রাতের আঁধার আর ভোরের আলো – এ দুয়ের মিলনতিথি। কোনোটিই সুস্পষ্ট নয়। আঁধার ঢেকে রেখেছে আলোকে, আর সেই আঁধারকেই ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে আলোর রেখা। চারপাশ শান্ত, নিরিবিলি। কোনো শব্দ নেই। পাঁচতলা দালান থেকে বেরিয়ে ডানদিকে পাঁচমিনিট হেঁটে গেলে পায়ের সামনে যে ব্যস্ত রাস্তা এসে থামে, সে রাস্তার ব্যস্ততার চিহ্নস্বরূপ কোনো শব্দ এখন অবধি ভেসে আসছে না। দিনের অন্যান্য সময় কিছুটা হলেও সে শব্দ কানে আসে। একের পরে এক গাড়ির হর্ণের শব্দ মৃদু হতে মৃদুতম হয়ে ভেসে ভেসে চলে আসে এই পাঁচতলা দালানে। কিন্তু এখন সমস্তটাই চুপচাপ। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ - এটিও এই নিঃস্তব্ধতার অন্যতম কারণ হতে পারে।
চারপাশের এই অদ্ভুত নির্জনতার চেয়েও আজ বেশি নির্জন সুফিয়া বেগমের বুকের মধ্যখানের মাঠটি। সেখানে খাঁ খাঁ করা তপ্ত রোদ্দুর, যা মরুভূমিকেও হার মানতে বাধ্য করে। মরুভূমিতে যেমন জলের সন্ধান অনিশ্চিত, তেমনি আজ তার বুকের তপ্ত মাঠে সুখের পায়রার অনুপস্থিতি সুনিশ্চিত। মরুভূমির পথে ক্লান্ত পথিককে পথ চলতে চলতে মুখোমুখি হতে হয় মরীচিকার। জীবনে বহুবার সে মরীচিকার চেয়েও জটিল দ্বিধার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আজ সে যে মরীচিকার মুখোমুখি, তা আর তাকে দ্বিধায় ফেলার জন্য সফল হতে পারছে না। সে সেই মরীচিকাকে প্রত্যক্ষ করেও এড়িয়ে চলছে। কারণ সে জানে। সে তার জীবনের অনাকাঙ্খিত সত্যটি জানে। জেনেছে গত রাতেই।
জীবনে কোনোদিনও সে একবারের জন্যও এই কথাটি ভাবতে পারে নি। যদি কখনো বা নিজেরই অজান্তে কথাটি মনে এসেছে, তখনই সে অতি দ্রুত তার সামনে এক অদৃশ্য আস্তরন টেনে দিয়েছে। মনের মধ্যে ভাবনাটিকে পাকাপোক্তভাবে জেঁকে বসার কোনো সুযোগ দেয় নি সে। কেন ? শাহীন কেন এরকম করতে যাবে ? সে কী করে নি শাহীনের জন্য ?
শাহীনের জন্মের পরে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শাহীনের বাবা পাড়ি জমাল পরপারের পথে। স্বার্থপর সব মানুষের আবাসস্থল এই দুই দিনের দুনিয়ায় সুফিয়া বেগম শাহীনকে নিয়ে একা হয়ে পড়ল, সম্পূর্ণ একা! চারপাশের সব চেনা মানুষ কেমন করে যেন অচেনা হয়ে গেল! সে সব চেনা মানুষ মুখোশ খুলল না কি নতুন মুখোশ পরে নিল- কিছুই বুঝতে পারল না সে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে ছোট্ট শাহীনকে বুকে আগলে রেখে শুরু করল নতুন জীবন। সেই নতুন জীবনের সঙ্গী হল একটি সেকেন্ড হ্যান্ড সেলাই মেশিন। খুব অল্প দামের মধ্যে সে সেটি কিনতে পেরেছিল। এভাবেই ‘ছোট্ট শাহীন’ আর ‘অল্প দরের সেলাই মেশিন’ হয়ে উঠেছিল তার জীবনের সঙ্গী।
এরপর কত্তগুলো দিন পেরিয়ে গেল। কত সময়, দুঃসময়, নিরবে অশ্রুবর্ষণ, বুকে চাপা অব্যক্ত বেদনা! তারপর এল সে সুসময়। রাতের ঘন কালো অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠল। নির্জন, শূণ্য মাঠে পাখির কলকাকলি আর সবুজের উপস্থিতি-দুই ই যেন নতুন করে অনেক বছর বাদে ফিরে এল। কিন্তু এ সুসময়, ভোরের আলো, কুঞ্জন, সজীব সবুজ প্রাণ- কিছুই যেন তার নয়!
বাইরে থেকে আপাত দৃষ্টিতে সেই সেকেন্ড হ্যান্ড সেলাই মেশিনটার কোনো কৃতিত্ব এখন আর চোখে পড়ে না। পাঁচতলা বাড়ি, নীল রঙা গাড়ি, বিলাসবহুল জীবন- এ সবকিছুর ভিড়ে সেই মেশিনটা আজ হারিয়ে গিয়েছে। তার অবস্থানটাই ঠাওর করা যায় না- অবদান তো অনেক দূরের কথা!
কিন্তু এত কিছুতে তার কী ? এসবের কিছুই তো তার নয়! একবিন্দু অধিকার ও তার এসবের উপরে নেই। যদি থাকত তবে কী আর আজ রাতটা তার নির্ঘুম কাটত? দু’চোখ বেয়ে কী বেরিয়ে আসত কান্নার ঢল?
জীবনের বিভিন্ন বাঁকে বহু জীবনের নির্মম সত্যকে সে প্রত্যক্ষ করেছে। কখনো কারও কাছ থেকে গল্পোচ্ছলে শুনেছে, কখনো বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই নির্মম নিষ্ঠুরতাকে সে নিজ চোখে দেখেছে। কিন্তু একবারের জন্যও সে নিজেকে ঐ অবস্থানে ভাবতে পারে নি। শাহীনকে সে আদর, স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা.......! কোনো কিছুরই অভাব রাখে নি সে। সবসময় চেষ্টা করেছে ছেলেকে দুঃখের স্পর্শজাল হতে দূরে রাখতে। নিয়তির ফেরে কখনো সখনো ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সে দমে যায় নি। আবার চেষ্টা করেছে তাকে একটু সুখের স্পর্শ এনে দিতে।
কিন্তু কি জানি! কোথাও হয়তো বা সুক্ষ্ম বা গাঢ়- কোনো রকম ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। তাই এই শাস্তি। তাই আর সে এখন থেকে নিজের ছেলের সাথে থাকতে পারবে না। চলে যেতে হবে সেখানে, যেখানে বর্তমান সময়ের, বেশিরভাগের জীবনেরই একটা নির্দিষ্ট অংশ তাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডেকে চলে। সে জায়গাটি সকলের নিকট পরিচিত এক ধরনের আশ্রম হিসেবে। বৃদ্ধাশ্রম। হ্যাঁ। নামটা বৃদ্ধাশ্রমই বটে। শাহীন গতকাল বৌমার সাথে এই জায়গাটির ব্যাপারেই তো কথা বলছিল।
সুফিয়া বেগমের স্পষ্ট মনে আছে ওদের বলা কথাগুলো। আর তাই তো সে ফজরের নামাজ শেষ হতেই দু’চোখের পানি আড়ালে রেখে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলে ব্যাগ গুছানোর কাজে। শুধু শুধু কষ্ট পেয়ে তো আর লাভ নেই! আজ সে নিজে অক্ষম। তাই তার মনের কষ্ট বোঝার মতো সক্ষমতাও কারো নেই!
৬ মাস পরে.....
রাতের আঁধার আর ভোরের আলো- এ দু’য়ের মিলনতিথি। কোনোটিই সুস্পষ্ট নয়। আঁধার ঢেকে রেখেছে আলোকে আর সেই আঁধার ভেদ করেই বেরিয়ে এসেছে আলোর রেখা। চারপাশ সুনশান, নিরিবিলি। সবচেয়ে বেশি নিরিবিলি সুফিয়া বেগমের নিথর দেহখানি। তার একসময়ের নরম, কোমল দেহ অসাড়, শক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে পাঁচতলা বৃদ্ধাশ্রমের এক ঘরে। সে ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ। তাই ঘরটি একটু বেশিই নির্জন। কিন্তু তার চেয়েও নির্জন সুফিয়া বেগমের সারা শরীর। বন্ধ হয়েছে হৃৎস্পন্দন, থেমে গিয়েছে রক্তের পরিবহন। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সে চলে গিয়েছে পরপারে। তথাকথিত কোমল, সুন্দর, মনোরম পৃথিবীর মায়া!!!
২৮ এপ্রিল - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪