জলসঙ্কটে

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী (নভেম্বর ২০১৭)

অমিতাভ সাহা
২০২৫ সালের এক গ্রীষ্মের সকালবেলা।

বেলা ১০ টা। বাইরে সূর্যদেবের অকৃপণ আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে। আমি এসি রুমে আত্মগোপন করে আছি। বাইরে টেম্পারেচার ৬০ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই। স্কিন জ্যাকেট ছাড়া বাইরে বেরনো অসম্ভব। মাথার ঘিলু অব্দি শুকিয়ে যাবার জোগাড়। কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে রোদে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেই যথেষ্ট। এই বীভৎস গরমের জন্য আমাদের হোম অফিস করার অপশন দেওয়া হয়েছে। মানে অফিসের বিভিন্ন কার্যকলাপ ফ্যাক্স, ই-মেল মারফৎ ঘরে বসেই সম্পাদন করা হচ্ছে। সাইট রিলেটেড ওয়ার্কস কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। চাকরটাকে বললাম কিছু খাবার দিতে। ও ফ্রাইং প্যানটা বাইরে নিয়ে গিয়ে রোদে একটা অমলেট বানিয়ে নিয়ে এলো।

অমলেটে মুখ দিচ্ছি, কলিং বেলটা বেজে উঠল। চাকরটা দরজা খুলে দিতেই দেখলাম যে ছেলেটা মিটার রিডিং নিতে আসে, সেই ছেলেটা। ইলেকট্রিক মিটারের রিডিং নয়, ওয়াটার মিটারের। না, এটা আদৌ আশ্চর্য হবার মত কোন ব্যাপার নয়। এটা হল প্রত্যেক মাসে আমরা পরিবার পিছু যে পরিমাণ জল ব্যবহার করি, তার উপর এক ধরনের শুল্কবিশেষ। গত এক বছর ধরে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আসলে খুব হেলাফেলা করে ব্যবহার করার জন্য আর ইচ্ছেমত অপচয় করার জন্য প্রাকৃতিক জলসম্পদের যে আকাল দেখা দিয়েছে, তার মোকাবিলার জন্যেই এই ব্যবস্থা। ছেলেটা ওয়াটার মিটারের রিডিং দেখে স্পট বিলিং মেসিন থেকে বিল বের করে দিয়ে গেল। বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিলের মত এখন নতুন বিল অ্যাড হয়েছে, জলের বিল। দেখলাম এই মাসের বিলটা বেশি এসেছে। চাকরটাকে হাঁক লাগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এ মাসের বিল বেশি হল কেন।

ও বলল, “হুজুর, এ মাসে প্রত্যেকদিন স্নান করেছি তো। তাই বোধ হয়”।

“তোকে বলেছি না, একদিন অন্তর স্নান করবি। এই আকালের বাজারে প্রত্যেকদিন স্নান একধরনের বিলাসিতা”।

“আচ্ছা হুজুর, এই মাস থেকে তাই করব”।

জল এখন এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে আর হেলাফেলা করার জিনিস নয়। মানুষ দেরিতে হলেও জলের মর্ম বুঝতে পেরেছে এবং এতদিন হেলাফেলা করে ব্যবহার করার মূল্য আজ মানুষকে দিতে হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে জল সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। জলের উপরেই সমস্ত প্রাণের অস্তিত্ব নির্ভর করে আছে। কিন্তু মানুষের বিবেচনাহীন ব্যবহার ও অপচয়ের ফলে জলসম্পদ এখন দুর্লভ। সরকার জলের মর্ম বুঝতে পেরে এখন আইন প্রণয়ন করে জলের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে এবং প্রতি পরিবার (চার জন) পিছু ৩০ লিটার জল প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ করেছে। অতিরিক্ত জল ব্যবহারের জন্য লিটার পিছু বিল পে করতে হয়। সেজন্য প্রত্যেক বাড়িতে এখন ওয়াটার মিটার বসানো আছে। জলের বিল যাতে বেশি না আসে, সেজন্য সবাই এখন জল খুব হিসেব করে ব্যবহার করে।

জলের যে এত আকাল হবে, বাপের জম্মে ভাবিনি। আগে ত ভাবতাম, তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। তাই জলের কোন কমতি নেই। এখন বুঝি তিন ভাগ জলের বেশিরভাগটাই নোনা জল, খাবার উপযুক্ত নয়। মাটির তলায় যে জল আছে, তাও সীমিত। কিন্তু আমরা ইলেক্ট্রিক মোটর পাম্পের সাহায্যে সুইচ টিপে টিপে বেশিরভাগ জলই তুলে নিয়েছি। তাই ভূগর্ভস্থ জলের লেভেল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আগে যেখানে ৩০-৪০ ফিট খুঁড়লেই জল পাওয়া যেত, এখন সেখানে ১৫০ ফিটে গেলেও জল পাওয়া যায় না।

তার উপর বৃষ্টিপাতও তথৈবচ। গত কয়েক বছরের মিটিওরলজিক্যাল ডেটা অ্যানালিসিস করে বৃষ্টিপাতের ডিক্লাইনিং ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং যে হারে বাড়ছে, বৃষ্টিপাতও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে। খাল-বিল, নদী-নালা বর্ষার তিন-চার মাস বাদ দিয়ে বাকি সারা বছরই প্রায় শুকনো থাকে। তাই কৃষি সেচের জন্য প্রয়োজনীয় জল এই সব উৎস থেকে গ্রীষ্মের বা শীতের সময় পাওয়া যায় না। অগত্যা ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভর করতে হয়। দু’এক বছর হল মিউনিসিপ্যালিটি থেকে খুব মাইকিং করে বেড়াচ্ছে, বৃষ্টির জল ধরে রাখুন আর সঙ্গে পাম্ফলেট বিতরণ করছে। সরকারি উদ্যোগে প্রচুর পুকুর খননের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে যাতে বৃষ্টির জল ধরে রাখা যায় এবং সেই জল সেচের কাজে ব্যবহার করা যায়। আমার বাড়ির ছাদে যে বৃষ্টির জল পড়ে, সেটাকে আমি ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছি। ছাদের আউটলেট থেকে একটা পাইপ লাগিয়ে নীচে একটা ড্রাম বসিয়ে দিয়েছি। বাড়ির পেছনে কিছু ফুল আর সব্জির বাগান আছে। ড্রামে যে বৃষ্টির জল জমে তা খুব যত্নে ব্যবহার করে ওই বাগানে জল দেই।

আগেকার মত জমিতে ঢালাও জল দেবার দিন শেষ। আগে যখন অঢেল জল ছিল, তখন কাঁচা নালা কেটে গাছে বা ফসলে জল দেওয়া হত। তার ফলে বেশিরভাগ জল নালা দিয়ে বয়ে যাবার সময়েই নষ্ট হয়ে যেত, গাছের গোড়ায় পৌঁছাত সামান্য অংশ। তাই এখন নতুন পদ্ধতি হল, গাছের মূলে ফোঁটা ফোঁটা করে জল দেওয়া যাতে জলের সঠিক সদ্ব্যবহার হয়। ইস্রাইলে অনেক বছর আগে থেকেই এ ধরনের পদ্ধতি কৃষি ও উদ্যান পালনের জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। ওখানে জলের আকাল কস্মিনকাল থেকেই ছিল। আমার বাগানেও আমি তাই করে থাকি।

এখন আরেক নতুন উপদ্রব হয়েছে, সকাল বিকাল আকাশে হুস হুস করে যখন তখন প্লেন উড়ে বেড়াচ্ছে। এগুলো অবশ্য যাত্রীবাহী বিমান নয়। এদের উদ্দেশ্য হল ক্লাউড সিডিং বা মেঘের উপর বিভিন্ন কেমিক্যাল (সিল্ভার আইওডাইড, পটাসিয়াম আইওডাইড বা ড্রাই আইস) স্প্রে করে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানো। মেঘের মধ্যে যে ছোট ছোট ওয়াটার পার্টিকেলগুলো থাকে, এই কেমিক্যালগুলো সেগুলোকে কন্ডেন্স করে ওয়াটার ড্রপলেট ফর্ম করে, তার ফলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। চায়না থেকে এই টেকনোলোজি আমদানি করা হয়েছে। যেসব জায়গায় বৃষ্টিপাত খুব কম হয় বা বৃষ্টি হবার আগেই হাওয়ায় মেঘ উড়ে অন্যত্র চলে যায়, সেখানে এই পদ্ধতি কিছুটা কার্যকরী হয়েছে।

আর কত রঙ্গ যে দেখব!

অমলেট খেতে খেতে আজকের খবরের কাগজটা নিয়ে বসলাম।
প্রথমেই একটা হেডিং চোখে পড়ল - “এক বোতল জল নিয়ে হাতাহাতিতে গুরুতর জখম যুবক”

আসলে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে কয়েকমাস আগে থেকে। গত দু’এক বছর ধরেই এ অঞ্চলের অনেক মানুষের মধ্যে দাঁত ও হাড়ের ক্ষয় ও বিকৃতিসহ বিভিন্ন প্রকার রোগের উপসর্গ দেখা দিচ্ছিল। সেই সঙ্গে অনেক শিশুর মধ্যে বয়সের সাথে সাথে সঠিক বুদ্ধিমত্তার বিকাশ হচ্ছিল না বা নিউরলজিক্যাল ডিসর্ডারের অনেক কেস উঠে আসছিল। কর্মসূত্রে আমি সরকারী জলসম্পদ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। ব্যাপারটা বহুদিন ধরে চলতে থাকায় আমাদের বিভাগ থেকে নির্দেশিকা জারি করে পানীয় জল পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এই এলাকায় ব্যবহৃত বিভন্ন হ্যান্ড পাম্প, সাবমারসিবল পাম্প আর কুয়ো থেকে পানীয় জলের স্যাম্পল কালেক্ট করে আমরা একটা টিম মিলে ল্যাবরেটরি টেস্ট করলাম। যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই। জলে বিভিন্ন রকম হেভি মেটালসের সন্ধান পাওয়া গেল। তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক হল লেড, মারকারি ও ক্যাডমিয়াম, যাদের মাত্রা পারমিসিবল লিমিটের থেকে অনেকটাই বেশি। আর মুশকিল হল এই টক্সিক এলিমেন্টগুলো ডেস্ট্রয় করা যায় না।

এখন প্রশ্ন হল, এই অশুদ্ধিগুলো জলের মধ্যে এলো কোথা থেকে? গত কয়েক দশক ধরে বাড়বাড়ন্ত জনসংখ্যা ও নগরায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিভিন্ন শিল্প, কলকারখানাগুলি। কারখানার যেমন ধরুন টেক্সটাইল, লেদার, পেইন্ট কারখানার বর্জ্যগুলো অনেকক্ষেত্রেই ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট না করেই রিলিজ করে দেওয়া হয় বিভিন্ন নদীনালায়। এছাড়া বর্তমান সময়ে কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন পেস্টিসাইড ব্যবহারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে যার মধ্যেও এই ক্ষতিকারক হেভি মেটালসগুলো থাকে। এই অপদ্রব্যগুলি জলের সঙ্গে মিশে ধীরে ধীরে চুঁইয়ে মাটির গভীরে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ জল বিষাক্ত করে তোলে। আর এই জলই আমরা পাম্পের সাহায্যে তুলে পানীয় জল ও গৃহস্থালির রান্নার কাজে ব্যবহার করি।

এভাবেই এই টক্সিক এলিমেন্টগুলো আমাদের অজান্তেই খুব স্বল্প মাত্রায় পানীয় জল ও খাবারের সঙ্গে আমাদের শরীরে ঢুকে ফুসফুস, কিডনি, হার্ট ও অন্যান্য অঙ্গে জমা হতে থাকে আর স্লো পয়জনিং করতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে শরীরে প্রবেশ করার ফলে এদের কন্সেন্ট্রেশন বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে রক্তে মিশে গিয়ে বিষক্রিয়া করতে থাকে যার ফলে বিভিন্ন অরগ্যান ফেলিউর যেমন কিডনি ড্যামেজ বা ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। তাই এদের ইফেক্ট চটজলদি ধরা পড়ে না। ধরা পড়ে শরীরের অনেকটা ক্ষতি হয়ে যাবার পর।

হেভি মেটালস জল থেকে ফিল্টার করা খুব সহজ নয়। বিভিন্ন ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট করে, যেমন রিভার্স অস্মোসিস করে অনেকটা রিমুভ করা যায়। আজকাল বাজারে যে ওয়াটার ফিল্টারগুলো আছে, তারা অনেকে এই টেকনোলোজি ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু গ্রামে গঞ্জে বহু দরিদ্র মানুষ আছে, যাদের এই ফিল্টারগুলো অ্যাফোর্ড করার মত আর্থিক সামর্থ্য নেই। তারা বড়জোর জল ফুটিয়ে খেতে পারে না হলে ফিটকিরি ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তাতে জলে হেভি মেটালস কন্সেন্ট্রেশনের কোন পরিবর্তন হয় না। তাই গবর্মেন্ট ফান্ডিং থেকে আমরা জলসম্পদ বিভাগের উদ্যোগে একটা ড্রিঙ্কিং ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ডেভলপ করেছি যেখানে বিভিন্ন ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট করে হেভি মেটালস ফ্রি ওয়াটার বিনামূল্যে সর্বসাধারণের জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু এর জোগান প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। সেখানেই বিপত্তি। সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে জল দেবার সময় প্রায়শই ঝামেলা মারামারি বেধে যাচ্ছে।

যদিও সরকারি উদ্যোগে এরকম আরও অনেক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করার পরিকল্পনা আছে, যতদিন বাস্তবায়ন না হচ্ছে, ততদিন এই মারামারি কাড়াকাড়ি লেগেই থাকবে।

“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি,
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার”-

কবি সুকান্ত যে আশা রেখে গেছিলেন, তা কি আদৌ কখনো সত্যি হবে?

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এ কেমন পৃথিবী উপহার দিয়ে যাব আমরা?


আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান সচেতনতা ভাল লাগল,শুভকামনা সতত।
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত জলের অপচয় বন্ধ করা / শুদ্ধ জলের যোগান .... বর্তমান সময়ে খুবই জরুরি । ভাল লিখেছেন । কবি সুকান্তের লাইন দুটি এই গল্পে সুন্দর মানিয়েছে । শুভকামনা রইল ।

১৯ এপ্রিল - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪