১
সুলথা মিয়ার কপালে ভাঁজ পড়েছে; ভুরু কুঁচকে উঠেছে তার। পদ্মাপাড়ের প্রচণ্ড রোদে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। এবারের সূর্যের তীব্রতাও যেন অনেক বেশী। তবে এই রোদে সুলথা মিয়ার কোন ভাবান্তর অবশ্য নেই। সে এই পদ্মা পাড়েরই ছেলে। বংশানুক্রমে জেলে সে-তাই খর রৌদ্রের সাথেই আজন্ম বসবাস। কি রোদে পোড়া, অথবা অঝোর বৃষ্টিতে স্নান সবই তার জীবনের নিত্য সাথী যেন। আহারের দুবেলা খাদ্য জোটানই যেখানে ঝক্কি,তারও মাঝে আছে কিছু সুখ স্বপ্নও। প্রতিটি ভোরের সূচনা হয় এখানে নতুন স্বপ্নে-কোনটাই পূরন হবেনা জেনেও। পাড়ে বাধা নৌকায় বসে গান গাইছিল সুলথা মিয়া। খুব স্পর্শকাতর পল্লী-বিরহের গান। পাশে বসা হাশেম মাঝি গানের অনুষঙ্গ হিসেবে কিছুক্ষণ পর পর সমঝদারের ভঙ্গিতে ‘আহা,আহা’ করছিল। বসে থাকবার সময় এখন না তাদের,বাতাসের অপেক্ষা করছিল তারা। অবসরের ফুরসত কোথায়? সামনে পহেলা বৈশাখ। শহরের ইংরেজি চালের কেতাবি মানুষেরা এই একদিনের জন্য খাঁটি বাঙালি হবেন,সে রসদ তো সুলথা মিয়াদেরকেই যোগাতে হয়-তাদের পাতে ইলিশ তুলে দিতে ব্যস্ততার শেষ নেই হাজারো মাঝির। বেলা শুরু না হতেই জাল ফেলে তারা। আরও মাছের আশায় নদীর গভীর থেকে গভীরে বেয়ে চলে নৌকা। দিন রাত কাটে ব্যস্ত সময়। সারা রাত খেটে খুটে ভোরে মাছগুলো আড়তে পৌঁছে দিয়ে তার পর ঘুমুতে যায় তারা। পরদিন আবার সকাল না গড়াতেই কাজের শুরু। রাত্রি শেষে সামান্য যা আয় তাতে সাতটি পেট চালান দুঃসাধ্যই বটে। গান গাইতে গাইতে থেমে যায় সুলথা মিয়া। ‘কি মিয়া থামলা যে?’ হাশেম মাঝি বলে উঠল।
‘বাতাস ছাড়ছে কাহা,চল যাই’ ।
হাশেম মাঝি মাথা নাড়েঃ ‘হ,নাও ছাড়্ আহন’।
লগির খোঁচায় নৌকা সামনে এগোয়-বৈঠা বাইছে দুজনেই। নৌকাও বেশ এগিয়ে চলেছে সামনে। নদীর কিছু গভীরে যেতে না পারলে মাছ তেমন উঠবে না জালে। গত কদিনের ধকলে শরীরটা ভাল যাচ্ছে না সুলথা মিয়ার,সাতজন নিরন্ন মানুষের মুখ দোলা দেয় ভাবনায়। অসুস্থ শরীর অবসর চাইতেই পারে-তবে সেটা কারো কারো জন্য বিলাসিতা। বাবার ওশুধ,মায়ের বাতের বাথায় অঘুমো রাত,বিধবা বোন,বোনের দু’সন্তান; আর সবার মধ্যে ছাপিয়ে উঠে কমলার শ্যামলা মুখ। গত পৌষে বিয়ে হয়েছে ওদের। ভারী মিষ্টি মেয়েটা। স্বামী অন্তঃপ্রান মেয়েটা সারা দিন সংসারের একাজে অকাজে খেটে চলে। সাত চরে রা নেই মেয়ের। বিয়ের দিনেও ভাল কোন শাড়ি দিতে পারেনি সুলথা বউটাকে,মনে পড়তেই বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। তরুণ মাঝির মনে খেলে যায় কত কথা,বউ হয়ে আসার পর থেকে ওর নিত্য অভাবের সাথে মিশে আছে বউটির জীবন। আজ এতদিন পর সে একটা বায়না ধরেছে,দরিদ্র মাঝি অনিশ্চিত সে দাবি আদৌ পূরণ করা সম্ভব হবে কিনা। অস্ফুটে বলে উঠে সে-
‘কাহা,চইত মাস তো স্যাশ হয়া আহে- পয়লা বচ্ছরে আমাগোর ট্যাহা কিছু বারাইব না?’
হাশেম মাঝি হাসে-
‘ নারে পুলা,আমাগরে কিছু দিতে রাজি অয় নাই মহাজন।’
চমকে উঠে সুলথা,বুকে মোচর দিয়ে উঠে তার। নতুন বছরে কিছু বারতী আয় না হলে বউটাকে দেয়া কথা রাখবে কিভাবে সে? সে যে কথা দিয়েছে ‘’নয়া বচ্ছরের পয়লা দিনে আর পান্তায় মরিচ ডলতে হবে না’’-ভাজা ইলিশ দেবে পাতে তুলে। কিন্তু বাড়তি টাকার যোগার না হলে সেটা যে আর কোন ভাবেই সম্ভব না। তাছাড়া তার মা বলেছে প্রথম পোয়াতি নয়া বউকে বাচ্চা প্রসবের আগে বাবার বারিতে পাঠাতে হলে নতুন শাড়ি চুড়ি আর ফিতাও লাগে বৈকি।
চিন্তায় হোক আর রোদেই হোক কপালটা কুঁচকে থাকে তার। বাবা ছেলেবেলায় নাম রেখেছিল সুলতান মিয়া। ৭বিঘা জমি-হালের বলদ সহ বেশ সচ্ছলতাও ছিল। পদ্মার ভাঙ্গনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। বাধ্য হয়েই বাবার সাথে সুলতান মিয়ার শৈশব পরিনত হয়েছিল সুলথা মাঝিতে। চিরাচরিত জেলে জীবনে লাগেনি দিন বদলের হাওয়া। গঞ্জের TV তে ওরা শুনতে পায় বাজারদর। কিন্তু পানিতে বাস করে কুমিরের সাথে তো যুদ্ধ চলে না,তাই সব জেনেও কিছু করার থাকে না। সারাদিন এমন নানান ভাবনায় কেটে যায় তার। দিন গড়িয়ে রাত আসে,তার পর রাত্রিও বাড়তে থাকে,এক সময় ঝিমুতে থাকা হাশেম মাঝি বলে ওঠে-
‘’রাইত তো ম্যালা হইল,চল ফিইরা যাই।‘’
সুলথা’র মোটেও ফিরবার ইচ্ছে নেই। মা-বাবা আর স্ত্রীর জন্য সামান্য কিছু’র বাবস্থা করতে হলে তাকে আরও কিছু সময় থাকতে হবে। তাই সে বললঃ
‘’আর এক বার জাল ফালাই না ক্যান কাহা?’’
হাশেম মাঝিও রাজি হয়। দূরাগত কোন নৌকা থেকে মাঝিদের কণ্ঠ ভেসে আসছে... সেইসব নৌকার মৃদু আলো গুলো পদ্মার বুকে অপূর্ব শোভা বাড়িয়েছে। কিন্তু সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার ক্ষমতা জীবন যুদ্ধে বিপর্যস্ত দরিদ্র মানুষদেরকে দেয়া হয়নি।
২
সারাদিনের কাজ শেষে বারান্দায় মাদুর পেতে বসে ছিল কমলা। কেরোসিন বাতির আলোয় কিছু একটা সেলাই করছিল সে। পাশেই থালায় ভাত, সামান্য বাসি তরকারি আর ডাল। একটা ছোট বাটির এক কোনে কিছু কাটা পেঁয়াজ, মরিচ রাখা। ছোট একটা কলসে পানি রাখা আছে। দরিদ্র আয়জন,কিন্তু তাতে ভালবাসা আর যত্নের ছাপ স্পষ্ট। রাত বেড়েছে,কিছুটা ঝিমুনির মত এসে গেছে তার। কারো গলা খাঁকারি শোনা যেতেই চমকে জেগে উঠল কমলা। কিছুক্ষণ পরেই উঠনে দেখা গেল সুলথা মাঝি আসছে। ত্রস্ত পায়ে প্রায় দৌড়ে গেল সে। মাছের খালুই টা এগিয়ে নিতে নিতে বললঃ
‘’অজুর পানি দিছি।হাতমুখ ধুইয়া আসেন।‘’
হাত-মুখ ধুয়ে এসে মাদুরে বসল মাঝি। ততক্ষণে কমলা নতুন আনা মাছ কেটে বেছে চুলোয় ছাপিয়েছে। স্বামীর ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলঃ
‘’জ্বাল দিয়া আনি,বেশিক্ষণ লাগব না।‘’
মমতায় আর্দ্র হয়ে যায় মাঝি-
‘’এই কামডার কি দরকার আছিল? খমখাই কষ্ট বাড়াইলি কমলা।’’
কণ্ঠে স্পষ্ট সহানুভুর ছাপ।
কমলা লাজুক হাসিতে কমলা বলল -
‘’কষ্টের আর কি,বাসি সালন খাইতে আপনার ত কষ্ট হইত’’
অদূরে শাশুড়ির সাড়া পেয়ে ঘোমটা আরও টেনে নেয় কমলা। পাশে বসে সস্নেহে ছেলের খোঁজ নিল। সংসারের অভাব অভিযোগের সামান্য কিছু কথাও হল,তবে ক্লান্ত ছেলেকে অবসর দিল বিশ্রামের;বেশিক্ষণ আর দাঁড়াল না সে।
বাসাপাশি বসে আছে দুজনে,কারো মুখেই কথা নেই তবু যেন অনেক কথাই বলা হয়ে যাচ্ছে-উঠনে চাঁদের আলো পড়েছে,সে অবাক চোখে মুগ্ধ তরুণ তরুণীর ভালবাসা দেখছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর আর কি কিছু থাকতে পারে?
৩
রাত কিছু বাকি থাকতেই বেড়িয়ে পড়েছিল তারা আজ,কাল পহেলা বৈশাখ। মাছের দামটাও চড়া,তাই মাছ পাবার আকাংখাও ওদের বেশী আজ। নদীর দুলুনিতে তন্দ্রামত এসে গিয়েছিল তাদের,তারপরও দুজনে কাজ করে যাচ্ছে সুলথা আর হাশেম মাঝি-দুজনেই। দুপুরের দিকে চিন্তিত হয়ে পড়ল দুজনেই। ঐ যে আকাশের কনে কাল মেঘ দেখা যাচ্ছে। চিন্তাটা কিছুক্ষণের মধ্যেই আতঙ্কে পরিণত হল। কালবৈশাখী ঝড় এত দ্রুত আঘাত হানবে ভাবনাটা সেভাবে নারা দেয়নি আগে,তাই তেমন কোন সতরকতাও তারা নেয় নি। হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল ঝড়,আর মুহুর্তেই সেটা দানবীও রুদ্র রূপে হাজির হল।
একমনে আল্লাহকে ডাকছে দুজন। কিছু বুঝে উঠবার আগেই বড় একটা ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাদের। দক্ষ সাঁতারু হলেও গর্জে উঠা পদ্মার সাথে পেড়ে উঠছে না কিছুতেই। তারপরও বাঁচার তাগিদে অনুমানে তীরের দিকে সাঁতরে যাবার চেষ্টা করছে প্রাণপণ। ডোবা ভাসার ফাঁকেই কমলার শান্ত শ্যামলা মুখটা মনে পড়ল সুলথা’র...’’আহা এই জীবনে বুঝি আর দেখা হবে না’’...নিঃশ্বাস আটকে আসছে,চেতনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার..................
কোন এক বিচিত্র কারণে জ্ঞান হারানোর আগে শৈশবের বাজান মেলার বাঁশির সুর শুনতে পেল সে...।।
৪
ঝড় থেমে গেছে। এদিকে জেলেপাড়ায় নতুন ঝড় উঠেছে। কেউ স্বজন হারিয়েছে,কারো বা প্রিয়জন ফিরে আসেনি এখনো.. সেই একই চিরাচরিত আবহমান গ্রাম বাংলার মাঝি জীবন...মৃত্যু যেন এখানে ওঁত পেতে থাকা ক্ষুধার্ত জন্তুর মত...।
সুলথার বাবা সেই তখন থেকে নদীর তীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্ন অনেক মাঝির সাথে সেও ঝড়ে নিখোঁজ।
শোকে পাগল হয়ে গেছে সুলথার মা-বোন;বিলাপ করে কাঁদছে তারা।
আর কমলা নিশ্চুপ নির্বাক পাথর যেন। কান্নার শক্তিও হারিয়েছে সে। চোখে জল গড়িয়ে শুকিয়ে গেছে-তাকে উদ্ভ্রান্ত উন্মাদিনীর মত দেখাচ্ছে। স্বামী নয় শুধু,অনাগত সন্তানের চিন্তায়ও ব্যাকুল সে। আপন মনে নিজেকেই দোষ দিচ্ছে সে,
’’আমার জন্যই মাঝ নদীতে গিয়া তার এই অবস্থা। আল্লাহ আমি কিছু চাই না শুধু তারে ফিরায়ে দেও আল্লাহ্।‘’
হারানর তীব্র ব্যাথায় পরিবারটির সবাই মুষড়ে পড়েছে ভয়ানকভাবে। অনেকে সান্ত্বনা দিতে এসেছে। ভীড়ের মাঝে কেউ একজন বলে উঠল হাশেম মাঝির নৌকাকে উত্তর পাড়ায় ভাসতে দেখা গেছে,সেখানে কাউকে পাওয়া যায় নি।
কান্নার শব্দ এতে আরও বেড়ে গেল,আশংকাই না সত্যি হয় এই ভয়টি প্রবল ভাবে ছেপে বসল তাদের মনে।
৫
তীব্র রোদে সুলথা মিয়ার কপালে ভাঁজ পড়েছে; ভুরু কুঁচকে উঠেছে তার। পিপাসায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে,পদ্মাপাড়ের প্রচণ্ড রোদে ঝলসে যাচ্ছে চোখ। এবারের সূর্যের তীব্রতাও যেন অনেক বেশী। তবে ঝড়ে ডুবে বালির চড়ায় জ্ঞান ফিরে পেয়ে এই রোদ কারো খারাপ লাগবার কথা নয়;তারও লাগছে না। বরং রোদটিকে কমলার শ্যামলা মুখের মতই মধুর মনে হচ্ছে।
মা-বাবা আর কমলা কতই না ভাবনায় আছে,চোখের পানি মুছবার চেষ্টা করল না সে; সেজদাহ করে শোকর জানাল আল্লাহর।
তারপর উঠে দাঁড়াল সে প্রিয়জনদের কাছে যাবার আকুলতায়;
দ্রুত পা চালাচ্ছে সে,আজই আবার তাকে বেরতে হবে সাতটি মুখের খাবারের সন্ধানে ।
পদ্মার মাঝিরা খুব দ্রুতই স্বাভাবিক হবার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে।
০৮ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪