প্রত্যহ প্রত্যুষে তিনি রাস্তা দিয়ে দৌড়াতেন আর বলতেন- ‘কে দুইন্না নিবা উঠো, কে আখেরাত নিবা উঠো’। অতি সকাল বেলা ঘুমের ঘোরে কথাটা বাজে লাগত মানুষের কেননা তখনও অধিকাংশ মানুষ ঘুম থেকে উঠেনা। এ যেন তার রুটিন বাঁধা কাজ। মানুষ তাতে অতিষ্ঠ কিন্তু কেউ কিছু বলেনা। সবাই তাকে সাইজু পাগলা বলে চেনে।
অমেদ ও সমেদ শহরে লেখাপড়া করে, দুদিনের জন্য গ্রামে বেড়াতে এসেছে,অবশ্য এ গ্রামেই তাদের জন্ম। নাম শুনে এবং এদের দুজনের আচার ব্যবহার দেখে দু’ ভাই মনে হলেও তারা বন্ধু। বাড়ি একই গ্রামের দু’ পাড়ায়। অমেদ বড়লোক হলেও সমেদ বিপরীত অর্থে ছোটলোক তবে ছোটলোক নয়। দুজনেই সকাল বেলা হাটতে বেড়িয়েছে, পথে সাইজু পাগলার সাথে দেখা; সাইজু পাগলা তখনও চিল্লাচ্ছে- কে দুইন্না নিবা উঠো, কে আখেরাত নিবা উঠো’।
চাচা এগুলা আপনে কি কন?
হ ঠিকইতো কই,দুইন্না নিলেও সকালে উঠতে অইব,আখেরাত নিলেও সকালে উঠতে অইব,এ্যার ব্যত্যয় কি।
অমেদ সহাস্যে বলে-চাচা আমারে ‘দুইন্না’ দেন।সমেদ বলে- আমার ভাগে তা হলে আখেরাত চাচা।
সাইজু পাগলা দুজনের আপাদ মস্তক চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নেয়; তারপর মুচকি হাসি মারে।
অ, তোমরা অমেদ সমেদ না?
হ চাচা।
তোমার বাপতো........শেষ না হতে অমেদ বলে-
হ চাচা।
দুইন্নার ওজন কত জানো ? লইতে পারবা?
অমেদ মাথা চুলকায়
তারপর সমেদের দিকে তাকিয়ে বলে – তুমি আখেরাত লইবা ?
অমেদ যেহেতু একটা লইছে আমার তো অন্যটা লওন লাগে, না কি চাচা?
আইচ্ছা ।
চাচা কখন দেবেন ?
কাইল সকাল আটটায় আমার বাইত্তে আইসো।
পরদিন সকালে সমেদ কি একটা কাজে আটকা পড়ে তাই অমেদ একাই আসে সাইজু পাগলার বাড়িতে । বাড়িতো নয় পাখির বাসা, এ যেন আসমানিদের বাড়ি। উঠোনে আসমানির বয়োসী একটা মেয়ে, হাতে পান্তা ভাতের থালা; দু’ গালচি দিয়ে তখনও চুইয়ে পড়ছে পান্তার পানি। পাশে বসে সাইজু পাগলা কি একটা বই পড়ছে।
স্লামালেকুম চাচা
ওয়া আলাইকুমুস সালাম। স্লালামালেকুম না অমেদ, ছহি অইল- আস্সালামু আলাইকুম।প্রথম কথাতেই থমকে যায় অমেদ; একটা হালকা শট খায় পিটুইটারীতে, কিছুটা থতমতো খেয়ে বলে-
না মানে ওরকমই তো প্রায় সবাই বলে।
হ জ্যানারেল শিক্ষিত্রা পেরায় ঐ রহমই কয়। দুক্কু বিষম দুক্কু, মিয়ার পো; কোনডা ছহি আর কোনডা ছহিনা তারা হেডা বুঝেনা, বুঝার চেষ্টাও করেনা; অথচ মুসলমান নাম ফাডায়া বেড়ায়।
অমেদের কিছুটা হলেও আঁতে ঘা লাগে; তবুও সায় দিতে হয়।
হ চাচা কিছুই আরবি শিক্ষা করতে পারি নাই।
পারো নাই না, পড়ানো অয় নাই, এই পড়ার দাম কম, এ পড়া দিয়া তো আর লাক লাক টেহা কামাই করা যায়না, তাই আইজ কাইলের বাবা মাগো ইচ্ছাও কম। এই পড়া কামে লাগে বিয়ার সমে আর মরনের সমে।
অমেদ নির্বাক।
দাড়াইয়া দাড়াইয়া কতা কইতাছি যে!আহো আহো গরে বহো, এই ছমিরনের মাও মোড়াডা লইয়া আহো, দ্যাহ কেডা আইছে।
অমেদ ক্ষণকাল অবাক,কে বলে সাইজু পাগলা, বুদ্ধিজীবিও তো ফেল।সামান্য সময় খরচ করে বলে-
চাচা কাল যে আপনি বললেন ..........।
অ হেই কথা, তওবা তওবা, হুনো মিয়ার পো,দুইন্না আখেরাত দেওয়ার কারও সাইদ্য নাই,তয় চোহে দেহা যায়।
চাচা এটা কি বললেন, আমি তো কিছুই বুঝলাম না।
মিয়ার পো বুঝবা, বুঝবা; বহো আগে চাইরডা পান্তা খাও।
বলতে বলতে বুড়ো স্ত্রী থালায় করে পান্তা ভাত ও কাঁচা মরিচ দুজনের সামনে এনে দেয়। সাইজু পাগলা গো-গ্রাসে খেতে খেতে বলে-
ক্যা,হেই কবিতাডা পড় নাই? “কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর......” স্বর্গ নরক তো আতের কাছে।
হ পড়ছি।
কার লেহা কও দেহি?
(সলজে) মনে নাই চাচা।
দুক্কু, এই হানেই তো দুক্কু;এহনকার ছাতরোরা তো কবিতা মুকস্ত করেনা কবির নাম কইব ক্যামনে। বত্তমানে বাইচা আছে এমুন একজন কবির নাম কও দেহি?
চাচা ঐগুলান পড়ার তেমন সময় পাইনা।
হা-হা-হা, আসাইলা অমেদ,বত্তমান ছাতরোরা পড়েডা কি! যাক হে কথা। হুনো অমেদ, এই দুইন্নায় যার একদম হাত পাও ছাড়া কিচ্চু নাই তারাই সুখি;আর যাদের অনেক আছে, তারা।
চাচা একটু বুুঝিয়ে বলেন
দরো আমার কতা,আমার যেটুকু জমি,হেটুকুতে খোরাকী অয়না; আবার আমি এক পরকার গেরস্ত বলে কেউ কামেও ডাহেনা,তাই এই পান্তাবাত কফালে।যাওকগা কামের কতায় আহি।তুমি দুইন্না নিবা কইছিলানা ?
হ চাচা, অমেদ বলে।
তাইলে কাইল ফজর থিকা আমার লগে গুরন লাগব,পারবা?
এতক্ষণে সমেদেও কথা তার মনে পড়ে।
সমেদ আইলো না?
না চাচা ও একটা ঝামেলায় পড়ছে।
অ, কি কও মিয়ার পো।
অমেদ সকৌতুকে সায় দেয়।
পরদিন খুব সকালে অমেদ ও সাইজু পাগলা যেতে থাকে জেলে পাড়ার দিকে । প্রথম বাড়িটাই নাড়– গোপালের। সূর্য্য তখনও না উঠলেও নাড়– গোপালের ডেরায় কথার ভাঁজ পাওয়া যাচ্ছে। সাইজু ডাক ছাড়ে , অ নাড়– গোপাল, ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢোকে।
কি রহম মাছ পাইলা নাড়–?
পাইছি কাহা, আইজ চলবি। যদিলকাল বাহি না পড়ে । বাহি পড়লে তো কলিকাল বাদাবোনে বউ।নাড়–র স্ত্রী জাল গোছ করছিল, ছ্যাত করে উঠে বলে
দেহেন কাহা আমি ভুইতের সংসার করি, মাছ নিয়া ব্যাপারীর প্যাড ভরাবে ; আনবার সময় আনবে কাঁচকলা ।
নাড়– খানিকটা ফুসে উঠে। অমেদের চোখে পড়ে তার নেংটি পরা পাছা ঠান্ডায় তখনও ঠকঠক করে কাঁপছে। সাইজু বলে নাড়– যাইরে।
তখন বেলা অনেক বেড়েছে, গা ঘেমে যাচ্ছে অমেদের। সাইজু আগে আগে যাচ্ছে, সামনে একটা ভাঙ্গা সাঁকো; তড়তড় করে পাড় হয়ে গেল সাইজু; অমেদ টিপটিপ করছে। কি মিয়ার পো দরন লাগবো নাহি? বলে মিটিমিটি হাসতে থাকে। আমার অব্যেস অয়া গ্যাছেগা।
পাশের ক্ষেতে কাজ করছে পরান শেখ । হাত ইশারায় ডাকে সাইজু। আরে মিয়া জিরায়া যাও, বলে কি একটা গাছের নীচে বসে। পরান শেখ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আসে।
কার কাম কর মিয়া?
দেওয়ানির।
চুলায় আড়ি চড়ব তো?
কি করমু, কাম তো পাইলাম না।মিয়াবাই কপালে আছে আড়, কি করে চাচা খাজিন্দার।
বিকেলে অমেদ ও সাইজু পাগলা বাজারের দিকে যাচ্ছে। অমেদকে সাইজু পাগলার সাথে হাটতে দেখে কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে; সাইজু পাগলা সেটা বুঝতে পেরে বলে-
হাসো ক্যা মিয়ারা ? বইুঝবা, বইুঝবা; আইজ বুইজবানা বুইঝবা কাইল ,মাথা হাতাইবা পাইড়বা গাইল।
ইতোমধ্যে পথে পরান শেখের সাথে দেখা
বাজার অইল পরান, কি কিনলা?
কি আর কিনমু, দেওয়ানীর তো দেহাই পাইলামনা, টেহা পামু কই?
রাইতে খাবা কি ?
কি আর খামু, পোলার মায়ে কয়ডা আলু কুড়ায়া আনছে দেখছিলাম, ঐ কয়ডা হিজান ছাড়া.......।
বাজারের মুখে ঢুকতে তারা দেখে নাড়– গোপাল ও ব্যাপারীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে।
মোর ছাওয়ালরা রাইতে খাইবে কি ,টেহা না দিলি?
কি খাবি, মুই কি কইরে কমু।তোরে কইছিলাম বড় মাচ দিতে; তুই দিলি বগের পুটকি দিয়া ঝইরা পরে হেই মাছ।
বড় মাছ দরতে পারিনাই কর্তা।
তাইলে টেহা চাস ক্যান? ভাগ, বলে সরে পরে সে।
নাড়– গোপালের মুখ বিমর্ষ হয়ে যায়। অমেদ স্পষ্ট দেখতে পায় নাড়– গোপার বিড়বিড় করে মুখ নাড়ছে,যা বলছে তাতে কানার ভাই অন্ধও বুঝবে এটা কোন আর্শিবাদের কথা নয়; এই দুনিয়ায় পঁচে মরার কথা।অমেদ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সেদিকে। সাইজু পাগলা অমেদে গায়ে হালকা ঝাকি দিয়ে বলে-“ এই নেও দুইন্না বলে- নাড়– গোপালের দিকে ইঙ্গিত করে,সমেদেরেও পাঠায়া দিও তারেও একদিন হাতে আখেরাত দরায়া দিমুনে।
তারপর নাড়– গোপাল কাঁচকলা নিয়ে বাড়ি ফিরে।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
সুপ্রিয় পাঠক,
এই পৃথিবীতে নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা বরাবরই আমাদের উচ্চ শ্রেণির দ্বারা নির্যাতিত,আমরা উচ্চ শ্রেণী কখনও ভাবতে চাইনা যে, তাদেরও মানুষের মত বাঁচার অধিকার আছে ,স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত আমরা । পার্থিবে নিম্ন শ্রেণির জীবন ধারা দেখানোর মাধ্যমে বিষয়ের সাথে গল্পের সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করা হয়েছে ।
১৯ মার্চ - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৫৮ টি
সমন্বিত স্কোর
৮.৫২
বিচারক স্কোরঃ ৬.৭২ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ১.৮ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪