এক.
আমি এখনো রোহানার চোখে এক নিস্তব্ধতা খুঁজে পাই। তার নিস্তবতার প্রতিটা শব্দে গভীর নিঃশ্বাস প্রবাহিত হয়। অনেকদিন কোথায় যেন তার হাসি, ঠাট্টা, বিদ্রুপ আর মুঠোমুঠো তামাশা লুকিয়ে গেছে। জানি না, একদম জানারও কোনো সুযোগ হয়নি আমার। বারো হাত শাড়ি পড়া সেই উজ্জ্বলময় দিন আমি এখনো খুব মিস করি। মিস করি তার চোখে চোখ রেখে, পাশাপাশি বসে ঔপন্যাসিক দিনগুলো। স্মৃতির দিনলিপিরা এখনো আমার পুরো হৃদয়কে উত্তাল-পাত্তাল করে তুলে। হয় তো তার কোন এক মায়াটান তাকে দিনদিন অসুখী করে তুলেছে। তার ইতিবাচক জীবনের সারমর্ম থেকে খুঁজে পাওয়া যায় মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন! ছোট ভাই সবে মাত্র এক দুই পা করে লালসার দিনকে অতিবাহিত করতে চেয়েছে কেবলি! মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্বল। কথিত জীবনের রূপ টেনে বুকের ভিতর আলগে রাখা ব্যক্তিটির নামই হলেন মা। পৃথিবীর ঘুমানোর স্বপ্নে নিস্তব্ধ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তখনো যদি মা বেঁচে থাকেন- বেঁচে থাকবে ভালোবাসা! জেগে উঠবে সমস্ত মায়াজাল। সেই মায়ের আঁচল ধরেই বেড়ে উঠা দুই সন্তানের এক কাব্যিক গল্প। জীবনের উপাদান আর বিস্তৃত পৃথিবীর সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা এক শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ধীরেধীরে বেড়ে উঠা আর হাঁড়ি-পাতিল ও মায়ের মুখ থেকে শব্দ শেখা সেই স্মৃতির দিনগুলো পেরিয়ে স্কুলের গন্ডিতে নিয়ে আসতে কতটা কষ্ট আর কতটা যুদ্ধ করতে হয় সেটা সে মা জানেন, যে মা নিজেকে চেনেননি কিংবা জানেননি; শুধু চিনেচেন এবং জেনেছেন সন্তানের রূপবদলের দিন, সন্তানকে মানুষ করে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সেই ইতিহাস! অথচ তারই ভিতর রোহানার মায়ের পেরিয়ে গেছে কতটি কান্নাভেজা সময় আর রাত্রির বুকে সংগোপন করা নিজের অভিমান। একদিন ঠিকই সমস্ত আকাঙ্খা আর ইচ্ছেকে একত্রিত করে মেয়েকে জয়ের মুকুট পড়িয়েছেন, কিন্তু পরবর্তীতে সেই ইচ্ছা আর আকাঙ্খার সনদে উঠে এসেছে নির্মম ইতিহাস! জন্ম থেকে প্রজন্মের সেই রীতিনীতির গল্পের সরে যদি লেখা থাকে কষ্ট তবে ঘুমন্ত শহরে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে যাওয়াই শ্রেয়৷ হয় তো সেই পথকে বেঁচে নিতো এমন হাজারো নারী, শুধু একটা বাক্য বেঁচে থাকার আলিঙ্গণ দেয়, বেঁচে থাকার জন্য নতুন শব্দ কিংবা বাক্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। কারণ স্বইচ্ছায় মৃত্যু মহাপাপ। সেই কাটাময় জর্জরিত দিন পেরিয়ে রোহানার মা আজ নতুন আরেকটা অভিমান বুকে সংগোপন করে রোহানাকে আমার হাতে তুলে দেয়। সেদিন রোহানার চোখে জল দেখেছি ঠিকই, অথচ ভালোবাসার বর্ণাঢ্য র্যালী যেন আমার আর তার আকাশে বাতাসে উড়েছিল। যদিও আকাশ একটাই। নিজের রোহান নামের সাথে রোহানাকে পেয়ে আরেক বুক ভালোবাসা জমিয়ে উঠলো। দিন আর রাতের এই গোপন স্বরলিপি বেধ করে পেরিয়ে এসেছি সবে মাত্র কয়েকটি মাস, হাতে গোণা গোটা কয়েক দিন। হাসি-ঠাট্টা-বিদ্রুপ আর তামাশার কমতি ছিল না সংসার নামক এই সফটওয়্যারে।
দুই.
একটা অন্তঃবৃত্তের পথ ধরে হেটে ছিলাম। ভার্সিটির গণ্ডি পেরিয়ে চাকরিতে জয়েন দিতে না দিতেই মা-বাবার খেয়াল খুশিমতে আটকা পড়ে গেছি একটা নতুন জীবনে একটা নতুন সংসারের। রোহানায় ছিল তখন একমাত্র আমার স্ত্রী। বুকে জমানো সারাটি জীবনের ভালোবাসার ফুল ফুটে এসেছিল যে নারী সে শুধু ভালোবাসা ছাড়া পুরুষের কাছে অন্যকিছু চায় কি না মনে হয় না। কারণ তার ভালোবাসার ফুটন্ত গোলাপে সব চাওয়া-পাওয়ার ইতিবৃত্ত ঘটে। অথচ সে নারীটিকে শুধু ভালোবেসেই গিয়েছিলাম, কিন্তু তার মন পাতানো কাব্যিক শব্দগুলো বুঝে নিতে ব্যর্থ হয়েছি বারবাংবার। যে পুরুষ নারীর অস্পষ্টতাকে বুঝে নিতে ব্যর্থতা অনুভব করে সে অনুভূতির খেয়ালে তাকে কাপুরুষ বলা ছাড়া কিছু মনে হয় না। সকালের বাড়ন্ত ভালোবাসার বেখেয়ালে বেড়িয়ে পড়েছি অফিসে কেবলি, অথচ দীর্ঘায়িত সময়ে খাওয়া-দাওয়ার নিয়মমাফিক খুঁজ নিতে পারিনি কোনদিন। সংসারকে বাঁধতে ছুটির সময়কালীন দেখাতে পারিনি অস্পর্শতার কোনো নতুন দিগন্তের মেলা। বোঝার চেষ্টা করিনি কোনোদিন হাসির মাঝেও কোনো অভিমান লুকিয়ে আছে কি না। সেই রোহানার চোখে আজ নিস্তব্ধতা। নীরবতার কোন ঢেউ আজ তাকে ভিজিয়ে তুলেছে জানতে অক্ষম হয়েছি! না জানি শিশুকালে হারানো পিতার শোকে নিজেকে অসুখী করে তুলেছে কি না। নাকি কোন অবাধ্য জোছনায় সে নিজেকে বিষণ্নতায় আটকে রেখেছে। শুধু মন ভাবনায় একটাই উঠে আসে, রোহানা ফিরে আসো সেই ভালোবাসার দর্পনে। যেখানে শুধু হাসিগুলো ফুটে উঠবে। অথচ দমক দিয়ে সে কথাটাও বলতে পারিনি। যদি না আরো বেশি কষ্ট পায়। যদি না সে অনুতপ্তকে বুকে সংগোপন করে ফের জমে উঠে দীর্ঘশ্বাস। সে দীর্ঘশ্বাসে যদি না মহান রব লিখে দেয় আমি অপরাধী; তখন কি হবে! এতোটা ভালোবাসা যার জন্য ছিল সে আজ নীরব-নিস্তব্ধ! নিপুণ বড়শির টানে যেন সে হারিয়ে যাচ্ছে।
তিন.
দিনদিন চাকরির প্রতি মনোযোগ বাড়ে আর দায়িত্ব বেড়ে যায়। তাই আজকাল রোহানাকে সময় দিতে অতোটা প্রস্তুতি নিতে পারিনি। ভাবছি হয় তো মায়ের কাছে মনটা ঠিক হয়ে যাবে। অনেকদিন তার মা দেখতে আসে না তাকে। ভাবলাম নারীর হৃদয়ের টান মা। সে মাকে যদি দীর্ঘদিন ধরে না পায় তাহলে হতভম্ব হয়ে পড়ে। জীবনের সব লেনদেন এক মাকে শেয়ার করে, দুই স্বামীকে শেয়ার করে। অথচ অভিমানগুলো হয় তো আমাকে প্রকাশ করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় আমাকে নিয়ে তার ভীষণ অভিমান। ভাবতে ভাবতে তাড়াতাড়ি ছুটে আসলাম। রোহানাকে নিয়ে সেদিন তাদের বাড়িতে চলে গেলাম। গিয়ে দেখলাম তার আম্মু বড্ড অসুস্থ্য। চেহারাটা কালশিটে হয়ে গেছে। প্রথমে মুখে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব ছিল পরে ঠিকই মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছিল। অসুস্থতার জন্য ভালো করে কথা বলতে পারেনি। অন্যদিকে রোহানা তার মাকে ধরে এতোটা চিৎকার মেরে কান্না করেছে যা আমাকে অবাক করে ফেলেছে। যাকে কোনকিছুর কমতি রাখিনি কোনদিন আজ কোন অভিমানে সে এমন করে কাঁদছে বোঝে উঠতে পারিনি। একটা ভাবনা আমার পুরো আকাশ ঘিরে ফেলেছে। ফের নিজের বাড়ি ছুটে চললাম। ভাই-বোন, মা-বাবা কারো থেকে কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। তাহলে কোথায় গিয়ে প্রশ্নটা দাঁড়িয়ে থাকলো। কোন জবাব আসেনি। হঠাৎ একদিন শুনি রোহানা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মন ভালো রাখার জন্য দিয়ে এসে আরো অসুস্থ। মনস্তাত্ত্বিক ঠিক রাখতে না পেরে চলে গেলাম। কারণ তাকে তো আমাকেই দেখতে হবে। তাকে দেখার অধিকার তো আমাকেই দেওয়া হয়েছে। গিয়ে দেখি জ্বরে ভীষণ রকম কাঁপছে। আমাকে দেখে তার দু'চোখ সমুদ্রজলে ভাসতে লাগলো।
চার.
পরিবারের প্রতি ভালোবাসাটা একটু অন্যরকম ছিল। বরাবর স্বাচ্ছন্দবোধ। মা-বাবা, ভাই-বোন কারো প্রতি মোটেও কমতি ছিল না। আমার শুধু আমি নয়, সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন। আর সে ভাবেই স্বপ্নটা রঙিন হয়। অথচ বিয়ের পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসে থমকে দাঁড়াতে হয়েছে আমাকে। আমি পুরুষ। জীবনের সমস্ত কষ্ট উজাড় করে হলেও একমুঠো ভালোবাসা কুড়াতে পারি৷ তাই তো সংসারের প্রতি সে প্রেমটা জেগে উঠে নিদারুণ। ছোট বোন রাহি। যে ছোটবেলা থেকে আমার হৃদয়ের মণিকোঠা ছিল। কখনো রাহিকে রেখে কোন আনন্দ মুহূর্ত পালন করেছি কি না আমার মনে হয় না। সবসময় সংসারের এলোমেলো জিনিসপত্র ঘুচিয়ে রেখেছে। খোঁজ নিয়েছে। ভালোমন্দ বলেছে। সে বোনটার কিছুদিন পর বিয়ে। যদিও মুখে হাসির ছোঁয়া কিন্তু বুকের মধ্যখানে তার মায়ারজাল এড়াতে পারি না। তবুও মেনে নিতে হয়, সৃষ্টিকর্তার এ বিধান চিরন্তন। পাড়াপড়শি খুশির ঢাকঢোল ছড়িয়ে দিচ্ছে রোজ রোজ। এ দিক দিয়ে সংসার একটু আড়মোড়। কানাঘুষা শোনা যায়- 'রোহানা যেন সে বিয়েতে উপস্থিত না থাকে।' তার আম্মু যেন বিয়েতে না আসে। এমন এক প্রস্তাব পাশ হওয়ার আবেদন পত্রটি মায়ের থেকে বাবার কাছে চলে এসেছে। বাকী কথার ইতিবৃত্ত লুকিয়ে গেল। কেউ কেউ বলে রোহানার মা আসলে সম্মানহানি হতে পারে। ছেলে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সেখানে অনেক উচ্চবিত্ত লোকেরা আসবেন। তাতে যদি রোহানার আম্মু থাকে সম্মানের ক্ষতি হতে পারে নিশ্চিত। সে সমস্ত কথাগুলো আর কান দিলাম না। বেখেয়ালে রেখে দিলাম। সময় হলে সবকিছুর জবাব নিশ্চিত উঠে আসবে। পরেরদিন অফিস থেকে কঠিনকিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা দ্রুত ফাইল জমা দিতে হবে। স্যারকে বুঝিয়ে বললাম, 'বোনের বিয়ে, স্ত্রী অসুস্থ্য।' স্যার চিন্তা না করার অনুরোধ ছড়িয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তুমি পারবে সবকিছু। ভয়কে জয় করা তোমার কাজ। এগিয়ে যাও।
পাচ.
কাজের চাপে বেশ কয়েদিন হতভম্ব হয়ে পড়লাম। মন ঠিক ছিল না। একটু শান্তির আশ্রয় খুঁজেছিলাম। পরক্ষণে মনে পড়লো রাহির বিয়ে। দ্রুত ফাইলটা নিয়ে এসে অফিসে স্যারকে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে দেখি সত্যি বিয়ের ঢাক-ঢোল পিটাচ্ছে। নাচগান, আনন্দ মাতাল। লাল, নীল, হলুদ মিটিমিটি বাতির মেলা জমিয়ে তুলেছে চারদিক। উন্মাতাল পরিবেশ। সবদিক দিয়ে রোহানা, তার মা ও ছোট ভাইকে চিহ্ন চিহ্ন করে খুঁজলাম। কাউকে পাইনি। না পেয়ে রাহিকে বললাম,
-) এতোটা নিঠুর হইলি, ভাইয়াকে একটা ফোন ও দিতে পারোস নাই।
রাহি হেসে বলল,
-) আমার তো বিয়ে! খোঁজ তো তুমি নিবা, আমি কেমন আছি? খাওয়াদাওয়া হয় কি না? পরিস্থিতি ঠিক আছে কি না?
-) নাটক করিস না তো। আচ্ছা তোর ভাবী কই? ওদেরকে আসতে বলেনি?
তখন রাহি মিহি কণ্ঠে জবাব দেয়-
-) মা তাঁদেরকে আসতে মানা করে দিয়েছেন।
-) আ রে কেন মানা করেছেনে?
রাহি গভীর নিঃশ্বাস ফেলে প্রশান্তির চোখে একটা উত্তর দিল- পুরনো কিছু লেনদেন নিয়ে!
-) যেমন?
-) তোমার বিয়ের সময় একটা ফাঁকা কথা হয়েছিল। ভাবীকে তোমার কাছে বিয়ে দিতে গেলে দুই লক্ষ টাকা যৌতুক দিতে হবে। যদিও ভাবী তোমার পছন্দ ছিল, কিন্তু মা বাবা তা লুকিয়ে রেখেছিল। বলেছিল- আমার ছেলে যেন মোটেও জানতে না পারে। তাঁদেরকে এ ও বলেছিলেন- টাকার এখন প্রয়োজন নেই, যখন লাগবে তখন চাইব। রেডি করে রাখিয়েন। এমতাবস্থায় আমার বিয়ের খরচের কথা ভেবে ভাবীর মায়ের কাছে বেশ কয়েকদিন ধরে টাকা চাইলে তিনি এতো বড় অংকের টাকা দিতে ব্যর্থতা প্রকাশ করেন। কারণ তার একটি মাত্র ছেলে, তাও আবার এতো টাকা ইনকাম করার সুযোগ কই? যার ফলস্বরূপ তাঁদেরকে আসতে মানা করেছিলেন! আমি জানতাম না, তবে সামান্য শুনেছিলাম এখন।
০) রাহির কথাগুলো শোনে নিশ্চুপ চুপসে গেলাম। অবাক হয়ে পুরো শরীর থেকে ঘাম জড়তে লাগলো। মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো টানতে টানতে ভাবনায় পড়ে গেলাম। ভালোবাসা তাও আবার টাকা দিয়ে। টাকায় কি জীবনের পরিণাম? আমার অজান্তে এত বড় পাপ। ভীষণ ঝড় উঠেছিল সেদিন। বিব্রত হয়ে গেলাম। কেউ পরের দেওয়ার আশায় সুখ কুড়াতে চায়, আর কেউ একমুঠো ভাতের জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে। কারো শহরে বৃষ্টি ঝড়ে আবার কারো শহরে সুখের প্রদীপ জ্বালিয়ে পূর্ণিমার আসর বসায়।
সেদিন শ্রাবণের একটা ঝড় উঠেছিল আকাশে-বাতাসে। বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছেটা কিঞ্চিৎ ছোট হয়ে উঠেছিল, তবুও পরম মেহেরবান সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়েছিলেন।
ছয়.
রাত দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘতর হয়ে উঠেছিল। আমি আর আমার একাকীত্ব শব্দরা মাতাল পরিবেশের সাথে নীরবতার আশ্রয়ে ব্যস্ত। ঘুম নেই; রোহানার অভিমানের সাথে মিশ্রিত হয়ে গেছে সব সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না। ভালো লাগে না কোন পথ। আমার আমি আর মেঘাচ্ছন্ন মেঘের সাথে কিঞ্চিৎ পার্থক্য খুঁজে পাইনি। বসে বসে একটা চিন্তায় অবিরাম ব্যস্ত। একদিকে আনন্দে পরিবার, অন্যদিকে আমি। হঠাৎ একটা ফোন আসলো রোহানা পূর্বের অসুস্থের রেশ ধরে এখনো ভালো হয়নি। বরং মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। কয়েকদিন ধরে ডাঃ চিকিৎসাধীন। কিন্তু মোটেও সুস্থ্য হচ্ছিল না। খবরটা শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। না জানি সে অভিমান নামক অসুখে তাকে কতটা নিদ্রাহীনতায় ভুগিয়েছিল। না জানি আমার ভালোবাসার চৌকাট কে হারাম করে দিয়েছিল। ভীষণ ভাবনা নিয়ে একটা দৌড় মেরেছিলাম সেদিন। চারদিক নিঝুম। ভেসে বেড়াচ্ছে আমার নিশাচর পাখিগুলো। যেন উতলা সাগরে উতলা মন জাহাজ নিয়ে একাকী যুদ্ধে বিব্রত। কখন মাঝি ফের ফিরে আসবে ঘাটে।
ঘুমোট মাখা চোখ নিয়ে উপস্থিত হলাম রোহানার বাড়ির সামনে। মায়ের আহাজারি, ভাইয়ের চিৎকার ভেসে চলছে। সামনে দাঁড়াতেই রোহানা কাছে টেনে নিয়েছিল। অসুস্থতা নিয়ে একটা কাগজ হাতে তুলে দিয়েছিল, যেখানে স্পষ্ট উঠে এসেছিল-
"এ পর্যন্ত বেঁচে থাকা হয় তো তোমারি জন্য। বলতে চেয়েও পারিনি। প্রতিটা রাত্রি আমাকে অসুখী করে ফেলেছে। গরীব হয়ে জন্মগ্রহণ করাটা হয় তো অন্যায়। বাবার মৃত্যুর পর বড় হয়ে এ পর্যন্ত এসে যতোটা কষ্ট পাইনি, ততোটা কষ্ট পেয়ে নিজেকে আজ মৃত্যুর পথে নিলামে তুলতে হয়েছে। আমি চাকরি করে হলেও সমস্ত টাকা শোধ করে দিবো বলেছিলাম। কিন্তু তাতে আমাকে সময় দেওয়া হয়নি। তোমাকে না বলা কথাটি রাখতে গিয়ে বারংবার নিজের কাছে পরাজিত হয়েছিলাম। উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেও, উচ্চ শিক্ষিত হয়েও যৌতুকের বাধ্যবাধকতা আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাঁচার চেয়ে যৌতুক নামক বিদ্বেষী শব্দ নিয়ে পৃথিবী নামক যন্ত্রণার শহর থেকে বিদায়ী নেওয়াই আমার কাছে শ্রেয়। ভালো থেকো, আমাকে ক্ষমা করে দিও রোহানা!"
লেখাটি পড়ে শেষ করতে না করতে রোহানা আমার কোলে জীবনের সমস্ত মায়া পরিত্যাগ করে জীবনের ইতিবৃত্ত ঘটায়!
কঠিনতম এ পথ বুকে পাথর বেঁধে আজো রোহানাকে খুঁজে চলেছি৷ সমস্ত আবেগ, ভালোবাসা ফুটন্ত গোলাপের মতো চারদিকে, তবুও রোহানাকে ক্ষণিক ভুলতে পারি না। যৌতুক নামক এ অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকুক হাজারো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এবং কবর ঘরে ভালো থাকুক আমার প্রিয়জন এমন প্রার্থনায় রোজ রোজ হাত তুলি!
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এ গল্পের গভীর ভাবনায় ফুটে উঠেছে যৌতুক নামক কঠিন অভিশাপের বাস্তবতা। রোহানা ভাই বোন দুই জন। বাবা ছোটবেলা মারা গেলে মা অনেক কষ্ট করে রোহানা ও তার ভাইকে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলেন। ভাই চাকরি না পেতেই বোনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে গল্পের নায়েক রোহানের মা বাবা রোহানের জন্য রোহানাকে দুই লক্ষ টাকা গোপনে যৌতুক দেওয়ার কথা বলে রোহানাকে রোহানের স্ত্রী হিসেবে আনে৷ পরবর্তীতে রোহানার মা সময় মতো টাকা দিতে না পারলে রোহানার প্রতে বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করে। রোহানা সেইসব সয়ে যেতে যেতে একসময় অসুখে পড়ে যায়। মানসিক অসুস্থ রোহানাকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সমস্ত মায়া ত্যাগ করে পৃথিবী থেকে বিদায়ী নিতে হয়েছে৷ উক্ত যৌতুক শুধু রোহানা নয়, বরং আমাদের পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে হাজারো নারী কষ্টে জর্জরিত। সুখ নামক শব্দটা হারিয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করে শেষ ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সুতরাং সমসাময়িক সেই বাস্তবতা ফুটে উঠেছে এ গল্পে। অতএব আমার গল্পটি বিষয়ের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করি।
২২ ডিসেম্বর - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
৬৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪