দৃষ্টিকানন

অন্ধ (মার্চ ২০১৮)

মৌরি হক দোলা
  • ১৩
  • ১৩
‘মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে
নিঃসীম শূণ্যে শ্রাবণবর্ষণ সঙ্গীতে
রিমিঝিম, রিমিঝিম, রিমিঝিম........’

অসম্ভব সুন্দরভাবে নেচে চলেছে ‘দৃষ্টিকানন’ এর একাংশ। অসাধারণ বললেও কম বলা হয়ে যাবে। দর্শক সারির সবাই বিমোহিত হয়ে তাদের নাচ দেখছেন। মোটামুটি সবার চোখেমুখেই সন্তুষ্টির উপস্থিতি সুস্পষ্ট। একটু বেশি সন্তুষ্টি যার চোখেমুখে স্পষ্ট ছাপ ফেলেছে, সে প্রীতম। দর্শকদের জন্য নির্ধারিত আসনের প্রথম সারির এক কোণে সে বসে আছে। নৃত্যরত দলের প্রতিটি স্টেপ সে অতি সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। এই সুক্ষ্ণভাবে দেখার মাধ্যমে সে নিজের মনকে আরেকটু বেশি সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছে। সৃষ্টিকর্তা এদের সকলকে এক অসাধারণ গুণ দান করেছেন। এরা চোখে দেখতে পায় না। তবুও শ্রবণ আর অনুভবের সাহায্যে এরা যেন পৃথিবীর সমস্ত সাধারণ মানুষদের থেকে নিজেদেরকে অসাধারণ হিসেবে প্রমাণ করে আলাদা এক রূপ ধারণ করেছে।

প্রীতমের মুগ্ধ দৃষ্টি এদের নাচের দিকে যতটা না ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল নৃত্যপর হেমার দিকে। ‘অপূর্ব! অসাধারণ নাচে মেয়েটি।’ নাচ শেষে আর সব দর্শকের মতো দু’হাতে করতালি দিতে দিতে নিজের মনকেই কথাগুলো বলছিল সে। কিন্তু নিজের মনকে জানাতে গিয়ে কীভাবে যেন মনেরই অজান্তে কথাগুলো উচ্চারিত হল তার ওষ্ঠাধরে, কর্ণগোচর হল তার পাশের আসনে বসা সোহাগের।

-কি রে, মাথা ঘুরে গেল না কি ?
-মানে ?
-না, তোর চোখমুখ আর কথাবার্তায় কেমন যেন এক আবেগের আভাস!
-কি যে বলিস না তুই!


মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে প্রীতম আর সোহাগ বাইরের ফুলেল শোভিত বাগানের মাঝ দিয়ে নদীর মতো বয়ে চলা সরু পথটা ধরে হাঁটছে। আশেপাশে আরও লোকের দেখা মিলে... কোথাও পাঁচ-সাতজনের একটা দল গোল হয়ে বসে তাদের গল্পের আসর জমিয়ে তুলেছে, কোথাও বা মনের কথা আদান-প্রদানে ব্যস্ত যুবক-যুবতীর দল জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে, কোথাও আবার দেখা যাচ্ছে, যারা পারিবারিকভাবে এসেছে তারা স্মৃতিরক্ষার্থে এই সুন্দর গোধূলী লগ্নের কিছু মূহুর্ত মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দি করে রাখছে।
.

দৃষ্টিকানন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন। সংগঠনের নামটা বটে দৃষ্টিকানন কিন্তু এই কাননের কোনো ফুলেরই দৃষ্টিশক্তি নেই। তবে তাদের মনের সম্প্রসারিত দৃষ্টি চক্ষুদৃষ্টির অনুপস্থিতির ব্যাপারটাকে এক লম্বা আস্তরণে আবৃত করে রেখেছে। শুধু যে কেবল এদের মনের দৃষ্টিটাই প্রসারিত তা নয়, এরা সবাই স্বাবলম্বী। সবাই কোনো না কোনো সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত – কেউ গান গায়, কেউ নাচ করে, কেউ কবিতা আবৃত্তি করে, কেউ বা মনের দৃষ্টির সাহায্যে জগৎটাকে উপলব্ধি করে সেই জগতের নানা বিষয় তুলে ধরে তাদের স্বরচিত পঙক্তিমালায়।

সোহাগের মামা এই সংগঠনের উদ্যোক্তা। প্রায় ষোল-সতের বছর দেশের বাইরে থেকে বছর দশেক পূর্বে যখন সে দেশে ফিরে আসে, তখন-ই তিনি এই উদ্যোগটা নেন। টিনের দোচালা ঘরে যাত্রা শুরু হয় দৃষ্টিকাননের। সাতজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, দু’জন শিক্ষক আর দেখাশোনা করার জন্য খুব অল্প সংখ্যক কর্মচারী ছিল তখন। আজ দশ বছর পরে সেই চিত্রটা সম্পূর্ণই বদলে গিয়েছে। টিনের দোচালা ঘরের জায়গায় তৈরি হয়েছে ইট-পাথরে তৈরি দোতলা দালান। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য যারা, তাদের সংখ্যা বেড়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এখানে শিক্ষকদের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনই বেড়েছে কর্মচারীর সংখ্যা।

দৃষ্টিকাননের পুষ্পদেরকে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজের সাথেও যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবছরই তাদের এই প্রতিভা সকলের সামনে প্রকাশ পায় বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন। এই অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য আধুনিক নকশায় একটি মিলনায়তনও তৈরি করা হয়েছে। আর সেই মিলনায়তনের সামনে একটি উদ্যান। অবশ্য দৃষ্টিকাননে কোনো পুষ্পকানন থাকবে না তাই কি কখনো হয়! দৃষ্টিকাননের ফুলগুলো এই পুষ্পকাননের ফুলগুলোর মতোই তো সজীব, সতেজ আর উজ্জল।
.

সোহাগ আর প্রীতমের বন্ধুত্ব অনেকদিনের। শুধু বন্ধুত্ব নয়, গভীর বন্ধুত্ব। অনার্স ফাইনালের পরে সোহাগই প্রীতমকে প্রস্তাবটা দেয় শ্রীসোমপুরে বেড়াতে যাবার জন্য। ছুটি কাটানোর জন্য ভালো একটা পন্থা- এ কথা মনে করেই সে একবারেই রাজি হয়ে যায়। সোহাগকে আর দ্বিতীয়বারের জন্য কিছু বলতে হয় নি এ ব্যপারে। তখনই তারা প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শ্রীসোমপুরের উদ্দেশ্যে যেখানে ‘দৃষ্টিকানন’ নামক এক জীবন্ত ফুলের বাগান আছে।


শ্রীসোমপুর থেকে ফিরে আসার পর থেকেই প্রীতম নিজের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। সারাক্ষণ দু’চোখের সামনে শুধু সেই মায়াভরা মুখখানি ভেসে উঠছে। চোখের পাতাগুলো একটির উপর আরেকটি রাখলে পৃথিবীর সমস্তকিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখায়, আর ঠিক তখনই দেখা মিলে দু’টো টানা টানা হরিণ চোখের, যে চোখ সৃষ্টিকর্তা অতি সুনিপুণভাবে, সযতনে সৃষ্টি করতে গিয়ে তার দেখার শক্তি দিতে ভুলে গিয়েছেন। আবার কখনো কখনো কার মিষ্টি হাসির শব্দ যেন সে শুনতে পায়, মনে হয় সে-ই হাসছে। তখন নিজের মনে সে নিজেই হেসে উঠে, এক অদ্ভুত, চাপা হাসির রোল পড়ে যায় তার মনের আঙিনায়।

সেদিন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার অনেক পরে প্রীতম আর সোহাগ সোহাগদের মামাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়। কিন্তু চৌকাঠে পা রাখতে না রাখতেই প্রীতমের পা থমকে যায়। তার দৃষ্টি স্থির হয় সেই মেয়েটির দিকে, যাকে সে ঐ নৃত্যানুষ্ঠানে দেখেছিল। নিজেকে অবাক অবস্থায় আবিষ্কার করে সে। সোহাগ তখন ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে।

ও বাড়িতে তিনটে দিন কাটিয়েই ফিরে আসে তারা। কিন্তু তার মন এখনও ও বাড়ির আনাচে কানাচেই পড়ে রয়েছে। কারণ সেখানেই তো রয়েছে সেই হরিণ চোখের মেয়েটি। ও বাড়িতে থাকার সময় মেয়েটি সম্পর্কে কিছু কিছু কথা সে জেনে নিয়েছে নিজের মনের তাগিদেই।
হেমা। হ্যাঁ, মেয়েটির নাম হেমা-ই। সোহাগের মামীর বাবার বাড়ির দিকের আত্নীয়া সে। জন্ম থেকেই তার দু’চোখে দৃষ্টিশক্তি নেই। দৃষ্টিকানন প্রতিষ্ঠার বছর তিনেক পরে সে শ্রীসোমপুরে আসে। শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্নীয়া বিধায় সোহাগের মামা তার থাকার ব্যবস্থা নিজ বাড়িতেই করেন। কিন্তু লেখাপড়া করা, প্রশিক্ষণ নেওয়া- এসব সে দৃষ্টিকাননের অন্য সব বন্ধুদের সাথেই করে। আর নাচের ক্ষেত্রে তার পারদর্শীতার বিষয়টি তো প্রীতমের স্বচক্ষে দেখা।

মনের মধ্যে এই অদ্ভুত পরিবর্তন তাকে এক নতুন আনন্দের ছোঁয়া দেয়, জন্ম নেয় নতুন এক ধরনের ভালোলাগা। এই ভালোলাগা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে যে মূল হোতা তার সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না তা সে জানে না। কিন্তু ক্ষুদ্র জীবনের এই ক্ষুদ্রতম মূহুর্তের স্মৃতি রক্ষার প্রেরণায় সে প্রিয় নীল কালিতে ডাইরির পাতায় লিখে রাখে যুক্তবর্ণযুক্ত একটি ছোট্ট শব্দ ‘দৃষ্টিকানন’। উদ্ধৃত চিহ্ন দিয়ে লেখাটা শেষ করতেই তার ঠোঁটের এক কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে। এই হাসির অর্থ হয়তো বা গভীর কিংবা ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্রতম সময়ের জন্য ভালো লাগার একটি স্মৃতিচিহ্ন !!!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া গল্পটি আবার পড়লাম। বেশ ভালো লাগল। লিখতে থাকুন। ভালো করবেন।
কাজল I cordially accept your friendship. You r my first friend here. I'm new here. Hope you will read my poem in next issue if they publish. max for you dear.
হ্যাঁ, পড়ার ইচ্ছে রইল। আর কবিতাটা নিশ্চয় ছাপা হবে। ধন্যবাদ...
Fahmida Bari Bipu amar bengali typing e ektu jhamela hochee. tai evabe likhchhi bole dukkhito. golpo ta porlam Dola. Tomar aro ekta lekhao er age porechhilam mone achhe. amar mone hoi tomar moddhe besh valo shomvabona achhe. tumi ektu regular thako, ar notun notun plot niye vabo. golper twist niye beshi vabbe. ki kore golper moshala aro beshi kore jomano jai shetao joruri. ei golpo ta pore khub aram peyecchi. banan vul paini ar chhoto chhoto para kore likhechho. tobe golpo hishebe jome Otheni kintu. ekta experience type lekha mone hoyese. shob shomoy je golpe twist thakbei ta noi, tobe ekhane golper bapti arektu chhorale valo lagto. vote diyechhi. agamir jonno shuvokamona.
ধন্যবাদ আপু। আপনাদের পরামর্শ আমার জন্য খুব জরুরি। এত সুন্দর পরামর্শের জন্য আরেকবার ধন্যবাদ জানবেন। আর হ্যাঁ, গল্পটা একটু ছোট হয়েছে। গত মাসে পরীক্ষা শেষে তিন দিন সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু লেখা শেষ করতে পারব কি পারব না এই ভেবে খুব দ্রুত লিখেছিলাম। তবে, হ্যাঁ আমি আপনাদের পরামর্শ অনুসরন করার চেষ্টা করব। দোয়া করবেন আমার জন্য। ভালো থাকবেন.... শুভকামনা....
সেলিনা ইসলাম সৃষ্টিকর্তা মানুষকে কখনোই শূন্য করে পৃথিবীতে পাঠান না! গল্পের পটভূমি এবং লেখা বেশ ভালো লাগল। শুভকামনা রইল।
ধন্যবাদ..... শুভকামনা.....
কাজী জাহাঙ্গীর দোলা, সত্যিই আন্দেলিত করলেন আমাকে। বেশ সাবলীল বনর্ণায় ধরে রেখেছেন শেষ পয্যন্ত। ব্যাকরনেও কোন অসংগতি নেই। চর্চা চালিয়ে যান। অনেক শুভকামনা আর ভোট রেখে গেলাম।
ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল আপনার জন্যও.....
আজাদ ইসলাম ছোট্ট লেখিকার বড় লেখাটি ভাল লেগেছে।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু হেমা অন্ধ হলেও তার যোগ্যতা দিয়ে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন প্রীতমের মনে ভাল লাগা সৃষ্টি করতে পেরেছে। সে প্রমাণ করেছে অন্ধ হলেও সে অবহেলিত নয়। অনেক ভাল লাগল গল্পটি। আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।
ধন্যবাদ....শুভকামনা....
সালসাবিলা নকি খুব ভালো লেগেছে। দৃশ্যপট ও বর্ণনাভঙ্গী এতো সুনিপুণ যে চোখের সামনেই সব ভেসে উঠছিল... শুভকামনা লেখিকা
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী গল্পের ভিতরে এক ধরনের রোমাঞ্চিত দৃশ্য, চরিত্র, অনাবিল কথোপকথন পাওয়া যায়। যা যে কোন পাঠকেরই ভালো লাগার কথা এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার রেশ বাড়বে। আর বিষয় বলতে সোহাগ সোহাগাদের মামাদের বাড়িতে স্থির হয় এবং পরক্ষণে মেয়েটিকে দেখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়→এইটুকুতে প্রকাশ করতে চেয়েছেন মনে হয়? খুব সুন্দর কাহিনী সম্বলিত গল্প। দিন দিন আপনার হাতের নিপুণতা, গল্পের প্রাঞ্জলতা, সমাপ্তির দৃশ্য দিন দিন আরও সুন্দর হচ্ছে। শেষে বলবো অসাধারণ গল্প। অনেক অনেক শুভকামনা রইল, ভালো থাকুন।
ধন্যবাদ....শুভকামনা নিরন্তর.....
সাদিক ইসলাম দৃষ্টিহীনতার চেয়ে আবেগে বেশি জোর হ্যা দৃষ্টিহীনতাই জয়ি হয়েছে সুন্দর চোখ আলোহীন হয়েও অনেক টানে। আপনার পরিশুদ্ধ বানান আর লেখার গতি ভালো লেগেছে গল্পে যদিও ঘটনা কম আপনি অন্ধত্ব হৃদয় দিয়েই উপলব্ধি করেছেন। শুভ কামনা।
ধন্যবাদ.... শুভকামনা নিরন্তর....

২৮ এপ্রিল - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪