জনসভা

কষ্ট (জুন ২০১১)

আহমেদ সাবের
  • ২৯
  • 0
  • ১৯
-১-

আমাদের এলাকায় এ সময়টা জনসভার সময়। খাল বিল শুকনা, চলাফিরার সুবিধা। ধান উঠে গেছে, কৃষকের গোলায় ধান, মনে খুশী। শীত পড়া শুরু করেছে, তাই রোদের তেজ কম। শুন্য মাঠে মেলা মেলা বসে। মাওলানা, মৌলভি, পীর সাহেবরা আসেন। ওয়াজ মাহফিল হয় রাত ভর। আর আসেন জনদরদী নেতার দল, জনতার দরদে কুম্ভিরাশ্রু ফেলতে।


আয়েনদ্দি প্যান্ডেল বানাচ্ছে। ঢাকা থেকে মন্ত্রি আসবেন। এলাকার এম, পি সাহেব আসবেন। দশটা তোরন হবে, বিরাট প্যান্ডেল হবে - মহা হুলুস্থুল ব্যাপার। আয়েনদ্দি সকল কাজের কাজী, যখন যা পায়, তাই করে। মৌসুমে ক্ষেতে কামলা দেয়। কাছের পাট কলে কাজ করে মাঝে সাঝে, যদি পায়। মাটি কাটা, ঘর ছাওয়া, মাছ ধরা, কোনটাতেই আপত্তি নেই। পেটের তাগিদ নিয়ে কথা।


ধান উঠে গেছে বলে ক্ষেতের কাজ কম। মাঝে মাঝে বরো চাষের কাজ মিলে তে-ফসলী গেরস্তের ক্ষেতে। গত সাপ্তা থেকে কাজ নেই। প্যান্ডেল বানানোর কাজটা পেয়ে বেঁচে গেছে আয়েনদ্দি। নইলে না খেয়ে থাকতে হতো বাল বাচ্চা নিয়ে। অবশ্য ব্যাপারটা নতুন নয়, গা সওয়া হয়ে গেছে ওর।


কাঠ-বাঁশের প্যান্ডেল। উপরে উড়বে সামিয়ানা। অনেক কামলা কাজ করছে। দিনে চল্লিশ টাকা পাবে আয়েনদ্দি। দু দিনের কাজ। তা নিয়েও রাজ্যের ধানাই পানাই।


ছোকরা গোছের নেতা, নাম জব্বার মিয়া, প্রায় মারতে আসে আয়েনদ্দিকে। ব্যাটা হারামজাদা, মন্ত্রি সাব আসতাছে। এলাকার কত উন্নতি অইবো। তুই ব্যাটা একটু গতর খাটবি, তাও টাকা চাস।


উন্নতি অইবো না কচু, মনে মনে বলে আয়েনদ্দি। টাকা যদিও আসে, সব গিলবা তোমরাই।


আয়েনদ্দি বাঁশের আগায় উঠে একটা বাঁশের সাথে আরেকটা বাধছে নারকেলের দড়ি দিয়ে। কাজটা কঠিন বটে। এক হাতে দুটো বাঁশ একসাথে ধরে অন্য হাতে রশি প্যাচাতে হয়। আয়েনদ্দি কাজ করছে আর ভাবছে। গতকালের টাকাটা দোকানের ধার শুধতেই চলে গেছে। আজকের টাকায় চাল নিতে হবে। একটা মেয়ে আছে আয়েনদ্দির, জরিনা, বায়না ধরেছে একটা লাঠি-অলা লেবেঞ্চুসের। পয়সা বাচিয়ে তাও নিতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কাজ মোটামুটি শেষ। বাকী কাজটা অন্ধকার হলেও শেষ করে যেতে হবে। জব্বার মিয়া বলেছে, নইলে পয়সা মিলবেনা।


হঠাৎ করেই পা টা হড়কে গেল আয়েনদ্দির। হাতের কাছে কিছু ধরবার সুযোগ পেলনা সে। ষ্টেজের পাশেই মুখ থুবড়ে পড়লো ধুপ করে। প্যান্ডেলের একটা কাঠে জোরেই চোট লেগেছে ওর মাথায়। রাত্রিটা যেন একটু তাড়াতাড়িই এসে গেল ওর কাছে। দু-চোখ জুড়ে রাজ্যের অন্ধকার।


দু একজন কাজ ফেলে ছুটে আসল দেখতে। ঘাসের উপর শুইয়ে পানি ছিটাল চোখে, মুখে। একটু পর হুশ ফিরে এল ওর। আয়েনদ্দি চোখ খুলতেই একজন ডেকে নিয়ে আসলো জব্বার মিয়াকে।

এসেই ধমক দিয়ে উঠলো সে। ব্যাটা অকর্মার ধাড়ি, তোদের মতো অপদার্থদের জন্যই দেশের এই দুর্দশা। যা ভাগ এখন।


প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে আয়েনদ্দির। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। একটু পানি খেয়ে ছোকরা নেতাকে বললো, জব্বার ভাই, আমার টাকাটা দেন।


ব্যাটা মগের মুল্লুক পাইছস? গজরিয়ে উঠে জব্বার। কাজ না কইরাই টাকা চাস।


কয়েকজন এসে সুপারিশ করাতে আয়েনদ্দি টাকা পেলো - তবে পুরোটা নয়। পুরো কাজ করেনি বলে পাঁচ টাকা জরিমানা। আর পাঁচ টাকা সভার চাদা। সবাই শ হাজার করে চাঁদা দিচ্ছে, আর তুই ব্যাটা দেশের জন্য পাঁচটা টাকা দিতে পারবিনা, জব্বারের মন্তব্য।


-২-


ঘরে ফিরছে আয়েনদ্দি। পকেটে ত্রিশ টাকা। পাঁচ টাকা দেশের জন্য গেছে। দেশ কি নেতার জন্য বানানো তোরন আর প্যান্ডেল? উত্তরটা মিলাতে পারেনা সে।


গ্রামের হাট প্রায় ভাংতে বসেছে। আধা কেজী চাল আর কিছু তরকারী কিনলো সে। মেয়ের জন্য কিনলো দুটো লাঠি-অলা লেবেঞ্চুস। দু মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে, বাড়ী যেতে। শূন্য মাঠ, হিমেল হাওয়া বইছে। মাঠ ভর্তি ধান গাছের গোড়া। মাঠের মাঝে পায়ে চলার দাগ। আয়েনদ্দি হাটছে আর হাটছে। পথ যেন আর ফুরাতে চায়না।


মাথার ব্যাথাটা বাড়ছে। বেশ শীত লাগছে। শীতটা কি এবার একটু আগে ভাগেই এসে গেল? ব্যাথাটা অসহ্য লাগেছে। কান দিয়ে গরম হাওয়া বেরুচ্ছে লু হাওয়ার মত। দুরের আলোগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। আয়েনদ্দি পাশের ডোবা থেকে গামছাটা ভিজিয়ে নিল। চোখে, মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে আবার চলতে শুরু করলো।


সে ভেবেছিল, বাড়ী আর পৌছাতে পারবেনা; শূন্য মাঠের মধ্যেই পড়ে থাকবে সারা রাত। তবু হাল ছাড়লোনা। নিজকে নিয়ে চললো টেনে হিচড়ে। না, সে ঠিকই পৌছেছিল। তবে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। আয়েনদ্দির বউ আয়না, ভিটায় বসে মাঠের প্রতিটি সঞ্চরনশীল বস্তুকেই আয়েনদ্দি ভেবে ভেবে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল, আর ওর চোখ জড়িয়ে আসছিল ঘুমে, তখনি আয়েনদ্দি এসে ভিটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আয়না ভয়ে প্রায় চিত্কাের দিতে গিয়ে দেখল, লোকটা আর কেউ নয়, ওর স্বামী আয়েনদ্দিই বটে।


লোকটার চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেল আয়না, কি হইছে আপনের? এমুন লাগতাছে ক্যান? হড়বড় করে প্রশ্ন করে সে।


এমুন কিছুনা, মাথায় একটু চোট লাগছে, উত্তর দেয় আয়েনদ্দি। আয়নাকে ঘাবড়ে দিতে চায়না সে।


সারাটা দিন প্রায় অভুক্তই ছিল আয়না। ভাত বসিয়ে আয়েনদ্দির কপালটা টিপে দিল সে। গোলমালে জরিনার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ঘুমের জড়তা ভাংতেই বাবার গলা ধরে সে বললো, আমার লেবেঞ্চুস আনছ? আয়না লেবেঞ্চুস দুটো উঠিয়ে রেখেছিল। একটা এনে মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিল। খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে প্রায় দুপুর রাত।


-৩-


আয়েনদ্দি শুয়ে আছে। মাথার ব্যাথাটা খুব বেশী নয়, আবার কমও নয়, কেমন সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসে আছে। জরিনা ঘুমাচ্ছে, ঘুমন্ত আয়নার গলা প্যাচিয়ে ধরে। দুরে একটা কুকুর ডাকছে। আয়েনদ্দির বাড়ী খোলা মাঠের মধ্যে। শো শো করে বাতাস বইছে। পাটকাঠের বেড়ার ভেতর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরে পিন পিন করে।


আধো ঘুমে, আধো জাগরনে স্বপ্ন দেখে আয়েনদ্দি। জব্বার ভাই বলছে বউ, বাচ্চা, সব্বাইরে লইয়া মিটিংএ যাইতে। লোক বেশী অইলে মন্ত্রি সাব খুশী অইবো। আয়েনদ্দি আয়নাকে নিয়ে জনসভায় যাচ্ছে। ওর কোলে জরিনা, নতুন কাপড় পরা। কেমন যেন ঈদ ঈদ লাগছে ওর। লোকে লোকারন্য সভার মাঠ। খুব খুশী জরিনা।


প্রচন্ড তৃষ্ণায় ঘুমটা পুরোপুরিই ভেঙ্গে গেল আয়েনদ্দির। বাইরে আলোর আভাস। সকাল হয়ে আসছে। আয়নাকে কি ডাকবে? না থাক, বলে নিজেই উঠতে গেল সে। সারা পৃথিবীটা যেন ঘুরে উঠলো লাটিমের মতো। সাথে সাথেই শুয়ে পড়লো সে। গা টা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। মাথার ব্যাথাটাও বেড়েছে।


আয়না, আয়না, ডাক দিল সে। কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বেরুলোনা ওর। হাত দিয়ে পিঠে ধাক্কা দিতেই হুড়মুড় করে উঠে বসলো আয়না।


কি হইছে, কি হইছে, চরম উত্ক।ন্ঠা ওর চোখে মুখে।


পানি, ফ্যাসফেসে গলায় বললো আয়েনদ্দি।


পানি এনে আয়েনদ্দির হাতে দিতে গেল সে। আয়েনদ্দি শুয়েই থাকলো। উঠতে পারলোনা। মাথাটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বালিশ থেকে উঠিয়ে, আয়েনদ্দিকে পরম যত্নে পানিটা খাওয়ালো আয়না।


আপনার গা ডা তো জ্বরে পুইড়া যাইতাছে, বললো সে।


আয়েনদ্দির মাথায় ঠান্ডা পানির পট্টি দিতে দিতেই সকাল হয়ে যায়। আয়না ভাবতে থাকে, এখন সে কি করবে? এত সকালে কি ডাক্তার সাবরে পাওন যাইবো?


আয়েনদ্দির চাচাতো ভাই জলিল থাকে পাশের ঘরে। ওকে ডেকে উঠায় আয়না, জলিল ভাই, তোমার ভাইর শইলটা ভালা না। একটু দেইখা যাও।


এত সকালে ডাকাতে একটু বিরক্তই হয় জলিল, তবু আসে।


একটু দো টানায় পড়ে য়ায় আয়না - সে যাবে ডাক্তার সাহেবের কাছে, না জলিলকে পাঠাবে? জলিলকে দেখলে ডাক্তার সাহেব পাত্তা নাও দিতে পারেন। আর সে গেলে কেঁদে কেটে হলেও ডাক্তার সাহেবের অনুগ্রহ মিলতে পারে। কিন্তু এদিকে আবার অসুস্থ আয়েনদ্দিকে রেখে যেতে হবে জলিলের হিল্লায়। অনেক ভেবে, শেষ পর্য্যন্ত নিজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আয়না। জলিলকে সব বুঝিয়ে পথে পা রাখে সে। রাস্তাতো আর কম নয়, ঝাড়া দু মাইল। তাড়াতাড়ি পা চালায় সে।


-৪-


মন্ত্রি সাহেব আসবেন বলে আজ সব ছুটি। স্কুল, পোষ্ট অফিস, টি-এন-ও অফিস, সরকারী ডিসপেনসারী, সব। ডাক্তার সাহেব কাল থেকেই এম, পি সাহেবের বাড়ীতে। মন্ত্রি সাহেবের সম্বর্ধনার যোগাড়যন্ত্র নিয়ে ব্যাস্ত। সরকারী ডিসপেনসারীর পেছনেই থাকেন কমপাউন্ডার সাহেব। ওনার বাসায় সকাল থেকে জুয়ার আসর বসেছে।


আয়না দেখে, ডিসপেনসারী বন্ধ ভেতর থেকে। প্রচন্ড নিরাশ হয়ে যায় সে। না, হাল ছাড়লেতো চলবেনা। একটা কিছু উপায় বের করতে হবে। ডিসপেনসারী বন্ধ হলে কি হবে, লোকগুলোতো হাওয়া হয়ে যায়নি। ভেতর থেকে বন্ধ, তার মানে, ভেতরে কেউ আছে। দারোয়ান তো ঠিকই থাকবে। ওকে জিজ্ঞেস করলেই ডাক্তার সাহেবের হদিশ মিলবে। দরজার কড়া ধরে নাড়তে থাকে সে।


ভেতরে তাশ খেলায় নিমগ্ন মানুষগুলো কিছুই শুনতে পায়না। আয়না আরো জোরে কড়া নাড়তে নাড়তে দরজার উপর করাঘাত করতে থাকে। হঠাৎ একজন শব্দটা শুনতে পায়।


কমপাউন্ডার সাব, কেউ যেন দরজা ধাক্কাইতাছে, লোকটা বলে।


সবাই চুপ করে শব্দটা শুনে। হ্যাঁ, দরজায় একটা শব্দ হচ্ছে বটে।


এই হারামজাদা, তালগাছের লাহান খাড়াইয়া কি রং দেখতাছস? দারোয়ান ছোকরাকে ধমক লাগায় কম্পাউন্ডার সাহেব। যা, দেইখা আয় কোন হালায় এই সাত-সকালে মরতে আইছে। জবাবটা কায়দা মত দিস কিন্তু।


কায়দাটা জানে দারোয়ান ছোকরা। কেউকেটা কেউ হলে বলতে হবে, আপনি বসেন, কম্পাউন্ডার সাহেব বাথরুমে, আমি খবর দিতাছি। মাঝারি গোছের কেউ হলে বলতে হবে, উনি এখনই রুগী দেইখা ফিরলেন। একটু রেষ্টে আছেন। বসেন। আর বাকী সবাইকে বলতে হবে, কম্পাউন্ডার সাব বাসায় নাই, জরুরী কাজে সদরে গেছেন। ফিরতে রাইত অইবো।


আয়নার কপালে তৃতীয় উত্তরটাই জুটলো, কম্পাউন্ডার সাব বাসায় নাই, জরুরী কাজে সদরে গেছেন। ফিরতে রাইত অইবো।


আয়না নাছোড়বান্দা, ডাক্তার সাব কই? আয়েনদ্দি মইরা যাইতাছে, ওরে বাঁচাইয়া দেন ভাই। খপ করে দারোয়ান ছোকরার হাতটা ধরে বসে আয়না। মনটা একটু দয়াদ্র হয় দারোয়ানের। বললো, এম, পি সাবের বাড়ীত যাও। ডাক্তার সাবরে ওইখানে পাইবা।


হাতটা ছেড়ে দেয় আয়না। সময় নাই। এম, পি সাবের বাড়ী সে চিনেনা, জলিলকে পাঠাতে হবে। ছুটে বেরিয়ে যায় আয়না।


-৫-


ঘুম থেকে উঠে মাকে না দেখে মনটা একটু খারাপ হয় জরিনার । তাও একটু ক্ষনের জন্য। চারটা মুড়ি দিয়ে নিজে নিজেই নাস্তা সারে সে। ওদের বাড়ীর সামনে দিয়ে রাস্তা। দুর দুরান্ত থেকে মানুষ যাচ্ছে দল বেধে জনসভায়। দুপুর হয়ে গেছে। আগে না গেলে সামনে যায়গা পাবে না।


মা নাই। নিজেই নিজের পছন্দের জামাটা বের করে পরে নেয় সে। একটু খুঁজে দ্বিতীয় লেবেঞ্চুসটাও পেয়ে যায়। ওটা চুষে ঠোঁট দুটো লাল করে ফেলে।


কি বাজান, তুমি না কইছিলা আমারে নেতাগো দেখাইতে লইয়া যাইবা, বাপের হাত ধরে সপ্রশ্ন দৃষ্টি রাখে জরিনা।


মা রে, তোর বাজানের শইলডা ভালা না, অশ্রুশিক্ত কন্ঠে বলে জলিল।


এইডা নতুন কথা না। বাজানের শইলডা মাঝে সাঝে খারাপ হয়ই। তা বইলা সভায় যাইবোনা। ভাবতেই পারেনা জরিনা। দুঃখে চোখে জল এসে পড়ে ওর।


চোখে জল আসে আয়েনদ্দিরও। মাথার ব্যাথায় শরীরটা ধনুকের ছিলার মতো বেঁকিয়ে আসে। জলিল, তুই মাইয়াডারে একটু সভা দেখাইয়া আনিস, বলে সে। কিন্তু ওর কথাটা কেউ শুনতে পায়না।


এমন সময় ঝড়ের বেগে হাফাতে হাফাতে ঘরে ঢুকে আয়না। দু মাইল রাস্তা সে দৌড়ে পার হয়ে এসেছে।


জলিল, ডাক্তার সাব আছে এম, পি সাবের বাড়ীত। তুমি যেমন কইরা পার, ডাক্তার সাবরে ধইরা তোমার ভাইর লাইগা একটু দাওয়াই আইনা দাও, এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে আয়না।


জলিল বেরিয়ে পড়ে বিনা বাক্য ব্যায়ে। আয়না স্থানুর মতো বসে থাকে। কি করবে কোন দিশা পায়না।


আমারে সভায় নিয়া চল, আমি নেতা দেখুম , মন্ত্রি দেখুম, পা আছড়ে চিত্কাের করে কান্না জুড়ে দেয় জরিনা।


থাম হারামজাদী, মেয়ের মুখে দুটো চড় বসিয়ে দেয় আয়না।


অবাক হয়ে যায় জরিনা। ওর চিত্কাড়র থেমে যায় সাথে সাথে। মাটির উপর উপুড় হয়ে গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে সে।


প্রচন্ড ব্যাথার ঘোরেও সব উপলদ্ধি করে আয়েনদ্দি। চোখ ভেঙ্গে প্লাবন নামে ওর।


-৬-


এলাহি কান্ড এম,পি সাহেবের বাড়ীতে। মন্ত্রি সাহেব এসে গেছেন। সাথে ডজন দুয়েক চেলা চামুন্ডা। পুরা মহকুমার গন্যমান্য ব্যাক্তিরাও আছেন। দেদার খাওয়া দাওয়া চলছে, ফুর্তি চলছে। বাড়ীর বাইরেও মহোত্সতব। ভিক্ষুকদের জটলা। যেন মেলা বসেছে। এম,পি সাহেবের চেলারা বাড়ীর গেট পাহারা দিচ্ছে। ঝামেলা মেটাচ্ছে।


এম,পি সাহেবের বাড়ীর গেটে এসে মহাসমুদ্রে পড়ে যায় জলিল। পাহারাদারদের এক জনকে বলে, ভাই, আমারে একটু ভিতরে যাইতে দেন, জরুরী কাম আছে।


তোরাব হুনছস, আরেক পাহারাদারকে ডেকে বলে লোকটা। লাট সাব আইছে, ভিতরে যাইতে চায়। হো হো করে হেসে উঠে দুজন।


ভাই, আমার ডাক্তার সাবরে বড় দরকার, লোকটাকে আবার বলে জলিল।


ভাগ ব্যাটা। এইটা কি হাসপাতাল পাইছস? তেড়ে উঠে লোকটা।


এমন সময় গেটের ভেতর জব্বার মিয়াকে দেখতে পেয়ে ধড়ে প্রান ফিরে পায় জলিল।


জব্বার ভাই, জব্বার ভাই। চিত্কাফর করে ডাকতে থাকে সে। ডাকটা শুনে এগিয়ে আসে জব্বার মিয়া।


জব্বার ভাই, ডাক্তার সাব রে একটু খবর দেন। আয়েনদ্দি আর বাচবোনা , হড়বড়িয়ে বলে যায় জলিল।


কোন আয়েনদ্দি?, সপ্রশ্ন দৃষ্টি রাখে জব্বার।


আপনের লগে কাম করছিল গত দুইদিন ধইরা। মনে করিয়ে দেয় জলিল।


কত ব্যাটাইতো কাম করছিল, আমি কি সবার চেহারা মুখস্ত কইরা রাখছি। এখন কি চাস? আবার সপ্রশ্ন দৃষ্টি রাখে জব্বার।


ডাক্তার সাবরে একটু খবর দেন, আয়েনদ্দি মইরা যাইতাছে। কাতর স্বরে বলে জলিল।


ডাক্তার সাব দেশের কাজে ব্যাস্ত। দেশ বড় না তোর আয়েনদ্দি বড়? যা, এখন ভাগ। সভায় আসবি। সভার পর দেখা যাইবো, কি করা যায়। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে ভেতরে ঢুকে যায় জব্বার মিয়া।


-৭-


মিছিলের পর মিছিল যাচ্ছে সভার ময়দানে। তাদের শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে গ্রামের ধুলি ঢাকা প্রান্তর।


আয়েনদ্দি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব শুনতে পাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে জরিনা। আয়না একের পর এক জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে আয়েনদ্দির মাথায়। চোখ দুটো পড়ে আছে দরজার বাইরে, কখন জলিল ফিরবে অষুধ নিয়ে।


সভা শুরু হয়ে গেছে। মন্ত্রি গাড়ী থেকে নেমেছেন। সারা মাঠ প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে শ্লোগানে শ্লোগানে। জনতার ভীড়ে এগুতে পারছেন না তিনি। মালার পর মালা দেয়া হচ্ছে তাকে। অনেক কষ্টে জনসাগর পেরিয়ে মঞ্চে উঠলেন তিনি। বসলেন নির্ধারিত চেয়ারে।


বক্তৃতার পর বক্তৃতা চললো। এক সময় মন্ত্রি সাহেব বক্তৃতা দিতে উঠলেন। সারা মাঠ হাত তালিতে ফেটে পড়লো আবার। বক্তৃতা চলছে। জব্বার মিয়া সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে ষ্টেজের পেছনে দাড়িয়ে। হঠাৎ কে একজন এসে জব্বার মিয়ার কানে কানে কিছু বললো। জব্বার মিয়া একটু ভাবলো। তারপর কাগজে কিছু লিখলো। তারপর বিড়ালের মতো চুপিচুপি মঞ্চে উঠে কাগজটা এম,পি সাহেবের হতে ধরিয়ে দিল।


এম,পি সাহেব কাগজটা পড়লেন। ভাবলেন কিছুটা। তারপর কিছু লিখলেন কাগজটায়। মন্ত্রি সাহেবের বক্তৃতা চলছে। তিনি একটু থামলেন পানি খাওয়ার জন্যে। এই ফাঁকে ওনার হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিলেন এম,পি সাহেব।


কপালটা একটু কুচকালো তার কাগজটা পড়ে। তাও ক্ষনেকের জন্য। বক্তৃতা চললো আবার। প্রায় শেষ পর্বে এসে গেছেন তিনি।


ভাই ও বোনেরা, একটা শোকের খবর দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করবো। আপনারা আপনাদের মনকে শক্ত করুন, থামলেন তিনি।


জনতার মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠলো।


আমাদের পার্টির প্রিয় কর্মী, জনদরদী নেতা জনাব আয়েনদ্দি মন্ডল আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। আজ বিকাল চারটায় তিনি আমাদের মায়া কাটিয়ে, আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে পরকালের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। ইন্নালিল্লাহে .... । গতকালও তিনি এই মাঠে দাঁড়িয়ে সবার নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশ সেবার সংগ্রামে। জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু তিনি দেশের জন্য দান করে গেলেন। তার এই ত্যাগকে আপনারা বৃথা যেতে দেবেননা। যে দলের জন্য উনি জীবন দিয়ে গেলেন, সে দলকে আসন্ন ভোটে বিজয়ী করে ওনার মৃত আত্মার প্রতি যথাযথ সন্মান প্রদর্শন করুন। ওনার ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, আমি আমার পক্ষ থেকে ওনার পরিবারের জন্য এক হাজার টাকার দান ঘোষনা .......।


জনতার মুহুঃ মুহুঃ শ্লোগানে মন্ত্রির বাকী কথা চাপা পড়ে গেল।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খোরশেদুল আলম আমাদের চারপাশের বাস্তব ঘটনা, ভাব প্রকশ এক কথায় চমৎকার, ধন্যবাদ আপনাকে এত ভালো লেখার জন্য।
sakil বাস্তবিক ঘটনার প্রতিফলন ঘটেছে এই গল্পে . আমাদের সমাজের কিছু sotto কথা উঠে এসেছে আপনার গল্পে . আমার কাছে prothom থেকে ভালো লেগেছে এবং যাকে বলে এক নিশাসে পরে শেষ করলাম . আপনার জন্য অনেক শুভকামনা রইলো .
মোঃ ইকরামুজ্জামান (বাতেন) সাবের ভাই, রাজনীতি আমি মোটেও বুঝি না; তবে আপনার `জনসভা'য় আজকালকার হিংসার রাজনীতির বিষয়বস্তু সুন্দর...রাজনীতির মানুষগুলো কি আসলে এ রকম! গল্পটা কিন্তু আজকের জন্য ফিট...
আহমেদ সাবের যারা আমার গল্পটা কষ্ট করে পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন ( ahmad mukul, নাজমুল হাসান নিরো , জারিফ আল সাদিক , এস, এম, ফজলুল হাসান , অবিবেচক দেবনাথ, মামুন ম.আজিজ, রওশন জাহান, ঝরা, লুতফুল বারি, পান্না, আযহা সুলতান , Md. Akhteruzzaman, S.M Kaiyum, স্বপ্নচারীনি, ফরিদুল ইসলাম নির্জন, প্রজ্ঞা মৌসুমী, সূর্য , মনির মুকুল, আশা , nahin ahmed , শিশির সিক্ত পল্লব , md siful islam simum, Khondaker Nahid Hossain ) তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ahmad mukul এবং নাজমুল হাসান নিরোর মন্তব্যের আলোকে গল্পটা পড়ে মনে হল, চতুর্থ ও পঞ্চম পর্বে কিছুটা কাট ছাট বোধ হয় করা যেতে পারে। সব বারের মত, এবারও মনে প্রাণে চাই, মান সম্মত লেখা পুরষ্কার পাক।
খন্দকার নাহিদ হোসেন ছাবের চাচা, কি গল্পই না একটা লিখেছেন। একপাশে যন্ত্রণা অন্যপাশে জনসভার আয়োজন তার ভিতর দিয়ে তুলে আনা ভণ্ডামি। একটানে পড়ে ফেলার মতো ঝরঝরে একটা গল্প। আর ডাক্তারকে খোঁজাখুঁজির মধ্যে দিয়ে যে উত্তেজনাটা সৃষ্টি করেছেন তাতে বলতেই হচ্ছে গল্পকারের হাত অনেক দামি।
Abu Umar Saifullah বিজয়ী হবার জন্য প্রথমে অভিনন্দন জানাই, অনেক ভালো লাগলো
শিশির সিক্ত পল্লব আহমেদ সাবের ভাই অনেক সুন্দর....চালিয়ে যান....
nahin ahmed মাঝখানের স্পেস অনেক বেশি হয়ে গেছে তাই পড়তে অসস্তি লেগেছে শেষের দিকে. তবে গল্প হিসেবে খুব মানসম্মত.
আশা আঙ্কেল, গল্পটা চমৎকার লিখেছেন। হৃদয়বিদারক এক দৃশ্য যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। আর মন্ত্রীর ভাষণটা কতদিন মাথায় ঘুরপাক খাবে আল্লাহ মালুম। ধন্যবাদ আপনাকে- একটু কষ্ট মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্যে। কারণ; আমি কষ্ট পড়তেই ভালোবাসি। যদিও এরকম কষ্ট নয়।

০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪