আলো আসুক, আলো

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

আহমেদ সাবের
  • ৫১
  • 0
-১-
রকিবুল ইসলাম সাহেব বৃদ্ধ হয়েছেন। দেশ ছেড়েছেন সেই আটত্রিশ বছর আগে। ভাল ছাত্র ছিলেন। অনেক লেখা লেখি করে জি আর ই, টোফেলের বেড়া ডিঙ্গিয়ে লস এঞ্জেলস ‘এর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পান। সেখান থেকে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট আর পি এইচ ডি শেষ করার পর থেকে যান সেই দেশে। সাফল্যের সোপান গুলো টপকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন হিসেবে অবসর নিয়েছেন গত বছর। প্রায় বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে দেশ থেকে এত দূরে থেকেও প্রাণপণে সেবা করেছেন দেশের মানুষদের। দেশে আত্মীয় স্বজনদের পড়া লেখার জন্য নিয়মিত খরচ যুগিয়েছেন, বিবাহ বা চিকিৎসায় সব সময় সাহায্য করেছেন। দেশ থেকে কোন ছাত্র পড়াশুনার জন্য আমেরিকা আসলে তার ভর্তি, থাকবার যায়গা ঠিক করা, দুর্দিনে আর্থিক সাহায্য করা – সব বিনা দ্বিধায় তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। তাই লস এঞ্জেলস ‘এর বাঙ্গালী মহলে তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র তিনি।

দেশের মত বিদেশেও বাঙ্গালীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয় – অমুক লোক দেশ প্রেমিক, তমুক লোক দেশের শত্রু, দেশকে বিদেশের কাছে বেচে দিতে চায়, ইত্যাদি। তাদের সাথে মতে মিলে না রকিবুল ইসলাম সাহেবের। কারুর দেশ প্রেম নিয়ে কখনো সন্দেহ প্রকাশ করেন না তিনি। দেশ কি শুধু একখণ্ড জমি? দেশ জমির চেয়ে অনেক বড়। দেশ মানে আশৈশব লালিত স্মৃতি - সুখ, দুঃখের ফুলের মালা, ঘুমপাড়ানি গান, বৈশাখের ঘূর্ণি নাচন, শ্রাবণের বৃষ্টির সংগীত। দেশ মানে যৌবনের প্রথম অনুরাগ, প্রথম বিরাগ, প্রথম প্রেম এবং প্রথম বিরহ। দেশ মানে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এর আত্মিক বন্ধনের আজন্ম শৃঙ্খল, আর তারই নাম শেকড়। সেই শেকড় কে কি অস্বীকার করা যায়? কেউ কি নিজের অস্তিত্বকে ভাল না বেসে পারে? তাই তিনি বিশ্বাস করেন, যে যত দুরেই যাক, সবার মন পড়ে থাকে বাংলাদেশের শ্যামল ছায়ার সান বাধানো ঘাটে; টলটলে জলের পদ্ম দিঘীর অতলে।

তিনি বিদেশে থাকলেও সারাক্ষণ মন পড়ে থাকতো দেশে। তাই অবসর নেবার পর ঠিক করলেন, যে দেশ তাকে এত কিছু দিয়েছে সে দেশের দুঃস্থ মানুষের সেবায় বাকী জীবনটা কাটাবেন তিনি। ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে। ওদের নিয়ে চিন্তা নেই। পিছু টান শুধু নাতি-নাতনিদের জন্য। তবুও দেশের টানে ওদের মায়া ত্যাগ করে একদিন গ্রামের বাড়ীতে ফিরে আসলেন তিনি, স্ত্রীকে সাথে করে। এর আগে যতবার দেশে এসেছেন, ঢাকায় আত্মীয় স্বজনের বাড়ী দাওয়াত খাবার পর গ্রামের বাড়ীতে থাকবার তেমন সুযোগ পান নি। তাই এবার গ্রামের বাড়ীতে আসলে সারা গ্রামে হই চই পড়ে গেল।

প্রতিদিন অনেক লোক প্রফেসর রকিবুল ইসলাম সাহেবের সাথে দেখা করতে আসেন। কারও চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার, কারও মেয়ের বিয়ের খরচ চাই, কারও সন্তানের শিক্ষার খরচ চাই, কারও চাকুরীর তদবির। প্রথম প্রথম কিছু লোককে সাহায্য করবার পর তার বোধোদয় হল, এভাবে জনে জনে সবার সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা তো তার নেই। শেষে চাচাতো ভাইদের সাথে আলাপ করে ঠিক করলেন, গ্রামের স্কুলটার জন্য যদি কিছু করা যায়। ওই স্কুলটাতে তিনি নিজে পড়েছেন। ওখান থেকে এস এস সি পাশ করেছেন। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে স্কুলটার সাথে। চাচাতো ভাই এবং তাদের ছেলে মেয়েরাও তাকে সাহায্যের আশ্বাস দিল।

একদিন সকালে দুই চাচাতো ভাই এর দুই ছেলে, ইয়াসিন আর জুবায়েরকে নিয়ে তিনি স্কুল দেখতে গেলেন। ওরা স্থানীয় কলেজে পড়ে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যে স্কুলে পৌঁছে, স্কুলের অবস্থা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। বাঁশের বেড়া গুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা। টিনের ছাদ চুইয়ে বৃষ্টির পানি পড়েছে ঘরের মধ্যে। বেশীর ভাগ শ্রেণী কক্ষে ছাত্রদের বসার বেঞ্চি নেই। সব চেয়ে শঙ্কিত করল তাকে নদীর অবস্থা। স্কুলটা অবস্থিত নদীর পাড়ে। নদীর এ দিকের পাড়টা ভাঙ্গছে। যে কোন সময় স্কুল ঘরটাও তলিয়ে যেতে পারে নদীর গর্ভে। শিক্ষকদের সাথে কথায় কথায় জানা গেল, স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান অসুস্থ হয়ে পড়বার পর স্কুলের প্রতি তেমন সময় দিতে পারছেন না। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে স্কুলের অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। তদবিরের অভাবে সরকারী সাহায্যও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। কথায় কথায় তিনি বললেন, স্কুল ঘরটা বর্তমান স্থান থেকে সরানো দরকার। স্কুলের শিক্ষকরাও তাতে সম্মতি জানালেন। একজন শিক্ষক বললেন, সরানোর চিন্তা করা হয়নি যে, তা নয়। তবে, স্কুল ফান্ডের যে নড়বড়ে অবস্থা, তাতে নতুন যায়গায় জমি কিনে স্কুল স্থানান্তর অসম্ভব ব্যাপার। রকিবুল ইসলাম সাহেব আশ্বাস দিলেন, পশ্চিম পাড়ায় তার কিছু জমি আছে। স্কুলটা সেখানে সরানো যেতে পারে। ঠিক হল, স্কুলের উন্নয়নের ব্যাপারে গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনার জন্য পরবর্তী সপ্তাহে একটা আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে।

পরের সপ্তাহে স্কুল ঘরেই আলোচনা সভা বসলো। রকিবুল ইসলাম সাহেব ইয়াসিন আর জুবায়েরকে নিয়ে সভায় এলেন। তিনি, প্রধান শিক্ষক এবং স্থানীয় দু জন গণ্যমান্য ব্যক্তি বসলেন চেয়ারে। ইয়াসিন আর জুবায়ের বসলো অন্যান্যদের সাথে সার করে রাখা বেঞ্চিতে, শ্রোতাদের কাতারে। উপরের শ্রেণীর কিছু ছাত্রকেও দেখা গেল দর্শকদের মধ্যে। হেডমাস্টার সাহেব প্রথমেই স্কুলের সমস্যার কথা বর্ণনা করলেন তার বক্তব্যে। তার পর, রকিবুল ইসলাম সাহেব তার পরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরলেন আবেগময় ভাষায়। উপস্থিত কয়েকজন লোক তাদের বক্তব্যে তার উদারতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানালেন এবং রকিবুল ইসলাম সাহেবের সাথে কাজ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করলেন। একটা সৌহার্দ পূর্ণ পরিবেশে আলোচনা চলতে লাগল। একটার পর একটা প্রশ্ন আসতে থাকল আর রকিবুল ইসলাম সাহেব উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন।

হঠাৎ পেছন দিকে একটা শোরগোল উঠল। ইয়াসিন লাফিয়ে উঠে এক ভদ্রলোকের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে একটা গালি দিয়ে বলে উঠল, কি কইলি? এক্ষুনি মাফ চা।

ইয়াসিন যার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে চেঁচামেচি করছে, তিনি ইয়াসিনের বাবার বয়সী। ভদ্র লোকের চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল। তিনি আমতা আমতা করে বলে উঠলেন, আমি তো এমন কিছু বলি নাই যে ......।

উনার কথা শেষ হবার আগেই আবার চিৎকার করে উঠলো ইয়াসিন। এখন আবার ভিজা বিড়াল সাজতেছে। কি তুই কসনাই, রকিব চাচা ইলেকশনে খাড়া হওনের মতলবে এই সব করতাছে। কি কয়নাই? ইয়াসিন ওর বন্ধুদের দিকে চোখ তুলে প্রশ্ন করল।

ইয়াসিনের বন্ধুরা কথাটা শুনেছে কি শুনে নাই, সবাই এক বাক্যে ইয়াসিনকে সমর্থন করল। তারাও একযোগে চিৎকার করতে লাগল, হ কইছে। আমরা সবাই শুনছি। তাদের কয়েকজন গালি দিয়ে বলে উঠল, এখনই মাপ চা। পায়ে ধইরা মাফ চা প্রফেসর সাবের কাছে।

প্রধান শিক্ষক কয়েকবার সবাইকে শান্ত হয়ে বসতে বললেন। কেউ ওনার কথায় কর্ণপাত করল না। যার সাথে এমন হইচই, তিনি আপন মনে গজ গজ করতে করতে সভা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। ইয়াসিন হঠাৎ করে ওনার জামার কলার ধরে চিৎকার করে উঠল। শুনছেন, সবাই শুনছেন, ব্যাটায় কি কয়?

কি কইছে? ইয়াসিনের এক বন্ধু প্রশ্ন করে উঠল।

ইয়াসিন বলল, শয়তান কয়, এই সব ঘোড়ার ডিমের সভার লাইগা না কি ওর সারা দিনের ব্যবসা পণ্ড। ব্যাটার এত বড় সাহস, এমন একটা মহৎ কাজেরে ঘোড়ার ডিম কয়।

বন্ধুটি বলে উঠল, ব্যাটারে আইজকা থেইকা বয়কট। পুরা গেরামের পক্ষ হইয়া ওরে আমরা বয়কট করলাম।

একজন শিক্ষক দাঁড়িয়ে উঠে বলে উঠলেন, ইয়াসিন, তোমরা এমন করছ কেন? কালাম সাহেবকে ওনার কথা বলতে দাও।

কালাম সাহেব কারো কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ধীরে ধীরে সভা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ইয়াসিনের আরেক বন্ধু শিক্ষক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, আপনে কালটু মিয়ারে অন্যায় ভাবে সাপোর্ট করছেন। আপনেরেও আমরা বয়কট করলাম।

ইয়াসিনের বন্ধুরা সবাই এক যোগে চিৎকার শুরু করলো, বয়কট বয়কট। একে একে অন্যরাও এ পক্ষ ও পক্ষ নিয়ে হট্টগোলে যোগ দিলেন। অবশেষে সভা পণ্ড হয়ে গেল। রকিবুল ইসলাম সাহেব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না, ব্যাপারটা কি হচ্ছে। কালাম সাহেব নামের লোকটা এমন কি বললেন যে, ইয়াসিনরা এমন ক্ষেপে গেল। ক্ষোভে, দুঃখে তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল।

পরবর্তী কয়েকদিন তিনি গুম ধরে বাড়ীতে বসে রইলেন। এ জন্যই কি তিনি দেশে এসেছিলেন? কত সাধ ছিল, দেশের কাজে জীবনের বাকী সময়টা কাটিয়ে দেবেন। অনেক বছর তো হল বিদেশে। আর কত? দেশের ঋণটা তো শোধ করতে হবে। আশা ছিল, স্কুলটার কাজ শেষ হলে ধীরে ধীরে গ্রামের অন্য সমস্যার দিকে নজর দেবেন। কি হতে কি হয়ে গেল? এদিকে ইয়াসিন এবং জুবায়েরও তাদের ব্যাবহারে লজ্জিত। তারাও ভয়ে চাচার বাড়ির ত্রি-সীমানায় পা দিচ্ছে না। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাহেব একদিন দেখা করে গেছেন রকিবুল ইসলাম সাহেবের সাথে। কালাম সাহেব সহ দু চার জন গণ্য-মান্য ভদ্রলোকও এসেছিলেন দেখা করতে। তাদের মুখে সেদিনের সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছেন তিনি। সপ্তাহ খানেক গত হবার পর, একদিন রাতের বেলা ইয়াসিন আর জুবায়েরকে ডাকালেন তিনি। দু জন এসেই, চাচা আমাদের মাফ করে দেন বলে ওনার পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আরে আরে, কি করছিস তোরা? বলে ওদেরকে টেনে উঠিয়ে বুকে জড়ালেন তিনি। বস, পাশে বস।

ইয়াসিন আর জুবায়ের ওনার এক পাশে জবু থবু হয়ে চৌকিতে বসল।

তোরা এমন রাগলি কেন সেদিন? ওদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি।

কালটু মিয়া আপনেরে অপমান কইরা কথা কইছে। মিন মিন করে বলে উঠে ইয়াসিন। সে কয়, আপনে না কি ইলেকশনে খাড়ানোর মতলবে টাকা ঢালতে আসছেন। শুইনা আমার মেজাজ খারাপ হইয়া গেল। সে শুধাশুধি আপনেরে গালি গালাজ করলো।

রকিবুল ইসলাম সাহেবে পরম আদরে এদের দু জনকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, পাগলারা, এত ভালবাসিস তোরা আমাকে? আমাকে একটু কটু কথা বললে তোদের এত কষ্ট লাগে? তা তো লাগবেই। রক্তের টান বলে একটা কথা আছে না। তবে শুন, সে ভালবাসাটা যদি আমার কষ্টের কারণ হয়, সেটা কি তোরা করবি?

না না চাচা। কক্ষনো না। এক সাথে বলে উঠে ইয়াসিন আর জুবায়ের।

কিন্তু তোরা সেটাই করে বসলি। কালাম সাহেব একজন বয়স্ক গণ্য মান্য ভদ্রলোক। বয়স্কদের নাম নিতে সম্মানের সাথে নিতে হয়। আর, কারও নামকে বিকৃত করা একটা বড় অপরাধ। ওনাকে কালটু মিয়া বলে ডাকা কি ভদ্রজনোচিত? বলে তিনি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ইয়াসিনের দিকে। ইয়াসিন লজ্জায় মাথা নত করল।

আর তিনি আমাকে গালি গালাজ করলেন কোথায়?। উনি শুধু পাশের লোককে বলেছিলেন, কি ব্যাপার? প্রফেসর সাব কি ইলেকশনে দাঁড়াবেন? কথার সূত্র ধরে বলে চলেন রকিবুল ইসলাম সাহেব।

ওই এক কথাই হইল। জুবায়ের বলে উঠল।

না, এক কথা হয় নি। আমি হঠাৎ করে গ্রামে এসে টাকা পয়সা খরচ করছি। তাতে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়। প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয়। আমি চল্লিশ বছর ধরে দেশের বাইরে। এই ক বছরে শত শত মিটিং ‘এ যোগ দিয়েছি। কোন মিটিং ‘এ গালাগালি তো দূরে থাক, গলার স্বর উঁচু করে কাউকে কখনো কথা বলতে শুনি নি। তোরা আমাকে অনেক ভালবাসিস, তা আমি জানি। আমাকে কি এতই ঠুনকো ভাবিস যে, কেউ কিছু বললেই আমার গায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে? আমি কয়েকটা পয়েন্ট টুকে রেখেছি। এখন সেগুলো মনোযোগ দিয়ে শুন।

প্রথমতঃ, প্রতিটা সভার একটা নিয়ম-কানুন থাকে। তোরা দু জন শিক্ষিত হয়েও সেটা মানিস নি। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, কালাম সাহেব আমার সম্মান হানিকর কথা বলেছেন। তোদের উচিৎ ছিল, সভার বৃহত্তর স্বার্থে সেটা এড়িয়ে যাওয়া বা সভার সভাপতিকে জানানো।

দ্বিতীয়তঃ, অসাধু ব্যক্তিরাই প্রশ্নের উত্তর দিতে ভয় পায়, কারণ তাদের কাছে উত্তর থাকে না। এবং উত্তর থাকেনা বলে, উত্তর দেয়ার বদলে তারা রেগে যায়। প্রশ্ন না করলে মানুষ জানবে কি করে? আর উত্তর না পেলে মানুষ মনে মনে ভুল ধারনা পুষে রাখবে। সেটা কি ভাল?

তৃতীয়তঃ, ইলেকশনে দাঁড়ানোর প্রশ্নটা উঠেছে আমাকে নিয়ে। আমি যদি ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারি, তোদের রাগার কি কোন কারণ আছে?

চতুর্থতঃ, যে কোন মানুষকে সবার সামনে অপমান করলে তাদের ইগোতে (অহং’এ) লাগে। ফলে তারা রেগে যায়। আর মানুষ রেগে গেলে, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। কালাম সাহেবকে অপমান করার ফলেই তিনি স্কুল উন্নয়নের উদ্যোগকে “ঘোড়ার ডিম” বলেছেন। এটা বলার জন্য উনি দায়ী নন, দায়ী তোরা, যারা ওনাকে রাগিয়েছিস। ওনাকে সবার সামনে এভাবে চৎকার করে না বলে, চুপি চুপি বললে উনি নিজেই লজ্জিত হতেন এবং কথাটা বলার জন্য নিজেই মাফ চাইতেন। তোরা ওনাকে রাগিয়ে অপরাধ করলি আর তোদের বন্ধুরা উল্টো ওনাকেই বয়কট করলো, শিক্ষক সাহেবকে বয়কট করলো। তোরা সেই অন্যায় বয়কটের প্রতিবাদ করলি না।

পঞ্চমতঃ, তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হল, কালাম সাহেব অন্যায় করেছেন। কিন্তু, বয়কট করার ফলে ওনার কোন সমস্যা হবে না। শুধু আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমাদের সদিচ্ছা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ষষ্টতঃ সহনশীলতা এবং উদারতা একটা বিরাট গুন। তাতে বন্ধুত্বের পরিধি বাড়ে। কালাম সাহেব একজন সমাজ সেবক মানুষ। উনি অনেক সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে জড়িত। ওনাকে সাথে পেলে আমাদের উপকার হত। তোদের হঠকারিতায় আমাদের ক্ষতি হল।

সপ্তমতঃ, খনার একটা বচন আছে, “একে নষ্ট করে, সবে দুঃখ পায়, বালকে আগুন দিলে ঘর পোড়া যায়”। অন্য ভাবে বলা যায়, এক বালতি দুধকে নষ্ট করতে এক ফোটা গো-চোণাই যথেষ্ট। তোরা দু জন সেই গো-চোণার মত কাজ করেছিস। তোরা আর তোদের বন্ধুরা পুরো ভাণ্ডের দুধটা নষ্ট করে দিলি।

ইয়াসিন আর জুবায়ের বাচ্চা ছেলের মত শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, চাচা আমরা না বুঝে অনেক অন্যায় করেছি। আপনি আমাদের যে শাস্তি দেন, সেটা আমরা মাথা পেতে নেব।

তোরা মনে মনে অনেক কষ্ট পাচ্ছিস। সেটাই তো বিরাট শাস্তি। তবে, আরও কিছুদিন পেতে হবে তোদের সেই শাস্তিটা। আমি ঠিক করেছি, কাল ভোরে ঢাকা চলে যাব। কষ্টের আগুনে পুড়ে পুড়ে তোরা যদি খাটি হস, তবেই আমি ফিরে আসব। এখন তোরা যা। আমার জিনিষ পত্র গুছাতে হবে।

ইয়াসিন ও জুবায়ের মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তার পর চলে গেল।

-২-
ফজরের নামাজ পড়ে স্ত্রীর হাত ধরে লঞ্চ ঘাটের দিকে যাচ্ছেন রকিবুল ইসলাম সাহেব। বাড়ী থেকে আধা কিলোমিটারের মত হাটা পথ। ওনার বাড়ীর কেয়ারটেকার রজব আলীর হাতে একটা সুটকেস। লঞ্চ ঘাটের কাছাকাছি আসতেই লোক জনের গলার শব্দে ভয় পেয়ে গেল রজব আলী।

স্যার, লঞ্চ ত এখনও আসেনাই। এত শব্দ কিসের ঘাটে? ডাকাইত পড়ছে না কি? গলায় উৎকণ্ঠা রজব আলীর। চলেন, ফেরত যাই।

ডাকাতদের নেবার মত আমার সাথে কিছুই তো নেই রজব?

যদি টেকার লোভে আপনেরে ছিনতাই কইরা মাইরা ফালায়?

মারলে মারবে। একদিন তো যেতেই হবে রজব। আমরা প্রভুর কাছ থেকে এসেছি, আবার তার কাছেই ফিরে যাব।

শেষ রাতের চাপা অন্ধকার। লঞ্চ ঘাটে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জনের মত লোক। হ্যারিকেন হাতে ঘাটের সিঁড়িতে সাত আট জন লোক। কাছে আসতেই তাদের চিনতে পারলেন তিনি। কালাম সাহেব মাঝখানে, দু পাশে ইয়াসিন আর জুবায়ের। কালাম সাহেবের একটা হাত জুবায়েরের কাঁধে।

কি ব্যাপার কালাম সাহেব, আপনি এখানে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন রকিবুল ইসলাম সাহেব।

ওরা আমাকে পাকড়াও করে ধরে নিয়ে আসল বাড়ী থেকে। ইয়াসিন আর জুবায়েরকে দেখিয়ে হাসতে হাসতে বললেন কালাম সাহেব। সারা রাত দু জনে ঘুমায় নাই। বাড়ী বাড়ী ঘুরে বন্ধুদের জোগাড় করে শেষ রাতে আমার কাছে এসেছে। ওরা আপনাকে যেতে দিবে না। আমাকে ধরেছে, আপনাকে যেন বলি।

আমি তো যাচ্ছি না। শুধু দেহটা যাচ্ছে কয়েকটা দিনের জন্য। মনটা তো এখানেই থাকল। আপনাকে তো বলেছি, আমার দেহকে ফিরিয়ে আনার চাবি ওদের হাতে। ওরা যদি সব বিরোধ ভুলে মিলে মিশে আপনার সাথে কাজ করতে পারে, তবেই আমার দেহটা ফিরে আসবে।

ইয়াসিন আর জুবায়েরকে বলেছি আপনার শর্তের কথা। উত্তর দিলেন কালাম সাহেব। ওরা কথা দিয়েছে, ওদের সব বন্ধুদের নিয়ে মিলে মিশে কাজ করবে আমার সাথে।

কথা দেওয়াটা ঝোঁকের মাথায় কি না, সেটা দেখতে চাই কালাম সাহেব। কিছু দিন ওরা কাজ করুক আপনার সাথে আপনার জনকল্যাণ প্রকল্প গুলোতে। আপনি ওদের কাজে খুশী হয়ে যেদিন আমাকে ডাকবেন, সে দিনই আমি ফিরে আসব। আমি কিছুদিন ঢাকা গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকব। আমার অবর্তমানে, আপনি ওই ছাই চাপা আগুন গুলোর দায়িত্বে থাকলেন। আমাকে প্রতিদিন শুধু অগ্রগতির রিপোর্ট দেবেন।

লঞ্চ চলে এসেছে। নদীর ওপারে অন্ধকারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে একটা বিরাট সূর্য উকি দিচ্ছে আকাশে। ইয়াসিন আর তার বন্ধুরা ঘাটের সিঁড়ির দু পাশে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে রকিবুল ইসলাম সাহেবকে। আনন্দে ওনার চোখ দুটো জলে ভরে উঠল।

আলো আসুক, আলো। প্রভাত সূর্যের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রের মত বিড় বিড় করে বলে উঠলেন তিনি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহমেদ সাবের ধন্যবাদ প্রজাপতি মন । এই সামান্য লেখাটা আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশী হলাম।
প্রজাপতি মন কি যে ভালো লাগলো গল্পটা, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এমন আপাদমস্তক একজন ভালোমানুষের জন্য আমার গর্ব হচ্ছে। যদি সব মানুষই রকিবুল সাহেবের মত হতো তবে আমাদের দেশের চেহারাই পাল্টে যেত। আমারও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এমনভাবে দেশটাকে পাল্টে দেই, কিন্তু সাধ আছে সাধ্য নেই। আজ আর বলবোনা এমন ভালো লেখায় ভোটিং বন্ধ কেন? আমরা পাঠকেরা আপনার লেখা ভালোবাসি আর এটাই মনে হয় একজন লেখকের বড় পাওয়া। এই ভালোবাসাটুকু দিয়ে গেলাম। প্রিয়তে ঠাঁই করে নিলাম গল্পটি।
আহমেদ সাবের গল্প-কবিতার পাতার এক সময়ের সব চেয়ে সক্রিয় মানুষটা সংসারের দাবীতে হয়তো আজকাল তেমন সময় দিতে পারছেন না। এর মাঝেও গল্পটা পড়েছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ।
বিন আরফান. পড়লাম ভাই. তবে ভোট দিতে না পেরে দুঃখ নিয়ে ফিরে গেলাম.
আহমেদ সাবের প্রিয় আহমাদ মুকুল ভাইজান, শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে গল্পটা পড়েছেন জেনে আমি কৃতার্থ। আপনার মূল্যবান মন্তব্য হৃদয়ে গেঁথে রাখলাম।
আহমাদ মুকুল .....ছাঁইচাপা আগুনগুলোকে বশে রাখতে প্রায়শঃই মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয়ের ভরসায় যেতে হয়। এটা কি আপনি কম জানেন, নাকি কম মানেন? কর্মব্যস্ততা এবং মনোসংযোগে ঘাটতি লেখা এবং পাঠ উভয় থেকে সাময়িক দূরে রেখেছিলো। কিঞ্চিত মুক্তি পেয়েছি। তাই আপনার গল্পের পাঠক। বলা বাহুল্য সময়টা দারুন কাজে লাগলো।
আহমেদ সাবের ধন্যবাদ M.A.HALIM। আপনারও শুভ কামনা করি।
M.A.HALIM সোজা কথায় অসাধারণ। বন্ধুর জন্য শুভ কামনা রইলো।
আহমেদ সাবের ধন্যবাদ জুয়েল দেব । তোমার মঙ্গল কামনা করি।
জুয়েল দেব অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। গল্পের ছলে বলা কথাগুলো গেঁথে গেছে মনের মধ্যে। আমি বুকে তুলে রেখেছি। মনে রাখার চেষ্টা করবো, যতদিন পারি। আপনার সাফল্য কামনা করছি।

০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪