প্রিয়ন্তী
মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা চঞ্চলা একটি মেয়ে প্রিয়ন্তী। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান, দেখতে খুব মিষ্টি ছিলো, ধীরে ধীরে আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো। পরিবারের অনেক স্বপ্ন তাকে নিয়ে, একদিন বড় হবে, সমাজে আলোচিত মানবী হবে, দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবে।
প্রিয়ন্তীরও খুব ইচ্ছে ডাক্তার হবে, গরীব ও দুঃখীজনের পাশে দাড়াবে। মেধাবী ছাত্রী ছিলো প্রিয়ন্তী, শিক্ষকদের ও নয়ন মনি ছিলো ।
সবে মাত্র বয়ঃসন্ধিকালে পদাপর্ণ করলো প্রিয়ন্তী , বয়স ১৩ এলাকার নাম করা গার্লস স্কুলে ৮ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করে। ক্লাশের মধ্যে সবচেয়ে মায়াবিনী চেহারার অধিকারিণী ছিলো সে, সুন্দরী বলে প্রতি দিনই এলাকার বখাটেদের দ্বারা টিজিং এর শিকার হতে হয় । নারী বলে কিছুই বলার নাই, প্রতিবাদ করার সাহস তখনো সৃষ্টি হয়নি। নীরবে সহ্য করতে হয় টিজ গুলো ।
আজ ২৬ই মার্চ স্বাধীনতা দিবস, স্কুলে প্রত্যুষে সকল শিক্ষার্থীদের উপস্থিত থাকার জন্য আগের দিন নোটিশ পাঠিয়েছিলো প্রধান শিক্ষক। প্রিয়ন্তী একটু দেরি করে ফেলছিলো ৭ টায় বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছিলো, দেরি হওয়ার কারনে বন্ধুরা তাকে ছেড়েই চলে গিয়েছিলো , তাই একা একা রাস্তার একপার্শ্ব দিয়ে স্কুল পথে হাটছিলো ।
স্কুল থেকে অদুরে পাড়ার টং দোকানে বসে তখন আড্ডা দিচ্ছিলো রানা, রানা পৌরসভা মেয়রের ছেলে, পয়সাওয়ালা পিতার একমাত্র ছেলে, তাই রানার কর্মকান্ডে পিতা মাতার তেমন হস্তক্ষেপ ছিলো না, পড়াশুনাও তেমন করেনি, ১০ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করা কালীন সময়ে বখাটেপনার কারনে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলো, পরে আর পড়াশুনা করে নি, বাবা অঢেল সম্পত্তির মালিক তেমন পড়াশুনার প্রয়োজন নাই, কাজ কর্ম না করেও বসে খেলেও পাঁচ পুরুষ খেয়ে শেষ করতে পারবে না।
রানার দৃষ্টি কোনে বন্ধী হলো রাস্তার বিপরীত পার্শ্ব দিয়ে হেটে যাওয়া ত্রয়োদশী ফুটফুটে বালিকা প্রিয়ন্তী, পকেট থেকে বেনসনের প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট মুখে গুঁজে নিলো, বসা থেকে উঠে পিছু নিলো প্রিয়ন্তীর , প্রিয়ন্তী ভয় পেলো খুব দ্রুত পায়ে হেটে স্কুলের গেট অতিক্রম করে হাফ ছেড়ে বাচলো, চোখে মুখে আতঙ্কের রেখা বিরাজ করতেছিলো, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পর বাড়ির পথে যখন ফিরছিলো পথিমধ্যে আবার রানার সাথে দেখা, ভয়ে বন্ধুদের মাঝে জড়সড় হয়ে গেলো প্রিয়ন্তী। পথ আগলে দাড়ালো রানা, প্রিয়ন্তীর হাত ধরে টান দিলো রানা, বন্ধুরা সাথে থাকার কারনে সে বেলা রক্ষা পেলো প্রিয়ন্তী।
একাকী স্কুলের পানে হেটে যাচ্ছে প্রিয়ন্তী , পথিমধ্যে পথ আগলে দাড়ালো রানা, হাত ধরে টানা টানি শুরু করলো, এক ঝাটকি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে পিছনের দিকে দৌড় দিলো প্রিয়ন্তী, রানা ও থেমে নাই সে ও তাড়া করলো প্রিয়ন্তী কে, প্রিয়ন্তী ছুটে চলছে রানাও পিছনে পিছনে, প্রিয়ন্তী কে আটকিয়ে ফেললো রানা, উড়না টান দিয়ে ফেলে দিলো, প্রিয়ন্তী সজোরে চড় বসালো রানার গালে, রাগে ক্ষোভে রানা পকেটে থাকা ব্লেড বের করে প্রিয়ন্তীর গলা বরাবর টান দিলো, চিৎকার দিয়ে উঠলো প্রিয়ন্তী , নিজেকে আবিষ্কার করলো তার রুমের মাঝে, দুঃস্বপ্ন দেখেছে প্রিয়ন্তী, চিৎকার শুনে বাবা মা দৌড়ে এলো প্রিয়ন্তীর রুমে, জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে তোমার, প্রিয়ন্তী জবাব দেয় খারাফ স্বপ্ন দেখেছি, ভয় করছে খুব, তোমরাও এখানে ঘুমাও, মেয়ের কথা রক্ষার্থে বাবা মা প্রিয়ন্তীর রুমেই ঘুমালো। পরদিন আর ভয়ে স্কুলে যায়নি প্রিয়ন্তী, বাবা মা ভাবলো শরীর খারাফ করছে, তাই স্কুল মিস করছে, আর বিনা কারনে স্কুল মিস করার মতো ছাত্রী না প্রিয়ন্তী।
এরপর থেকে প্রতিদিনই রানার দ্বারা টিজের শিকার হতো প্রিয়ন্তী, কিন্তু ভয়ে কাউকে বলতে পারতো না, এমন কি বাবা মাকে ও না। মেয়ের মাঝে এমন পরিবর্তন দেখে চিন্তায় পড়ে গেলো বাবা মা, যে মেয়ে কিনা সবসময় ঘর মাতিয়ে রাখতো, এখন কিনা তার চোখে মুখে কেমন জানি ভয় বিরাজিত থাকে, বন্ধুদের নিকট থেকে খবর নিয়ে জানতে পারে প্রিয়ন্তী মেয়রের ছেলে রানার দ্বারা প্রতিদিন টিজের শিকার হচ্ছে। এর প্রতিকার করার জন্য প্রিয়ন্তীর বাবা মা পৌরসভা অফিসে গেলো এবং রানার বাবার নিকট রানার নামে অভিযোগ করলো, অভিযোগ শুনার পর রানার বাবা রাতে খাবার সময় রানাকে খুব শাসালো, রাগে ক্ষোভে রানা খাওয়া ছেড়ে উঠে চলে গেলো।
পরদিন সকালে পথিমধ্যে প্রিয়ন্তীর পথ আটকালো রানা, সিগারেটের ধুয়া ছাড়ছে প্রিয়ন্তীর মুখের উপর, ধমক দিয়ে বললো... এই মেয়ে এত্ত বড় সাহস তোর, তুই আমার নামে অভিযোগ করোস, আজকে তোকে দেখে নিবো, এই বলে পিছনে থাকা চুরি বের করলো, ভয় পেয়ে প্রিয়ন্তী পিছনে দৌড় দিলো, মনে পড়ে গেলো প্রিয়ন্তীর সেই রাতের স্বপ্নের কথা, ভাবলো এই বুঝি তার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, চিৎকার করলো প্রিয়ন্তী, কেউ এগিয়ে আসলো না, রানার হাত থেকে প্রিয়ন্তী কে উদ্ধার করতে, পিছন থেকে কোপ দিলো রানা মাটিতে পড়ে গেলো প্রিয়ন্তী, পশুর মতো এলোপাথাড়ি কোপাতে লাগলো রানা, রক্তের বন্যায় ভেসে গেলো পিচডালা পথ, চুরিকাঘাতে জর্জরিত হয়ে নিথর হয়ে গেলো প্রিয়ন্তীর দেহ, ভেঙ্গে গেলো একটি পরিবারের স্বপ্ন, নিভে গেলো একটি সম্ভাবনাময়ী প্রাণ।
আর জনগন তাকিয়ে তাকিয়ে যেনো শুটিং দেখছিলো, রাস্তার মাঝে একটি মেয়েকে এভাবে হত্যা করে লোক চক্ষু সম্মুখদিয়ে পালিয়ে গেলো রানা, অথচ তখন কাহারো কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না।
আইনের দারস্ত হয়েও ন্যায্য বিচার পেলো না প্রিয়ন্তীর পরিবার, মেয়রের ছেলে বলেই পার পেয়ে গেলো রানা। আজ হাজারো প্রিয়ন্তী প্রাণ হারাচ্ছে রানাদের দ্বারা, কিন্তু রানারা পার পেয়ে যাচ্ছে উপযুক্ত শাস্তি ছাড়া। আইন আজ সৃষ্টি করছে রানাদের মতো অপরাধী দের আর প্রাণ দিতে হচ্ছে প্রিয়ন্তীদের।
কাব্যের ভাষায়......
হে প্রিয়ন্তী ,
আজ তোমরা প্রাণ দিলে পিচডালা পথের মাঝে,
তোমরা আজ নারী বলে, রক্ষা করতে পারলে না নিজেকে,
পূর্ন করতে পারলে না তোমাদের স্বপ্ন কে,
রানাদের মতো বখাটেরা,
আজ কেড়ে নিচ্ছে, তোমাদের প্রাণ,
ভেঙ্গে দিচ্ছে পরিবারের সকল স্বপ্ন।
পার পেয়ে যাচ্ছে রানারা ক্ষমতার দাপটে,
বাংলার মাটিতে আজ তোমাদের রক্ত ভাসে।
ওরা মানুষ না, ওরা নর পশু
ওরা খেলছে আজ তোমাদের ইজ্জত নিয়ে,
তোমাদের রক্তের মাঝে।
রক্ত পান করছে ওরা, আর বিলিয়ে দিচ্ছো তোমরা,
নারী বলে করতে পারছো না নিজেকে প্রতিরক্ষা ।
বিচার পাচ্ছো না তোমরা ধরার মাঝে,
সাহস পাচ্ছে রানারা মনের মাঝে
রক্তনেশায় মেতেছে ওরা, মানুষ নয় ওরা বর্বর হায়েনা।
আজ প্রান দিচ্ছো তোমরা,
আর আমরা চেয়ে থাকি, ভিডিও করি, ফেসবুকে আন্দোলন করি,
অথচ চাপাতির কোপে জখম তোমাদের দেহ খানি,
চাইলে পারতাম আমরা, করিতে তোমায় হায়েনার হাত থেকে রক্ষা,
করিনি তাই, তোমায় উদ্ধার করলে ভিডিও করবো কি সেথায়..?
প্রিয়ন্তী, আজ তুমি খুন হলে এক রানার হাতে
আমরা ফেসবুকে আন্দোলন করি তোমার হত্যার শাস্তির দাবিতে।
অথচ কাল খুন হবে অন্য প্রিয়ন্তী,
আমরা আবারো উঠিবো আন্দোলনে মাতি,
ভুলে যাবো আমরা গতকাল যে খুন হয়েছো তুমি,
পার পেয়ে যাবে তোমার খুনি,
চলিতেই থাকিবে আমাদের লোকদেখানো খেলা দিব্যি,
আর রানারা মুক্ত পায়ে করিবে তোমাদের রক্তে পদচারি।
ক্ষমা করো বোন, ক্ষমা করো তোমরা মোদের
মোরা পারলাম না আজ করিতে ন্যায্য বিচার,
রানারা আজ পার পেয়ে যাচ্ছে বারংবার।
হতাশ হয়ো না বোন, হতাশ হয়ো না তোমরা,
ন্যায্য বিচার পেলে না তোমরা মানব রচিত ধারায়
বিচার পাবে তোমরা সেদিন, যেদিন বিচারপতি হবেন স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা।