিল।
কোথায় মিলিয়ে গেল? শ্লেটের মত রঙ টানা টানা চোখ।ঐতো লোকটার আগে আগে যাচ্ছে।আমি গতি বাড়াই।একেবারে সামনে গিয়ে পথ আটকে জিজ্ঞেস করি, আমাকে চিনতে পারছেন না?
আগুনে চোখে দেখে মেয়েটা বলল,আপনি কে নাগর?

আমি এক দুঃসাহসের কাজ করে ফেললাম।খপ করে হাত চেপে ধরে বললাম,ইয়ার্কি না , সত্যিই আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?
--এই হারামী হাত ছাড়।এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,পয়সা আছে?
আমি তো অবাক! গতকালের কথাবার্তার সাথে আজকে কোন মিল খুজে পাচ্ছি না ।
চোখে জল এসে গেল।রুমাল বের করে চোখ মুছে দু-পা ফিরতেই শুনতে পেলাম,এই যে দাড়ান।
চমকে পিছন ফিরতে দেখল ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।কাছে গিয়ে বলল,আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন?
--কেন ডাকছিলেন?
--আপনার সঙ্গে অনেক কথা--।
--রাস্তায় দাঁড়িয়ে অত কথা বলা যাবেনা।সবাই আপনাকে ভাববে কাস্টোমার।আপনার জন্য একটা কাস্টোমার হাতছাড়া হয়ে গেল।
--কিন্তু আমার যে আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে।
--খানকিদের সঙ্গে এত কথা কিসের?
--বুঝেছি আমার সঙ্গে কথা বলতে আপনার ভাল লাগছে না? অভিমানের সুরে বললাম। --এখানে কথা বলা যাবে না , আমার সঙ্গে আসুন। মেয়েটি উলটো দিকে হাটতে লাগল।আমি পাশে পাশে হাটতে গেলে মেয়েটি বলল,
একটু পিছে পিছে আসুন। নাহলে ভাববে কাস্টোমার।
শাপলা সিনেমার কাছে এসে রাস্তা পার হল।রাস্তার ধারে বস্তি।বস্তির গা ঘেষে এক চিলতে ঘিঞ্জি গলি।গলির একদিকে বস্তি অন্য দিকে বিশাল পাচিল।পাচিলের ওপাশে পেট্রোল পাম্প।অন্ধকার ঘুটঘুট করছে।
--আপনার ওখানে বাথরুম আছে?
--কেন মুতবেন ? গলি দিয়ে এগিয়ে যান,ঐখানে নরদমায় ঝেড়ে দেন।তারপর এই দরজা দিয়ে ঢুকে মালতীর ঘর বলবেন।
মেয়েটি দরজা দিয়ে ঢুকে গেল।বা-দিকেই তার ঘর। মেয়েটি তালা খুলে ঘরে ঢুকল।এখন লোড শেডিং।বদ্ধ গুমোট ঘর।
--আপনার ঘরে আলো নেই?
--এখন লোডশেডিং।
--তাহলে পাশে লাইটপোস্টে আলো জ্বলছে?
--ওটা পেট্রোল পাম্পের,ওদের জেনারেটর আছে।আমার জানলা দিয়ে একটু আলো আসে। মেয়েটি না তাকিয়ে হ্যারিকেনের চিমনি লাগিয়ে ফিক করে হেসে বলল,গত কাল ও ভাবে আমার দিকে ভ্যাবলা কান্তের মতো তাকিয়ে ছিলেন কেন? -- আপনাকে আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছিলো, তাই তাকিয়ে ছিলাম। আপনাকে কোথায় যে দেখেছি.......... --লালমনির হাট বানিজ্য মেলার যাত্রা প্যান্ডেলে...? মনে পড়েছে.... --- হু মনে পড়েছে...মুন্নি বদনাম হুয়ি গানটায় এক সাথে নাচছিলাম।গতকাল না চেনার এত ভাব নিলেন কেন? -- পাবলিক প্লেস বুঝেন,আমরা বেস্যা হলেও সব জায়গায় নষ্টামি করি না ।
বুকের ভিতর থেকে সিগারেট বের করে জিজ্ঞেস করে,খাবেন?
--আমি খাইনা।
সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোয়া ছেড়ে বলল,আমারও ভাল লাগেনা।কাস্টোমারদের আবদারে ধরতে হয়েছে। আপনি কি কথা বলবেন বলছিলেন?
--আপনি বাড়ি ছেড়ে এখানে কেন? এই কি একটা জীবন?
দেখলাম,কুলুঙ্গিতে ফ্রেমে বাধানো একটা ছবি।
মেয়েটি বলল,শৈলেনের ছবি।মানুষটা আমাকে খুব ভালবাসতো।সুখেই কাটছিল কিন্তু বিধাতার ইচ্ছে নয়।নাহলে এত অল্প বয়সে কেন চলে যাবে?
--কি হয়েছিল?
--কিছুই না।বাইকে চেপে অফিসে যেত।দুপুরে ঘুমিয়েছি,ভাসুর এসে খবর দিল গাড়ীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে--।নিজেকে সামলাতে পারিনি বোধ হয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম।জ্ঞান ফিরতে শাশুড়ীর গঞ্জনা শুননাম আমি নাকি অপয়া বউ।
--শোকে সান্ত্বনা পাবার জন্য অনেকে এরকম বলে।আমি বললাম।
--কম বয়সী সন্তানহীনা বিধবাকে মানুষ অন্য চোখে দেখে।একদিন দুপুরবেলা মেঝেতে কম্বল পেতে শুয়ে আছি। বলা নেই কওয়া নেই ভাসুর ঘরে এসে ঢুকল।আমি উঠে দাড়ালাম।ভাসুর বলল, একী চেহারা করেছো?শৈলেন তো আমার ভাই ছিল কিন্তু যার যাবার তাকে আটকাবার সাধ্য কি?
ভাসুরের কথা শুনে চোখে জল চলে এল।উনি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে হাতটা খপ করে ধরে বললেন,একী খালি হাত?শাখা-নোয়া না থাক দু-গাছা চুড়িও তো পরতে পারো। গলা ভারী করে বললেন,দেখো সংসারে এতজনের মুখে দুটোভাত যেমন তুলে দিতে পারছি,তোমারও পেটের ভাতের অভাব হবেনা।একটু এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,শৈলেন নেই তো কি ? তারপর আমাকে চেপে ধরলেন।ধাক্কা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,ছিঃ আপনার লজ্জা করেনা? দিদি জানলে কি ভাববে?
--চোপ মাগী।আমার ঘর ভাঙ্গাতে এসেছিস।ভাতার মরেছে তাও তেজ গেলনা।সংসার চলে আমার পয়সায়--দূর করে দেবো বজ্জাত মাগী।ভাসুরের চেহারা বদলে গেল।
--এই বাড়ী আমার শ্বশুরের,আমারও অর্ধেক ভাগ আছে।আমিও জবাব দিলাম।
--কি বললে তুমি বৌমা?ছেলেটাকে খেয়ে শান্তি হয়নি,এখন বাড়ীর ভাগ নিতে চাও? শাশুড়ী ঢুকে বললেন।
বুঝলাম বাড়ীতে শান্তিতে থাকা সম্ভব নয়।সেদিন রাতে সবাই ঘুমোলে চুপি চুপি এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লাম।শুধু ওর এই ছবিটা সঙ্গে নিয়েছিলাম।
--কিন্তু আপনার বাবা মা ....? -- বাবা মা মারা গেছে , আছে এক দাদা নাম নরেশ। -- আপনার দাদা কি করলো আপনার জন্য?
--জল থেকে বাঁচতে আগুণে ঝাপ দিলাম।আপনি একটু বোসুন,চা বলে আসি।
মেয়েটি বেরিয়ে আবার ফিরে এল।কিছুক্ষন গুম হয়ে থেকে বলল, একদিন বাচ্চু এল আমাদের বাসায়।
-- কে বাচু?
-- বড়বৌদির ভাই।দুপুর বেলা ঘুমোচ্ছিলাম।হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলে দেখি মুখের উপর বাচ্চুর মুখ,জিভ দিয়ে লালা ঝরছে।হাত দিয়ে জামার কলার চেপে ঠেলতে লাগলাম,হারামীটা ঠোট উচিয়ে চুমু খেতে চাইছে।দিলাম সজোরে লাথি।খাট থেকে ছিটকে পড়ল,জামা ছিড়ে ফালা ফালা।
বৌদি ছুটে এল,ভাইকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে অবাক।কি হলরে বাচ্চু?
--দিদি ঘরে তোমরা কালসাপ পুষে রেখেছো।আজ আমায় কদিন পর তোমাদেরও দংশাবে এই বলে দিচ্ছি।
বৌদি কটকটিয়ে আমাকে দেখে বলল,তোর জামাইবাবু আসুক এর একটা বিহিত করে আমি ছাড়বো।সন্ধ্যেবেলা নরেশদা এল।আমি বললাম,কি হয়েছে শুনবে তো?ও বলল,তোর বৌদি কি মিথ্যে কথা বলছে?চোখ ফেটে জল চলে এল,অন্যের মেয়ে মিথ্যে বলছে না,নিজের মায়ের পেটের বোন মিথ্যে বলছে?
দাদা বলল--আমাদের একটু শান্তিতে থাকতে দেবেনা?বেরিয়ে পড়লাম,এই পাপের অন্ন খাওয়ার চেয়ে না খেয়ে মরা অনেক ভাল।থাকুক ওরা শান্তিতে।
কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকি ।চা-ওলা চা দিয়ে গেছে।চায়ে চুমুক দিয়ে একসময় বলল,এতকরেও তো সেই জীবনই--।
--না সে জীবন না, স্বাধীন জীবন।এখানে বলাৎকারের ভয় নেই। যা করব নিজের ইচ্ছেমত। পয়সা দিয়ে আমার ইচ্ছের মত যা করার করছি। --আচ্ছা আপনি কি করেন? – বললাম- একটা এতিম খানায় ছেলে মেয়েদের পড়াই। মেয়েটি বলল-খুব ভালো কাজ।
রাত হল।আজ আসি?
--আজ আসি মানে আবার আসবেন নাকি?
আমি হাসল।বেরিয়ে গলিতে পা রেখেছি,জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডাকলো,এইযে শোনুন।
জানলার কাছে যেতে মেয়েটি হাত বাড়িয়ে বলল,এটা রাখেন।
স্বল্প আলোয় দেখলাম একটা এক হাজার টাকার নোট।মুখ তুলে তাকাতে বলল, এতিম ছেলে মেয়েদের দিলাম।
আমার চোখ জলে ঝাপ্সা হয়ে যায়।আবছা আলোয় মেয়েটি ভাগ্যিস দেখতে পায়নি।

গলির মুখে মেয়েদের জটলা,পাশ কাটিয়ে যাবার সময় কানে এল,মালতীর নাগর।হি-হি-হি। গলি থেকে রাজপথে নেমে মাথা উচু করে দেখলাম,তারা ঝলমল পরিষ্কার আকাশ।কোথাও এক ছিটে মেঘের কলঙ্ক নেই।হাতে ধরা দোমড়ানো এক হাজার টাকার নোটের দিকে তাকিয়ে চোখ ছল ছল করে ওঠে।বাস আসতে উঠে পড়লাম।

এতদিন কত ভুল ধারণা বয়ে বেড়িয়েছি ভেবে অনুশোচনা হয়।বিশাল এই পৃথিবীতে কে কোথায় কোন প্রান্তে কীভাবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তার কতটুকু খবর কজন জানে।সেই তুলনায় আমরা তো ভালই আছি।.......................
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

১৪ মে - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪