তিনা

নবান্ন (অক্টোবর ২০১৯)

মোঃ মোখলেছুর রহমান
  • 0
  • ৩৯
আমার মেয়ে তিনা , বয়স এই ছয় ছুঁলো বলে। কেজি টু-তে পড়ে । বাসায় যতক্ষণ থাকি সারাদিন ঘুরঘুর করে আমার পেছন পেছন; রাজ্যের সব প্রশ্ন ওর মাথায়। কোন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শেষ করার যো নেই; ওর মন মত উত্তর হলে তবেই মুক্তি; নয়তো একটির উত্তরে দশটি প্রশ্নের লেজ জুড়ে দেয়।

সেদিন শুক্রবার, অফিস নেই; লেখালেখির ব্যারাম আছে বলে ডায়রিতে লাঙল চালাচ্ছিলাম। ব্যারামের সবিস্তার হল- স্ত্রীর শত বকাঝকা খেয়েও ব্যামোটা সারেনি। এমন সময় তিনা এল তার বাংলা বই নিয়ে। ‘আমার দেশ’ এর ষড় ঋতুর ‘হেমন্ত’ পড়ছিল- “ হেমন্তে নবান্ন উৎসব ঘরে ঘরে।” হটাৎ আমাকে প্রশ্ন করে নবান্ন উৎসব কি বাবা। আমি সংক্ষেপে বুঝালাম- ‘কৃষকের নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসব।’

-ধানগাছ কেমন বাবা ? তিনা জানতে চায়। কি দিয়ে বুঝাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আবার প্রশ্ন উৎসবে কে কে আসে? ‘ মা-বাবা,ভাই-বোন,দাদা-দাদী, নানা-নানী,মামা-চাচা সবাই’, আমি বললাম।

আমাদের নবান্ন কর না কেন? বলেই জিভ কেটে নিজেই উত্তর দেয়- ‘আমাদের তো ধান নেই তাই না বাবা? আমি শুধু মাথা ঝাকালাম। উত্তটা তেমন মনঃপুত হয়নি তাই আবার বলে- ‘তুমিই তো বলো,দাদুদের অনেক জমি,অনেক ধান হয়।’ দাদুরা নবান্ন করে না কেন বাবা?

বর্তমান ব্যস্তার সময়ে সাহিত্য করার তেমন সুযোগ পাই না। আজ ছুটির দিন যদিও একটু ফুরসত পেলাম ,তিনার পাল্লায় পড়ে সেটুকুও পন্ড হতে বসেছে। তিনার মাকে ডাকলাম। তিনার মা তো আরও এক আঙুল উপরে; গলা চড়িয়ে বলে-‘সামলাও তোমার আদুরে মেয়েকে।’ তিনা এই ফাঁকে কখন চলে গিয়েছে;তখন থেকে দরজার ফাঁকে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে বসল তিনা, হাতের কাছে যা পায় তাই আছড়ে ফেলছে। গিন্নি মরার উপর খাড়ার ঘা দিয়ে বলে-‘সামলাও ঠেলা।’ বলে নিজ কাজে ব্যস্ত হয়। অবশেষে তিনার হাতে পায়ে ধরে ‘এক দুপুরের কাজে তিন দুপুর ব্যয় করে তবেই রক্ষা।’

এই ফাঁকে বলে রাখা ভাল আমি একটা এন জি ও তে কাজ করি। শহরের যে দিকটায় থাকি সে দিকটায় গ্রাম তো দূরের কথা গ্রামের গন্ধটিও পাওয়া যায় না।

-দুই-

-বুবু তোমার নাম তিনা ক্যা কও দেহি?
-আমরা তিন বোন তাই আমার নাম তিনা। উত্তর শুনে দাদু থ মেরে যায়।
তিনার নামটি ওর দাদুই রেখেছিল। তিনা ওর নামের ব্যাখ্যা কোনদিন শুনেনি অথচ কি সুন্দও ব্যাখ্যা দিল। হঠাৎ করে দাদুকে প্রশ্ন করে বসল ‘তুমি নবান্ন কর না, না?
-হটাৎ নবান্নের কতা ক্যা বুবু ?
মডাম আপু বলেছে- ‘নবান্নে খুব আনন্দ হয়।’ বলতে বলতে একটি কাঠের স্কেল এনে খাতায় মার্জিন দিতে বসে। মার্জিন দেয়া শেষ হলে দাদুর দিকে ফিরে বসতেই হাতের চাপ খেয়ে স্কেলটি ভেঙে যায়। মন খারাপ হয়ে যায় তিনার। সহসা দাদুকে বলে-
-স্কেল কি দিয়ে তৈরি হয় দাদু?
- কাট দিয়ে।
-কাঠ কি দিয়ে তৈরি?
-গাছ থেইকা কাট অয়।
-কাঠ বুঝি খুব নরম? উত্তর না পেয়ে আবার বলে-‘ধান গাছের কাঠ হয় না দাদু?
তিনার কথায় দাদু হো হো করে হেসে ওঠে।
-হাসির আবার কি পেলে?
-আমরা যেমন অজ-পাড়াগাঁয়ে থাহি শহরের আঁচ পাইনা,তোমরাও তেমন অজ-শহরে থাহো গাঁয়ের কোন আঁচ পাওনা।
-সে কি দাদু?
-তা না অইলে কি? ধান গাছের তক্তা অয় কি না তাও জাননা বুবু।
-ও হো থুক্কু থুক্কু দাদু, কথাটা ছাড়া পড়ে যাচ্ছে।
-কোন কথাডা বুবু ?
- ঐ যে নবান্ন। তোমরা তো গ্রামে খাকো নবান্ন কর না কেন দাদু? নবান্ন করলে তো অনেক আনন্দ করা যায়।
-সে তো অনেক কতা বুবু।

আমার বাবা আসমত আলী দু’দিন হল এসেছেন। গ্রামে আমাদের জমি-জিরাত বেশ ভাল। দিন কালও ভালই চলছে। তিনা ও তার দাদুর মধ্যে অনেক ভাব। দাদুকে পেলে তিনা আমাদের (বাবা –মা) কথা ভুলে যায়।এমন কি খাওয়ার কথাও। আমি হঠাৎ এসে পড়ায় দাদু নাতনীর কথার মধ্যে ছেদ পড়ে ,কিন্তু বাবা কথার রেশ টেনে তিনার সঙ্গে কথা বলতে থাকে।
-কেনো বুবু তুমি নবান্ন নিয়া এত মাতা ঘামাইতাছ ক্যান্ ।
তিনা ও তার দাদুর আলাপের বিষয় বস্তু আমার গোচরে এলে আমিও যোগ দিলাম:-
-বাবা,তিনা আজ দু’দিন থেকে নবান্ন নবান্ন করছে।
-ও আমার কাছে জানবার চায় ধান গাছের তক্তা অয় কিনা।তুই তো একবারও ওকে গেরামে নিয়া গেলি না; ও জানবো কেমন করে যে ধান গাছের তক্তা অয় কি না।
-সময় করে উঠতে পারি কই।
-নবান্ন হলে আমি দাদু বাড়ি যাবো। তিনা বলে।
-বুবুরে নবান্ন তো অনেক আগেই দ্যাশ তেইক্কা উইঠ্ঠা গেছে। এহন মানুষের সুখ আছে ঠিকই কিন্তু শান্তি নাই।
কথাটা তিনা তেমন বুঝে না।
-নবান্ন করলে তোমাদের বাড়িতে যাবো,তোমার সাথে কথা বরবো ; তা না হলে তোমার সাথে আমার আঁড়ি। এক দুই তিন ,এই মুখ বন্ধ করলাম।
-তিন-

‘ধান গাছের তক্তা হয় কিনা’ কথাটি আসমত সাহেবকে মন-কাঁটার মতো ভীষণ যন্ত্রনা দিচ্ছে। তিনি তিনাকে গ্রাম দেখাবেন ,মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন এবং সামনের অগ্রহায়ণে নবান্নের সিদ্ধান্ত নেন।

তিনা ও তার দাদুর মধ্যে এখন প্রায়ই মোবাইলে কথা হয়।
-বুবু একখান্ খুশির খবর আছে।
-কি খুশি দাদু?
-সামনের আঘনে নবান হইবো।
-কি মজা! কি মজা!
তিনা তিড়িংবিড়িং লাফিয়ে এসে আমাকে খবরটা দিলে আমি কৃত্তিম উৎফুল্ল প্রকাশ করে ওকে বিদায় দেই। ও অনেক সেন্সিটিভ, ওর সাথে উৎফুল্ল প্রকাশ না করলে ওর হাতে পায়ে ধরে এক বেলা যাবে ওর মনের পরিবেশ স্বাভাবিক করতে। আমার উৎফুল্লের কিছু নেই কারন সিংহভাগ খরচটা আমারই ঘাড়ে।

-চার-

হেমন্ত শুরু হয়েছে, মাঠজুড়ে সোনালি ধানের সমারোহ; ক্ষেতের আলে আলে ঘুরলে নাকে আসে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ। আসমত সাহেব ধানক্ষেত দেখছেন কিন্তু আগের মত মন ভরেনা । আগে কত রকমের ধান ছিল,বিচিত্র তাদের নাম। কনে-মুখী, জামাই-মুখী,বিয়াইন-আদর, বিন্নি আরও কত কি। বিন্নি ধানের খৈ তো ছিল বাংলার বিখ্যাত। বেতো,জলঘুঙুর তো ছিল পানির রাজা,এদেরকে বর্ষার পানি কখনও ডুবাতে পারতো না; পানির সাথে পাল্লা দিয়ে এরাও বেড়ে উঠতো। নামও যেমন আলাদা, স্বাদও তেমন আলাদা ।

বর্তমানে হাইব্রিড হাতে গোনা কয়েকটি ধান মাত্র,তাতে স্বাদের যেমন পরিবর্তন হয়েছে ,মানুষের মনেরও তেমন পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত হওয়াতে মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়না কিন্তু মানুষের মনে আগের সেই আনন্দ নেই।

তিনার পরীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে,পরীক্ষা শেষে নবান্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যদিও ১লা অগ্রহায়ণ থেকে পরব শুরু হয়। সব আত্মীয় স¦জনকে দাওয়াত করা হয়েছে। তিনার ছোট খালা আসছে সুদূর মার্কিন মুল্লুক থেকে। তিনার ছোট চাচা আসছে থাইল্যান্ড থেকে। ওখানের ঝিনুক ও মুক্তোর মালার খুব নাম। তিনা ঝিনুকের মালা আনতে বলেছে ছোট চাচাকে। সব থেকে মজার আকর্ষণ হল- ছোট মামা আনছে সুদূর ময়মনশিংহ থেকে পালা গান। সারা গ্রাম আনন্দে টইটম্বুর।

তিনার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই কথা হয় আসমত সাহেবের। তিনা জানায় কাল পরীক্ষা শেষ হবে,ছুটি বেশি নাই তাই কালই রওনা হবে। আসমত সাহেব আয়োজনের এক ঢাড্ডা বর্ণনা দেয়-, জামাই-মুখী ধানের সিন্নি,কনে-মুখী ধানের পায়েস,বিন্নি ধানের খৈ ; কত রকম পিঠে-, মালপোয়া, দুধপোয়া, আন্দেসা,আর পিঠার রাজা চিতই পিঠা তো আছেই,কে না চেনে এই চিতই পিঠাকে। আরও আছে জামাইঢেলা। জামাইঢেলা পিঠার কথা শুনে তিনা হিহি করে হেসে ওঠে।
-দাদু তুমি জামাইঢেলা পিঠা খাইছ ?
-হ বুবু ঢেলও খাইছি, তর দাদী বেড়ার ফাঁক দিয়া পিডা দিছে হেইডাও খাইছি।
তিনা আবারও হাসে হিহি।
-পাঁচ-
তিনার মুখটা সকাল থেকে ফ্যাকাসে ফ্যাকাসে মনে হচ্ছে। গায়ে হাত দিলাম জ্বর জ্বর ভাব,জানতে পারলাম সকাল থেকেই নাকি ওর খারাপ লাগছে এবং ঐ অবস্থায় সে পরীক্ষা দিয়েছে। বিকেলে জ¦র আরও বাড়ে। মনটা অজানা এক আশংকায় আৎকে উঠে। বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরের ভীষণ প্রকোপ,সারা দেশ ব্যাপী চলছে আতংক। বড় বড় স্বাস্থ্যকমীর্, অফিসাররাও.....। তড়িঘড়ি ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এলাম, ডাক্তার নির্বাক;আমার চোখে শুধু তিনার মূখখানা.......!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কেতকী ওহ! ভোট বন্ধ!
কেতকী কিছু না জানা ধানের নাম জানলাম। ধন্যবাদ।
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত ভাল লাগল । শুভকামনা রইল ।
অনেক শুভ কামনা দাদা। ভাল থাকবেন।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

‘তিনা’ গল্পে গ্রামের নৈসর্গিক আনন্দের প্রতি শিশু মনের চিরায়ত টানকে বুঝানো হয়েছে।

১৯ মার্চ - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৫৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪