১।
প্রচন্ড ঘুমে আমার চোখ দুটো জড়িয়ে আসছে। মাথাটা ব্যাথা করতে শুরু করেছে দপ্ দপ্ করে।
এই মুহূর্তে আমি মাটিতে ঢালু কোন জায়গায় শুয়ে আছি, বলতে গেলে বেশ বেকায়দায়। ভালোই শীত করছে। সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি, সবে শহরে শীত আসার জন্য অনুমতি চাইছে। এতেই আমি রীতিমত কাঁপছি। অনিচ্ছা সত্বেও চোখদুটো মেললাম, খেয়াল করে দেখলাম জায়গাটা আসলে আমার পরিচিত। আমি ঠিক বনানী ১১ নম্বর ব্রিজের নিচে, লেকের পাড়ের মাটিতে শুয়ে আছি। কেন আমি এখানে তা মনে পড়ছেনা, সম্ভবত মাথার চোটটা দায়ী। ব্যাথার কারন জানতে ছুয়ে দেখে রক্তের অস্তিত্ত টের পেয়েছি একটু আগে।
খানিকক্ষনের চেষ্টায় উঠে দাঁড়ালাম। রাস্তায় এসে চারিদিকে তাকালাম। হাতের ঘড়িটা নেই, তবুও আন্দাজ করে বুঝতে পারছি এখন রাত দুটোর মতো বাজে। রাস্তায় তেমন গাড়ি নেই, মাঝে মাঝে হয়ত ছুটে যাচ্ছে একটা কি দুটো। আস্তে আস্তে সব মনে পড়তে শুরু করছে। অফিস থেকে আজ পাঁচটার দিকে বের হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, বনানী পোস্ট অফিসের কাছে "পপাইস্ ট্রিট" দোকানটায় যাবো। মেয়ে আমার চিজকেকের ভক্ত, ঠিক যেমন আমি ছিলাম ছোটবেলা থেকে। তাই বলে সবসময় মেয়েকে চিজকেক খেতে দিইনা। বেশি কোন কিছুই ভালো না, কখনও ওবেসিটিতে ভুগুক তা চাইনা। তবে বৃহস্পতিবারের কথা আলাদা। এদিন অফিস শেষে মেয়ের জন্য চিজকেক আর চকলেট ইত্যাদি কিনে নিয়ে যাই সারাটা সপ্তাহ লক্ষী মেয়ে হয়ে থাকার আর মন দিয়ে পড়ালেখা করার পুরষ্কার হিসেবে। এই রাতে আমাদের পরিবারে বেশ পার্টির মত হয়। বৌ আর মেয়ে মিলে রাত করে মজা করে মুভি দেখি, গল্প করি, ভালো মন্দ রান্না হয়ঃ হই চই করে খাই, যেন একটা আনন্দভূবন।
বেশ মনে আছে "পপাইজ ট্রিটে" গিয়ে আজ লোভ সামলাতে না পেরে একপিস চিজকেক খেয়ে ফেলেছিলাম, যেন অমৃতের স্বাদ। এরপর বাসার জন্য নিলাম, কিন্তু তারপর কি হলো সব ভূলে গেছি। এখানে কিভাবে আর কেন এলাম, কি হয়েছিলো, কতক্ষন ধরে আছি কিছুই মনে নেই। এটা যে মাথায় আঘাত পাবার কারনেই তা বুঝতে পারছি। পকেটের মোবাইল, ওয়ালেট সব গায়েব। সবচেয়ে গুরূতর ও ভয়ংকর সমস্যা হলোঃ আমি আমার বাসার ঠিকানা ভূলে গেছি। মেয়ে আর বৌ ছাড়া কখনও থাকিনি। আতংকে হাত পা কাঁপছে ওরা কি করছে আমাকে ফিরতে না দেখে এটা ভেবে।
২।
পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক সমাধান তো করতে হবে। ব্রেনকে আর বেশী চাপ দিলাম না। কারন এতে হিতে- বিপরীত হতে পারে। স্মৃতির বিস্বরণ তখন স্থায়ী ব্যাপার হয়ে যেতে পারে। বুদ্ধি খরচ করতে হবে। উত্তরায় আমার বন্ধু আসিফের বাসায় চলে যাবো, এরপর ওই আমার বউ বাচ্চার কাছে আমাকে পৌছে দেবে।
শরীরের ব্যাথা অগ্রাহ্য করে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ব্রিজ পার হয়ে বামে যাব নাকি ডানে ঠিক বুঝতে পারছি না। তেমন মানুষও চোখে পড়ছেনা যে জেনে নেব।অবশেষে বামে যাবো ঠিক করলাম। বেশ খানিকটা পথ চলার পর একটা কুকুরের ডাকে চমকে উঠলাম।কুকুরটা কালো রঙের আর দূবর্ল স্বাস্থের, একটা গলির সামনে দাড়িয়ে আছে। বামেই বনানী কবরস্থান তাই পরিবেশ কিছুটা অতিপ্রাকৃত। আমি কুকুরটাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলাম। আরো একটু এগোতেই উত্তরার একটা বাস পেয়ে গেলাম। চট করে তাতে উঠে পড়লাম। বাসে যাত্রী তেমন নেই। পেছনের একটা সিটে গিয়ে গা এলিয়ে বসলাম। বাতাসে আমার চুল উড়ছে। শরীরের ব্যাথা কিছুটা কমেছে। ঝলমলে ঢাকা- উত্তরা রোডে এসে মনটাও ভালো হয়ে উঠলো। এই রাস্তা ধরে এগোলে দেশটাকে অনেক বড়লোক মনে হয়। গুনগুন করে দুয়েকটা গানও বোধহয় গেয়ে ফেললাম। বাস চলছে।
উত্তরার রাজলক্ষীর সামনে এসে নেমে পড়লাম। কপাল ভালো, কন্ডাক্টর ভাড়া চায়নি। কোত্থেকে দিতাম চাইলে?সর্বনাশটা হলো যখন বুঝতে পারলাম যে আমি আমার বন্ধু আসিফের বাসার এগজাক্ট লোকেশানটা মনে করতে পারছি না। আগেই বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত ছিলো। কতবার গিয়েছি ওর বাসায়, অথচ বেমালুম ভূলে গেলাম! হাটতে হাটতে উত্তরা লেক পাড়ের মসজিদের পাশে এসে দাড়ালাম। এখানে ব্রিজটার পাশে সারি ধরে চায়ের দোকান, কত আড্ডা দিয়েছি এখানে বিয়ের আগে। এত রাতে খোলা নেই একটাও। ব্রিজের সিমেন্টের তৈরী রেলিংয়ে উঠে বসলাম। দুজন শ্রমিক শ্রেনীর মানুষ হেটে গেলো। আধঘন্টা পর একটা টহল পুলিসের দল এগিয়ে আসলো। আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো, যেনো মাঝরাতে ব্রিজের উপর মানুষ বসে থাকা খুবই স্বাভাবিক। ওদের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়েও মত পরিবর্তন করলাম, শেষমেষ লকারে না ঢুকিয়ে দেয় তাহলে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে, একটু পরেই আজান দেবে। ক্লান্ত বোধ করলাম, রেলিং থেকে নেমে পড়লাম। মাটিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শেষ রাতের সৌন্দর্য মুগ্ধ চোখে টেনে নিতে লাগলাম।
৩।
চোখটা বোধহয় লেগেই এসেছিলো, সকাল হয়ে গেছে। উত্তরার ব্যাস্ত মানুষেরা অফিস, স্কুল- কলেজে যাবার জন্য ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। অল্প একটু ঘুম হলেও মাথাটা বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, ঝরঝরে লাগছে এখন শরীরটা, উঠে পড়লাম। কপাল ভালো যে বাসার ঠিকানা মনে পরেছে। ইচ্ছা হচ্ছে যেন উড়ে রওনা হয়ে যাই। সে চেষ্টা অবশ্য করলাম না, মোড়ে এসে রাস্তা পার হয়ে গুলশানে যাবার একটা বাসে উঠে পড়লাম। রাশ আওয়ারের জ্যাম ঠেলে ঠেলে গুলশানে পৌছে বাসার দিকে হনহন করে হাটা দিলাম। মোড়ের কাছে এসে মানুষের বেশ জটলা দেখতে পেলাম। অজানা আশংকায় কেপে উঠলো বুক। আমার পরিবারের কিছু হয়নি তো আবার?
মনে সাহস সন্চয় করে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই দেখলাম একটা লাশকে ঘিরে আছে সবাই। ওই তো একটু দূরে দাড়িয়ে আছে অামার বৌ, কাঁদছে। কি ব্যাপার, তবে কি? আর ভাবতে চাইলাম না, এগিয়ে গেলাম।
পূর্নচোখে তাকালাম লাশের দিকে, সর্বনাশ এ যে আমি! বিশ্বাস হতে চাইছে না, অথচ অবিকল আমার চেহারা। ভয়ে আমার আত্বা শুকিয়ে গেলো। হঠাৎই চারজন লোক লাশের খাটিয়া নিয়ে উঠে দাড়ালো। পাশেই একটা পার্ক করা মিনি ট্রাকে আরো কিছু মানুষ সহ উঠে পড়লো। হচ্ছেটা কি? আড়চোখে একবার বৌকে দেখে নিলাম, মেয়েকে দেখছিনা কোথাও। আমিও চট করে উঠে পরলাম ট্রাকে। লাশের মুখটা এখন ঢেকে দেয়া হয়েছে। সাথের মানুষদের কিছুতেই চিনতে পারছিনা, কারা এরা? যাচ্ছেটা কোথায় এরা?
খানিকবাদে খেয়াল করলাম ট্রাকটা কোথাও এসে থেমেছে। একি? গতকাল রাতের সেই কালো, রোগা কুকরটা এখানে কি করছে? কুকুরটা একটা গেটের পাশে বসে আছে। গেটের গায়ে বড় বড় করে লেখাঃ "বনানী কবরস্থান"।
প্রচন্ড ঘুমে আমার চোখ দুটো জড়িয়ে আসছে। মাথাটা ব্যাথা করতে শুরু করেছে দপ্ দপ্ করে।
২২ জানুয়ারী - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪